২০২২ সালে আমরা ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পা রাখলাম। কিন্তু যে আশার আলোয়, যে প্রতিশ্রুতির ঘনঘটায় ভারত ‘স্বাধীন’ হয়েছিল সে-বছর, তার কতটুকু অবশিষ্ট আছে আজ? এই দেশের মধ্যে যারা বসবাস করছি এই সময়ে, তারা আদৌ স্বাধীন তো? এই প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করেই পেন আমেরিকা জানতে চেয়েছিল, বিভিন্ন লেখকের বক্তব্য। ‘স্বাধীন’ বা ‘স্বাধীনতা’ শব্দগুলো নিয়ে তাঁরা কী ভাবছেন আজকের দিনে, তাঁরা তা জানিয়েছেন। সেই শতাধিক লেখকের শতাধিক ভাবনার কথাগুলোই এবার থেকে বাংলা অনুবাদে প্রকাশ পাবে ডাকবাংলা.কম-এ।
সলমন রুশদি (লেখক)
স্বাধীন ভারতের পথ চলার শুরুর দিকে, ‘হিন্দুস্তান হমারা’র সেই যুগে, আমরা সবাই সবার উৎসব উদ্যাপন করতাম, একসঙ্গে। আমাদের পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল, কিংবা প্রায়-পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল, এই বৈচিত্রময় প্রাণভূমির সমস্তটা আমাদের নিজেদের, একান্ত আপন। আজ, সেই সাহচর্য, সেই একাত্মবোধ, সেই স্বাধীন চেতনা মৃত, বা মৃতপ্রায়। যে দেশটাকে আমরা এত ভালবাসতাম, তার ওপর এখন এক করাল ছায়া। হিন্দুস্তান আর ‘হমারা’ নেই। বলাই যায়, আজকের শাসক বলয়, ধ্বংসের আগুন দিয়ে তৈরি, বিধ্বংসী ভলক্যানোর মতো। সত্যিই কি নতুন কোনও গোষ্ঠী তৈরি করা সম্ভব, যা এই অনাসৃষ্টির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে?
থৃতি উমরিগার (লেখক)
জীবনে দুটো দেশকে মনে-প্রাণে ভালোবেসেছি, কিন্তু দুটো দেশই আমার মন ভেঙে দিয়েছে। একটা দেশ নিজেকে বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্র বলে দাবি করে, আরেকটা দেশ আজকে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু দুটো দেশকেই ভর করে রয়েছে এমন কয়েকটা পাপের ভূত, দেশ দুটো যাদের অস্তিত্ব বেমালুম অস্বীকার করে। এমনকী, সেই ভূতদের ঘাড় থেকে নামাতেও তারা চায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেই ভূত হল আদিম সেই ক্রীতদাসপ্রথা এবং বর্ণবিদ্বেষ। ভারতের ক্ষেত্রে জাতিভেদ, ইসলাম-ভীতি আর খ্রিস্টানবিরোধী মনোভাব। দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমান ভারত সরকার সক্রিয়ভাবে উঠে পড়ে লেগেছে যাতে এই বিষ দেশ জুড়ে তার রাজনৈতিকতায় রীতিমতো চারিয়ে যায়। তার জন্য চলছে দেশবাসীর মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ, মানুষের স্বাধীনতা হরণ। এবং, সংখ্যালঘু নাগরিকদের প্রতি এমন ভাব দেখানো হচ্ছে যেন তারা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এই দেশে। ন্যক্কারজনক সেই নাগরিকত্ব আইন ২০১৯ বা ‘সিএএ’-র ঘোষণা হোক, বা সোচ্চার সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের জেলবন্দি করা; ক্ষিপ্ত জনতাকে দিয়ে চার্চ মসজিদ দুরমুশ করা হোক বা পুলিশকে দিয়ে মুসলিম নাগরিকদের বাড়িঘর দোকানপাট উচ্ছেদ— সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি শোষণকে রীতিমতো অনুমোদন দিয়ে রেখেছে বর্তমান শাসকশ্রেণি। আমি এখনও বিশ্বাস রাখি, সংখ্যালঘুদের প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্রের এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে ভারতের হিন্দু নাগরিকরা সোচ্চার হবে শীঘ্রই। ভারতকে যেমন ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কল্পনা করেছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা দেশনায়করা, আজকের ভারতীয়রা সেভাবেই নতুন ভারতকে তার সমূহ সুসম্ভাবনা ও প্রতিশ্রুতির মধ্যে দিয়ে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করবে। এটা আমার আশা।
তিশানী দোশী (লেখক)
ভারতের পঁচাত্তরে উদ্ধৃতিধারা
মা, হে সকল ত্যাগের নিগূঢ় নিভৃত রূপ!
এক সময়, তোমার পথে-পথে রোজ দেখতাম
ঢেঁকিভাঙা ঊরু, গান গাইতে থাকা বুক,
ক্ষয়ে যাওয়া পাথরে চাকার শব্দ, সেই স্বাধীনতার স্বর্গে।
ওখানেই ছিল আমার ঘরবাড়ি, যদিও তখন বুঝিনি।
আর এখন ঢুকে পড়েছি, গুপ্তঘাতকের যুগে,
কে যেন পিছন থেকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি হিন্দু তো, ঠিক?’
জমিও কিছু জায়গায় ফসল প্রসব করে, জেনেশুনেই, কারণ একটা গল্পের একটাই ধারা
হয় না।
আয়নাও চিনেবুঝে ঠকঠক করে কাঁপে।
এতগুলো জ্বলন্ত বিকেলের পর, তোমার ঘরে শুধু কৃত্রিম আলো, জানলাগুলো আঁট বন্ধ।
আমি ভাবতে চাই, তোমার সঙ্গে আর আমার কোনও সম্পর্ক নেই।
পঙ্কিল ডোবায় নাক উঁচিয়ে রেখে বাঁচার চেষ্টা করেছি অনেক।
গোটা ভারতই কি তেমন হয়ে যায়নি? খাওয়ার টেবিলে ফেটে-পড়া আপেলের মতো
সে কেবল খুন হতে চায়।
কে ডুবল কে ভাসল, কিছু আর এসে যায় না।
‘বাদশা’, আমি বলি, আসলে কাউকেই বলি না, ‘তাড়াতাড়ি যাও, তোমার আকাশটা দেখে এসো।’
এখানে গাছেরাই বা কী করবে, নিজেদের দাবানলে আরও আগুন উসকে দেওয়া ছাড়া?
পংক্তিঋণ: সরোজিনী নাইডু, ভানু কপিল, নিসিম এজাকেইল, বিবেক নারায়ণন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজয় নাম্বিসান, রবিন গ্যাঙম, এ. কে. রামানুজন, অরবিন্দ কৃষ্ণ মেরহোত্রা, অরুন্ধতী সুব্রহ্মণ্যম, আদিল জুসাওয়ালা, কে. শ্রীলতা, কমলা দাস, জয়ন্ত মহাপাত্র, মীনা আলেকজান্ডার, হোশাং মার্চেন্ট, শ্রীনিবাস রায়াপ্রল, মোনা জোটে, জিৎ থায়িল, শ্রীলা রায় এবং ইউনিস ডিসুজা।
বিবেক মেনেজেস (লেখক, আলোকচিত্রী)
বর্তমানে ভারতের ক্ষুদ্রতম রাজ্যটি কিন্তু ১৯৪৭ সালে সেই বিখ্যাত ‘মধ্যরাতে স্বাধীনতা’ পায়নি। কারণ, পর্তুগিজ স্বৈরশাসক আন্তোনিও ডি অলিভেইরা সালাজার উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তি কিছুতেই স্বীকার করতে রাজি হননি। শেষমেশ, ৪৫১ বছর বয়সি পর্তুগিজদের এই শাসিত প্রদেশ, ‘এস্তাদো দা ইন্ডিয়া’ তথা গোয়ায় আক্রমণ হানতে হল এবং পর্তুগিজ স্বৈরিতার বিনাশ ঘটল ১৯৬১ সালে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নির্দেশে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র যুদ্ধের ফলেই এই জয় সম্ভব হল। মুক্তি পেল গোয়া।
খুব দুঃখের বিষয় যে, এর নিষ্পত্তি এভাবে ঘটল। সালাজারকে বারংবার বলা হয়েছিল— গোয়ার মানুষ তুমুলভাবে ভারতের স্বাধীনতাকে সমর্থন করেছে। এবং গোয়ার প্রবাসীরা ইতিমধ্যেই প্রবল অবদান রাখছেন ভারতের এই প্রজাতন্ত্র হয়ে ওঠার মহান নিরীক্ষায়— তা তাঁদের সংখ্যা যতই কম হোক না। তবুও, উপযুক্ত আলোচনার মাধ্যমে একীভূতকরণের পরিবর্তে (যেমনটা ফরাসি উপনিবেশিত ভারতের প্রদেশগুলির ক্ষেত্রে ঘটেছিল), কেবলই সংযুক্তি ঘটল এক্ষেত্রে। একেবারে আইনত উপায়েই ঘটল। আর সমস্ত শর্ত আরোপিত হল নয়া দিল্লির তরফে।
তারপরও, আশা ছিল অনেক। ক্ষুদ্র এই অঞ্চলটি, ১৯৮৭ সালে যা ভারতীয় যুক্তরাজ্যের অংশ হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যে পরিণত হল, প্রথম নির্বাচনে সরকারে নিয়ে এল এমন দলকে, যাদের মূল সমর্থনকারী বহুজন সমাজ। আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসে তা আশ্চর্য কাণ্ড। তারপর এক চমৎকার সফরের শুরু। জমি, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সংস্কারের মধ্য দিয়ে সে এক চমৎকার আধুনিকতার বাস্তবায়ন। দুর্ভাগ্যবশত, একবিংশ শতাব্দীর নিষ্ঠুর অবক্ষয় বন্ধ করার পক্ষে এগুলোর কোনওটাই যথেষ্ট হিসাবে প্রমাণিত হয়নি। কারণ বিভাজনের রাজনীতি ভয়ংকর ও নিকষ কালো আঁধার ঘনিয়ে শিকড় গেড়েছে। সত্যি বলতে এই মুহূর্তে, ভবিষ্যৎটা মোটেই ভাল ঠেকছে না।
বিজয় শেষাদ্রি (লেখক, অধ্যাপক)
কাজের সূত্রে আমার বাবা-মাকে ভারত ছাড়তে হয় সেই গত শতকের পাঁচের দশক নাগাদ। সেই দশকের মাঝামাঝি সময়ে, বাবা আগে দেশ ছাড়ল। তারপর, দশকের শেষদিকে মা, আর আমি মায়ের কোলে। তারা তাদের দেশটাকে যে যার নিজের বুকে করে নিয়েই উঠল ভিনদেশে। তাদের মনের মণিকোঠায় ছিল নতুন স্বাধীন সাধারণতান্ত্রিক ভারতের নৈতিকতা আর রাজনৈতিক ভাবধারাই মূলত। আর ছিল ভারতীয় মন, সংস্কৃতি, ধরনধারণ, আদর্শ। রাজনৈতিকভাবে খুবই সচেতন মানুষ ছিল তারা। আর সেই সাবেক আদর্শ ও কঠোর নৈতিকতাই সম্ভবত সবচেয়ে ভারতীয় গুণ। আমার বাবার জন্ম হয়েছিল অসহযোগ আন্দোলনের ঠিক পরে পরে। মায়ের জন্ম প্রথম গোল-টেবিল বৈঠকের সময়কালে। কৈশোরে আমার বাবা ছিল পাক্কা মার্ক্সবাদী। ভারতীয় বিজ্ঞানমনস্ক এবং বুদ্ধিবেত্তার পরিবারগুলোয় সে-সময় কমিউনিস্ট ভাবধারারই রমরমা। আমার মা যদিও এত তত্ত্বের কচকচানি বুঝত না, ধৈর্য হারিয়ে ফেলত। বরং, মা সরাসরি নেমে পড়ত মিছিলে, অভিযানে। মা ওটা খুব ভাল বুঝত— অংশগ্রহণ আর অংশগ্রহণ, রাস্তায় নেমে পড়া। ভারতে থাকাকালীন, তরুণ বয়সে মা অবস্থানে অংশগ্রহণ করত, বক্তৃতা দিত। আমেরিকায় এসেও, মা ভোটারদের সাহায্য করা, তাদের নথিভুক্ত করার কাজে লেগে পড়েছিল। ভোটপ্রার্থীদের জন্য ভোট ট্যালি করার দায়িত্ব থাকত তারই ওপর। প্রায় ৩০ বছর ধরে, এলাকার ডেমোক্রেটিক ক্লাবের হয়ে, ভোটের সময়, তাকে দেখা যেত, কোনও না কোনও পোলিং স্টেশনের একটা টেবিলে বসে আছে। তার রাজনৈতিক সক্রিয়তার সঙ্গে মার্কিন রাজনীতির হয়তো তেমন কোনও গভীর যোগ নেই। কিন্তু, আবিশ্ব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিকতায় তার কিছু অবদান তো থাকবেই এবং তা চিরকালীন, কোনও নির্দিষ্ট পরিস্থিতি বা সময়কালে সেটাকে গেঁথে ফেলা যাবে না। পরিণত-বয়স্ক মানুষরা সেই সময়ে এরকমই ছিল। সামাজিক সিদ্ধান্তে তারা সরাসরি জড়িয়ে পড়ত। হুকুমতের পরিসরে নিজেদের ইচ্ছা-ভাবনাবেত্তার প্রকাশ ঘটানোর কাজে উদ্যমী ছিল তারা। ধর্মীয় আচার-আচরণ বা কোনওরকম গড্ডালিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মানুষ ছিল না তারা। তারা তাদের সম্প্রদায়, তাদের কমিউনিটির মধ্যে যুক্তিবাদী কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করত। আর এই অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই তারা এই কর্মপদ্ধতিকে জীবিত ও যুক্তিনিষ্ঠ রাখার কাজটা চালিয়ে গিয়েছিল।
আমার বাবা-মা দুজনেই ছিল শান্তিবাদী এবং আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী। কট্টরভাবে তাদের অবস্থান ছিল শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে। যখন ছোট ছিলাম, বাবা-মা তাদের ভাবনাচিন্তা, তাদের কাজের মধ্য দিয়ে তো বটেই, একইসঙ্গে বিভিন্ন কথার মধ্য দিয়েও আমাকে বুঝিয়েছিল যে, কোনও একটি রাষ্ট্রের সরকারকে সর্বৈবভাবে দরিদ্র শ্রেণির পক্ষে ভাবতেই হবে এবং অবস্থান নিতে হবে। গণতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্নরকম চিন্তাভাবনা থাকতে পারে, উদ্দেশ্য থাকতে পারে, কিন্তু দরিদ্র শ্রেণির জন্য ভাবনাচিন্তা করাটাই হবে মুখ্য। আমার বাবা-মা ছিল সনাতন দক্ষিণ ভারতীয় বৈষ্ণব, কিন্তু তারা খুব ভালভাবে জানত, রাজনীতির জায়গায় ধর্মের পরিসর থাকবে ন্যূনতম। যতটুকু থাকবে, সেটাও সংযত। আর তারা খুব ভাল করেই জানত, সাম্প্রদায়িক অসূয়া এখনও অবধি ভারতের কাছে ভয়ংকরতম বিপর্যয় হিসাবে ধরা দিয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তার সার্বভৌমত্বের প্রাথমিক পর্যায় নিয়ে আমার বাবা-মায়ের গর্ব ছিল। যে-পর্যায়ে, সার্বভৌমত্ব তখনও স্পষ্ট নয়, কিছু বাহ্যিক জীর্ণতা আছে, কিছু হয়রানি রয়েছে। কিন্তু ধারণা ও আদর্শে তা প্রাচুর্যময়। ভবিতব্যের প্রতি তুমুল আশাবাদী। তার একটা স্বতন্ত্র আত্মগরিমা রয়েছে, রয়েছে গভীর ঐতিহাসিকতা, রয়েছে গতিময় প্রগতিশীলতা (যদিও খাপছাড়া) এবং রয়েছে আশ্চর্যরকমের উন্নতমানের অন্তর্ভুক্তিকরণ (যা প্রকাশ্য ও পরিকল্পিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি বাবাসাহেব আম্বেদকরের তৈরি সংবিধানে)। এই অন্তর্ভুক্তিকরণ, সহাবস্থানের চিন্তা ভারতের জটিল, বৈচিত্রময়, বহুমুখী ও বহুস্তরীয় সমাজ ও তার মানুষের কথা ভেবেই। ভারত থেকে দূরে আমি, আজ প্রায় ৬০ বছরের বেশি হয়ে গেল। ৬০ বছর আগের সেই সময়ে, যদ্দূর মনে পড়ছে, উপমহাদেশে প্রায় ১০ মাস কাটিয়েছিলাম। যার মধ্যে পাঁচটি মাস ছিলাম পাকিস্তানের লাহোরে। উর্দু পড়ার জন্য একটা স্কলারশিপ পেয়ে সেখানে গেছিলাম এবং বাকি সময়টা কেটেছিল বেঙ্গালুরুতে; যেখানে আমার জন্ম। ভারতে বসবাসকারী একজন ভারতীয়, বা ভারতের বাইরের কেউ কিন্তু দেশের খুব কাছাকাছি কিংবা একজন বিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষকের ক্ষেত্রে এমনটা তরজা উঠতেই পারে যে, আমার মতো লোক ভারতের রাজনৈতিক উন্নয়নের সমালোচনা বা নিন্দা করার কোনও অবস্থানে থাকতে পারে না। আমি যদিও এই যুক্তিটা আমল দিই না, কিন্তু কোত্থেকে এই যুক্তির উদ্রেক, তা আমি বিলক্ষণ জানি। এবং, কথা বলার মতো অবস্থান আমার থাকুক বা না-থাকুক, আমার বাবা-মায়ের সম্পর্কে কথা বলার হক তো আমার আছেই। আর, তারা যদি আজ বেঁচে থাকত, তাহলে, ভারতে এখন যা ঘটছে, সেসব দেখে তারা মর্মাহত হতই নিশ্চিত। লেখকদের হয়রান করে মারা, ভিন্ন মতকে দমন, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব এবং বৈরিতাকে উৎসাহ দেওয়া; বিচার বিভাগের উপর অনধিকার হস্তক্ষেপ এবং রাষ্ট্রের স্বার্থে কলকাঠি নাড়ানো; এবং রাগ, বিরক্তি, এমনকী ক্রোধের হিংস্র স্বর, যা রাজনৈতিক বক্তৃতার এখন অন্তর্নিহিত উপাদান হয়ে উঠেছে এবং ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, যা রাজনৈতিক প্রাঙ্গণকে বিষিয়ে তুলেছে— এসব দেখে তারা আতঙ্কিত হত না বলছেন? তবে, যা তাদের সবচেয়ে হতাশ করত, তা হল দেশটাকে একক, সমসত্ত্ব একরঙা করে তোলার প্রয়াস। যেটা আজকের বড় বড় নেতারা করছেন। আর তার মধ্য দিয়ে ভারতের অন্তর্নিহিত এবং অবিচ্ছেদ্য জটিলতা— যা আসলে বিচিত্র এবং সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সৌন্দর্য— সেগুলোকে ইচ্ছাকৃত প্রত্যাখ্যানের চেষ্টা চালানো। এই নেতাদের বোধে ভারত সম্পর্কে ধারণা এমন— ভারত কোনওকালেই তেমন জটিল ছিল না। কিন্তু, আখেরে ভারত এতটাও জলবৎ তরলং ছিল না যে একটা একরৈখিক ধারণা দিয়ে ভারতকে গিলিয়ে দেওয়া যাবে। এতটাও সহজ ছিল না যে, সহজেই গলাধঃকরণ হয়ে যাবে নিমেষে, আঁকড়ে ধরা যাবে তাকে, কোনও প্রচেষ্টা ছাড়াই। ভারত এমনটা নয়। ছিলও না কখনও।
সৌজন্যে : https://pen.org/india-at-75/