সাল সতেরশো উনআশি। অর্থাৎ নেপোলিয়ান বোনাপার্ট নামে এক দশ বছরের ছেলে ইশকুলে বসে ঔপন্যাসিক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে আর অতলান্তিকের ওপারে সদ্য, বছর তিনেক আগেই, জন্ম হয়েছে এক নতুন দেশের— নাম, ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা। ঠিক এই সময় লিওনার্ড অয়লার নামে এক প্রবল প্রতিভাশালী বৈজ্ঞানিক খেলার ছলে জন্ম দিলেন একটি ধাঁধার। সেটা এরকম—
মনে করুন, আপনি একটি সেনাদলের অধিপতি। আপনার সৈন্যদলে কয়েক অক্ষৌহিণী সৈন্য নেই— আছে মাত্র ছত্রিশজন। তাদের মধ্যে আবার ছ’টি দল। প্রতি দলে ছ’টি ভিন্ন পদাধিকারী ছ’জন অফিসার। মানে, যদি অন্যভাবে বলা হয়, আপনার কাছে ছ’জন করে একই পদাধিকারী সামরিক অফিসার আছেন এবং তাদের প্রত্যেককে রাখা হয়েছে ছ’টি দলে পৃথক ভাবে। এবার অয়লার বললেন, এই যে সৈন্যসামন্ত হল, এদেরকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে একটি ৬ x ৬ বর্গক্ষেত্র তৈরি হয়। ছত্রিশজনকে ছয়-বাই-ছয় বর্গক্ষেত্রে রাখা এমন কী আর কঠিন বিষয়! কিন্তু অয়লার সাহেব বললেন, রোসো বাপু। আগে পুরোটা শোনো। মনে রেখো, এই বর্গক্ষেত্রে লম্বালম্বি বা আড়াআড়ি কোনওদিকেই একটি সারিতে একই পদাধিকারী বা একই দলের দুজন থাকতে পারবে না।
যদি সুদোকু খেলার নেশা থাকে, তাহলে এই ধাঁধার মানে বোঝা সহজ হবে। সুদোকুতে যেমন প্রতি সারিতে একই সংখ্যা দু’বার আসা না-মুমকিন, তেমনি এই বর্গক্ষেত্রের বেলাতেও। আপাত ভাবে এই ধাঁধাকে রোববারের খবরের কাগজের ব্রেন-টুইস্টারের থেকে আলাদা কিছু মনে হয় না। কিন্তু অয়লার অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও নিজের ধাঁধায় নিজেই ধাঁধিয়ে গেলেন। দেখলেন, যদি ছত্রিশ জনকে ছয়-বাই-ছয় করে সাজানোর বদলে পঁচিশ জনকে পাঁচ-বাই-পাঁচ অথবা উনপঞ্চাশ জনকে সাত-বাই-সাত করে রাখার পরিকল্পনা হত, তবে তা হত অনেক সহজ। ছত্রিশজনকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না! তিনি নিজেই এই সমস্যাকে ‘অসমাধানযোগ্য’ তকমা দিয়ে দিলেন। কিন্তু সেটা প্রমাণ করতে পারলেন না।
প্রায় শতাধিক বছর পর ফরাসি গণিতজ্ঞ গ্যাস্টন টেরি প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন যে, অয়লার ভুল কিছু বলেননি। এর বেশ কিছু বছর পর উনিশশো ষাট সালে কম্পিউটারের সাহায্যে গণিতবিদরা দেখালেন যে দুই-বাই-দুই এর বড় যে-কোনও পূর্ণ সংখ্যার জন্য এটা করা সম্ভব— শুধু ছয়-বাই-ছয় বর্গাকারে ছত্রিশজনকে অয়লারের শর্ত মেনে দাঁড় করানো অসম্ভব! আচ্ছা বেয়াড়া তো!
বিশ্বের সমস্ত গণিতজ্ঞের দল এই অসম্ভবকে মেনে নিয়ে দিব্যি ছিলেন এতদিন। কিন্তু কিছু মানুষ থাকেন যারা অসম্ভবকে সম্ভব করে আনন্দ পান— এই জন্যই দুরূহ পর্বতশৃঙ্গ পরাজিত হয়, উথাল-পাথাল সাগর আত্মসমর্পন করে মানুষের স্পৃহার কাছে। এমন অসমাধানযোগ্য ধাঁধাও শেষমেশ হার মানতে বাধ্য হল দুশো তেতাল্লিশ বছর পর। আইআইটি মাদ্রাজের পদার্থবিদ্যা বিভাগে গবেষণারত সুহেল আহমেদ এবং অধ্যাপক অরুল লক্ষ্মীনারায়ণ পোল্যান্ডের কয়েকজন গবেষকের সাথে জোট বেঁধে এই দ্বিশতাব্দীপ্রাচীন সমস্যাটির সমাধানের খোঁজে নেমেছিলেন। অবশেষে সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে তাঁরা এই ধাঁধার সমাধান প্রকাশ করেছেন। আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই পদ্ধতিতে সমাধান অয়লারের সময় সম্ভব ছিল না। কারণ তখন পৃথিবীতে ‘কোয়ান্টাম মেকানিক্স’ শব্দবন্ধটিরই কোনও অস্তিত্ব ছিল না।
সুহেলরা এই সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের প্রতিদিনকার জগৎ ছেড়ে খোঁজ করা শুরু করেছিলেন কোয়ান্টামের দুনিয়ায়। ধাঁধার সেনাধিপতিরা যদি পারমাণবিক জগতের অধিবাসী হয়, তাহলেও কি এর সমাধান সম্ভব নয়? কারণ ওই জগতের কর্মকাণ্ড আমাদের এই বৃহত্তর জগতের চেয়ে অনেকটাই আলাদা।
কোয়ান্টাম কণার দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মকে কাজে লাগানো হল এক্ষেত্রে— এক, উপরিপাত (superposition) ধর্ম, এবং দুই, কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট। যে-কোনও কোয়ান্টাম কণাকে (যেমন, ইলেকট্রন) তার বিভিন্ন অবস্থার উপরিপাত হিসাবে ভাবা যেতে পারে। শ্রয়ডিংগারের সেই বিখ্যাত বেড়ালের গল্পটি যদি জানা থাকে, তাহলে স্মরণে থাকবে যে, ঘরবন্দি বেড়ালের উপর একটা কোয়ান্টাম ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রয়োগ করা হচ্ছে একটি মারণ গ্যাসের। একটি তেজস্ক্রিয় পরমাণুর বিকিরণের উপর নির্ভর করবে এই গ্যাসের নির্গমন এবং মার্জার-হত্যা। কিন্তু ঘর যখন বন্ধ, বাইরে থেকে বেড়ালের ম্যাও শোনারও উপায় নেই, কীভাবে বুঝব যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণটি হয়েছে কি না— আর তার ফলে বেচারা বেড়ালের মৃত্যু হয়েছে কি না? বোঝার উপায় নেই। আইনস্টাইনকে লেখা এক চিঠিতে আর্নেস্ট শ্রয়ডিংগার বললেন যে, আমরা ঘর না খুলে বলতে পারি, এই বেড়াল জীবন আর মৃত্যুর এক উপরিপাত অবস্থায় আছে। কিছুটা মৃত্যুর সম্ভাবনা আর কিছুটা সম্ভাবনা বাঁচার। ঘর খুললেই এই দুই রকম সম্ভাবনা ঘুচে গিয়ে যে-কোনও একটি হবে সত্যি। আর ঠিক এটাই হয় পারমাণবিক কণার ক্ষেত্রে। যতক্ষণ না একটি কোয়ান্টাম কণাকে ধরে বেঁধে দেখা হচ্ছে, সে তার সম্ভাব্য সকল অবস্থার একটা উপরিপাত হিসাবে বিরাজ করে। এটাই হল কোয়ান্টাম সুপারপোজিশন।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় ধর্মে। কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট বা ইপিআর প্যারাডক্স জাতীয় শব্দবন্ধ এখন মার্ভেল ইউনিভার্সের দৌলতে সকলেই মোটামুটি শুনেছি। দুটি কোয়ান্টাম কণা যদি এনট্যাঙ্গল্ড হয়, তাহলে তাদের একটির উপর অন্যটির ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। যেমন ধরা যাক, আমি এক জোড়া দস্তানা কিনে দুটি আলাদা-আলাদা বাক্সে বন্দি করলাম। বলা বাহুল্য বাক্সদুটি একই রকম দেখতে। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে, কোনটিতে ডান হাতের দস্তানা আছে, আর কোনটিতে বাঁ-হাতের। এবার দুটি বাক্সকে দুটি আলাদা ঘরে পাঠিয়ে দিলাম— এক ঘরে যদু আছেন, অন্য ঘরে মধু। এবার যদুবাবুর কাছে যে বাক্স এল তার ঢাকনা খুলে যদি তিনি দেখেন যে তার মধ্যে ডানহাতি দস্তানা আছে, তাহলে চোখ বুজে বলে দেবেন যে মধুবাবু পেয়েছেন বাঁ-হাতের খানা। অর্থাৎ একটির সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য অন্যটির ধর্মকে নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্টও অনুরূপ। শুধু সমস্যা হল যে, কণাগুলি কোয়ান্টাম কণা— আর তাই যতক্ষণ না তাদেরকে ধরে-বেঁধে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে তারা ঠিক কী অবস্থায় আছে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না— সম্ভাব্য সকল অবস্থার সুপারপোজিশন হিসাবে তারা বিরাজ করে। মনে করা যাক, ইলেকট্রনের দুটি ধর্ম— ভাল এবং খারাপ। দুটি এনট্যাঙ্গলড ইলেকট্রনের একটিকে যেই ডেকে জিগ্যেস করব যে তুই ভাল না খারাপ, সে হয় বলবে আমি ভাল, নয়তো বলবে খারাপ (খারাপ হলেও সত্যবাদী সে)। তার আগের মুহূর্ত অবধি সে নিজেও নিশ্চিত ছিল না তার গুণ নিয়ে। ধরা যাক, সে বলল আমি ভাল ইলেকট্রন। এবার নিয়ম অনুযায়ী দুজনেই ভাল বা দুজনেই খারাপ হতে পারে না। অতএব, মেলায় হারিয়ে যাওয়া এর অন্য যে ভাই, তাকে ধরে এই মুহূর্তে যদি একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা যেত, সে যে আদতে খারাপ ইলেকট্রন— সেটা সে কবুল করতে বাধ্য হত। এদিকে আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বে বলেছেন যে, আলোর চেয়ে গতিশীল কিছু হয় না— কিন্তু একটি ইলেকট্রন ভাল হওয়া মাত্র অন্যটি সেই মুহূর্তেই খারাপ ইলেকট্রন হয়ে যাচ্ছে— অতএব একই মুহূর্তে দুটি ভিন্ন জায়গায় থাকা দুই ইলেকট্রন ভাইয়ের মধ্যে তথ্য বিনিময় হচ্ছে। আর এই তথ্যের আদান-প্রদানের গতিবেগ অসীম— বলা বাহুল্য আলোর গতিবেগের চেয়ে তা অনেক বেশি। আইনস্টাইন আর তার দুই সঙ্গী একে বললেন ইপিআর (আইনস্টাইন, পোডলস্কি, রোজেন) প্যারাডক্স আর ঘটনাটিকে দেগে দিলেন ‘ভুতুড়ে কাণ্ড’ বলে। যদিও পরে নীলস বোর-সহ বহু বৈজ্ঞানিক এর কারণ অনুসন্ধান করেছেন এবং পেয়েছেন সাফল্যও— কিন্তু সেসব বিজ্ঞানকথা আমাদের এই প্রবন্ধের বিষয় নয়।
কোয়ান্টাম কণাদের এই দুটি ধর্মকে ব্যবহার করে সমাধান হল দুশো তেতাল্লিশ বছরের পুরনো ধাঁধা। অয়লার আমাদের রোজকার জগতের যেসব সেনাধিপতিদের নিয়ে ছয়-বাই-ছয় বর্গ রচনার চেষ্টা করেছিলেন, সুহেল আর তার সাথীরা তাদের বদলে দিলেন কোয়ান্টাম সৈন্যবাহিনীতে। প্রত্যেক সেনানায়করা কোয়ান্টাম জগতের বাসিন্দা। মনে করা যাক, অয়লারের দুনিয়ায় এই ছ’রকম পদাধিকারী দাবার ছ’রকম ঘুঁটি— রাজা, মন্ত্রী, গজ, নৌকো, ঘোড়া এবং বোড়ে। আর ছ’টি বিভিন্ন রঙের দল— লাল, নীল, হলুদ, কমলা, সবুজ, বেগুনী। অয়লারের নিয়ম অনুসারে একটি পঙ্ক্তিতে দুটি লাল ঘুঁটি বা দুটি ঘোড়া থাকতে পারবে না। এবং অয়লারের মতে সেভাবে সাজানো অসম্ভব। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতের অধিবাসীদের একটি নির্দিষ্ট দলে নাম লেখানোর দায় নেই। একটি নির্দিষ্ট রং বা নির্দিষ্ট পদের ধারণাকে সরিয়ে দিয়ে একাধিক রং বা পদের সুপারপোজিশন হিসাবে তাদেরকে ভাবা যেতে পারে— লাল রাজার বদলে ঘুঁটিটি হবে লাল রাজা এবং কমলা মন্ত্রীর সুপারপোজিশন। সাথে থাকবে এনট্যাঙ্গলমেন্ট। এমন দুইখানা ঘুঁটি যদি এনট্যাঙ্গল্ড হয়, তাহলে একজনকে পর্যবেক্ষণের সময় লাল রাজা অবস্থায় ধরা গেলে, অন্,জন কমলা মন্ত্রী হিসাবে ধরা দিতে বাধ্য হবে। অতএব একটি নির্দিষ্ট পঙ্ক্তিতে কারা থাকতে পারে তা নির্ভর করবে অন্য একটি পঙ্ক্তির অবস্থার উপর। এই কোয়ান্টাম সেনাদের নিয়ে নির্দিষ্ট অ্যালগরিদম ব্যবহার করে অনেকটা রুবিক্স কিউব সমাধানের ধাঁচে একটা সমাধান বের করে ফেললেন আইআইটি মাদ্রাজের গবেষকেরা।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই আড়াইশো বছর আগে অয়লারের ধারণার দূরতম বিন্দুতেও ছিল না কোয়ান্টাম বা সেই জগতের অদ্ভুত নিয়মাবলি। কিন্তু তার ‘অসমাধানযোগ্য’ সমস্যার সমাধান অবশেষে হল, আর সেটা এমন অভিনব পদ্ধতিতে— কে জানে, হয়তো কবরের মধ্যে প্রশান্তির সাথে পাশ ফিরে শুলেন লিওনার্ড অয়লার।