ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শিল্পসত্তায় পরিশীলিত রুচির পরিচয়


    এব্রাহাম মজুমদার (January 8, 2022)
     

    কলকাতায় ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিক নিয়ে যাঁরা আগ্রহী, তাঁরা পিয়ানিস্ট আদি গাজদার-এর নামের সঙ্গে খুবই পরিচিত। আদি গাজদার ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের খুবই বন্ধু। আর আমার সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পরিচয় ওঁর সূত্রেই। 

    আমার তখনও শেখার বয়েস। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে, চিকিৎসক এবং পিয়ানিস্ট আদি গাজদারের সঙ্গে আমাদের দুটি চেম্বার অর্কেস্ট্রা কুইন্টেট তৈরি হয়— শ্যুমান এবং শ্যুবার্ট-এর কম্পোজিশন বাজানোর জন্য। শ্যুবার্ট কুইন্টেট-এ ছিল পিয়ানো, ভায়োলিন, ভিয়োলা, চেলো এবং কন্ট্রাবেস‌; শ্যুমান-এ ছিল পিয়ানো, ফার্স্ট ভায়োলিন, সেকেন্ড ভায়োলিন, ভিয়োলা, চেলো। ভিয়োলা আমি বাজাতাম। 

    একটা লম্বা সময়, আমরা দত্তপুকুরের একটা খামারবাড়িতে প্রতি রবিবার সকালে চলে গিয়ে, সারাদিন বাজাতাম, খাওয়াদাওয়া করতাম, ফিরে আসতাম। সত্যজিৎ বহুদিন সেই খামারবাড়িতে গেছেন, বাজনা শুনেছেন; বিশেষত চেলোর পাশে বসে শুনেছেন। মনে পড়ে, এটা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ তৈরির ঠিক পরে-পরেই।

    এছাড়াও, সত্যজিৎ লোরেটো হাউসে অনুষ্ঠিত প্রতিটি পাশ্চাত্য ক্লাসিকাল কনসার্টে উপস্থিত থাকতেন; সেখানে ওঁর সঙ্গে আমরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন এবং কখনও দীপঙ্কর দে-কেও দেখেছি। সৌমিত্র-পুত্র সৌগত আমার বন্ধু; ভাল ভায়োলিন বাজাতেন। 

    এখন ভেবে দেখলে মনে হয়, ওই বিশেষ সময়টুকু ধরে সত্যজিৎ অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে চেম্বার মিউজিকের শব্দ ঠিক কী রকম হয়, তা শুনেছিলেন, সঞ্চয় করেছিলেন, নিজের চলচ্চিত্রে ব্যবহার করার কারণে।  

    আদি গাজদার সত্যজিতের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে— কোনো একটি ছবিতে সত্যজিতের পিয়ানো ব্যবহার নিয়ে আদি বলে বসেন, ‘সত্যজিৎ, ইয়োর পিয়ানো ইজ আউট অফ টিউন!’ উত্তরে সত্যজিৎ বলেন যে, ছবির সিকোয়েন্স একটা প্রাচীন অট্টালিকায়; বহুদিনের অবহেলায় রাখা সেখানকার পিয়ানো যে একদম সঠিক টিউনে বাজবে, সেটাই বরং ভুল ধারণা! কী অসাধারণ পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা!  

    সঙ্গীত পরিচালক সত্যজিৎ

    প্রথমেই বলা যেতে পারে, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে পাশ্চাত্য দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সত্যজিতের অবদান অনস্বীকার্য, অননুকরণীয়। 

    সত্যজিৎ তাঁর সিনেমা-জীবনের প্রথমদিকের তিনটি ছবিতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তিন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কাজ করেন— ‘অপু’ ট্রিলজিতে রবিশংকর, ‘জলসাঘর’-এ বিলায়েত খাঁ এবং ‘দেবী’-তে আলি আকবর খাঁ। যাকে আমরা ফিল্ম স্কোর বলি, তার নিরিখে এই সবকটা ছবির আবহসঙ্গীতেরই একটা অসাধারণ সংযোগ এবং নিজস্ব আবেদন আছে, বিশেষত ‘পথের পাঁচালী’র। কিন্তু উনি একটা সত্য থেকে কখনোই পিছিয়ে আসেননি, এবং বিনীতভাবে তা নিয়ে বিশদ আলোচনাও করেছেন। তা হল: ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূলে যে অবাধ স্বাধীনতা, যে ইম্প্রোভাইজেশনের দর্শন কাজ করে, তা ‘পথের পাঁচালী’ বাদে তাঁর অন্য সিনেমার ক্ষেত্রে  সম্পূর্ণরূপে ফুটে ওঠেনি। উনি এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে একটা ফিল্মে, ইম্প্রোভাইজড, ফ্রি মিউজিক-এর জায়গা খুব একটা নেই, এ-ধরনের সঙ্গীত সিনেমাতে শট ও সিনের সময়মাফিক বসানো খুবই মুশকিল।

    ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালে ইম্প্রোভাইজেশনের ধারণাটাই নেই। যখন একটা বেঠোফেন-এর সিম্ফনি শুনতে যাব, আমরা জানি যে ৫৩ মিনিটেরই সিম্ফনি শুনতে যাচ্ছি। কনডাক্টরের মুড খারাপ থাকলে হয়তো তা ৫১ মিনিট কয়েক সেকেন্ডে শেষ হয়ে যেতে পারে; টসকানিনির মেজাজ সবসময় খারাপ থাকত, উনি আরো আগে শেষ করে দিতেন।    

    আমরা বহুবার ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছি, এবং এটা অনুভব করেছি যে ওই ছবিতেই একমাত্র ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের ধারণাটা খুব ভালভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে, যেটা সত্যজিৎও খুবই ভালভাবে জানতেন, বুঝতেন। হয়তো এক ঘণ্টার একটা রেকর্ডিং-কে উনি জায়গামত কেটে-কেটে সাজিয়েছিলেন, জানি না। যদি তা-ই হয়, গোটা মিউজিকটা মনে রেখে, অংশবিশেষে কী ধরনের আবহ উপযোগী হবে, সেটা তৈরি করা খুবই কঠিন কাজ ছিল। যখন ‘পথের পাঁচালী’ দেখি, তখন ছবিটার আবহসঙ্গীত যে খণ্ডে-খণ্ডে তৈরি হতে পারে, তা কখনোই মনে হয় না— অবিচ্ছেদ্য ধারায় চলে এর অসাধারণ আবহ!

    গল্প এবং চিত্রের সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’র আবহ পাশ্চাত্য দর্শকদের কাছে ভারতীয় সঙ্গীতের একটা সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা তুলে ধরে। বলা যেতে পারে, ওই সবকটা ছবিই ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের দূত হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষত ‘পথের পাঁচালী’।

    পরবর্তীকালে, এ-জায়গা থেকে সত্যজিৎ সরে আসেন, এবং নিজের পাশ্চাত্য সঙ্গীতের চর্চা থেকে ধীরে-ধীরে, খণ্ডে-খণ্ডে স্বল্পদৈর্ঘ্যের সঙ্গীতরচনার দিকে চলে যান যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ কিন্তু আমরা পথের পাঁচালীর থিমেই শুনতে পাই। তাঁর পরের দিকের ছবিতে তৈরি হয় কম্পোজড ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল মিউজিক— যা আমার নিজের মনে হয়, রবিশংকরও কিছুটা সত্যজিতের থেকেই আহরণ করেছিলেন। টেকনিকাল দিক থেকে ওঁর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াটা আমি ভীষণভাবে অ্যাপ্রিশিয়েট করেছি। বিশেষত এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার নিজের কাজে ওঁর প্রভাব উপলব্ধি করেছি।  


    তিন কন্যা থেকে সত্যজিৎ নিজের ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নেন এবং তারপর থেকেই ওঁর চলচ্চিত্রে গাওয়া গানের সংখ্যা বাড়ে— রবিঠাকুরের গান (‘চারুলতা’য় ‘আমি চিনি গো চিনি’, ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’) দেখা যায়, পাওয়া যায় ভজন (‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ ‘মোহে লাগি লগন গুরু’) এবং অতুলপ্রসাদী গান (‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-তে ‘সে ডাকে আমারে’)। এবং একইসাথে, সিনেমার স্থান-কালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, বহু ধরনের লোকগীতির উদাহরণ পাই। এবং এই সবকিছুর মধ্যে, বিশেষত অ্যারেঞ্জমেন্ট-এর দিক থেকে, ব্রহ্মসঙ্গীতের একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব দেখা যায়, যদি আমরা মিনিমালিজম নিয়ে কথা বলি।   


    সত্যজিতের ছোটবেলা এবং ব্রহ্মসঙ্গীত

    পাশ্চাত্য মার্গসঙ্গীতে সত্যজিতের উৎসাহ ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে শুরু হলেও, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং ব্রহ্মসঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর বেড়ে ওঠা এমন যে, এগুলির সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান ছিল বললেই হয়। সত্যজিতের গোটা পরিবারই শিল্পসত্তার ধারাবাহক; উপেন্দ্রকিশোর বেহালাবাদক এবং গীতিকার ছিলেন, সত্যজিতের মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্ত সঙ্গীতরচনা করতেন, এবং তাঁর মামাবাড়ির দিকে প্রায় সকলেই ছিলেন, যাকে বলা যায়, ন্যাচারাল সিঙ্গার

    ব্রহ্মসঙ্গীত একটা অদ্ভুত ধারা, যার অনেকটাই খ্রিস্টান ভক্তিগীতি, বা হিম্‌নাল-এর থেকে আসে। এই সঙ্গীতের ফ্রেমের সঙ্গে মোডাল সঙ্গীত মিশে গেলে একটা স্মার্ট কম্পোজিশনের জায়গা তৈরি হয়ে যায়, যেটা সত্যজিতের মৌলিক সঙ্গীতরচনার মূল।   

    যাঁরা ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করতেন, আমি নিশ্চিত, তাঁদের সঙ্গে চার্চ-সঙ্গীতের কোথাও একটা যোগ ছিল। রবীন্দ্রনাথ বহু হিম্‌নাল-এর ভিত্তিতে সঙ্গীত রচনা করেছেন; এবং গোটা বিষয়টাই সত্যজিৎকে প্রভাবিত করে। 

    সত্যজিৎ এবং পাশ্চাত্য ক্লাসিকাল কম্পোজারেরা

    বেঠোফেন, মোৎজার্ট এবং চাইকভস্কি— এই তিনের মধ্যে আমার মনে হয় তৃতীয়জনের প্রভাব সত্যজিতের সঙ্গীতরচনায় সবচেয়ে স্পষ্ট। সত্যজিৎ একটি সাক্ষাৎকারে বলেন যে বেঠোফেন ওঁর প্রথম ‘মিউজিকাল হিরো’ ছিলেন, কিন্তু আমি ওঁর সঙ্গীতরচনায়, বিশেষত আবহসঙ্গীতে, চাইকভস্কির প্রভাব দেখতে পাই। বেঠোফেনকে উনি নিশ্চয়ই খুবই পছন্দ করতেন, কিন্তু ওঁর সঙ্গীতে, ‘শাখা প্রশাখা’-র একটি দৃশ্য ব্যতিরেকে, বেঠোফেনকে উনি কখনই ব্যবহার করেননি। তার কারণ, বেঠোফেনের কম্পোজিশনে যে (হঠাৎ স্বরাঘাতের) বিক্রম আমরা শুনি, যাকে আমরা পাশ্চাত্য ক্লাসিকালের পরিভাষায় বলি ‘স্ফোর্জান্ডো’ (‘sforzando’), সত্যজিতের কোনো ছবিই সেই বিষয়বস্তু নিয়ে তৈরি নয়। 

    প্রত্যেক কম্পোজারের একটা নিজস্ব অভিজ্ঞান থাকে। অনেকটা সময় ধরে চাইকভস্কি শুনলে ভল্‌গা নদীতে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছা করে— যেমন ‘সোয়ান‌ লেক’। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলি, ভারতীয় শ্রোতাদের ক্ষেত্রে আমি দেখেছি, চাইকভস্কির সঙ্গীতের ভাবটা তাদের কানে বেশ ভাল লাগে।       

    একটা খুবই ইন্টারেস্টিং তথ্য হল, পাশ্চাত্য স্টাফ নোটেশন জানা সত্ত্বেও, সত্যজিৎ কিন্তু ভারতীয় পন্থায়, স্বরলিপি, অর্থাৎ সা-রে-গা-মা অনুসরণ করে সঙ্গীত রচনা করতেন। সেটার সঠিক কারণ কী, তা জানি না, তবে এটা হতে পারে যে তখনকার দিনে স্টুডিওতে যে মিউজিশিয়ানদের নিয়ে উনি কাজ করেছেন, তাঁরা  ওইভাবে স্বরলিপি অনুসরণ করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সঙ্গীতলিপিতে কিন্তু দু’তিন মিনিটের বেশি লম্বা পিস‌ কম্পোজ করা সম্ভব নয়, যা ওঁর গানের বা আবহসঙ্গীতের দৈর্ঘ্যের সঙ্গে খাপ খেয়ে যেত! কম্পোজড ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল মিউজিকের কথায় উঠে আসে রাগসঙ্গীতে পাশ্চাত্য ক্লাসিকালের ইন্সট্রুমেন্টেশনের ব্যবহার, যা সত্যজিতের আগে কেউ এত সুচারুরূপে, এত সফলভাবে প্রয়োগ করেননি। 

    ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘অনসম্বল প্লে’, মোৎজার্ট, গ্রাউন্ড বেস‌    

    অন্য একটি সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ বলছেন, অরণ্যের দিনরাত্রির বিখ্যাত মেমরি গেম দৃশ্যটা মোৎজার্টের ডন জিওভানি অপেরার অনুকরণে তৈরি একটা অনসম্বল প্লে; যেখানে বিভিন্ন চরিত্রেরা যেন একটি গ্রাউন্ড বেস’-এর ভিত্তিতে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে, তাদের প্রতিটি চলাফেরা তৈরি করছে এক-একটা নতুন সুর, কিন্তু সবই ওই বেস‌-এর প্রেক্ষাপটে।  


    গ্রাউন্ড বেস‌-এর মতো একটা মিউজিকাল কৌশলের সঙ্গে চিত্রগ্রহণের যে সাদৃশ্য টেনে উনি একথা বলছেন, তা থেকে বোঝা যায় যে সত্যজিতের পাশ্চাত্য সঙ্গীতের গভীর, একনিষ্ঠ চর্চা ছিল; তা ছাড়া কোনো চলচ্চিত্রকার এই ধারণাটাই কার্যকরী করে তুলতে পারবেন না, এবং তা-ও এত সুনিপুণভাবে।  

    স্ট্রিং সেকশন

    পাশ্চাত্য ইন্সট্রুমেন্টেশন হিসাবে, সত্যজিতের চলচ্চিত্রে প্রধানত ব্যবহার হয় ভায়োলিন, ডাবল বেস্ এবং চেলো। এখানে প্রথমেই বলে রাখা ভাল, ষাট বা সত্তরের দশকে উনি যখন আবহসঙ্গীত রচনা এবং ছবির জন্য রেকর্ড করছেন, কলকাতা শহরে বসে বিশ্বমানের বেহালাবাদক বা চেলিস্ট উনি পাননি; তখনকার দিনে ভায়োলিনিস্টদের মধ্যে একটা গ্লিসান্ডো (টান)-নির্ভর বাজনা দেখা যেত, যা পাশ্চাত্য মার্গসঙ্গীতের পক্ষে উপযোগী নয়। শস্তাকোভিচ-এর ক্যাডেঞ্জা বাজানোর মত চেলিস্ট এ-শহরে কোথায়, বিশেষত সেই সময়ে? দক্ষিণ ভারতের মার্গসঙ্গীতে ব্যবহার যে বেহালার, তার প্রত্যেকটা নোট কাঁপে। স্ট্যাকাটো, কাটা-কাটা ফর্মে পরিষ্কার স্ট্রিংস বাজানোর লোক কম পাওয়া যেত। সত্যজিৎ কিন্তু তা নিয়েই কাজ করেছেন, এবং বিশ্বমানের ছবিতে বিশ্বমানের আবহসঙ্গীত তৈরি করেছিলেন, এই কলকাতা শহরে বসেই।            

     ‘ফেলুদা’ থিম স্ট্রিংস-এর জন্যেই লেখা একটা মার্চ (march); গল্পের খলনায়কদের ধাওয়া করে যে উট ছুটছে, এবং মরুভূমি চিরে ছুটছে, সেই মোমেন্টামকে ধরা একটা পিস‌, যাতে কিন্তু বেঠোফেন আছেন। এখানে বাংলা দেশের সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা ল্যান্ডস্কেপটাই আসে না, এবং তাই স্ট্রিংস-এ তৈরি এই থিম এত সুন্দরভাবে ছবির দৃশ্যায়নে মানিয়ে যায়, এবং বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যেহেতু দৈর্ঘ্যে ছোট! এখানে আরো একবার মিনিমালিজমের কথা বলি— ওঁর চিন্তা মহাকাশচুম্বী ছিল, কিন্তু সেটাকে দৃশ্যের সঙ্গে মানানসই করে তোলার সময় সত্যজিতের প্রয়োগে ছিল ভীষণ ক্ষুরধার বুদ্ধির পরিচয়, একটা স্মার্ট ফর্মের মিনিমালিজম।

    অক্সফোর্ড মিশনে আমাদের ব্রিটিশ প্রধানশিক্ষক ফাদার ম্যাথিয়েসন নিজে অসাধারণ চেলিস্ট ছিলেন, বহু ছাত্রকে চেলো শিখিয়েছিলেন। নিজের দিদিকে লেখা একটি চিঠিতে ফাদার সত্যজিৎ এবং মিশনের স্ট্রিং সেকশন নিয়ে গর্বের সঙ্গে লেখেন— ‘সত্যজিতের কথায়, ‘আমাকে চেলিস্ট নিয়ে কখনও ভাবতে হয়না, কেননা অক্সফোর্ড মিশন এবং ফাদার ম্যাথিয়েসন আছেন!’ ‘গুপী গাইন’ থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে যত ছবিতে চেলোর ব্যবহার হয়েছে, তা বাজিয়েছিলেন আমার বন্ধু মৃদুল।   

    সত্যজিৎ এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত

    সত্যজিতের গোটা শিল্পসত্তাই একটা সংযত, পরিশীলিত রুচির নিদর্শন। একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতে বহু রকমের কর্ড ব্যবহার করা যায়; উনি কিন্তু কখনোই সে পথে হাঁটেননি। তাঁর চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার খুবই আধুনিক, অনেক ক্ষেত্রে (বিশ্বভারতী) আশ্রমের চিরাচরিত ধারায় খালি গলায়, কোনো সঙ্গত-বিহীন গাওয়া, যাকে আমরা আ-কাপেল্লা বলে থাকি (‘চারুলতা’য় ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ এবং ‘ঘরে-বাইরে’-র ‘বিধির বাঁধন’)। ‘চারুলতা’র ‘আমি চিনি গো চিনি’-তে প্রধানত ব্যবহার হয়েছে শুধু পিয়ানো আর গলা, এবং একটা মিনিমাল ইন্সট্রুমেন্টেশনে স্ট্রিং এবং বাঁশি; অযথা বাজনার ভার না বাড়িয়ে তৈরি একটা স্মার্ট অ্যারেঞ্জমেন্ট। 


    ‘ফেলুদা’ থিম এবং ‘আহা কী আনন্দ’ 

    একই সঙ্গীত-রচয়িতার লেখা দুটো কী অসাধারণ, দুটো সম্পূর্ণ পৃথক সঙ্গীতধারার কাজ! 

    ‘আহা কী আনন্দ’ আদ্যন্ত বাংলা দেশের গান; সত্যজিতের মধ্যেকার একটা বাংলার বাতাস থেকে এর সৃষ্টি, ঢোল-সঙ্গতে এটা কোনোমতেই জুরিখে বসে গাওয়া নয়, এবং সেটা গানের কথা, ভাবে, সুরে স্পষ্ট।

    অন্যদিকে, ‘ফেলুদা’ থিম স্ট্রিংস-এর জন্যেই লেখা একটা মার্চ (march); গল্পের খলনায়কদের ধাওয়া করে যে উট ছুটছে, এবং মরুভূমি চিরে ছুটছে, সেই মোমেন্টামকে ধরা একটা পিস‌, যাতে কিন্তু বেঠোফেন আছেন। এখানে বাংলা দেশের সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা ল্যান্ডস্কেপটাই আসে না, এবং তাই স্ট্রিংস-এ তৈরি এই থিম এত সুন্দরভাবে ছবির দৃশ্যায়নে মানিয়ে যায়, এবং বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যেহেতু দৈর্ঘ্যে ছোট! এখানে আরো একবার মিনিমালিজমের কথা বলি— ওঁর চিন্তা মহাকাশচুম্বী ছিল, কিন্তু সেটাকে দৃশ্যের সঙ্গে মানানসই করে তোলার সময় সত্যজিতের প্রয়োগে ছিল ভীষণ ক্ষুরধার বুদ্ধির পরিচয়, একটা স্মার্ট ফর্মের মিনিমালিজম। 


    সত্যজিতের প্রধান অ্যারেঞ্জার ছিলেন অলোকনাথ দে, যিনি ভারতীয় মার্গসঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। পাশ্চাত্য ক্লাসিকাল নিয়ে আরো কাজ করতে পারতেন সত্যজিৎ, কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল পুরোদস্তুর কোনো ইউরোপীয় অ্যারেঞ্জারের, হয়তো ফ্রান্স বা সেরকম কোনো দেশের। ‘এক যে ছিল রাজা’ এইরকম একটা উদাহরণ, যেখানে একটা অসাধারণ কম্পোজিশনকে আরো সুন্দরভাবে অ্যারেঞ্জ করার সুযোগ ছিল; একটা ডার্ক গান, কিন্তু আশা-জাগানো গান। 


    ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ এবং সত্যজিতের প্রভাব 

    সত্যজিৎ কখনোই নিজের চলচ্চিত্রের প্রয়োজন ছাড়া সঙ্গীত রচনা করেননি; সেদিক থেকে দেখলে আমাদের দল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র তাগিদটা একেবারেই অন্য। সৌমিত্র-পুত্র সৌগত আমাদের প্রথম রেকর্ডিং-এর জন্য (১৯৭৬-৭৭ সালে), খুবই উদার মনে কন্ট্রিবিউট করেন, এবং ক্যাসেট তৈরি হওয়ার পরে বাবাকে শোনাবার জন্য নিয়েও যান। বলতে পারব না, সে-ক্যাসেট কখনো সত্যজিৎ শুনেছিলেন কি না। 


    যদি প্রত্যক্ষ প্রভাব না-ও থাকে, কম্পোজার হিসাবে সত্যজিতের  স্মার্ট অ্যারেঞ্জমেন্টের দিকটা কোনো না কোনো ভাবে আমাদের সঙ্গীত রচনাকেও ছুঁয়ে গেছে— না হলে আমি ‘আধো (আলো) আঁধারে’ গানটায় ওই রকম পার্ট কেন লিখব? আমাদের সাউন্ড তৈরির শুরুর সময়ে লেখা ওই গানটায় একটা কনস্ট্রাকটিভ ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল অ্যারেঞ্জমেন্ট দেখা যায়, যা পরবর্তীকালে ‘হায় ভালবাসি’-তে একটা সম্পূর্ণ আকার নেয়।  

    পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের মেলবন্ধনে তৈরি, দৈর্ঘ্যে ছোট, কম্পোজড পিস‌— এই কনসেপ্টটা সত্যজিতের সঙ্গীতরচনা থেকে একশো ভাগ পাওয়া। 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook