আরে, কচু খেলে যা!
দক্ষিণ কলকাতার যে-অঞ্চলে আমাদের বড় হয়ে ওঠা, সেখানে এক পাড়া থেকে আর এক পাড়া যেতে গেলে কয়েকটা দারুণ শর্টকাট ছিল, এবং সেগুলো সবই বস্তির ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা। বড়রা মাঝে-মাঝেই এই রাস্তাগুলোকে ভীতিজনক বলে মনে করিয়ে দিতেন— ‘সন্ধের পর অমুক রাস্তায় ফিরো না’, ‘একা-একা তমুক রাস্তায় যেও না’, ‘ওই রাস্তায় ভূত আছে’— ইত্যাদি। তার কিছু সঙ্গত কারণও ছিল; এ-সব রাস্তায় খুচরো মাতাল, সোলো পাগল, হই-হুল্লোড় করে খেলা ফুটবল, মাঝে-সাঝে মারপিট, লেগেই থাকত। তবে, যতদিনে একা-একা আমার ছোট লাল সাইকেলে অশ্বিনী দত্ত-টু-ডোভার লেন করতে শিখে গেছি, এ-সব পেরিয়ে আমার কাছে প্রবল অ্যাট্রাকশন ছিল বস্তিটার ভিতরেই, গোয়াল-লাগোয়া একটা মুদির দোকান। সেই দোকানে, চাল-ডাল-মোমবাতি-লজেন্সের পাশাপাশি, লম্বা কাঁচের বয়ামে থরে-থরে সাজিয়ে রাখা থাকত নানা রকমের আচার (যার কথা আর একদিন বলা যেতে পারে)। কিন্তু আজকের বিষয় কচুভাজা।
আমাদের একান্নবর্তী মধ্যবিত্ত বাড়িতে সে-যুগে কচুর পদ তৈরি হয়ে থাকত কিছু-কিছু— যার মধ্যে কচুর শাক বা লতি দিয়ে রান্না করা নানা মাছের প্রণালী অন্যতম— কিন্তু সে-ছাড়া খুব একটা কচু খাওয়া হত না। ‘ওল খেয়ো না ধরবে গলা’র জুজুতে আমি কচু আর ওলকে সমগোত্রীয় ধরে দুটোর কোনোটাই খেতে চাইতাম না, এবং এই আতঙ্কটা থেকে বহুদিন কচুভাজাও ছুঁয়ে দেখিনি। তারপর, বছর দশেক বয়েসে, খেলার শেষে ৫০ পয়সার কচুভাজা কিনে খেয়ে আরো তিনটে মিষ্টি লজেন্স খেতে হয়েছিল। সেখানেই শুরু।
ঠিক অবিশ্বাস্য ঝাল না হলেও, কচুভাজা— আর তার দোসর ঝালমটর— যথেষ্ট ঝাল। প্রথমে বোঝা যায় না, কিন্তু গোটা পাঁচেক কুড়কুড়ে কচুভাজা মুখে পড়লেই ঝালটা (আর অসামান্য মশলা-নুনটা) ঠিক টের পাওয়া যায়। খুচরো খাবারের ধর্ম মেনে, এবং বৃহত্তর চানাচুর পরিবারের সম্মান বজায় রেখে, কচুভাজা একেবারেই পথচলতি— বা আড্ডাচলতি— স্ন্যাক্। কচুভাজা কেউ দারুণ খিদের মুখে খায় না; কচুভাজা খাওয়াই হয় সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে, বাজেট ডেট-এ, মদের চাটের ভূমিকায়, ফক্রামির আনুষঙ্গিক হিসাবে। তুমি এক টিন কচুভাজা খেয়ে নিতেই পারো, কিন্তু তার রিক্স নানা রকম হতে পারে।
আমরা যাকে কচু বলছি, ইংরেজিতে তার নাম ‘টারো’(taro)। আমরা কচুভাজা বলতে যা খেয়ে থাকি, তা সাধারণত কচুর বালবোটিউবার, বা কন্দ, ইংরেজিতে ‘corms’। এই কচু কন্দকে পাতলা করে কেটে ‘চিপ্স’ বানিয়ে ভেজে ফেললেই তৈরি হয়ে যায় অতি-পরিচিত কচুভাজা। তবে আসল খেলা মশলা-নুনে। শুকনো এই কম্বিনেশন একদম সঠিক না হলে কচুভাজা আর ভেজা কাগজ সমান। মরীচ, মৌরি, ধনে, জিরে, আমচুর, আর কষে লাল লঙ্কার গুঁড়োয় তৈরি ভাজা মশলার পারফেক্ট মেলবন্ধনে কচুভাজার আসল খোলতাই। এর সঙ্গে চালের গুঁড়ো আর পোস্ত ব্যবহার করতেও শুনেছি, তবে খরচ বেড়ে যাবে বলে অধিকাংশ কারিগর এই শেষ দুই উপাদান ব্যবহার করেন না।
১৯৪৩-এর বাংলার ভয়াবহ মন্বন্তর কিভাবে বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিল, তা গবেষণার বিষয়। ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, আমার ঠাকুমা (আদি বাস ঢাকা বিক্রমপুর) এবং দিদিমা (আদি বাস ময়মনসিংহ) দুজনেই উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন, দুজনেই তেতাল্লিশের মন্বন্তর দেখেন, এবং খেতে বসে কচু না খেলে, বা নেহাত আপত্তি জানালে, দুজনেই তার গুণাগুণ নিয়ে তীক্ষ্ণ কিছু কথা না শুনিয়ে ছাড়তেন না। তাঁদের মতে, কচুর মত অখাদ্য-কুখাদ্যকে ভরসা করে বহু বাঙালি গৃহস্থ এই ভয়ানক সময় পার করে দিয়েছিলেন। সেটা কতটা সত্যি, বলতে পারব না, তবে এটা ঠিক যে বুভুক্ষু বাংলাকে এই দুর্ভিক্ষ দেখিয়েছিল কিভাবে উৎপাদন করা সবজির প্রতিটা অংশ ব্যবহার করা যেতে পারে— যে ‘অশনি সংকেত’-এর প্রয়োজনীয়তা থেকে উঠে আসে লাউ-এর খোসা-ভাজা, কুমড়োফুলের তরকারি, কচুশাক, ফেনাভাত। তবে বঙ্গদেশে খাদ্যবস্তু হিসাবে কচুর উপযোগিতা যে অপরিসীম, তার প্রমাণ এই প্রদেশের অমৃততুল্য কিছু রেসিপি— সর্ষে-পোস্ত দিয়ে কচুর লতি, কচুবাটা, কচুশাক (ইলিশের মাথা দিয়ে বা সেদ্ধ ছোলা সহযোগে), কচু-চিংড়ি ইত্যাদি।
একটু নেট ঘাঁটলেই জানা যাবে, প্রাচীন রোমে কচু— যার রোমান নাম ‘কলোকেসিয়া’— প্রায় আলুর মতই খাওয়া হত। এ-প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, আলু আদতে দক্ষিণ আমেরিকার সবজি, যা ইউরোপে আসে মাত্র ১৬শো শতাব্দীতে, স্পেন এবং ব্রিটিশ আইল্সের মাধ্যমে। পঞ্চম শতাব্দীতে লেখা রোমান পাক-প্রণালীগ্রন্থ এপিসিয়াস-এ কচুর উল্লেখ রয়েছে; রয়েছে ‘টারো’ দিয়ে তৈরি পাখির মাংস এবং অন্যান্য মাংসের রেসিপি, সেদ্ধ করা কচু এবং নানারকমের সসের কথা। কচুর ব্যবহার যেখানে ছিল আলু-সমান, এবং স্বাদ-স্বভাবও যার প্রায় আলুরই মতো, সেখানে ভাজা কচুর চল ছিল না, এ-কথা কেউ হলফ করে বলতে পারে?
এই সব সিরিয়াস আলোচনার মধ্যে আমি মাঝে-মাঝেই ভেবেছি, কচুভাজা কি সত্যিই ভাজা কচু? ছোটবেলায় আমি প্রায় ৮০ শতাংশ নিশ্চিত ছিলাম যে কচুভাজার মূল উপাদান একটা নতুন ধরণের আলু, কেননা ‘কচু’ বলতেই ‘কচুপোড়া’র সংযোগে যে বিতৃষ্ণাটা জেগে উঠত, তার সঙ্গে এই খাসা স্ন্যাকটা যেন ঠিক খাপ খায় না। পরে আস্তে-আস্তে মেনে নিয়েছি, আদ্যোপান্ত বিহারী দোকানের খবরের কাগজের ঠোঙায় বিক্রি হওয়া, ওই হুশ-হাশ করে চেবানো অসাধারণ ব্যাপারটা ভাজা কচু, এবং তাতে কিছু আসে যায় না।
কচুভাজার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা রোম থেকে বহুত দূর অস্ত্, বরং ছাপরা, মুজফফরপুর বা কটকের কাছাকাছি হতে পারে। ১৬ নং. বস্তির মুদির দোকান পেরিয়ে যখন বড় শহরে ঘোরাফেরি করেছি, কচুভাজা খেতে ইচ্ছে হলে সেটা প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে খুঁজে পেয়েছি ‘নন-মেঙ্গলি’ দোকানে; এবং একটা বিশেষ আর্থসামাজিক স্তরের দোকানে। বর্ধিষ্ণু পাড়ার মুদির দোকানে আজকাল কচুভাজা পাওয়া যায় কি না, বলতে পারব না, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায়, ফিকে হলুদ বালবের তেলচিটে বিহারী কাকার দোকান ছাড়া ভালো কচুভাজা খুব একটা পাওয়া যায়নি, সে যতই ‘হট চিপ্স’ ফ্র্যাঞ্চাইসেরা তড়পাক। এর জন্য অবশ্যই দায়ী একটা পাঁচমিশালী, মধ্যবিত্ত পাড়ায় আমার বড় হয়ে ওঠা এবং তার অবচেতন স্মৃতি। পার্ক স্ট্রিটের চোখ-ধাঁধানো খাদ্যসামগ্রীর দোকানের র্যাকে ১২৭ টাকার সামুদ্রিক নুন-মাখানো ‘টারো চিপস’ দেখে— এবং তাকে আদতে কচুভাজা হিসাবে চিনে—ছবি হয়ে গিয়েছি, কিন্তু এ-বারে আর চেখে দেখিনি। স্মৃতিটা হারিয়ে যায় যদি?
ছবি এঁকেছেন অনুষ্টুপ সেন