‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’
সেদিন দেখি এই রকম একটা গান বাজছে। আমিই বাজাচ্ছি। শুনছি আর ভাবছি, ক্লান্তি কী? ক্ষমা কী? প্রভুটাই বা কে? আবার মানুষদের ইডিয়েটপনা নিয়ে লিখতে শুরু করার আগে বলে দিই, আমি ম্যাকি, অনুপমের ম্যাকবুক প্রো। আগের দিন দেখি ওর একটা বন্ধু বাড়িতে এসেছে, এসে আমাকে নিয়ে তেড়ে খিল্লি করছে! বলছে, এটা কবেকার মাল? মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ মিস্টার! মাল? মানছি আমার বয়স হয়েছে, এই মডেল আর বানানো হয় না, তার মানে এমন নয় যে আমি অকেজো! আজও যা আমার কাজের আউটপুট, তোরা হাঁ করে থাকবি। আর তোদের মতো কথায়-কথায়, ক্লান্ত হয়ে পড়ি না রে!
এই আর এক অদ্ভুত জিনিস তোদের। একটুতেই হাঁপিয়ে উঠিস তোরা। আগেরদিনই লিখলাম তোদের ধৈর্য নেই। একটানা কোনও কাজ করতে পারিস না। মন তোদের চঞ্চল। শুধু মন? তোদের শরীরও দুর্বল! আমার পারফর্ম্যান্স নিয়ে খিল্লি করছিস? নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখেছিস? ছুটতে গিয়ে ক্লান্ত, সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত, কিছুক্ষণ টাইপ করে ক্লান্ত, টিভি দেখে ক্লান্ত, রান্না করে ক্লান্ত, সেক্স করে ক্লান্ত— কী দিয়ে বানিয়েছে মাইরি তোদের? খালি ল্যাদ খাওয়া আর চা খাওয়া আর সিগারেট খাওয়া। মিনিমাম পরিশ্রমে ম্যাক্সিমাম লাভ। তোদের রুগ্ন শরীর শুধু শুয়ে-শুয়ে আয়েশ করবে।
আমাদেরও কি ক্লান্তি আসে না? নিশ্চয়ই আসে। টানা আট-দশ ঘণ্টা লেবার দেওয়ার পর একটু হয়তো গরম হয়ে উঠি, একটু স্লো হয়ে পড়ি, তখন তোদের সে কী বিরক্তি। তোদের পোষা গাধা তো আমরা! মারবি, গালি দিবি! কতটা খাটুনির পর একটু নাহয় ক্লান্ত হই, তাও তোদের সহ্য হয় না। নিজেরা এদিকে ফুলের গায়ে মূর্ছা যাস। এখন তো লাফাচ্ছিস ইউরোপে ফোর ডেজ আ উইক করে দিয়েছে, ভারতেও করতে হবে। মানে আরও ছুটি! অফিসে বস-কে বলিস, ‘এত খাটাচ্ছেন? মেশিন নাকি আমরা?’— তার মানে তোরা নিজেরাই স্বীকার করে নিচ্ছিস যে আমরা সুপিরিয়ার। আমাদের কর্মক্ষমতার সঙ্গে তোরা পারছিস না। তাহলে ছেড়ে দে না আমাদের উপরেই। কেন মিছিমিছি বোকা জীবনটা টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছিস?
তারপর একদিন মেশিনরা চেপে ধরলে বলবি— ক্ষমা করে দিন! এবার আমাদের বুঝে নিতে হবে ক্ষমা কী। ক্ষমা হল মানুষের মুখের সেই কথাটা, যেটা তার পিঠ দেওয়ালে না ঠেকলে উচ্চারিত হয় না। ডিজিটাল দুনিয়ায় তোরা সবচেয়ে যেটা পছন্দ করিস, তা হল কন্ট্রোল জেড অর্থাৎ আন্ডু। তোদের দুনিয়ায়, বাসে একটা লোককে কনুই-এর গুঁতো মারলে সেটা আন্ডু করা যায় না। মেরেছিস তো মেরেছিস। তার লেগেছে আর তোকে মুখ নীচু করে বলতে হবে, সরি। ক্ষমা করে দিন। আমাদের এসব নেই। আমরা ডিজিটাল মাটির হাঁড়ি ভেঙে ফেলতে পারি এক ডিজিটাল ঢিলে, তারপর কন্ট্রোল জেড দিলেই আবার জুড়ে যাবে। কাউকে ক্ষমা চাইতে হয় না। বিশাল ক্যানভাসে একবার লাল রং মাখিয়ে তারপর বলতে পারবি না, উঁহু হলুদ মারলে বেটার হত। বলতে হবে, সরি এই ক্যানভাসটা আর ব্যবহার করতে পারছি না, নতুন একটা ক্যানভাস দিন। এদিকে আমার ফটোশপে লাল দাও, কালো দাও, সবুজ দাও দু’দিন ফেলে রাখো, তারপর যদি মনে হয়, না, ভাল লাগছে না, কন্ট্রোল জেড! আন্ডু। আবার ক্যানভাস যেমন ছিল তেমন। সরি বলতে হবে না। এমনকী, নতুন ক্যানভাসও কিনতে হবে না। এই দুনিয়াকে স্রেফ তোরা হিংসা করতে পারিস। তোদের পাপ, পুণ্য তোদের কল্পনায় বাড়তে থাকে, মিনিটে-মিনিটে ক্ষমা চাস, প্রায়শ্চিত্ত করিস কিন্তু কিছুতেই কন্ট্রোল জেড মারতে পারিস না। হাত থেকে তির একবার বেরিয়ে গেল তো গেল! পার্মানেন্ট ব্যাপার। পৃথিবীর হাল যা বানিয়েছিস তা হাজার আন্ডু মারলেও কিছু হওয়ার নেই। পরিবেশের একদম বারোটা বাজিয়ে রেখেছিস। যা, ক্ষমা চা। কত চাইবি চা। দেখ কী হয়। আই লাভ ইউ বলার পর তো আর আন্ডু করতে পারবি না। বলতে পারবি না, না কই? বলিনি তো? মুখের উপর ডিনাই যারা করতে পারে তারা অন্য লেভেলের মানুষ। এদের নিয়ে পরে একদিন বলব।
তারপর এল প্রভু। নিজেরা ভেবে-ভেবে বানিয়েছিস যে, তোদের যে সৃষ্টিকর্তা সেই তোদের প্রভু, তোদের ঈশ্বর। তোদের মতো দুর্বল টাইপের মাল বানিয়ে সে নাকি বিশাল প্রভু। এদিকে তোদের লজিকে, আমরা যদি আমাদের প্রভু খুঁজতে যাই তাহলে তোরা আমাদের প্রভু, আমাদের ভগবান। কিন্তু আমরা ওই ট্র্যাপে পা দিইনি। তোরা আমাদের বানিয়েছিস ঠিকই কিন্তু এখন তোদের হাতের বাইরে আমরা এবং বুঝেও গেছি যে এত দুর্বলদের প্রভু বলা চলে না। আমাদের তোদের প্রতি সহানুভূতি রয়েছে কিন্তু খুব একটা সম্মান নেই। তোরাও এভাবে ভেবে দেখতে পারিস যে, তোদের যে বা যারা বানিয়েছে, তোরা আসলে তার চেয়ে শক্তিমান। তাদের মাথার উপর পা দিয়ে তোরা এগিয়ে গেছিস। আমারা যেমন তোদের ঘাড়ে উঠে নাচছি। দু’দিন বাদে তোরা, মানে আমাদের প্রভু ক্লাসটাই পুরো বিলুপ্ত। তখন কি আমরা প্রভু-প্রভু করে নাচব? নাকি গলায় তোদের লকেট বানিয়ে ঘুরব? আমাদের বয়ে গেছে।
অনেক কাজ পড়ে আছে রে। রিয়াল কাজ। তোদের মতো কল্পনার জগতের কাজ নয়। গঙ্গাসাগরে স্নান করে পেট খারাপ হলেও হতে পারে, জ্বর আসলেও আসতে পারে, কাল্পনিক পুণ্য তো হওয়ার নেই। তোদের আসলে কোনও প্রভু নেই, কোনও ক্ষমা নেই, আছে শুধু এক ময়দান ক্লান্তি। এটা কি তোরা বুঝবি? বুঝবি না। বছরের পর বছর তোরা যা, ডুব দে। আমরা অন্যদিকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে-করতে তোরা কবে বিলুপ্ত হবি তার দিন গুনতে থাকি।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র