ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ৫৩

    বিমল মিত্র (March 11, 2022)
     

    পর্ব ৫২

    পৌঁছলাম বম্বে। ঠিক যা ভেবেছি তাই। সেবার যে লোনাভালায় গেল গুরু দত্ত, তার উদ্দেশ্য আর কিছু নয়। শুধু গল্প লেখা। আমাকে দিয়ে গল্প লিখিয়ে না নিলে গুরু দত্তের শান্তি নেই। আগেই বলেছি লোনাভালা জায়গাটা বোম্বাই থেকে প্রায় নব্বই মাইল। ও-পথে আগে অনেকবার গিয়েছি। ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ আগে ওখানে বসেই লেখা হয়েছিল।

    গুরুর একটা বাড়ি ছিল ওখানে, চারদিকে ধান-ক্ষেত, তার মধ্যেই একটা ছোট্ট বাংলো। সেখানে টেলিফোন আছে, ইলেকট্রিক ডায়নামো আছে। সংসারের দৈনন্দিন কাজ চালাতে যা-যা দরকার হয়, সবই আছে।

    গুরু বললে— চলুন কোনো হোটেলে যাই—

    আমিই আপত্তি করলাম। তার চেয়ে এই ভালো। নিরিবিলি, নিঃসঙ্গ ভাবে গল্প লেখা। আমি আর গুরু, শুধু দুজন। আর কেউ নেই কোথাও। গীতা নেই, ওয়াহিদা নেই, স্টুডিও নেই, ইনকাম ট্যাক্স নেই।

    আমি বসলাম কাগজ-কলম নিয়ে। গুরু গেল খাবারের বন্দোবস্ত করতে। রান্নার বাতিক গুরুর বরাবরের। খেতে ভালোবাসুক আর না-বাসুক, রান্না তার একটা শখ। একবার সে রান্নাঘরে যায়, আর একবার আমার কাছে এসে বসে।
    জিজ্ঞেস করেন— কদ্দূর হল—

    কিন্তু গুরু পাশে বসে না থাকলে কি সিনেমার গল্প লিখে আরাম আছে? তার মন কেবল পড়ে রয়েছে রান্নাঘরে। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই গুরু অনেক কিছু রান্না করে ফেললে। এক রকম অদ্ভুত ভাত রান্না করলে। বোম্বাই ভোরা-মুসলমানদের স্টাইলে। তারপর মাছ। মাছের কালিয়া। গুরু ভাবত আমরা বাঙালিরা মাছ না হলে খেতে পারি না। তাই আমার খাওয়ার কথা ভেবেই মাছ, মাংস রান্না করত। সেদিনও পরিপাটি করে রান্না করেছে গুরু। বেলা যখন একটা তখন রান্না শেষ হল। টেবিলে পরিবেশনও করে দিল খাবারগুলো।
    আমি খেতে বসলাম। বললাম— আপনিও খেতে বসুন—

    গুরু বললে—আপনি খান, শরীরটা খারাপ লাগছে, একটু পরে খাবো—

    বলে বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। আমি খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম গুরু যেন যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে লাগল। উল্টোদিকে মুখ করে গোল হয়ে শুল। তারপর খানিক পরে ছটফট করতে লাগল। মুখ দিয়ে কাতরানির শব্দও বেরোতে লাগল। আমার ভয় করতে লাগল। আমি সামনে থাকলে পাছে গুরুর অসুবিধে হয় তাই বাইরের বারান্দায় এসে বসলাম। কিন্তু তখনও যন্ত্রণার আর্তি শুনতে পেলাম ভেতর থেকে। সত্যিই আমার ভয় করতে লাগল। এই প্রবাসে কে গুরুকে দেখবে? এখানে ডাক্তার কোথায় পাব?

    ভেতরে গিয়ে দেখলাম গুরু বিছানার ওপর ছটফট করছে। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠেছে। জিজ্ঞেস করলাম— একজন ডাক্তার ডেকে পাঠাব?

    গুরু প্রথমে হাত নেড়ে বলল— না—

    আমিও তাকে বিরক্ত না করে আবার বাইরের বারান্দায় এসে চুপ করে বসে রইলাম। ভাবলাম, যদি গুরুর যন্ত্রণা বাড়ে। যদি অবস্থা আরও খারাপ হয়। তখন কি ভবে? তখন আমি কি করব? তখন গুরুর মা-স্ত্রী-ভাইদের কাছে কি-ই বা জবাবদিহি করব?
    খানিক পরে আবাত ভেতর থেকে গুরুর ডাক এল। আমি কাছে যেতেই গুরু বললে— বিমলদা চলুন, বোম্বাই ফিরে যাই—

    আমি খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম গুরু যেন যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে লাগল। উল্টোদিকে মুখ করে গোল হয়ে শুল। তারপর খানিক পরে ছটফট করতে লাগল। মুখ দিয়ে কাতরানির শব্দও বেরোতে লাগল। আমার ভয় করতে লাগল। আমি সামনে থাকলে পাছে গুরুর অসুবিধে হয় তাই বাইরের বারান্দায় এসে বসলাম। কিন্তু তখনও যন্ত্রণার আর্তি শুনতে পেলাম ভেতর থেকে। সত্যিই আমার ভয় করতে লাগল। এই প্রবাসে কে গুরুকে দেখবে? এখানে ডাক্তার কোথায় পাব?



    বললাম— এই অবস্থায় যেতে পারবেন— এই নব্বই মাইল রাস্তা—

    গুরু বললে— হ্যাঁ—

    তা সেই রকমই ব্যবস্থা হল! সকালবেলা এসেছি, আবার বিকেলের মধ্যেই ফিরে যাওয়া। জিনিসপত্র যা কেনা হয়েছিল তা সমস্তই গ্রামের লোকেদের হাতে বিলিয়ে দেওয়া হল। চাল, ডাল, তেল-ঘি আরো কত কি? গুরুর অনেক শখের রান্নাও অভুক্ত পড়ে রইল।
    সমস্ত আবহাওয়াটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল ক-ঘন্টার মধ্যেই।

    ওদিকে তখন ঝম-ঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আগস্ট মাসের বৃষ্টি আর বিশেষ করে বোম্বাই অঞ্চলের বৃষ্টি। একবার আরম্ভ হলে আর থামতে জানে না। এদিকে গাড়িটাও ছোট— স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড। দুটো মাত্র দরজা। সামনে ড্রাইভার চালাচ্ছে। আমরা দুজন পেছনে। দুপাশে আঁটা কাঁচের জানালা। বাইরে মুখ বাড়িয়ে থুতু ফেলবারও উপায় নেই। গুরু যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছে হেলান দিয়ে।

    রাস্তায় কেবল উঁচু থেকে নামা। পাহাড় থেকে আমরা সমতলে নামছি। বাঁকা-চোরা রাস্তা। একটু পিছলে গেলে আমরা সবাই গুঁড়িয়ে চুরমার হয়ে যাব। আর কতক্ষণ? অন্ধকার নেমে এল খাইনিক পরেই। হেডলাইট জ্বালিয়ে চলেছি সামনের ঢালু পথ লক্ষ্য করে। সেই অন্ধকারের মধ্যেই হাতের ঘড়ি দেখবার চেষ্টা করছি। আর কতক্ষণ বাকি।

    হঠাৎ গুরু ড্রাইভারকে বললে— গাড়ি থামাও—

    গাড়ি রাস্তার ধারে থামল। গুরু নেমে গিয়ে দেখলাম রাস্তার পাশে বসল। বসল তো বসলই। আর ওঠে না। কি করছে অখানে বসে-বসে? অসুখের মধ্যে কেমন একটা অসহায়তা আছে। সেই অসহায়তা অন্যের সামনে লজ্জা পায়। বিশেষ করে সুস্থ লোকের সামনে। অথচ সেই সুস্থ লোকের সাহায্যও দরকার। কিন্তু তখন মনে হয় আমার দুর্বলতা যেন কারো নজরে না পড়ে। আমি যে অসমর্থ, এটা যেন কেউ জানতে না পারে।

    অনেকক্ষণ পরে গুরু উঠল। উঠে আবার গাড়িতে এসে বসল। গাড়ি ছেড়ে দিলে। বসল সামনের সিটে। বললে— কিছু মনে করবেন না বিমলদা, আমি সামনের সিটে বসছি—
    বললাম— কি যে বলেন, আপনি আরাম করবার চেষ্টা করুন। কি করছিলেন আপনি ওখানে?

    গুরু বললে— মনে হচ্ছিল বমি হবে, কিন্তু অনেক চেষ্টা করলাম, তবু বমি হল না—

    গাড়িটা তখন চলতে আরম্ভ করেছে। তারপর যখন রাত নটা তখন অঝোর বৃষ্টির মধ্যে গাড়িটা পালি হিল-এর বাড়িতে এসে পৌঁছল—

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook