আলুকাবলি
আলুকাবলি কারে কয়?/ চুরমুর যাহা নয়…’
এটা যে-সে ব্যাপার নয়। পাতলা করে কাটা সেদ্ধ আলুর সঙ্গে কাঁচা, নরম করে তোলা ভেজানো ছোলা, কুচি-কুচি শসা, কিছুটা কাঁচা টমেটো, কিছুটা সেদ্ধ মটর, মিহি করে কাটা পেঁয়াজ (কিছু-কিছু ক্ষেত্রে অল্প আদা), বেশ জম্পেশ কাঁচালঙ্কা, হালকা পাতিলেবু, আর একটা অতুলনীয় তেঁতুল-মশলা মাখা রগরগে চাটনিতে তৈরি যে বস্তু, যা খেয়ে দুনিয়াকে অবিশ্বাস্য সুন্দর, হুশ-হুশে ঝালে রঙিন (কেননা চোখ বেয়ে অঝোর জল পড়বে) মনে হয়, বুঝতে হবে, আলুকাবলি সেই জিনিস। আলুকাবলি ঝাল-ই হয়, বাই ডেফিনিশন, এবং যারা ঝাল খেতে পারেন না, তাঁদের আলুকাবলি মোটেই খাওয়া উচিৎ নয়। আ-ঝালা আলুকাবলি হয় না, যেমন ভেজ বিরিয়ানি বলে কিছু নেই।
ফুচকাওয়ালারা অনেক সময়ে সযত্নে মেখে পরিবেশন করলেও, বুঝতে হবে, আলুকাবলি চুরমুর নয়। সমঝদারেরা জানেন, আলুকাবলি ফুচকাওয়ালার কাছে পাওয়া যায় না। আলুকাবলি আলাদা, স্বতন্ত্র, স্বকীয় মহিমায় বিরাজ করা একটা অদ্ভুত খুচরো খাবার, যা সম্পূর্ণভাবে বঙ্গদেশের একান্ত একটা সান্ধ্য স্ন্যাক, যা ইস্কুল-ফেরতা খাওয়া যায়, যা লেকের ধারে, ভিক্টোরিয়ার মাঠে আর ময়দানে প্রেমের খুনসুটিতে ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়, ওদিকে আবার মদের চাট হিসাবেও অতুলনীয়।
আলুকাবলির সঙ্গে আমাদের সবারই বোধহয় প্রথম পরিচয় ইস্কুলে। পাম এভিনিউতে, পাঠভবনের প্রাইমারি ইস্কুলের গেটের ঠিক বাইরে বসা আলুকাবলি-আচার-ওয়ালা কাকুর জন্য আমাদের টিফিন টাইমটা মায়াবী হয়ে উঠত। ক্লাস থ্রি-তে বাড়ির থেকে এক টাকা চেয়ে নিয়ে এসে নিজের এবং বন্ধুর জন্য মাখা আলুকাবলি খাওয়ার মধ্যে যে রোমাঞ্চ, সেটা আর কোনো বয়সে অনুভব করা যায় বলে তো মনে হয় না। অবশ্য বাচ্চাদের জন্য মাখা বলে সেই আলুকাবলি অতটা ঝাল হত না। এর পর বালিগঞ্জ প্লেসের হাইস্কুলে উঠে বুড়োদা’র রকমারি খুচরো খাবারের ঝুড়ির সঙ্গে পরিচয়ের কথা আগেও লিখেছি। ক্লাস ফাইভ থেকে ইস্কুল পেরোনো, অর্থাৎ বারো ক্লাস অবধি প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু টুকিটাকি খাওয়া হয়ে এসেছিল, যার মধ্যে অবশ্যই ছিল ঝাল-ঝাল, টক-টক, মশলাদার এবং এন্তার মজাদার আলুকাবলি।
স্ট্রিট ফুড বিশেষজ্ঞ ভাস্কর মুখোপাধ্যায় তাঁর গবেষণাপত্র ‘Between Elite Hysteria and Subaltern Carnivalesque: The Politics of Street Food in the City of Calcutta’(South Asia Research; Sage Publications, New Delhi, London)-তে যে ‘দুষ্টু খিদের’ কথা লিখেছেন, আলুকাবলি-আকাঙ্ক্ষা সেই ক্যাটেগোরিতেই পড়ে। মনোবিশ্লেষণ তুলে ধরবে যে এর সঙ্গে অবশ্যই মুখ-গহ্বর সংক্রান্ত যৌনতার একটা সংযোগ আছে। তা হোক না। যৌন কৌতূহল ছিল কি না মনে নেই, তবে আট বা নয় বছর বয়সের ইস্কুলের আর কোনো স্মৃতি থাকুক বা না-থাকুক, এক চিলতে খেলার মাঠটার কোণে বাঁদর-ঝোলার টঙে বসে আলুকাবলি সাঁটাচ্ছি, সঙ্গে আর এক-দুই বন্ধু, সেটা আমার বেশ মনে আছে। শুধু খাওয়াটা তো নয়, টিফিন টাইমের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও তাকে টেনে রেখে দেওয়ার এই গোটা ব্যাপারটায় যে দুষ্টুমি মিলেমিশে আছে, আলুকাবলি তো সেই সাময়িক অবাধ্যতারই মেটাফর।
ঝালমুড়িওয়ালারাও আলুকাবলি মেখে দেন, এবং কিছু ক্ষেত্রে সেটা বেশ ভালোই খেতে হয়। একটা সময় ছিল, যখন কলকাতার বহু ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে ডেডিকেটেড আলুকাবলিওয়ালাদের পসরা দেখা যেত। এঁদের সবথেকে বেশি দেখেছি অফিস যাতায়াতের রাস্তায়, যেমন গড়িয়াহাট মোড়ে বা কালীঘাট মেট্রো স্টশনের বাইরে, আর ব্যস্ত অফিস-পাড়ায়, সে অফিস যেখানেই হোক না। ফুচকাওয়ালাদের বাঁশের ‘আওয়ারগ্লাস’-এর চেয়ে সাইজে কিছুটা ছোট একটা স্ট্যান্ডের উপর, একটা ফ্ল্যাট বেতের থালায় কলাপাতার উপর সাজিয়ে রাখা থাকত একরাশ কাঁচা ছোলা, পেঁয়াজ, শসা, আদা, লঙ্কা, টমেটো। এক পাশে সারি-সারি লেবু, আর তার সঙ্গে বিটনুন-ঝুরিভাজা-মশলার কৌটো, এবং প্রাইড অফ প্লেস নিয়ে একটা শিশিতে সেই ম্যাজিক তেঁতুল-গোলা জল। থালাটার মাঝে মাখার একটু লম্বা একটা স্টিলের বয়াম। অল্প, বেশি, আরো বেশি এবং নারকীয় ঝালে মাখা আলুকাবলি বহু সন্ধ্যার রাক্ষুসে খিদের উপযুক্ত সমাধান হিসাবে কাজ করেছে।
পরে অনেক ভেবে দেখেছি, আলুকাবলি মাত্রেই কেন অ্যায়সা ঝাল হয়। উত্তর একটাই— ঐ তেঁতুল-গোলা জল। ফুচকাওয়ালাদের জল অনেক বেশি পাতলা, অনেকটাই ডাইলিউটেড। তুলনায় আলুকাবলির ওই মারাত্মক জলের কনসেন্ট্রেশন ঢের বেশি, এবং ভাজা জিরে-লঙ্কাগুঁড়ো-আরো-কত-কী-তে গোলা ব্যাপারটা সেদ্ধ আলু এবং কাঁচা স্প্রাউটস-এ ঢেলে দিলেও স্বাদ অপূর্ব হতে বাধ্য। অবশ্যই, ওই লেভেলের ঝালে মাখা আলুকাবলি বেশি খাওয়া যায় না!
পাঁড় মাতালেরা অনেকে বলে থাকেন যে মদের সঙ্গে আলুকাবলি খেলে নাকি ঝালে নেশা কেটে যায়, তাই আরো বেশি মদ খাওয়া যায়। তাই শহরের অন্যান্য বহু প্রান্ত থেকে একেবারে উধাও হয়ে গেলেও, এখনো অনেক বাংলার ঠেকের বাইরে নিবেদিতপ্রাণ আলুকাবলি-ওয়ালাকে পাওয়া যাবে, যাবেই।
আগে বেশির ভাগ সময়ে শুয়ে কাটাতাম। ইদানীং কোভিড-ভীতিতে প্রাণ হাতে করে একটু-আধটু এক্সারসাইজ করা শুরু করেছি। জিমের প্রশিক্ষক বলেছেন, খাওয়া-দাওয়া ঠিক না করলে মুগুর ভেঁজেও কোনো লাভ নেই। তাই ঠেকে শিখছি। মাঝে-মাঝে স্যাট করে অন্তর্যামী ফোনের স্ক্রিনে, সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ধরণের হেলদি খাওয়া-দাওয়া, স্ন্যাক, ব্রেকফাস্ট অপশন ভেসে উঠছে। একদিন দেখি শরীরচর্চার জন্য প্রখ্যাত এক বলিউডি নায়ক ঘটা করে সেদ্ধ আলু, কাটা শসা, পেঁয়াজ, টমেটো, লেবু, জিরে গুঁড়ো আর হিমালয়ান পিংক সল্ট নিয়ে বসে বলছেন, সান্ধ্য জলখাবার হিসাবে এই সব ইনগ্রেডিয়েন্ট দিয়ে মাখা ‘চাট’-ই তিনি খেতে সবচেয়ে পছন্দ করেন, তার প্রধান কারণ হল এ-সব উপাদানই অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর, ‘অর্গ্যানিক’— এবং একটু ‘ইমলি’র ছোঁয়ায় একেবারে অনুপম।
গুছিয়ে নিয়েছি, নিজের আলুকাবলি।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র