সূর্য কালজ্ঞাপক। রাশিচক্রের এক-এক রাশিতে মাসব্যাপী তার অবস্থান। মাস-ঋতু-বছর সবই সূর্যের সংক্রমণের সঙ্গে যুক্ত। সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশকে সংক্রমণ বলে। রবির উত্তরায়ণ শুরু হয় মকর সংক্রান্তিতে। ‘মকরে প্রখর রবি’, অর্থাৎ এদিন থেকে সূর্য তাপ বাড়াতে থাকে। এটা হচ্ছে শীত ও গ্রীষ্মের সন্ধিক্ষণ। এই নৈসর্গিক পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত উৎসব হল মকর সংক্রান্তি। এদিন থেকেই সূর্য দক্ষিণায়ণ থেকে উত্তরায়ণের দিকে যাত্রা শুরু করে। তাই এই সময় থেকে রাত্রি অর্থাৎ অন্ধকার কমতে থাকে, অন্যদিকে আলো অর্থাৎ উজ্জ্বলতা বাড়তে থাকে। দৃষ্টি যেন পুনরায় অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা করে। এজন্যই প্রাচীনকাল থেকে জ্ঞানরূপ আলোর উপাসনায় মগ্ন ভারতীয় জীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। যে-পথ ধরে সূর্যের উদয় ও অস্ত এবং এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে চলাফেরা, জ্যোতিষশাস্ত্রের ভাষায় তাকে বলে ক্রান্তিবৃত্ত। এই ক্রান্তিবৃত্ত অর্থাৎ সূর্যের এই চলাফেরা যিনি পরিচালনা করেন, তাঁকে সংক্রান্তিপুরুষ বলে।
বাংলা পঞ্জিকার প্রতি মাসের প্রথমেই ন্যুব্জদেহ এক টিকিধারী ব্রাহ্মণের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। এই ন্যুব্জ ব্রাহ্মণ তাঁর হাতে ধরা লাঠিটি নিয়ে এক পা এগিয়ে রয়েছেন। তিনিই সংক্রান্তিপুরুষ। এগিয়ে চলেছেন মহাকালের পথে। দ্বাদশ রাশি সমন্বিত রাশিচক্র ৩৬০ ডিগ্রি ব্যাপ্তিযুক্ত ‘ভ চক্র’-এর উপর সমপতিত ও অন্তর্ভুক্ত। ‘ভ চক্র’-এর একটি বিশেষ প্রকাশ ওই টিকিধারী ব্রাহ্মণ বা সংক্রান্তিপুরুষ। তাঁকে কালপুরুষও বলা হয়। মানবদেহী এই কালপুরুষ রাশিচক্রে গতিশীল গ্রহ-নক্ষত্রাদি সময় যেমন চিহ্নিত করছেন, তেমনই সময়ের গুণও বহন করছেন। প্রকৃতির ক্রিয়াশীল শক্তির সাহায্যে সময়কেও একইভাবে গুণাক্রান্ত করছেন ওই কালপুরুষ। তাঁর নির্দেশেই সূর্য তার ক্ষণ অনুসারে এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে যাত্রা করে। সূর্যের এই যাতায়াত-বিবরণের কাল সম্বন্ধে ভবিষ্যপুরাণ, মৎস্যপুরাণ ও জ্যোতিষশাস্ত্রে বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে।
মকর সংক্রান্তির দ্বিতীয় সংকেতটিও গুরুত্বপূর্ণ— যেখানে সূর্যের গতিপথ বদলের সঙ্গে যে নৈসর্গিক ভাবনা জড়িয়ে, তার উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এ নিয়ে বিভিন্ন রকমের উৎসব পালন করা হয়। এইদিন থেকেই দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পালিত হয় অন্নোৎসব পোঙ্গল। অসমের মাঘবিহু মুখবন্ধ এইদিনে। গুজরাটেও এইদিন শস্যোৎসব পালনের অনুষঙ্গ হিসেবে সূর্যদেবতার পুজোর দ্যোতকস্বরূপ ঘুড়ি উড়িয়ে আনন্দ করার রেওয়াজ রয়েছে। ড. পল্লব সেনগুপ্ত তাঁর ‘পূজা পার্বণের উৎসকথা’ গ্রন্থে এ-প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘নতুন শস্য ঘরে উঠলে আনন্দোৎসবের রেওয়াজ বিশ্বজনীন এবং তার বয়সও অনেক হাজার বছর। কৃষির উদ্ভবের পর থেকেই এই শস্য উৎসবের ধারা প্রচলিত সমস্ত দেশে ও সমাজে। সেই বিশ্বজনীন ঐতিহ্যেরই ধারাবাহী আমাদের পৌষ সংক্রান্তির বিভিন্ন উৎসব।’ ‘হিন্দুর আচার অনুষ্ঠান’ গ্রন্থে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী উল্লেখ করেছেন, মকর সংক্রান্তিতে আরাধনা হয় ‘ঢেঁকি আর চাল’।
এই বিশেষ দিনটিতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে– যে যে জায়গায় প্রধান খাদ্যই হল ভাত– উৎসবের প্রচলন রয়েছে। এখন সূর্যের উত্তরায়ণ মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহে ঘটলেও, হাজার দুয়েক বছর আগে তার তারিখ ছিল পৌষের শেষেই। ওই প্রাচীন আমল থেকেই কালচক্রের পরিবর্তনের পটভূমিতে এই উৎসব পালন শুরু হয়েছিল সম্ভবত সেই সব অঞ্চলে, যেখানে আমন ধান ফলে এবং পৌষ মাসে গোলায় ওঠে। সূর্যের ওই কক্ষপথ পরিবর্তন উপলক্ষে তার উদ্দেশে প্রণতি নিবেদনেরই প্রতীক মকর সংক্রান্তির বিভিন্ন অনুষ্ঠান।
সূর্যের সঙ্গে শস্যের সম্পর্কের কথা প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ জেনে এসেছে। সূর্য যে কৃষির দেবতা তা ঋগ্বেদে রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে (৭/৩৬/১) সূর্য বর্ষণ করেন। কথাটা তৈত্তিরীয় আরণ্যকে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে— যে রশ্মিসমূহের দ্বারা আদিত্য তাপ দেন তাই দিয়েই পর্জন্য বর্ষণ করেন। মনুস্মৃতি গ্রন্থে বিষয়টা আরও স্পষ্ট। সেখানে বলা হয়েছে ‘আদিত্যজ্জায়তে বৃষ্টিঃ বৃষ্টিরন্নং ততো প্রজাঃ’ (৩/৭৬)। অর্থাৎ আদিত্য থেকে জাত হয় বৃষ্টি, বৃষ্টি থেকে অন্ন আর অন্ন থেকে প্রজা। কাজেই শস্য সূর্যের ওপর নির্ভরশীল।
মহারাষ্ট্রে মকর সংক্রান্তিকে তিল সংক্রান্তি বলে। মকর কাম অর্থাৎ ভালবাসার প্রতীক। মহারাষ্ট্রে ঘরে-ঘরে আগের দিন রাতে তিলের বিভিন্ন রকম নাড়ু তৈরি হয়। ভোরে স্নান করে ওইদিন নাড়ু খাওয়া হয়। কারও সঙ্গে কোনও কারণে মনোমালিন্য ঘটলে এ-দিনে নাড়ু নিয়ে একে অপরের বাড়ি যায় আর বলে— এই নাও তিল-গুড়, আর মিষ্টি কথা বলো। অবশ্য আয়ুর্বেদশাস্ত্রেও এই সময় তিল ও তিলের তৈরি খাদ্য খেতে বলা হয়েছে। এতে শরীরের শুষ্কতা দূর হয়।
উত্তরায়ণ বা মকর সংক্রান্তি উপলক্ষেই হয় গঙ্গাসাগরের মেলা। মকর সংক্রান্তির গঙ্গাস্নান মানুষের কাছে এক মুক্তির আবেদন নিয়ে আসে। পুরাণে তাই বলা হয়েছে— ‘ত্বং দেব সরিতাং নাথ ত্বং দেবী সরিতাম্বরে। উভয়োঃ সঙ্গমে স্নাত্বা মুঞ্চামি দুরিতানি বৈ।’ মকর সংক্রান্তির সঙ্গে সাগরসঙ্গমে পুণ্যস্নানের এক আধ্যাত্মিক যোগ রয়েছে। এই দিনেই সগর রাজার ষাট হাজার পুত্র মুক্তিলাভ করে।
সূর্যের অয়ন অর্থাৎ গতিপথ দুটো— উত্তরায়ণ আর দক্ষিণায়ণ। উত্তরায়ণ হল দেবযান পথ। যে-পথের শেষে রয়েছে আত্মার বন্ধনমুক্তির সন্ধান— ‘তত্র প্রয়াতা গচ্ছন্তি ব্রহ্ম ব্রহ্মবিদো জনাঃ’। ব্রহ্মবেত্তাদের ব্রহ্মলাভের পথ হল এটা। দক্ষিণায়ণ হল উলটো পথ। এ পথে গেলে আবার মানবজন্ম লাভ হয়। পৌষের সংক্রান্তি হল উত্তরায়ণ সংক্রান্তি। আমাদের দেশে সেই সনাতন যুগ থেকে এই উত্তরায়ণ কালকেই যাবতীয় শুভকাজের প্রশস্ত সময় বলে মনে করা হয়। এই উত্তরায়ণেরই আরেক নাম মকর সংক্রান্তি। কামশক্তি মকরকে আর মাথায় চড়তে না দেওয়ার প্রার্থনা করা হয় এইদিনে। গঙ্গার বাহন হয়ে সে গঙ্গামায়ের বশীভূত হয়ে তাঁর পায়ের তলায় আশ্রয় নিক। পূর্ববাংলায় এইদিনে বাস্তুপুজোর যে প্রথা রয়েছে, সেখানে মকরের বিকল্পে মাটির কুমির বলি দেওয়ার রীতি সম্ভবত এই আদিম ভাবনার সূত্রবাহী। পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় মকর সংক্রান্তির আগের দিন আমন ধানের কেটে আনা গুছিকে পুজো করা হয়, যার নাম আওনি বাঁওনি। রাঢ় বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচলিত টুসুদেবীর পুজোও এই তিথিতে সাঙ্গ হয়।
কপিল হচ্ছেন ভাগবত মতে বিষ্ণুর অবতার। মহাভারতে এঁকে বিষ্ণু বলা হয়েছে। ‘তত্ত্ব ও মানস’ নামে ছোট বইটি কপিল প্রণীত আদি সাংখ্যদর্শনের গ্রন্থ। পঞ্চবিংশতি তত্ত্বযুদ্ধ সাংখ্যদর্শন রচনা করেন কপিল। সাংখ্যমতে প্রকৃতি ও পুরুষ অনাদি। আত্মা কিছুই সৃষ্টি করে না, আত্মা কেবল দ্রষ্টা। কর্মফল অনুসারে আত্মা দেহান্তরে আশ্রয় নেয়। এইসব সাধনার জন্যই কপিল পাতালে আশ্রম করেছিলেন। তিনি শিবেরও ভক্ত ছিলেন। মহামুনি কপিল হলেন গঙ্গাসাগর সঙ্গমের অধীশ্বর। মকর সংক্রান্তিতে কপিলকে দর্শন দিয়েছিলেন স্বয়ং মহাদেব।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র