ম্যায় তো তন্দুরি মুর্গি হুঁ ইয়ার, গটকা লে সাইঁয়া অ্যালকোহল সে!
এইভাবেই করিনা কাপুর নিজের তন্দুরি সত্তাকে সমর্পণ করলেন, এক ঢোঁক মদের সঙ্গে ভোগ করে নেবার জন্য।
বিহারের সিওয়ান জেলার উশ্রী গ্রামের আকাশে গনগন করছে সূর্য। আশেপাশে অল্পবয়সি ছেলেরা ঘোরাঘুরি করছে, তাদের সর্বাঙ্গে ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’-এর আবেশ, কায়দা করে এমন কাছাকাছি ঘুরছে যাতে সব শুনতে পায়। আমার চারপাশে বসে আছে মেয়েরা, ফিসফিস করে কথা বলছে তারা। সবার মুখে আড়ষ্ট ভাব, চোখগুলো মাঝে মাঝে চক্রাকারে ঘুরতে-ঘুরতে ছেলেগুলোকে ধূর্ত দৃষ্টিতে মেপে নিচ্ছে। কুড়িজন মেয়ে এখানে জমায়েত হয়েছে সিনেমা নিয়ে আলোচনা করতে— মূলধারার বলিউড সিনেমা, কিছু ভোজপুরী ফিল্ম। বাড়ির দৈনন্দিন কাজ থেকে কিছুক্ষণের জন্য ছুটি নিয়েছে তারা— ছোট ভাই বা ছোট বোন একলা আছে, খাবার রান্না করা হয়নি এখনও। চারপাশে প্রায় শ’খানেক তরুণ ছেলেছোকরা এবং পুরুষ মানুষ অপেক্ষা করছে। আমি বারবার অনুরোধ করছি, আপনারা একটু চলে যান, এর পরে আপনাদের কথা বলার সময় দেওয়া হবে। তারা কয়েক ফুট পিছিয়ে যায়, আবার চুপচাপ ফিরে এসে ঠিক সেইখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রায় হাল ছেড়ে দেব-দেব করছি, এমন সময়ে আলোচনায় যোগ দিল সীতা। ‘সিনেমায় এইসব গান কেন ঢোকানো হয়েছে আপনি জানেন? যাতে ছেলেদের আরো ক্ষমতা দেওয়া যায়, সেই জন্যই! ওরা বুক ফুলিয়ে হাঁটাহাঁটি করে, এই গানগুলোর থেকে কয়েকটা কথা তুলে নেয়, আর আমরা যখন পাশ দিয়ে হেঁটে যাই তখন মোবাইলে জোরে-জোরে এই গানগুলো বাজায়। আমার কান ভোঁ-ভোঁ করে, অপমানিত লাগে, অসহায় লাগে।’ সীতার শীর্ণকায় শরীরটা রাগে কেঁপে ওঠে। ফিকফিক করে হাসির আওয়াজগুলো কমে আসে। সীতা চিৎকার করে কথা বলতে থাকে, আর এদের মধ্যে সবচেয়ে চুপচাপ যে-মেয়েটা, সেই মধুশ্রী ওর দিকে তাকিয়ে থাকে ভুরু কুঁচকে। একটু পরে আমারও সীতার জন্য একটু আশঙ্কা হতে শুরু করে।
এই গ্রীষ্মে উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিসগড় আর উড়িষ্যায় আগে থেকে বেছে রাখা বারোটা গ্রামে আমি বেশ কিছু কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতীদের নিয়ে এমন অনেকগুলো আলোচনায় বসেছি। অক্সফ্যাম ইন্ডিয়ার অনুমোদনে এই সমীক্ষাটি অনুসন্ধান করে দেখিয়েছে, বলিউডের কোটি টাকার কাহিনিগুলো মহিলাদের পক্ষে এক ভয়ঙ্কর দুনিয়ার জন্ম দিচ্ছে। এতে নারীবিদ্বেষ এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যকে সাংগঠনিক ভাবে মান্যতা দেওয়া হয়, মহিলাদের এবং মেয়েদের উপর নির্যাতনের সামাজিক রীতিকে পুষ্টি জোগানোয় এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। যৌন নির্যাতন এবং ক্ষমতার এই চক্রব্যূহকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে এসব সিনেমা।
যেসব গ্রামে আজও সন্ধে নামার আগেই ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, যেখানে চাকরি নেই, সেখানে অল্পবয়সি ছেলেরা ‘গ্রেট গ্র্যান্ড মস্তি’ (২০১৬)-র মতো সিনেমা দেখে যৌনতা সম্পর্কে শিখছে। যে অল্পবয়সি মেয়েরা পুলিশে চাকরি করার স্বপ্ন নিয়েও শেষমেশ নিজেদের মায়ের অর্থহীন, অসহ্য জীবনের পুনরাবৃত্তি করতেই বাধ্য হচ্ছে, তাদের স্কুলে যাবার পথে রাস্তা জুড়ে দাঁড়াচ্ছে সিনেমায় শোনা এমন সব নাচের গান, যাতে তাদের মতো মেয়েদেরই যৌন খিদেয় ভোগ করার এক টুকরো মাংস বলে জাহির করা হচ্ছে। যেটা আরও সমস্যাজনক, সেটা হল এরকম আইটেম সংগুলোকে সব স্তরেই সাদরে গ্রহণ করে নেওয়া হচ্ছে— সমস্ত অনুষ্ঠানে এমন গান লাউডস্পিকারে জোরে-জোরে বাজছে, এমনকী ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতেও। ফলে এই গানগুলো সহজেই দৈনন্দিন সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আলোচনায় যে-মেয়েরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই এ-গানগুলোকে নিয়ে রাগ এবং ঘৃণা প্রকাশ করলেও মানতে বাধ্য হয়েছেন, গানগুলো শ্রুতিমধুর এবং সেগুলো বেশ সহজেই মনে থেকে যায়, গানের সুরে-সুরে তাল দিতে ইচ্ছে করে।
সুতো ছাড়ার কাজ শুরু করতে চট করে একবার গুনে নিলাম— মোট ৪৫টি সিনেমা। বলিউডের সফলতম সিনেমাগুলোর কয়েকটা, সামাজিক বিষয়মূলক সিনেমা, মহিলাদের বানানো বা মহিলাদের নেতৃত্বে তৈরি বেশ কিছু সিনেমা যা আমাদের সমীক্ষার ফলাফলগুলোকে আশাজনক দিকে একটু হলেও ঠেলে দিতে পেরেছে। এই সমীক্ষার জন্য তৈরি করা মোট ২৮টি ইন্ডিকেটর বা নির্ণয়ক ব্যবহার করে সুতো গুটিয়ে নেওয়া গেল। সিনেমায় মুখ্য নারীচরিত্র মানে আসলে কী? প্রেমবিষয়ক বা প্রেমের সম্পর্কমূলক চরিত্র নয়, এমন চরিত্রে তাদের কতটা চোখে পড়ে? প্রতিশোধ বা বদলা নেওয়ার বাসনা ছাড়া এ-চরিত্রদের গতিবিধির অন্য কোনও কারণ দেখানো হচ্ছে কি? তাদের নিয়ে কতবার ঠাট্টা করা হচ্ছে, যা হালকা, লঘু রসের রসিকতা হলেও আসলে লিঙ্গবিদ্বেষী রসিকতা? এ-চরিত্ররা কি নিজেদের উপার্জন নিজেরা করে? কর্মক্ষেত্রে তাদের কতবার একজন পুরুষের চেয়ে ক্ষমতাশীল বলে দেখানো হয়? কতবার কোনও পুরুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করছে, বা নস্যাৎ করে দিচ্ছে?
আকাশকুসুম ভাঙতে বেশি সময় লাগে না। ৪৫টি সিনেমায় ১৩০০জন চরিত্রের মধ্যে ৭৩.৪% পুরুষ অভিনেতা, মহিলা অভিনেতা মাত্র ২৭.২%। অর্থাৎ নারীচরিত্রের চেয়ে পুরুষচরিত্রের সংখ্যা প্রায় আড়াই গুণ বেশি। মাত্র ২৩% সিনেমায় মুখ্য চরিত্রে মহিলাদের অভিনয় করতে দেখা যায়। কাহিনিগুলোয় পুরুষদেরই রমরমা, ৭৭% সিনেমায় তারাই মুখ্য চরিত্র। ৭৬.৭% সিনেমায় মহিলারা নিছকই প্রেমবিষয়ক চরিত্রে অবতীর্ণ হন, হয় প্রেমিকা রূপে সহ-মুখ্য অভিনেতা (৩৭.২%) নয় নায়কের প্রেমিকামাত্র (৩৮.৫%)। মুখ্য চরিত্রে যারা রয়েছে, তাদের ধরে হিসেব করলেও ৪৮% ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, নারীচরিত্রদের হাত ধরেই গল্প আদতে এগোচ্ছে। কিন্তু তিনভাগের মধ্যে দু’ভাগ সিনেমায় যে নারীচরিত্রদের হাত ধরে গল্প এগোয়, দেখা যায় তারা হয় প্রতিহিংসা নয় প্রেম, এই দু’রকম তাগিদে যা করার তা করছেন। যে-সিনেমাগুলো নিয়ে গবেষণা হয়েছে, তার মধ্যে ৮৮% সিনেমাতেই মহিলাদের বস্তুনিষ্ঠ (objectify) করা হয়েছে। যেসব সিনেমা বাজারে চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েছে, বিশেষ করে যেখানে ডাকসাইটে পুরুষ অভিনেতারা কাজ করেছেন, যেমন ‘থ্রি ইডিয়টস’ (২০০৯), ‘দাবাং’ (২০১২), ‘স্টুডেন্ট অফ দি ইয়ার’ (২০১২), ‘ধুম ৩’ (২০১৩), ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ (২০১৩), ‘কৃশ ৩’ (২০১৩), ‘কিক’ (২০১৪), ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ (২০১৪), অথবা ‘সুলতান’ (২০১৬), সেখানে এই গবেষণার জন্য বেছে নেওয়া একাধিক বা অন্তত একটি নির্ণয়ক অনুযায়ী মহিলাদের বস্তুনিষ্ঠ করা হয়েছে। এর মধ্যে লিঙ্গবিদ্বেষী ভঙ্গিতে মহিলাদের প্রদর্শন, মহিলাদের যৌনোদ্দীপক জামাকাপড়ে সাজানো, এমন অঙ্গভঙ্গি করা যা যৌন নির্যাতন বা শ্লীলতাহানির ইঙ্গিত দেয়— এমন একাধিক কর্ম চোখে পড়েছে। মহিলাদের দেখানো হয়েছে অবোধ, অবলা, অযৌক্তিক রূপে, তারা অসম্মান এবং নারীবিদ্বেষকে মুখ বুজে মেনে নেয়, সচরাচর সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার মতো বুদ্ধি তাদের নেই। জনমত কিন্তু এসব ব্যাপার হেলায় অবজ্ঞা করে গেছে। উপরে যে ক’টি সিনেমার নাম লিখলাম, সেগুলো প্রত্যেকটাই ২০০ কোটি টাকার উপর লাভ করেছে এবং সুপারহিট নামে খ্যাত হয়েছে। নারীদের যৌন বস্তু রূপে দেখানোর ব্যবসা আসলে লাভজনক। তার প্রমাণ হিসেবে সহজেই হিসেব-নিকেশের খাতা খুলে দেখিয়ে দেওয়া যায়।
শেষমেশ কথা বলার সুযোগ পেয়েই উশ্রী গ্রামের ছেলেরা আগে নিজেদের নির্দোষ সাব্যস্ত করতে চায়।
‘যে-মেয়েটি খুব তাড়াতাড়ি কথা বলছিল, ওর মতো মেয়েরাই কিন্তু সমাজের ক্ষতি করে।’
‘কেন, সে কি নিজের মত প্রকাশ করতে পারে না?’
‘অবশ্যই পারে। কিন্তু আমাদের বদনাম করছিল কেন? গ্রামের মেয়েরা শান্তশিষ্ট হবে, মিতবাক হবে, এই তো চাই।’
অন্য এক দিনের কথা। মজবুত করে বানানো রাঁচি খুঁটি হাইওয়ের আকাশে সূর্য প্রায় অস্ত গিয়েছে। আমার তরুণ সহযাত্রীদের বেশ শঙ্কিত লাগছে। দাসাম জলপ্রপাত থেকে আমরা খুব একটা দূরে নেই, যেখানে নারী-পুরুষেরা চুমু খেতেও যায়, আবার ঘূর্ণিজলে পড়ে ডুবে মরতেও যায়। আমার বাঁ-দিকে একটা নদী চোখে পড়ে। এ-নদীকে বন্দি করা হয়েছে। কোব্রা (কমান্ডো ব্যাটেলিয়ন ফর রিজোল্যুট একশন) সেনারা বিকটাকার সব কংক্রিটের চাঁই রেখে এ-নদীর স্রোত আটকে দিয়েছে।
এ-নদী আর যেখানে বয় না, সেখানেই একটা গ্রামের মানুষ সিনেমা দেখে কি না, তা জানতেই আমি এসেছি। আমার মিশনের ইনসাইডার জন একটু হেসে উত্তর দেয়, চিন্তা করবেন না। ওদের আর আছেই বা কী? নদী যেখানে পৌঁছয় না, আজকের যুগে ইন্টারনেট সেখানেও পৌঁছে যায়।
হুত্তার গ্রামে আগের দিন একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে, তার লাশটা পাওয়া গেছিল গাছের তলায় বসিয়ে রাখা অবস্থায়। স্কুল থেকে ফেরার পথে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। বাবা-মা এসে চুপচাপ লাশটা নিয়ে চলে গেলেন। ভয়ের অন্য কারণও আছে। গেরিলা যোদ্ধারা ঘরে-ঘরে আসতে পারে, মুরগির ঝোল, টাকা এবং আনুগত্যের খোঁজে। তাদের ভয়ে দরজা বন্ধ রাখা হবে। সবাই জানায়, এক সময়ে গুপ্তযুদ্ধ যেভাবে চলত এখন আর অতটা চলে না। এই নদীহীন গ্রামের ক্ষোভ-যন্ত্রণা-লালসা প্রশমিত করে রাখে আফিমের নেশা।
১৪ বছর বয়সি অন্বেষা অলিম্পিকে সোনা জেতার স্বপ্ন দেখে। রোজ ভোরবেলা উঠে মেয়েটা প্র্যাকটিস করে। খালি হাত, খালি পা, হাতে বানানো তির-ধনুক নিয়ে। ‘মেরি কম’ (২০১৪) আর ‘দঙ্গল’ (২০১৬) তার প্রিয় সিনেমা। মেরি কমের গল্প তার বিশেষভাবে ভাল লাগে, কারণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একজন খেলোয়াড় যে প্রান্তীকরণের (marginalization) শিকার হয়েছে, বর্ণবিদ্বেষ এবং বাবার মদের নেশায় আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠা দারিদ্র্যের মোকাবিলা করেছে, ভারতের মূল ধারার খেলার জগতে জায়গা করে নেওয়ার জন্য লড়াই করেছে— এ-কাহিনি তার বড় আপন মনে হয়।
ছেলেদের প্রতি কোনও সহানুভূতি দেখানোর সময় অন্বেষার নেই। ‘ওদের মাথাগুলো খেয়েছে সিনেমা’, সে জানায়, ‘নিজের ভাগ্য নিজের হাতে না নিয়ে প্রত্যেকজন নেশা করে, মদ গেলে আর সিনেমার নায়িকারা যেখানে সারাদিন নাচে সেই অন্ধকার জগতের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। আর নিজেদের যত লালসা, কামনা তা বের করে আমাদের উপর। সব ক’টা জানোয়ার।’
বুকের ভিতর আগুন নিয়ে যে সবাই বাঁচছে, তা নয়। এদের মধ্যে কতজন নীরবে বসে থাকে, কেউ হাসে, কেউ প্রেমে পড়েছে। যে অল্পবয়সি মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে তারা অবশ্য এসব ছেলেদের একটু বেশি প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। কারোর-কারোর নিজেদের অল্পবয়সি ছেলে আছে, তারা ইতিমধ্যেই মদের নেশা ধরেছে। দশ-বারো বছরের ছেলেরাও নেশা করতে শুরু করে দেয়। আর তারপরে সিনেমা দেখে।
৮৮ শতাংশরও বেশি সিনেমায়, অর্থাৎ বেশির ভাগ সিনেমাতেই, কোনও-না-কোনও রকমের যৌন নির্যাতন দেখানো হয়ে থাকে। তাতে অনার কিলিং বা সম্মান রক্ষার্থে হত্যা থেকে জোর করে প্রেমের সম্পর্ক শুরু করা, অশ্লীল মন্তব্য করা, বুকের দিকে তাকিয়ে থাকা, মদ খেয়ে মারধোর করা, কর্মক্ষেত্রে যৌন দুর্ব্যবহার, বা আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ টিপ্পনি, সবই রয়েছে। যৌন কুমন্তব্য বা দুর্ব্যবহারকে রসিকতা হিসেবে ব্যবহার করা বলিউডের এক বিশেষ স্বভাব। এ গবেষণায় দেখা ৮৬% সিনেমাতে নানা রূপে লিঙ্গবিদ্বেষী রসিকতার ব্যবহার আছে। গান, নাচ এবং সমষ্টিগত হই-হুল্লোড়ের ছদ্মবেশে যৌন নির্যাতন বা কারোর সম্মতি বা পছন্দের উপর জোরজুলুম করা দেখানো হয়ে থাকে। বড়সড় পুঁজির সাহায্যে কার্নিভাল বা উৎসব দেখানো হয়, সেখানে দৈনন্দিন, বাস্তব জীবনের সীমারেখাগুলোকে সুবিধেমতো আটকে দেওয়া হয়। বলিউডের বেশির ভাগ সিনেমাতেই এই সমাজ-বহির্ভূত প্রেক্ষাপটগুলোকে সৃষ্টি করা হয় ভারতের আইনে অপরাধ বলে গণ্য নানা রকম অপকর্মকে মানুষের পরোক্ষ বিনোদনের জন্য দৃশ্যমান করে তুলতে। সাংস্কৃতিক মাত্রা মাপার জন্য যে গিয়ার্ট হফস্টেড ইনডেক্স রয়েছে, তার মাপকাঠিতে ভারতবর্ষ বেশ জোরালো রকমের পুরুষালি দেশ, পৌরুষের মাত্রায় তার মাপ ৫৬। জনপ্রিয় সংস্কৃতির বৃহৎ উৎপাদনকারী হিসেবে বলিউড এই অসাম্যের আখরকে টিকিয়ে রাখার এক মুখ্য কর্মকার।
পুরুষতন্ত্রের এই যে দানবিক সাম্রাজ্য, যাকে এ-দেশে ধর্মের মতো মান্যতা দেওয়া হয়, তাকে প্রতিরোধ করার উপায় তবে কী? স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ের যে নারীকেন্দ্রিক বা নারীদের তৈরি সিনেমা, তা এই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যথেষ্ট সক্ষম নয়। কারণ বম্বেতে তৈরি ‘নারীবাদী সিনেমা’তে আসলে কী দেখতে পাই? আলিয়া ভাটের অগোছালো জিন্স আর অতি-পুরুষ শাহরুখ খানের প্রেমে পড়া। স্পোকেন ইংলিশ শেখার আর লাড্ডু বানানোর জন্য এন্টারপ্রনার আখ্যা লাভ করার গৃহবধূসুলভ স্বপ্ন। চুপিচুপি দুটো গালি দেওয়া, টাকিলা খেয়ে বিপ্লব করা, পুরুষটিকে প্রত্যাখ্যান করা, চাকরিটা নেওয়া, লুকিয়ে যৌন সম্পর্কে যুক্ত হওয়া। এগুলো আদতে ছোট্ট-ছোট্ট শখের বিপ্লব, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে এর সাহায্যে টলানো যায় না।
সিনেমায় যে আরও বেশি করে মহিলা চরিত্রদের নিজেদের কাজ এবং উপার্জন করতে দেখানো হচ্ছে, তাতেও বিশেষ সুরাহা হচ্ছে না। আমাদের দেখা ৫৮% সিনেমায় মহিলাদের পেশাদারি কর্মী হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানেই বিষের পাত্রের প্রবেশ। স্যুট পরা পুরুষ, পুরুষদের টাকার থলি এবং একদল জমকালো ‘সব পেয়েছি’ মহিলা চরিত্রদের দেখিয়ে, লিঙ্গসাম্যের বাক্সে একটা ঢেরা কেটে আসলে শ্রমজীবনে নারী-পুরুষের উপার্জনের ফারাকটাকেই আরও মজবুত করা হচ্ছে। ‘মেরি কম’ আর ‘দঙ্গল’ ক্রীড়াবিষয়ক সিনেমা— এ-দেশে মহিলাদের একমাত্র খেলার ব্যাপারেই উচ্চাশা থাকাটাকে মান্যতা দেওয়া হয়। এ-সিনেমা দুটি ছাড়া আর কোথাও মহিলাদের দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই এবং সাফল্যের গল্প বলা হয় না। গোটা কাঠামোটাকেই বরং উলটে দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ নারীচরিত্রদেরই নীচু স্তরের বা মধ্যস্তরের কাজ করতে দেখানো হয়, বরং তুলনামূলক ভাবে পুরুষেরা থাকেন কর্মক্ষমতার শীর্ষে। মহিলাদের ভাগ্যে জোটে সেক্রেটারি, সহকারী, যৌনকর্মী, রাজনৈতিকের রক্ষিতা, ফুলের দোকানদার বা নিয়তির গ্রাসে পতিত নায়িকা। পুরুষেরা হয়ে ওঠেন সিইও, রাজনৈতিক ব্যক্তি, ডাকসাইটে ব্যবসায়ী, তারকা বা ওইরকম ঝাঁ-চকচকে নানা চরিত্র। কেবল একটা সিনেমায় একজন মহিলাকে শীর্ষস্থানের কর্মী হিসেবে দেখা যায়। ‘দৃশ্যম’ (২০১৫) সিনেমায় তাবু পুলিশের একজন ইন্সপেক্টর জেনারেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তবে তিনি ব্যক্তিগত পরিসরেই এ-সিনেমায় যা করার তা করেন— তিনি নিজের হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে খুঁজছেন, এবং শেষপর্যন্ত একজন সাধারণ মানুষের চরিত্রে অজয় দেবগণের কাছে তিনি হেরে যান।
হ্যাঁ, ভারতের গ্রাম-মফস্সলের ব্যাপারে সিনেমায় একটা নতুন ধরনের সহানুভূতি, নতুন ভাবে তুলে ধরার ইচ্ছে তৈরি হয়েছে বটে, এবং তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সুলক্ষণ। কিন্তু নারীচরিত্রদের দৃশ্যায়ন এর ফলে বিশেষ পালটায়নি। ‘মাঞ্ঝি— দ্য মাউন্টেন ম্যান’ সিনেমাটির কথাই ধরা যাক। এ-সিনেমার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে নারীর দায়িত্ব, নারীর বহন করার বোঝা। কিন্তু তা সত্ত্বেও নারী নির্যাতন বা লিঙ্গভিত্তিক অধিকারের বিষয়ে কোনও স্পষ্ট দাবি জানাতে এ-সিনেমা অক্ষম। জাতিবিদ্বেষী এবং লিঙ্গবিদ্বেষী হিংসার সংযোগকে এ-সিনেমায় কেবল গ্রাম্য জীবনের পটভূমি হিসেবে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে। মাঝি নিজে মুসহর দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ, যাঁরা চরম দারিদ্র্য এবং সামাজিক বহিষ্কারের শিকার। একজন মুসহর দলিত মহিলা হিসেবে তার স্ত্রী ফাগুনিয়া এ-সিনেমার গল্পের মরণোত্তর চালক হয়ে ওঠে, কারণ তার স্বামী তার মৃত্যুকেই নিজের প্রেরণা বানিয়ে নিজের কাজকর্ম শুরু করে। মূলধারার ভারতীয় সিনেমা গ্রাম্য জীবনের দারিদ্র্য এবং অসাম্য দেখাতে গিয়ে এখানে এক সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও নিতে পারেনি— সমস্ত অভাব-বৈষম্যের কেন্দ্রে আছেন যে-মহিলারা, তাঁদের চোখ দিয়ে এই গোটা ব্যাপারটাকে দেখানো যেত। অপুষ্টি, মা এবং সন্তানদের মৃত্যুর হার, এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এ-সিনেমা আলোচনা করতে পারেনি, যে-বিষয়গুলো মূলত নারী এবং শিশুদের দুঃখের কারণ। ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’ (২০১২) সিনেমার গোড়ার দিকের একটি দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, একজন মহিলা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন। এই দৃশ্যায়ন অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ, এখানে যে-মহিলা মারা যান, তিনি একজন নামহীন, কণ্ঠহীন চরিত্র। তাঁর মৃত্যুর একমাত্র গুরুত্ব এই যে, তাঁর ছেলে, সিনেমার নায়ক সর্দার খান অনাথ হয়ে বড় হবে এবং প্রতিশোধকে পাথেয় করে তার গল্প এগোবে। এসব সিনেমায় বাস্তবকে তুলে ধরা হয় বটে, কিন্তু তা সম্পূর্ণ বাস্তব নয়। আর সবার কাহিনি বাদ দিয়ে সর্বাগ্রে পুরুষের কাহিনিকেই বেছে নেওয়া হয়।
এ-প্রসঙ্গেই ফিরে যাই পুরকাজির ক্ষেতে। তখন এপ্রিলের শেষ, ফসল তোলার ভরা মরশুম। ক্ষেত থেকে ব্যস্তসমস্ত গতিতে গম তোলা হচ্ছে, বছরভর সে-শস্য রাখা হবে গোলায়। শ্রমিকদের মধ্যে ভাগটা বেশ চোখে পড়ে। অল্পবয়সি ছেলেরা গ্রামের নালায় স্নান করে রোদের জ্বালা দূর করছে। মেয়েরা শস্য তুলবে বলে স্কুল কামাই করেছে। মহিলারা দুধের শিশু বুকে নিয়ে চলে গেছেন ক্ষেতে। আকাশের সূর্য নির্মম, নিষ্ঠুর।
সূর্যাস্তের পরে সবার দিনের কাজ শেষ হয়, তারা উঁচু-উঁচু শস্যের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে বাড়ি ফেরে। কয়েকদিন পর পরেই মেয়েদের এইসব আখের ক্ষেতে ধরে ধর্ষণ করা হয়। পুরকাজি শহরের ভারতী নামে একজন সমাজকর্মী আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ১৯৯৪ সালের ‘আঞ্জাম’ সিনেমার একটা গান আমার মনে আছে কি না। দু’কলি গেয়ে শোনায়, সঙ্গে মাধুরী দীক্ষিতের সেই কিংবদন্তি নাচের মুদ্রার নকল করে হাত আর বুক দুলিয়ে দেখায়। সেই যে গান ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল, যে গানে আখের ক্ষেতে ধর্ষণের সম্ভাবনার আখর নিয়ে তিনি হালকা ছন্দে গেয়ে উঠেছিলেন। বুছা বস্তি গ্রামে এ-জিনিস রোজকার ব্যাপার, সেখানকার মহিলারা নীরব থাকেন। বেশির ভাগ সময়েই খুন করা না হলে ক্ষেতে ধর্ষণের মামলায় কেউ নালিশ করে না। ধর্ষিতা উঠে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি চলে যান। পরের দিন আবার এ-পথেই আসতে হবে।
একটু চর্বিতচর্বণ কথাই হয়ে যাচ্ছে জানি, যে-ধরনের কথায় সব মজা মাটি হয়ে যায়। তবু অসাম্য এবং বৈষম্যের যে আবহমান স্রোত, তা এই চর্বিতচর্বণের মধ্যেই টিকে থাকে। বলিউডকে এই গুরুতর অপরাধের জন্য রক্ষণশীল, উদারপন্থী এবং এলিট— সবাই এক সঙ্গেই মাফ করে দিয়েছেন। মহিলা মানেই যে ভোগ করার বস্তু, সে-ধারণাকে সযত্নে লালিত এক ধরনের উদার কিশ (kitsch) প্রেমের ছবির মধ্যে দিয়েই টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। মহিলা মানেই উৎসব।