রামায়ণ-মহাভারত ছাড়াও এদেশের বিভিন্ন প্রান্তে দূরবাসী লোকেদের নিজস্ব গাথাকাব্য আছে, যেমন পঞ্জাবের হীর-রানঝা, মণিপুরের খাম্বা-থোইবি, কুমায়ুনের বীরুকথা ইত্যাদি, সংখ্যাতীত। আবার রামায়ণ-মহাভারতও নানা দূর অঞ্চলে বা জনজাতিদের মধ্যে অতি বিচিত্র বয়ানে গ্রথিত আর সুদীর্ঘকাল প্রচলিত। এগুলো কোথাও লিখিত ছিল না। সাধারণত বিশেষ সাংস্কৃতিক/ ধর্মীয় উপলক্ষে একত্র বসে সম্মেলক ভাবে গাওয়া হত। নানারকম নিয়ম ছিল সেই গায়ন পরিবেশনেরও। প্রায়ই মূল গায়ক থাকতেন এক বা দুজন, সঙ্গে থাকতেন দোহারের দল। সমস্ত গাথাটি মূল গায়েনদের কন্ঠস্থ থাকত। কিন্তু সুদীর্ঘ গাথাগুলি একটানা পুরোটা গাওয়া হত না, বিশেষ ধরনের উপলক্ষে বিশেষ অংশ গীত হওয়াই বিধি। দোহারদের মধ্যে কয়েকটি অন্তত অপেক্ষাকৃত তরুণ সুকন্ঠ। মূল গায়েন একটি পংক্তি বা পদ গেয়ে থামলে, তারা আবার সেটি গাইত। এভাবেই সমস্ত গোষ্ঠী সমগ্র গাথাটিকে আয়ত্ত করে ফেলত। এই বাসিন্দাদের অনেকেরই ভাষার নিজস্ব অক্ষর নেই, মুখে মুখেই তাঁদের সাহিত্যভাণ্ডার জীবনময় থেকেছে।
একশো বছরেরও আগে, ভারতের অন্যতম অগ্রগণ্য নৃতাত্ত্বিক শরৎচন্দ্র রায়, বিরহড়-দের মধ্যে প্রচলিত রামলক্ষ্মণের ‘কথা’র বর্ণনা করেছেন, যাতে রাম আর লক্ষ্মণ বনবাসে গিয়ে বিরহড়দের সান্নিধ্যে ছিলেন, তাদেরই মতো জীবন যাপন করে বনবাস পার করেন। কাশীদাসী মহাভারতে, শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের কাছ থেকে শিক্ষা নেবার কালে যুধিষ্ঠির যেমন নানা জটিল দার্শনিক প্রশ্নের সঙ্গে জ্বরের জন্মকথার মত উপাখ্যানও শোনেন, কৃত্তিবাসী রামায়ণে তুলসীগাছে কেন মূত্রত্যাগ করে কুকুর কিংবা ফল্গু নদী কেন অন্তঃসলিলা— এসব কথা অবলীলায় জড়িয়ে থাকে রাম-সীতা-লক্ষ্মণের সঙ্গে। যাঁদের সব প্রশ্নের উত্তরই চরিতার্থ হয় কোনো না কোনো ‘প্রামাণিকতা’র আশ্রয়ে, তাঁদেরকে শ্রদ্ধাসহ ঈষৎ দূরে রেখে আমরা পলিসভ্যতার মানুষরা অবাক হয়ে দেখি, বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের প্রাকৃতিক বস্তুগুলির সঙ্গে বাসিন্দাদের কল্পনা আর ভাবনার চিহ্ন যেন পলি-স্বভাবেই চলতে চলতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মহাকাব্যগুলির গায়ে। তবেই না কত দীর্ঘকাল ধরে এত ভিন্ন ভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে নিত্যপ্রবহমান থেকেছে এরা। নিত্যজীবিত বলেই তো! বিরহড়দের রামকথায় আছে কুলগাছ কেন অমরপ্রায়, কেনই বা চিরল-চিরল তেঁতুলগাছের পাতা। সাঁওতালি রামকথা নিশ্চিত জানে যে রাম ছিলেন সাঁওতাল। নাহলে কেন অমন শ্যামবর্ণ, আর স্ত্রী ও ভাইকে নিয়ে কেনই বা বাস করেন বনে? প্রতিটি গোষ্ঠী নিজের নিজের এলাকার বৈশিষ্ট্যকে জেনেছে ওইসকল মহাকাব্যে সংলগ্ন বলে, সুতরাং কোনো ক্ষমতার নাম লেখানো অনড় ও মৃত অস্তিত্ব থেকে মুক্ত থেকেছে কবেকার এই রামকথা বা ভারথ-কথা। ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা’য় পরিত্যক্ত এয়ারপোর্টে সীতার মুখে সেই আলগা ভাসিয়ে দেওয়া মন্তব্যটি মনে পড়ে, ‘কবে একটা যুদ্ধ হয়েছিল, এখনো দেখ তার দাগ পড়ে আছে।’ কোন সেই আদিম যুদ্ধের বীজ— ভূমি আর নারীর দখল নিয়ে, ক্ষমতাশালী পিতৃতন্ত্র যা থেকে তৈরি করে কখনো ইলিয়াড, কখনো মহাভারত, বা রামায়ণ। অন্য কোনো দেশে ক্ষমতাদখলের আরো কোনো গাথা। কিন্তু দেখি, আমাদের নিত্যজানিত এই সীমানার বাইরেও কত অভিনব রূপে বেঁচে ছিল সেই গাথাগুলি— যাদের নাম ‘জয়কাব্য’ নয়।
রাজস্থান গুজরাটের প্রান্তে ছোট ছোট পাহাড়, যাকে বলে ‘ডুঙ্গর’ (কী অদ্ভুত, পুরুলিয়াতেও সমতলের মধ্যে মাথাতোলা ছোট পাহাড়কে বলে ডুংরি!)— সেখানকার ‘ডুঙ্গরিয়া ভিল’দের মধ্যে গীত হয়ে এসেছে ‘ভিলোঁ নু ভারথ’। অন্যান্য আদিবাসীদের মত এঁদেরও মনে জমির মালিকানা-র ধারণাটি অনুপস্থিত। ফলে, প্রায় চারশতাধিক পংক্তি সম্বলিত মহাগাথায়, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ নিষ্পন্ন হয়ে যায় ঠিক ১৪ লাইনে। সেখানে অর্জুন উপস্থিত থাকেন না, যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় ‘বালা’, অর্থাৎ বালক অভিমন্যু। সে আর ভীম মিলে একদিনেই কৌরবপক্ষের যাবতীয় সৈন্যকে সংহার করে, ‘গিরগিটি যেমন একবার জিভ বার করেই গুবরেপোকার গুষ্টিসুদ্ধ চেটে নেয়’— সেরকম ভাবে। পাণ্ডবপক্ষে নিহত কেবল একজনই— অভিমন্যু। সে নিহত হয় কৃষ্ণ বাসুদেবের হাতে। সে আবার এক প্রাচীন শত্রুতার গল্প। এবং সে কাহিনিতে কৃষ্ণের ভূমিকাকে খুব দেবসুলভ অনিন্দিত বলা মুশকিল। ভিলদের এই ‘ভারথ’-এ কৌরবভাইদের সংখ্যা ৭৪ এবং গল্পের সাক্ষ্যে দেখা যায় তারা পাণ্ডবভাইদের থেকে বেশি খারাপ নয়। কর্ণের পালক মা-বাবা কুমোর-কুমোরনি চাষের জন্য একটু জমি চাইতে গেলে, পাশা খেলতে ও হুঁকো খেতে ব্যস্ত কৌরবরা বলে দেয়: ঐদিকে কত মাঠ পড়ে আছে, যেটা ইচ্ছে নিয়ে নে। তারপরেও সে কৃষি-উৎসুক দম্পতি যখন একটা সারগাদাও চায়, তখনও ‘সবুজহলুদ জাজিম বিছানো সভায়’ বসা রাজারা একইভাবে বলে: অনেক সারগাদা আছে, একটা গরুর গাড়ি নিয়ে যা, যেটা থেকে ইচ্ছে সার নিয়ে নে। বস্তুত, সেখানে সারকুড় খুঁড়তে গিয়েই, সেই নিঃসন্তান দম্পতি সদ্যোজাত কর্ণকে পায়। অপরপক্ষে পাণ্ডবদের সম্পর্কে প্রায়ই শোনা যায়: সারাদিন শেষে ঘরে এলাম, এখন পাণ্ডবরাজাদের লোক কেন আসছে? কিছু দোষ পেলেই তো চামড়া তুলে নেবে। কিংবা ভীম লোকজন এনে সুপ্রচুর মিষ্টি খাচ্ছে এবং বেছে বেছে ভালগুলো কিনছে, তাতেও ব্যাপারীরা খুশি হচ্ছে না। বলাবলি করছে, কে জানে কবে দাম দেবে, আদৌ দেবে কি না। ভীমপাণ্ডবের কাছে দাম চাইতে যাবে, এমন সাহস কার আছে?
আমাদের কাছে অপ্রধান অনেক চরিত্রই এইসব গাথায় সবচেয়ে বীর অথবা প্রধান। ভিলদের রামায়ণ ‘রোম সীতমনি কথা’য় গৌতম ঋষি ও ইন্দ্র হলেন দুই ভাই, ঠিক যেমন দুই ভাই দশরথ ও পাতালরাজ বাসুকি। কৈকেয়ী হলেন বাসুকির স্ত্রী, যিনি পরে দশরথের পুরীতে আসেন। গৌতমের স্ত্রী অহল্যার অসূর্যম্পশ্যা কন্যাই হনুমানের জননী। রাবণকে বধ করেন রাম নয়, লক্ষ্মণ।
রাবণের মৃত্যুবাণ আছে সূর্যের রথাসীন এক অগ্নিভ্রমরের মধ্যে। মাটিতে আগুন জ্বেলে প্রকাণ্ড কড়াইয়ে তেল ফুটতে বসানো হবে। সেই কড়াইয়ের দুদিকে দুই পা রেখে, ওপরদিকে শরসন্ধান করে অপেক্ষা করতে হবে, কখন সূর্যের রথ ঠিক মাঝ-আকাশে আসে আর সেই ভ্রমরকে দেখা যায়। নিচে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ছায়া দেখে ওপরে আকাশে তীর ছুঁড়ে তাকে মারতে হবে। যে মারবে, সেও তৎক্ষণাৎ মৃতপ্রায় হয়ে ছিটকে পড়বে। মনে না পড়েই পারে না, দ্রুপদসভায় পাঞ্চালীর স্বয়ম্বর জিতে নেবার বৃত্তান্ত। নিচে জলভরা থালায় ছবি দেখে ওপরে ঘূর্ণমান এক চক্রের মধ্যে দিয়ে তার ওপরে ঝুলতে থাকা মাছকে বিদ্ধ করার শর্ত। ঘূর্ণায়মান সুবর্ণচক্র কি সূর্যেরই মৃদুতর রূপ হয়ে দেখা দেয় না? কিছু মিথের চলাচলও মাঝেমাঝে আমাদের সব হিসেব গুলিয়ে দেয়। সেখানেই আবার সুমেরুর পাহাড় থেকে অমরজ্যোত গাছের পাতা এনে তাকে বাঁচানোর বৃত্তান্ত। সে পাতায় আলো জ্বলে। এদিকে সে-পাহাড়ের সব গাছের সব পাতাই তো জ্বলে, কোনটা সত্যিকারের অমরজ্যোত— চিনবে কী করে! এই ধাঁধার সমতুল ধাঁধা দেখা দেয় যখন আবিষ্কার হয়, রাত্রিকে দীর্ঘায়িত করার প্রয়োজনে হনুমানের সূর্যকে বগলে চেপে রাখার যে বৃত্তান্তের অভিনবত্ব আমাদের ছোটবেলায় হনুমানকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তাও অতখানি অভিনব নয়। মহাভারতে অভিমন্যু কৌরবদের যুদ্ধঘোষণার দস্তানা তুলে নিলে (এঁদের ভাষায় থালা থেকে পান তুলে নেওয়া), তার স্ত্রীকে রাত্রের মধ্যে বাপের বাড়ি থেকে আনবার জন্য পবনবেগী উট নিয়ে রওনা হয় দুই আহির। যাতায়াতে ছ’মাসের পথ, তাই ছ’মাসকে গুটিয়ে একরাত্রি করে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও আহিররা এদিক-সেদিক করে দেরি করে ফেলে এবং শেষ মুহূর্তে বিপদ বুঝে নিচ দিয়ে পার হতে থাকা রাত্রিকে খপ করে ধরে ঝোলায় ভরে রাখে। কাজ মিটে যাওয়ার পর অবশ্য তাকে ছেড়ে দেয়, আর মাফও চেয়ে নেয় বেচারির কাছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের সূক্ত প্রায় অবিকৃত পাই অর্জুন বিষাদখণ্ডে, ভিল ভারথ-এ। ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’-র এই প্রহেলিকার সমাধান করবে কে? এমনকী, পাণ্ডব-কৌরবের যে বিরোধ এই দুই মহা-আখ্যায়িকার মূল, মধ্যপ্রদেশের গোন্ডজাতির রামায়ণে সে-সীমানাও গুলিয়ে যেতে দেখি। ইন্দ্রের সৈন্যদলের হাতে বন্দি লক্ষণ সীতার স্বপ্নে প্রবেশ করে নিজের বিপদ জানান। সীতা রামকে তাড়া দেন, ‘শীঘ্র যাও, পাণ্ডবদের নিয়ে লক্ষ্মণকে উদ্ধার করে আনো।’
এটা ঠিকই যে, এসব গাথাকাব্যই, ইতিহাস বা সমাজদর্পণ নয়, কিন্তু এর মধ্যে কল্পনা বা ভাবনার যে উড়াল, কোথাও তার শুরু তো গায়ক বা কথাকারের সমাজেই। তাঁদের সমাজে, তাঁদের সমসময়ের মধ্যে এসে মিশেছে বহুদিনের আখ্যান ও গায়ন, বহুজনের প্রত্যক্ষ যোগদান, আর শ্রোতাদের সম্মেলক উপস্থিতি। বিশেষত যেহেতু এগুলির কোনো লিখিত ‘অবিকৃত’ রূপ ছিল না— গাওয়া হত, প্রবাহিত হতে থাকত স্রোতবৎ, তার মধ্যে কমবেশি মিশতেই থাকত সমকালীনতার কিছু ধুলো। যেমন ভিল মহাভারতে সতীত্ব-ধারণার অনুপস্থিতিতে এখনকার পাঠক কিছুটা হতবাক হয়ে যান, আবার ভিল রামায়ণে পদে পদেই দেখি নিতান্ত ইঁদুর-বাঁদরেও সীতার সতীত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে। গোন্ড রামায়ণে আবার প্রণয়-প্রত্যাশী মেয়েরা নায়ককে রীতিমতো বিপদে ফেলে আয়ত্ত করতেও পিছপা নয়।
জমির মালিকানার মতনই, সম্পদ বিষয়েও ভারথকথার কথাকারদের ধারণা অবাস্তব। তাঁদের কাছে ‘সম্পদ’ নামক মিথ-এ হয়ত ছিল কেবল সোনা, অঢেল সোনা। তাই ‘বেনের ছেলে’ স্বর্গের ঝাড়ুদারনির ছেঁড়া কাপড় দেখে তাকে একটা শাড়ি দেয়, সোনার শাড়ি। পাণ্ডবেরা ভাত খায় সোনার থালায়, দ্রৌপদী তাদের খাবার বেড়ে দেয় সোনার হাতা দিয়ে, কিন্তু সেখানেই ছাইগাদার ওপর বসে থাকে একটা কালো কুকুর। একমাত্র দ্রৌপদীই জানে, সেটা আসলে পাণ্ডুরাজা।
তবু, কেবলি চিত্তচমৎকারী কৌতুকময় ভিন্নতার আকর নয় এইসব মৌখিক গাথা, হায়েরোগ্লিফিক্সের মতন তার প্রছন্নে রয়েছে আশ্চর্য সব সংকেত। বনের মধ্যে বলদ মরে গেলে মৃতের পুনরুজ্জীবনের জন্য ডাকা হয় সূর্যকে, যে সূর্য বৈদিক সাহিত্য শুধু নয়, প্রাচীন মিশর, গ্রেকো-রোমান সভ্যতাতেও মৃতকে পুনর্জীবিত করার দেবতা। এরকম অনেক ছিন্নসূত্র। একই সঙ্গে আছে পাপ-পুণ্য ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে পরস্পরের বিপরীত এমন সব ধারণা, যা আজকের পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে তৎকালীন ক্ষমতার কাছ থেকে কোন পীড়ন এই প্রান্তিক, সুদূরবাসী মানুষদের মনে এমন বিচিত্র সব মূল্যবোধের ভাবনা তৈরি করেছিল! আমারই এই পরিচিত দেশের কোনো অংশে বয়ে যায় এমন আশ্চর্য সাহিত্যধারা, বহু মানুষের মুখ থেকে বুকে যার চলন, যে কোনো প্রকৃত নদীর মতনই সে চলন আজ হোঁচট খেয়ে হারাতে বসে। আর সঙ্গে চিরকালের জন্য হারায় বৈচিত্রের এক অচিন্তনীয় আকর।
ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত