একটা শার্প টার্ন। তারপর খুব বেশি হলে ফুট তিনেকের চওড়া একটা রাস্তা। মাটির রং টকটকে লাল এবং ভেজা। হাঁটতে লাগলাম। দু’পাশে পাকা মহুয়ার গন্ধে ম-ম করছে বাতাস। হঠাৎ শরতের শুরুতে কয়েক পশলা বৃষ্টিতে ভেজা বাতাসে দুলছে সুরটা। কিছু না হলেও মিনিট দশেক হাঁটার পর স্পষ্ট শুনতে পেলাম, শুধু সুর না, কথাও। বাংলাতেই গান গাইছে কোনও এক চিকন গলা। বেশিদূর যেতে হল না, চোখে পড়ল সাদার ওপর সবুজ, হলুদ, কমলা, বেগুনি বুটি-বুটি প্রিন্ট করা ফ্রক পরা মেয়েটাকে। পোশাকটা বহুবার ধোওয়ার পর মলিন হলেও, বছর সাত-আটেকের সে-মেয়ের মুখ অমলিন।
ও মা, এ তো একটা প্রায় মরা নদী। বালি, পাথরের খাঁজ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে জলের নরম স্রোত, তার ওপর একটা ছোট সাঁকো। আর সেই সাঁকোর তলায়, বড়জোর পায়ের গোছ অবধি ডোবা জলে ছলাৎ-ছলাৎ করে লাফাচ্ছে মেয়েটা, আর তার ধারালো, ভনিতাহীন গলায় সেই সাঁকোর নীচের দু’ধারের দেওয়ালের স্বাভাবিক ‘রেভার্ব’-এ মাঝে মাঝেই গেয়ে উঠছে গান। তার দোসর পুঁচকেটাকে দেখে ভাই বলেই মনে হচ্ছে, মাঝেমধ্যে সে-ও গলা মেলাচ্ছে। শুনতে থাকলাম ওদের সে-গান :
‘ও মা দুগগা অসুর আমার শ্বশুরমশাই
হেই ও মা দুগগা অসুর আমার শ্বশুরমশাই
এত লোকে ছাড়ান পেল আমার কেনে ছাড়ান নাই
হে মা দুগগা…’
এই কয়েক লাইনই বারবার গেয়েই যাচ্ছে দুই ভাইবোন, সংকোচহীন। মাঝেমধ্যে গান থামলে শুনতে পাচ্ছি ওদের জলের ওপর লাফানোর শব্দ। অনেকক্ষণ বাদে ওদের এনার্জিতে একটু ভাঁটা পড়ল বোধহয়, দুজনে মিলে বসল এসে একটা গাছের ছায়ায়। আমার ভেতরে গানটা তখন লুপ-এর মতো বাজছে, ‘ও মা দুগগা— ও মা দুগগা অসুর আমার শ্বশুরমশাই, অসুর আমার শ্বশুরমশাই’।
অসুরের কি ছেলে ছিল, তার বিয়ে হয়েছিল না কি, বৌমা এল কোথা থেকে? ভাইবোন মিলে গাছের ছায়ায় বসে পুঁটলি থেকে মুড়ি বের করে খাচ্ছে দেখলাম। ইচ্ছা করল কাছে যাই, জিজ্ঞাসা করি এ-গান ওরা শিখল কোথা থেকে, কার লেখা। গেলামও। আমাকে দেখে খুউব একটা চমকাল বলে মনে হল না, অপু-দুর্গা এক পলক তাকিয়েই আবার মাথা নীচু করে মন দিল মুড়ি খাওয়ায়।
অসুর আদৌ কারুর শ্বশুরমশাই কোনওদিন ছিল কি না, তা জানতে হলে নৃসিংহদাকে ফোন করতে হবে। কিন্তু আমি কয়েকজন শ্বশুরমশাইকে চিনি, যাদের ভেতরে অসুর ছিল জ্যান্ত। শুধু শ্বশুরমশাই নয়, পিসেমশাই, মেসোমশাই, মাস্টারমশাইয়ের মধ্যে আমি অসুরকে দেখেছি। যে-কোনও বড়সড় ‘মশাই’, অর্থাৎ ক্ষমতাবানের মধ্যে, কর্তৃপক্ষের হোমরাচোমরার মধ্যে, বা সেই হোমরাচোমরার পা-চাটা হবু-হোমরার মধ্যে দেখেছি সাক্ষাৎ অসুরকে বিরাজ করতে। অসুরকে আমরা ‘অমানুষ’ বলে একটা অবিচার করি। না, পেশিবহুল ঝাঁকড়া চুলের যুদ্ধরত মূর্তিটাকে দেখতে কার্তিকের চেয়ে অনেক-অনেক আকর্ষণীয় লেগেছে বলে তার প্রতি ঝুঁকে পড়ছি না, বরং তার সোলার প্লেক্সাস-এর ওপরে দুর্গার বল্লমের গেঁথে যাওয়া দেখে হয়তো শান্তিই পেয়েছি, পূর্বপুরুষ তাকে শয়তান ভাবতে শিখিয়েছে বলে। কিন্তু যাকে আমরা অমানুষ বলি এবং যে-কারণে বলি, সে তো তার মনুষ্যত্বই। মানুষ বলেই খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ বা অন্য কিছু করতে পারে, প্ররোচনা ছাড়াই।
অমানুষ তো তারা, যাদের ভাষা নেই, ব্যাকরণ নেই, ডিকশনারি নেই। গরু-ভেড়া-ছাগল-কচ্ছপ বা চিতাবাঘ— তারা না খেয়েছে ঘুষ, না দিয়েছে পয়সা নিয়ে অন্য কাউকে চাকরি, না লুকিয়েছে তার আঁচলের তলায় শক্তিশালী বাহুবলী অপরাধীকে, খুনিকে দেয়নি কোনও ক্যারেকটার সার্টিফিকেট, খাবার জন্যে ছাড়া খুন করেনি কাউকে, প্রেম করেছে একে অপরের ইন্সটিংক্টের commonness-এর জন্যে।
তাই মনে হয়েছে, মানুষই অসুর। আবার কিছুটা দেবতাও বটে। দেবী দুর্গা, যাঁর দশ হাতে দশ-দশটা চুনা-হুয়া অস্ত্রের সম্ভার, যার পেছনে তাবড়-তাবড় দেবতার আশীর্বাদ, তিনিও তো রক্তপাত ছাড়া, খুনহীন কোনও উপায়ে অশুভকে সিধে করতে পারেন না।
মনে পড়ল, দশমীর দিন বিসর্জনের আগে মূর্তিদের পাড়ার মা-মাসিমা বরণ করে নিচ্ছেন শেষবার। মা দুগগা, লক্ষ্মী, গণেশের ঠোঁটে বা শুঁড়ে গুঁজে দিচ্ছেন সন্দেশের অংশ। খেয়াল করেছি, অসুরও বাদ যায়নি এই মিষ্টিমুখ থেকে। বউদিরা তার ঠোঁটেও গুঁজে দিয়েছেন মাখা সন্দেশ। আমার ছোটবেলার মনের প্রশ্ন বড় হয়নি— কিন্তু বড়বেলাতেও সেই ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি। নিজেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করে গেছি : তাহলে… অসুরও কি দেবতা, না কি দেবতার মধ্যেও অসুর বেঁচে থাকে মানুষ রূপে?
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র