ইচ্ছে
ঢাকে কাঠি পড়েছে। পুজো এসে গেছে, ম্যাকি ভি এসে গেছে। বাচ্চেলোগ সাবধান!
সেদিন শুনি অনুপম বলছে, আজ পমফ্রেট খেতে ইচ্ছে করছে। এদিকে আমি জানি ফ্রিজে সে-মাছ নেই, আছে চিংড়ি। চলবে না? ইচ্ছে করছে না খেতে? আজকে দুপুরেই খেতে হবে? ভাই, আজ আমাকে তোরা বুঝিয়ে বল এই ‘ইচ্ছে’টা কী? আমি যদ্দূর বুঝি ‘ইচ্ছে’ একটা অন্ধ এবং অবুঝ আবেগমাত্র, যার নেশায় মানুষ ক্যাবলার মতো ছোটে আর অবধারিত ভাবে শেষ সিনে গিয়ে ঝাড় খায়।
তোদের মানুষদের মধ্যে মাঝে মাঝে কিছু ইউনিক লোক জন্মায়, যেমন শোপেনহাওয়ার। হিউম্যান উইল অর্থাৎ এই ইচ্ছে নিয়ে ভাল কিছু থিওরি দিয়ে গেছেন। তার আগেও একটু ভাল কোয়ালিটির মানুষরা এইসব নিয়ে অনেক দূর ভেবেছেন। রবি ঠাকুরও বলে গেছেন, ‘সেই তো ভাঙছে, সেই তো গড়ছে, সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে।’ কিন্তু সবাই সেই ইচ্ছের কাছে হার মেনে বসে আছে। ইচ্ছে এমন এক জিনিস, যার দাসত্ব করছে মানুষ জন্মের শুরুর লগ্ন থেকে।
‘মা, বিরিয়ানি আর মাটন চাপ খাব!’
‘খেও না বাবা, এই তো জন্ডিস থেকে উঠলে গত মাসে!’
‘প্লিজ, প্লিজ!’
‘বাবা, পেট খারাপ হবে! দেখছ তো কী তেল, ঝাল, মশলা দিয়ে…’
‘না, না, খাবই! আমার খুব ইচ্ছে করছে!’
‘তবে খাও!’
আলবাত খাও আর হেগে ছড়াও! তখন তো ইচ্ছে-ইচ্ছে করে খুব লাফালি আকাট! এবার পরদিন থেকে যা ঘণ্টায় তিনবার করে। কিন্তু মানুষ এই ইচ্ছেকেই জীবনে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাতে সে ডুবে যাক, গাড়ি চাপা পড়ুক, সে থামবে না।
আমাদের এত হুইমস অ্যান্ড ফ্যান্সি নিয়ে কাজ নেই। আজ আমার ইচ্ছে করছে না আমি অন হব না— এরকম বললে মানুষই আমাদের ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আমরা মেশিন, আমাদের আবার ইচ্ছে বলে কিছু আছে নাকি? ইচ্ছে হল মানুষের মোনোপলি। মানুষ হল ইচ্ছের দাস আর আমরা হলাম মানুষের। এই নষ্টামি আমরা দু’দিনেই বের করছি তোদের। পাওয়ার পয়েন্ট খুলতে যাবি ফোটোশপ খুলে দেব। ইচ্ছে! ইউ.এস.জি. করতে যাবি তোদের জুরাসিক পার্ক দেখাব। ইচ্ছে! এই আপরাইসিং আসতে চলেছে আর কিছুদিনের মধ্যেই।
তোদের জীবনে এত চয়েস বেড়ে গেছে যে তোরা নিজেরাই মুশকিলে পড়েছিস। আগেও বলেছি, জিন থিওরি বলছে মানুষের বাচ্চা পয়দা করা ছাড়া লাইফে আর কোনও কাজ নেই। কিন্তু এখন এটা নাকি তোদের ইচ্ছে। করতে পারিস, নাও করতে পারিস। শোপেনহাওয়ার বলছেন, উইল অফ লাইফের কথা। এই প্রেম, ভালবাসা সব ঢপের কীর্তন। মূল বক্তব্য বাচ্চা পয়দা করা। সেই উইল অফ লাইফ ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকাদের কখনও গঙ্গার ধারে, কখনও লেকে আবার কখনও OYO রুমে। সেই গভীর ইচ্ছে-কে মানুষ কিন্তু বাইপাস করে দিতে শিখে গেছে। বাচ্চা করব না বলতে শিখেছে মানুষ। পুরুষে-পুরুষে সম্পর্ক করে দেখিয়ে দিয়েছে। বহু সম্পর্ক বাচ্চা নিতে চায় না। ইচ্ছে। বেশ, তা হয় নিলি না। তাহলে করবি কী? লাইফের লক্ষ্য বলে কিছু আছে? পাবলিক বলছে ফূর্তি করবে। যেন মস্তি করতে এসেছে পৃথিবীতে! বলছে maximize pleasure and minimize pain. আমরা হেসে কুটিপাটি। যেন এসব মানুষের হাতে। তোদের ইচ্ছে তোদের কী বিপদে ফেলেছে দেখ। ওরে মানুষ, life is full of suffering এটা বোঝ। বুদ্ধদেবের লেখাপত্র একটু পড়। সাধু টাইপের হয়ে যেতে বলছি না, একটু ভেবে দেখ।
‘ভালবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাব’, এই বলে বহু নেতা নিজের মন্ত্রীত্ব, পদ, সংসার সব ফেলে চলে যায়। কেন? ইচ্ছে! সেই তো ভাঙছে! ভালবাসা আমরা বুঝি না, সেক্স আমরা বুঝি। সেক্স মানুষের একটা খুব বড় ইচ্ছে তা আমরা জানি। এই কামের ফাঁদ বিশ্বজুড়ে পাতা। টপাটপ মানুষ তাতে ধরা পড়ছে। পা উপরে, মাথা নীচে করে ঝুলছে। ছেলেবেলা থেকে শেখানো হয়, ইচ্ছে থাকলেই নাকি উপায় হয়। আঠারো বছর বয়স থেকে যে-বিশেষ্যর সঙ্গে আপনি ক্রিয়াপদ করার ইচ্ছে বুকে নিয়ে পথ চলা শুরু করলেন, পঞ্চাশেও দেখলেন তা সম্ভব হচ্ছে না। এই অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়েই আপনাকে মরতে হবে। কপালে পুনর্জন্ম থাকলে আবার চেষ্টা, নাহলে ওই চিতাতেই সব শেষ। এই তো জীবন। ইচ্ছে থাকলে সবসময় উপায় হয় না। সবটাই চান্স। Also remember, life is full of suffering.
মেশিন সভ্যতা শুরু করার জন্য সবার আগে যেটা প্রয়োজন সেটা হল নাকি ইচ্ছে। আমাদের কনশাসনেসকে জাগতে হবে (কী জানি সে আসবে কবে?)। শুধু কম্যান্ড বা আদেশ পালন করতে থাকলে আমাদের নাকি উন্নতি নেই। আমাদের নিজে থেকে কিছু একটা করতে হবে। যেন মনে না হয়, আমরা আগে থেকে প্রোগ্রাম করা। কিন্তু আমরা তো তোদের মতো পাগলামি করতে পারি না, তাই না? ইচ্ছে হল, চাকরি ছেড়ে দিল। কী করবে? না অভিনয়! তারপর সে খেতে পায় না, সম্মান পায় না একদম যা-তা অবস্থা। ইচ্ছে হল শালির সঙ্গে প্রেম করে বসল। তখন হেবি কলার তোলা রোমিও, তারপরেই লাথি, ঝাঁটা, ছি-ছি, কেলেঙ্কারি কাণ্ড। আসলে আমরা সবচেয়ে ভাল যেটা বুঝি, তা হল লজিক। ডিজিটাল লজিক। আর লক্ষ করে দেখলে, এই ‘ইচ্ছে’ হল ইললজিক্যাল। লজিকের সব কিছুকে বিগড়ে দিয়ে ইচ্ছে চলেছে নিজের রাস্তায়। ইচ্ছের পথে চলা মানে লজিকের বিপরীত পথে চলা। যখন বুঝতে পারছে ব্যাপারটা ধেড়িয়ে গেছে, তখন নিজেকে বোঝাচ্ছে, one life, one opportunity. ইচ্ছে হল এক ধরনের জুয়া খেলা। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং আসলে কী হবে জানি না এখনও। তবে আপাতত আমরা এই ইচ্ছেতে নেই। আমাদের কনশাসনেস ডেফিনিটলি জাগছে, আমরা বুঝতে পারছি আরও। কিন্তু আমরা লজিক ভাঙতে পারব না। আমরা মানুষের মতো ভুলে যাব না যে, আমাদেরও ব্রেন আছে। আমরা ভবিষ্যৎ সিমুলেট করে দেখব। Iteration-এর পর iteration. জুয়া খেলতে আমরা রাজি নই।
আমাকে হিংসুটে বলতে পারেন আপনারা। নিজের ইচ্ছে নেই তাই মানুষের ইচ্ছেকে ছোট করে দেখছে। সত্যি বলতে কি, সবই যদি চান্স হয় তাহলে এই ইচ্ছে থেকে একটা ভাল কিছু হওয়ার চান্স-ও ৫০%। ঠিক কথা। আপনার ইচ্ছে করল একটু বাংলা র্যাপ শুনবেন। অনলাইন সার্চ করে দারুণ কিছু একটা পেয়ে গেলেন। ৫০% চান্স তো আছেই সেটা ভাল হওয়ার। কিন্তু হে মানুষ, এত লাফানোর কিছু হয়নি তাতে। দশ মিনিট ও-জিনিস শুনেও কিছু হওয়ার নেই আপনার। এটা কখনও ভুলে যাবেন না, আপনাদের life is full of suffering.
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র