ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শান্তিনিকেতন ডায়েরি: পর্ব ১৩


    নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় (March 19, 2022)
     
    ‘সবার সাথে মিলাও’

    রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সত্য যেখানে সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায়, তা-ই উৎসব। এখানে ‘সত্য’ বলতে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী বুঝিয়েছিলেন তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। সকলের সঙ্গে এক বৃহৎ সংযোগের সম্পর্কে মানুষের অস্তিত্বের যে ‘সত্য’, সম্ভবত তার কথাই এখানে বলতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনে তাঁর আশ্রম বিদ্যালয় এবং পরবর্তী কালে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পিছনে নানা কারণ এবং উদ্দেশ্য ছিল। তার মধ্যে একটা ছিল মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ। আর এই সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ভাবধারায় দীক্ষিত তাঁর আশ্রমে কিছু উৎসব-অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করেছিলেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমে পুজো-পার্বণ নিষিদ্ধ। তবু সেই সব ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানের আনন্দ থেকে উৎসাহীরা যাতে বঞ্চিত না হন রবীন্দ্রনাথ তা নিশ্চিত করতে কিছু উৎসবের উদ্ভাবনও করেছিলেন। যেমন ধরা যাক শিল্পের দেবতা বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঠাকুরের পুজো না করে শিল্পের আরাধনা করতে তিনি প্রবর্তন করেছিলেন শিল্পোৎসবের। আবার আশ্বিনে দুর্গাপুজোর লগ্নে রবীন্দ্রনাথ আশ্রমে শরতের বন্দনায় সূচনা করেছিলেন শারদোৎসবের। তার জন্য তিনি একটা নাটকও রচনা করেছিলেন, যার নামও ছিল ‘শারদোৎসব’। আশ্রমের উৎসব-অনুষ্ঠানের জন্য তিনি বেশ কিছু গানও রচনা করেছিলেন। যেমন শুধু জুজুৎসু লড়াইয়ের অনুষ্ঠানের জন্য তিনি লিখেছিলেন একটা গান, ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজের অপমান’। আবার শান্তিনিকেতনের উপাসনাগুলো বাদ দিয়ে প্রায় যে-কোনও অনুষ্ঠানের শেষে গাইবার জন্য তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের শান্তিনিকেতন, সে যে সব হতে আপন’ গানটা, যা পরিচিত ‘আশ্রম সংগীত’ হিসেবে।  

    রবীন্দ্রনাথের জীবনযাপন এবং তাঁর আদর্শ দুই ভিন্ন পথে হেঁটে যায়নি। তিনি নিজে যা বিশ্বাস করতেন, জীবন এবং অভ্যাসকে তিনি সেই পথে প্রবাহিত করবার চেষ্টা করতেন। সারাজীবন সহযোগের আদর্শে দীক্ষিত মানুষের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির মিলনক্ষেত্র হিসেবে তিনি পৃথিবীকে কল্পনা করে এসেছিলেন। এই একের সঙ্গে অপরকে মিলিয়ে দেওয়ার কাজে উৎসবের যে একটা বড় ভূমিকা রয়েছে, তা তিনি বিশ্বাস করেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘উৎসব একেলার নহে। মিলনের মধ্যেই সত্যের প্রকাশ—সেই মিলনের মধ্যেই সত্যকে অনুভব করা উৎসবের সম্পূর্ণতা।’ (উৎসব, ‘ধর্ম’)  

    সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আশ্রম বিদ্যালয়ের এবং বিশ্বভারতীর উৎসবের কিছু বিবর্তন হয়েছে, তাদের সংখ্যাও বেড়েছে। বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যের অঙ্গ হিসেবে রয়ে গিয়েছে যেসব উৎসব, তাদের একটা ছোট্ট তালিকা তৈরি করা যেতে পারে— যে উৎসব-অনুষ্ঠানগুলোকে বিশ্বভারতীর মূল উৎসব-অনুষ্ঠান বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। 

    মহর্ষি স্মরণ। ৬ মাঘ (জানুয়ারি)। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিনে প্রভাতী উপাসনা এবং অপরাহ্ণে ছাতিমতলায় স্মরণ অনুষ্ঠান। গাওয়া হয়, ‘পরিপূর্ণম্‌ আনন্দম্‌’, ‘দেহ জ্ঞান দিব্য জ্ঞান’, ‘কোন্‌ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো’।   

    নেতাজির জন্মদিন। ২৩ জানুয়ারি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনে গৌরপ্রাঙ্গণে সন্ধ্যার আলোকসজ্জা। গাওয়া হয় ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো’ এবং প্রাসঙ্গিক স্বদেশ পর্যায়ের গান। 

    মাঘোৎসব। ১১ মাঘ (জানুয়ারি)। উপাসনাগৃহে সন্ধ্যা-উপাসনা। ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাদিবসের অনুষ্ঠান। 

    সাধারণতন্ত্র দিবস। ২৬ জানুয়ারি। আলপনা দেওয়া প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা উত্তোলন। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের মতোই গাওয়া হয়, ‘বন্দে মাতরম্‌’, ‘তোমার পতাকা যারে দাও’, ‘জনগণমনঅধিনায়ক জয় হে’, ‘ও আমার চাঁদের আলো’।   

    শ্রীনিকেতনের বার্ষিক উৎসব ও মেলা। মাঘ। ৬-৮ ফেব্রুয়ারি। গাওয়া হয়, ‘ফিরে চল মাটির টানে’, ‘পরবাসী চলে এসো’, ‘অগ্নিশিখা এসো এসো’। 

    দীনবন্ধু জন্মোৎসব। ১২ ফেব্রুয়ারি। রবীন্দ্রনাথের সহযোগী দীনবন্ধু চার্লস ফ্রিয়র এন্ড্রুজের জন্মদিন। 

    গান্ধী পুণ্যাহ। ১০ মার্চ। মহাত্মা গান্ধীকে স্মরণ করে আশ্রমের সকলে নিজে হাতে এইদিন আশ্রম পরিষ্কার করে থাকেন। 

    বসন্তোৎসব। দোলপূর্ণিমা। মার্চ। আগের রাত্রের বৈতালিকে গাওয়া হয়, ‘ও আমার চাঁদের আলো’। বসন্তোৎসবের ভোরের বৈতালিকের গান, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।‘ শোভাযাত্রার গান, ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল’।   

    বর্ষশেষ। চৈত্র সংক্রান্তি। এপ্রিল। উপাসনা মন্দিরে সান্ধ্য-উপাসনা।  

    নববর্ষ ও বর্ষবরণ। ১ বৈশাখ। এপ্রিল। ভোরের বৈতালিকে গাওয়া হয়, ‘ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়’। উপাসনায় গাওয়া হয়, ‘হে চির নূতন’। 

    রবীন্দ্র-জন্মোৎসব। ২৫ বৈশাখ। মে। ভোরের বৈতালিকের গান, ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার।‘ 

    ধর্মচক্র প্রবর্তন। গৌতম বুদ্ধকে স্মরণ করে আষাঢ় পূর্ণিমার উপাসনা।  

    রাখিবন্ধন উৎসব। রাখি পূর্ণিমা। সাধারণত ছাত্রীরা সকলকে রাখি পরান। 

    রবীন্দ্র-প্রয়াণ দিবস ও বৃক্ষরোপণ। ২২ শ্রাবণ। আগস্ট। প্রভাতী উপাসনা এবং অপরাহ্ণে বৃক্ষরোপণ। ভোরের বৈতালিকের গান, ‘এবার দুঃখ আমার অসীম পাথার’। উপাসনায় গীত হয়, ‘সম্মুখে শান্তি পারাবার’। বৃক্ষরোপণের অন্যান্য গান— ‘মরু বিজয়ের কেতন উড়াও’, ‘আয় আমাদের অঙ্গনে’, ‘আহ্বান আসিল মহোৎসবে’, ‘নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জ ছায়ায়’, ‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে’। হয় পঞ্চভূতের আবাহন এবং পঠিত হয় ‘প্রাণের পাথেয় তব’(‘বণবাণী’) কবিতা।    

    হলকর্ষণ। ২৩ শ্রাবণ। আগস্ট। কৃষির সম্বৃদ্ধি প্রার্থনা করে শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণের অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়, ‘ফিরে চল মাটির টানে’, ‘আমরা চাষ করি আনন্দে’, ‘এসো হে তৃষ্ণার জল’, ‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে’। দুই সুসজ্জিত বলদ বালির বেদিতে হলকর্ষণ করে।     

    রবীন্দ্রসপ্তাহ। ২৩ শ্রাবণ থেকে সপ্তাহব্যাপী। আগস্ট। রবীন্দ্রনাথের জীবন এবং সৃষ্টি নিয়ে আলোচনার অনুষ্ঠান। 

    স্বাধীনতা দিবস। ১৫ আগস্ট। পতাকা উত্তোলন এবং সন্ধ্যায় স্বদেশী সংগীতের অনুষ্ঠান।  

    বর্ষামঙ্গল। আগস্ট। শ্রাবণের শেষ সপ্তাহে বর্ষাকে বরণ করে নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান। 

    শিক্ষকদিবস। ৫ সেপ্টেম্বর। সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনে ছাত্রছাত্রীরা একদিনের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করে থাকেন।   

    শিল্পোৎসব। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। সেপ্টেম্বর। গাওয়া হয়, ‘কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন, ও তার ঘুম ভাঙাইনু রে’। 

    নাট্যোৎসব (শারদোৎসব)। মহালয়ার আগের দিন পর্যন্ত প্রায় দুই সপ্তাহ ব্যাপী নাটকের উৎসব। 

    রামমোহন স্মরণ। ২৯ সেপ্টেম্বর। বিকেলে ছাতিমতলায় উপাসনা। 

    আনন্দবাজার। মহালয়ার দিন। শারদাবকাশের ঠিক আগে ছাত্রছাত্রীদের হাতের কাজ, খাবারের মেলা। লভ্যাংশ জমা পড়া পড়ে বিশ্বভারতীর সেবা-বিভাগে।  

    রথীন্দ্রমেলা। ২৭ নভেম্বর। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে শ্রীনিকেতনে আয়োজিত শিল্পমেলা।  

    নন্দনমেলা। ১-২ ডিসেম্বর। নন্দলাল বসুর জন্মদিনে কলাভবনে আয়োজিত শিল্পমেলা। 

    দিনেন্দ্রনাথের জন্মদিন। ২ পৌষ। ডিসেম্বর। রবীন্দ্রনাথের সুরের ‘ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন।  

    পৌষ উৎসব এবং পৌষমেলা। ৭-৯ পৌষ। আগের রাত্রের বৈতালিকের গান, ‘আজি যত তারা তব আকাশে’। ৭ পৌষ ভোরের বৈতালিকের গান, ‘মোরে ডাকই লয়ে যাও’। ছাতিমতলায় ব্রহ্ম-উপাসনার পর গাওয়া হয় ‘কর তাঁর নাম গান’, এবং ‘আগুণের পরশমণি’।  

    খ্রিস্টোৎসব। ২৫ ডিসেম্বর। সন্ধ্যায় উপাসনাগৃহের উপাসনা। গাওয়া হয়, ‘একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে’। উপাসনার পরে  গাওয়া হয়, ‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে’।  

    এইসব উৎসব-অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রতি বুধবার উপাসনাগৃহে সকালে হয় আশ্রমের সাপ্তাহিক উপাসনা। সাধারণত মন্ত্রোচ্চারণ, রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে পাঠ এবং গান এই উপাসনার অংশ। উপাসনাগৃহ অথবা ছাতিমতলায় অন্যান্য অনুষ্ঠানের মতো অনুষ্ঠান শেষে ‘আশ্রম সংগীত’ গাইবার চল নেই। জাতীয় সংগীতের মতোই শান্তিনিকেতনে আশ্রম সংগীত গাওয়া হয় দাঁড়িয়ে। আশ্রমে উৎসবের পোশাক সাদা। শান্তিনিকেতনের এইসব উৎসব-অনুষ্ঠান এখনও যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা আচার্যের সেই কথাই, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী—কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ (উৎসবের দিন, ‘ধর্ম’) 

    কভারের ছবি: বৃক্ষরোপণ উৎসব (১৯৩৬); চিত্রগ্রাহক শম্ভু সাহা

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook