ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • নিজেকে দেখি আমাকে দেখুন


    সুস্নাত চৌধুরী (January 1, 2022)
     

    সান্তা ক্লজ বলে কেউ নেই; তার নামে চালিয়ে আসা ধারাবাহিক ঘটনাটি আসলে প্ল্যানমাফিক বানানো বচ্ছরকার একটি গাঁজাখুরি আয়োজন মাত্র। এ-কথা প্রথম জানার পর শুধু বাবা-মায়ের উপর থেকেই নয়, জীবনের উপর থেকেও যেন বিশ্বাস চলে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। কনকনে ডিসেম্বর সে-বার হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিষাদের মরশুম। শেষমেশ, মাথায় উপহারের ঝুলি ভেঙে পড়া সাড়ে আট বছরের অসহায় বালককে হাফ-খুদখুশির রাস্তা থেকে ভরপুর খুশির জোয়ারে যা ফিরিয়ে আনে, তা একটি সামান্য ডায়েরি।

    সেসব ডায়েরি সামান্যই ছিল। কিন্তু হয়ে উঠত অসামান্য। কোনও-না-কোনও সংস্থা থেকে পাওয়া সৌজন্য উপহার। বিনামূল্যের, কিন্তু মহার্ঘ। তার শক্ত মলাট। কোণে সোনালি স্বপ্নের মতো ছোট্ট ধাতব সুরক্ষা। ঝকঝকে রুলটানা পাতা। উপরে শৌখিন হরফে ছাপা সেই সব তারিখ, যা এখনও আসেনি। পাতার পর পাতা শূন্যতা যেন নতুন বছরের চিরনতুন সম্ভাবনার আকাশ। আমাকেই এই সব ভরিয়ে তুলতে হবে— ভাবলে শিহরন খেলে যেত শরীরে। হাতের লেখার কথা ভাবতে হবে না, বানান ঠিক হচ্ছে কি না মাথায় রাখার দরকার নেই; শুধু রোজ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে লিখে ফেলতে হবে আমার মন যা চায়। কোনও গোপন কথা হোক কিংবা সেদিনের অভিজ্ঞতা। আমিই এর মালিক। রুলটানা হলেও এই তিনশো পঁয়ষট্টি পৃষ্ঠায় আমি রুলবিহীন, স্বাধীন, বেপরোয়া। এ-ডায়েরি তো আর কেউ পড়বে না; কেননা বাবা বলেছে, অন্যের ডায়েরি পড়লে ঠাকুর পাপ দেয়।

    ভোর-ভোর ঘুম থেকে উঠব। রোজ সকালে পড়তে বসব। ইশকুলে মারপিট করব না। বই-খাতা গুছিয়ে রাখব। এমন অনেক কিছুর সঙ্গেই লিস্টে থাকত— প্রতিদিন নিয়ম করে ডায়েরি লিখতে বসব। কিন্তু পুরনো বছরের শেষ আর নতুন বছরের শুরুর দিনগুলি জুড়ে নিজেই নিজেকে দেওয়া যে-প্রতিশ্রুতি আর সংকল্পের উষ্ণতা খেলা করে, বাঙালির শীত চলে যাওয়ার আগেই তা বিদায় নেয়। নববর্ষের হাই-রেজোলিউশন ছবি ক্রমে পিক্সেলে-পিক্সেলে ভাঙতে থাকে। আগামী দিনগুলোর জন্য ‘সেরা’ হয়ে ওঠার যে-আকাঙ্ক্ষা ভিতরে-ভিতরে কাজ করে, তাকে বাস্তবায়িত করার মতো যথেষ্ট প্রয়াস আমাদের মধ্যে জন্ম নেয় না। তাই আগেভাগেই খচিত হয়ে থাকে আলস্যের নিশ্চিত জয়। সাধ থাকে, সাধনা থাকে না। সাধ্য ছিল কি না, সেই প্রশ্ন অবান্তর হয়ে যায়। আমার বাল্যকালেও এর অন্যথা হয়নি। ‘কাল থেকে ঠিক পালটে যাব দেখে রাখিস তোরা’ বলতে-বলতে শুধু অশ্বমেধের ঘোড়া নয়, ডায়েরি খুলে রেখে আমিও ঘুমিয়ে পড়েছি, খাটের মধ্যিখানে।

    কোনও বারেই আমার ডায়েরি-লেখা তাই বেশি দূর এগোতে পারেনি। মাসকাবার হয়তো হয়েছে, কিন্তু বছর ফুরোয়নি। ফের ডিসেম্বর এসেছে, ফের জানুয়ারি। আরেকটা নতুন ডায়েরির আকাঙ্ক্ষায় মন উদ্বেল হয়েছে। বিনয় মজুমদার না পড়েই বুঝে গিয়েছি, ‘দিনপঞ্জী মানুষের মনের নিকটতম লেখা’। কিন্তু নতুন বছর ঈষৎ পুরনো হতেই যে-কে-সেই! চাড় ফুরিয়েছে ক্রমে। আরও একটি ডায়েরির উপরে জমেছে ধুলো, ভিতরে নীরবতা। বয়স বেড়েছে, কাহিনি থেকেছে একই।

    ‘অদ্য বঙ্গাব্দ বারোশো অষ্ট নব্বই তাং ষোলোই আশ্বিন শুক্রবার— আমি শ্রীমতী দিব্যহাসিনী দেবী এই দিনলিপিটি লিখিতে শুরু করিলাম।

    কিন্তু কেন করিলাম?

    আমি কে? কী এমন মানুষ? যে আমার দিনলিপি? এর আবার মূল্য কী? হয়তো কিছুই নাই। তবে এ লেখা তো অপর কাহারও চক্ষুগোচর হইবার জন্য নয়। সযত্নে লুকাইয়া রাখিতে হইবে। শুধু লিখিবার ইচ্ছায় লেখা।…’

    প্রকাশের বাসনায় নয়, শুধু লেখার ইচ্ছেয় লেখা। মেকি ক্রাফ্‌টের বদলে শব্দের প্রতি সততা। দেখনদারিত্ব ভুলে আয়নার সামনে দাঁড়ানো। যেখানে ঝলমলে পোশাকের আড়াল নেই, আছে স্নানঘরসম নগ্নতার স্বাভাবিকতা। এইখানেই ডায়েরি আর সব আখ্যানরীতিকে অতিক্রম করে যায়। হয়ে ওঠে ব্যক্তিমানুষের নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথনের আর্কাইভ। এ সেই তুমুল ব্যক্তিগত খেলা, যেখানে রেফারির বাঁশি নেই, দর্শকের বাহবা নেই, এমনকী বিপক্ষ দলের প্রতিরোধটুকু পর্যন্ত নেই। অবস্থাপন্ন বাঙালি পরিবারের সাধারণ গৃহবধূ দিব্যহাসিনী দেবীর ‘লাল খেরো বাঁধানো জাব্দা খাতাখানা’ ঠিক তেমনই (‘দিব্যহাসিনীর দিনলিপি’, আশাপূর্ণা দেবী)— সামান্যের ভাঁজে যেখানে লুকিয়ে থাকে অসামান্যতা।

    প্রকাশের বাসনায় নয়, শুধু লেখার ইচ্ছেয় লেখা। মেকি ক্রাফ্‌টের বদলে শব্দের প্রতি সততা। দেখনদারিত্ব ভুলে আয়নার সামনে দাঁড়ানো। যেখানে ঝলমলে পোশাকের আড়াল নেই, আছে স্নানঘরসম নগ্নতার স্বাভাবিকতা। এইখানেই ডায়েরি আর সব আখ্যানরীতিকে অতিক্রম করে যায়। হয়ে ওঠে ব্যক্তিমানুষের নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথনের আর্কাইভ। এ সেই তুমুল ব্যক্তিগত খেলা, যেখানে রেফারির বাঁশি নেই, দর্শকের বাহবা নেই, এমনকী বিপক্ষ দলের প্রতিরোধটুকু পর্যন্ত নেই। অবস্থাপন্ন বাঙালি পরিবারের সাধারণ গৃহবধূ দিব্যহাসিনী দেবীর ‘লাল খেরো বাঁধানো জাব্দা খাতাখানা’ ঠিক তেমনই (‘দিব্যহাসিনীর দিনলিপি’, আশাপূর্ণা দেবী)— সামান্যের ভাঁজে যেখানে লুকিয়ে থাকে অসামান্যতা।

    কিছু প্রশ্ন তবু শুরুতেই আসে, দিব্যহাসিনীরও যেমন এসেছিল— ‘আমি কে? কী এমন মানুষ? যে আমার দিনলিপি?’ ধরা যাক, ২৬ জুন ১৯২২ তারিখে কারও ডায়েরির এন্ট্রি যদি এমন হয়— ‘কারাকোরম্, বন্দাকুশ পাহাড়ের দশ মাইল উত্তর। আমরা এখন সবসুদ্ধ দশজন—আমি, আমার ভাগ্নে চন্দ্রখাই, দুজন শিকারী (ছক্কড় সিং আর লক্কড় সিং) আর ছয়জন কুলি। আমার কুকুরটাও সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে।’ কিংবা কোনও এক দোসরা জানুয়ারির লেখা যদি শুরুই হয় এই ভাবে— ‘রকেটটা নিয়ে যে চিন্তাটা ছিল, ক্রমেই সেটা দূর হচ্ছে। যাবার দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই মনে জোর পাচ্ছি, উৎসাহ পাচ্ছি।’ না, মোটে সমস্যা নেই। অর্থাৎ, ডায়েরি লেখকের নাম প্রফেসর হুঁশিয়ার বা প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু হলে চলবে। নচেৎ হীনম্মন্যতার চোরাবালি আমাদের অনেককেই টানতে থাকে। তেমন কেউকেটা যদি আমি না হই কিংবা ‘বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে’ যদি না ঘটে চলে, তখন নিজেরই ভিতরে প্রশ্ন জাগে, এই দিনপঞ্জিকা লিখে চলার তাৎপর্য কতটুকু। আর এই দ্বিধা থেকেই ছেদ পড়ে ডায়েরি লেখার দৈনন্দিন অভ্যাসে। কিন্তু এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে যে মুকুন্দ চক্রবর্তী না থাকলে অনামা ফুল্লরা নিজেই লিখতে পারবে না তার বারোমাস্যা?

    গত শতাব্দীর সর্বাধিক আলোচিত দিনলিপিটিতেও দেখতে পাওয়া যায় এই প্রসঙ্গই— ‘…আসলে আমার মনে হয়, তেরো বছরের এক স্কুলের মেয়ের মনখোলা কথাবার্তা কোনো আগ্রহ জাগাবে না—না আমার, না সেদিক থেকে আর কারো। তা হোক, কী আসে যায় তাতে?’ অনুমেয়, লেখিকার নাম আনা ফ্রাঙ্ক। ডায়েরি শুরুর দিন কয়েকের মাথায়, ১৯৪২ সালের ২০ জুন সে লিখছে— ‘এটা ঠিকই, কাগজের আছে সহ্যগুণ এবং এই শক্ত মলাট-দেওয়া নোটবই, জাঁক করে যার নাম রাখা হয়েছে ‘ডায়রি’, সত্যিকার কোনো ছেলে বা মেয়ে বন্ধু না পেলে কাউকেই আমি দেখাতে যাচ্ছি না—কাজেই মনে হয় তাতে কারো কিছু আসে যায় না। এবার আদত ব্যাপারটাতে আসা যাক, কেন আমি ডায়রি শুরু করছি তার কারণটা: এর কারণ হল আমার তেমন সত্যিকার কোনো বন্ধু নেই।… আমার ডায়রিতে একের পর এক নিছক ন্যাড়া ঘটনাগুলোকে সাজিয়ে দিতে চাই না, তার বদলে আমি চাই এই ডায়রিটা হোক আমার বন্ধু, আমার সেই বন্ধুকে আমি কিটি বলে ডাকব’। (‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী’, ভাষান্তর: সুভাষ মুখোপাধ্যায়)

    এই যে ডায়েরিকেই ‘সত্যিকার’ বন্ধু করে নেওয়া, তা বস্তুত ডায়েরির চোখ দিয়ে নিজেকে চিনতে চাওয়ার বাসনা। শুধু আনা নয়, ডায়েরি লেখার নেপথ্যে এই ইচ্ছা আমাদের অনেকের ভিতরেই কাজ করে যায়। ‘আমাকে পড়লে মনে খুঁজো এইখানে, এখানে খুঁজছি আমি জীবনের মানে।’ আমার দিনলিপিতে আমি আমাকেই নথিবদ্ধ করে রাখি, কারণ আমাকেই আমি সেখানে খুঁজে পেতে চাই। কিন্তু কখনও যদি এমন হয়, নিজেকে ‘স্নানের ঘরে নগ্ন দেখে’ নিজেরই বিতৃষ্ণা জাগে— আয়নায় যাকে দেখছি তাকেই মনে হয় নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু— চূড়ান্ত একঘেয়ে, আদ্যন্ত হিপোক্রিট, একেবারে হেরো একটা কুৎসিত মানুষ— তখন কোথায় জায়গা পাবে সেই অবসাদের দিনলিপি?

    উনিশ শতকের এক অজ্ঞাতনামা কলেজ পড়ুয়া ডায়েরি-লেখকের অবস্থানকে দেখেছিলেন খানিক ভিন্ন ভঙ্গিতে। ১৫ মে ১৮৯১ তিনি ডায়েরিতে লিখছেন— ‘অনেকের পক্ষে ডায়ারি লেখা অভ্যাসটা অত্যন্ত ক্ষতিজনক। যাহারা নিজের সামান্য মনের ভাবকে বাহিরের জিনিস অপেক্ষা অধিক আদর, অধিক প্রাধান্য দেয়, যাহাদের মনের গঠন সংকীর্ণ—নিজেকে ছাড়িয়া অপরের দিকে যাইতে যাহাদের মন স্বভাবতই অনিচ্ছুক, সেরূপ লোকেদের পক্ষে ডায়ারি লেখার অর্থ—সকল প্রকার চিন্তা ও উদার মনের ভাব হইতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া আপনার ক্ষুদ্রতাকেই প্রধান করিয়া তোলা।’ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই ডায়েরির কয়েকটি পাতা পেশ করেন ‘সবুজ পত্র’ সম্পাদকের দরবারে। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য ছিল— ‘ছাপার অক্ষরে ইহা প্রকাশ করা যাইতে পারে। একটা প্রধান কারণ এই, ছাপিবার জন্য ইহা লেখা হয় নাই।’ এই ডায়েরি লিখিত হওয়ার চব্বিশ-পঁচিশ বছর বাদে, ১৯১৫ সালে তা ছাপার জন্য পাঠাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। মজার ব্যাপার হল, ওই বছরই ২৭ এপ্রিল এমন আরেক অজ্ঞাতনামার ডায়েরি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি লেখেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। বয়ঃসন্ধি কালে এসে পড়া একটি মেয়ের রোজনামচা। উনিশ শতকের বাঙালি যুবকের ডায়েরি থেকে উঠে আসা দ্বন্দ্বের কিছু সুরাহা মিলতে পারে অস্ট্রিয়ার এই কিশোরীর বয়ানে। মেয়েটি লিখে রাখছে কীভাবে সে দিনে-দিনে বড় হয়ে উঠছে, কীভাবে তার বন্ধুত্বগুলি গড়ে উঠছে, আবার ভেঙেও যাচ্ছে, কীভাবে সে দায়িত্ব নিতে শিখছে, কীভাবে তার কাছে ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে যৌনতার রহস্য। ব্যক্তিগত হয়েও যা ভীষণ রকম নৈর্ব্যক্তিক। নির্দিষ্ট হয়েও, সামগ্রিক। ফ্রয়েড বলছেন— ‘Of all these things we have a description at once so charming, so serious, and so artless, that it cannot fail to be of supreme interest to educationists and psychologists’। মেয়েটির এগারো থেকে সাড়ে চোদ্দো বছর বয়সের মধ্যে লেখা এই দিনলিপি ‘A Young Girl’s Diary’ ১৯২১ সালে যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, ভূমিকা হিসেবে থাকে ফ্রয়েডের চিঠিটিই।

    কাজেই, ডায়েরি বিষয়টি কখনওই একমাত্রিক নয়, তার মধ্যে থেকে যায় নানা স্তর। তা যেমন জনৈকের হতে পারে, তেমনই বিশেষেরও। বিখ্যাত ব্যক্তিদের ডায়েরি, তার আকর্ষণও কিছু কম নয়; কারণ সেখানেও যাবতীয় মোড়কের একেবারে ভেতরে থাকা রক্ত-মাংস-পুঁজ-বীর্যের আসল মানুষটিকে স্পর্শ করা যায়। আমাদের সাহিত্যিকরাই এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। বিভূতি-মানিক থেকে ইলিয়াস-সন্দীপন। কিংবা জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদারের ডায়েরি। যা খুলে দেয় একের পর এক জানলা। কেজো কথা, আলগা কথা, ভারী কথার অকপট কোলাজ প্রথাগত সাহিত্যের নিখুঁত মার্জিনের তোয়াক্কা করে না।

    কখনও আবার ডায়েরির মধ্যে শুরু থেকেই থাকে প্রকাশের সম্ভাবনা। কখনও নির্দিষ্ট বিষয়ের ধারাবিবরণই হয় লক্ষ্য। এভাবেই ব্রিটিশ রমণী ফ্যানি পার্কস চেনান উনিশ শতকের কলকাতা, রাজনারায়ণ বসুর ‘দেবগৃহে দৈনন্দিন লিপি’ তুলে ধরে ব্রাহ্মসমাজের ছবি। শিবনাথ শাস্ত্রীর বিলেত ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় গড়ে ওঠে ‘ইংলণ্ডের ডায়েরি’। রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি’।

    অশান্ত কালপর্বের বর্ণনাও বারবার উঠে এসেছে দিনপঞ্জির পাতায়। তখন আর শুধু নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা নয়, টালমাটাল সময়কে ধরে রাখাও সেই ডায়েরির উদ্দেশ্য। শব্দে-ছবিতে ‘তেভাগার ডায়েরি’ লিখেছেন সোমনাথ হোর। তামাম দুনিয়া নড়ে বসেছে দুজনের ডায়েরিতে— আনা ফ্রাঙ্ক আর চে গুয়েভারা। বলিভিয়ার ডায়েরিতে সংগ্রামী জীবন আর লড়াইয়ের গোপন প্রস্তুতির অনুপুঙ্খ ছবি এঁকে গিয়েছেন চে। মৃত্যুর ছ’দিন আগে ৩ অক্টোবর ১৯৬৭-তে যেমন তিনি লিখছেন— ‘দীর্ঘ দিন, অপ্রয়োজনে তীব্র; মূল শিবিরে পৌঁছোবার উদ্যোগ-আয়োজন চলছে এমন সময় উরবানো এসে খবর দিল সে শুনেছে কয়েকজন কৃষক যেতে যেতে বলছে: “এরাই কাল রাত্রে কথা বলছিল,” আমরা তখন রাস্তায়। সংবাদটা বেঠিক বলে মনে হলো, তবু সম্পূর্ণ সত্য বলে ধরে নিয়েই এগোতে হবে ঠিক করলাম এবং তৃষ্ণা না মিটিয়েই পাহাড়ের ওপরকার সমতল জায়গায় গিয়ে চড়লাম, সেখান থেকে সৈন্যদের দেখা যায়। বাকি দিনটা পরিপূর্ণ শান্ত; সন্ধেবেলায় সকলে নিচেয় নেমে কফি বানালাম—জলটা যদিও তেতো আর যে কেটলিতে বানানো হয়েছে সেটা তেলতেলে, তবু খেতে লাগল অমৃত। তারপর আমরা এখানে খাবার জন্যে রাঁধলাম ভুট্টার লপসি আর সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্যে এল্কের মাংস দিয়ে ভাত। তিনটেতে আমরা হাঁটা শুরু করলাম, তার আগেই একবার খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। অনায়াসে চ্যাকো এড়িয়ে আমরা পূর্বনির্দিষ্ট গিরিসংকটে এসে পড়লাম। জল নেই এখানে, কিন্তু সৈন্যবাহিনী যে খোঁজখবর নিয়ে গেছে তার প্রমাণ রয়েছে’। (‘চে গুয়েভারার ডায়েরী’, ভাষান্তর: অরুণ রায় ও কল্পতরু সেনগুপ্ত)

    আবার ‘কারাগারের রোজনামচা’ লিখতে গিয়ে অসহনীয় বন্দিজীবনের কথাই শুধু নয়, শেখ মুজিবের লেখায় ঝলমল করে উঠছে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। ১৯৬৬ সালের ৬ জুন তিনি ডায়েরিতে লিখছেন— ‘আমি একা থাকি, আমার সাথে কাহাকেও মিশতে দেওয়া হয় না। একাকী সময় কাটানো যে কত কষ্টকর তাহা যাহারা ভুক্তভোগী নন বুঝতে পারবেন না। আমার নিজের উপর বিশ্বাস আছে, সহ্য করার শক্তি খোদা আমাকে দিয়েছেন। ভাবি শুধু আমার সহকর্মীদের কথা। এক এক জনকে আলাদা আলাদা জেলে নিয়ে কিভাবে রেখেছে? ত্যাগ বৃথা যাবে না, যায় নাই কোনোদিন। নিজে ভোগ নাও করতে পারি, দেখে যেতে নাও পারি, তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা আজাদী ভোগ করতে পারবে। কারাগারের পাষাণ প্রাচীর আমাকেও পাষাণ করে তুলেছে। এ দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মা-বোনের দোয়া আছে আমাদের উপর। জয়ী আমরা হবই। ত্যাগের মাধ্যমেই আদর্শের জয় হয়।’ বঙ্গবন্ধুর এই ডায়েরির মতোই সুফিয়া কামালের ‘একাত্তরের ডায়েরী’ কিংবা কানাইলাল চক্রবর্তীর ‘শরণার্থীর দিনলিপি’ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সাদা পাতায় কলমের আঁচড়ে সারা পৃথিবী জুড়ে রচিত হয়েছে এমনই কত না বিচিত্র ডায়েরি!

    অথচ পেনসিল নয়, আমাদের হাতে রইল কি-বোর্ড আর টাচস্ক্রিন। ক্রমে এমন একটা সময়ে গোটা পৃথিবী এসে দাঁড়াল যে শুধু ডায়েরি লেখা নয়, কলমে-কাগজে যে-কোনও লেখার অভ্যেসই বিপন্নপ্রায়। পার্সোনাল ব্লগ, ফেসবুকের টাইমলাইন, টুইটার ইত্যাদি আজ হয়ে উঠেছে ডায়েরির বিকল্প। অনলাইন দিনলিপি। হাতে-লেখা ডায়েরি কি তা হলে হারিয়েই যাবে? শেষ পাতায় ছোট্ট পিকু সেই কবেই লিখে রেখেছিল, ‘…আর এখন আবার আমার বিছানাতেই লিখছি ডাইরি আর পাতাই কিন্তু নেই এখন আর কেউ নেই খালি আমি আর দাদু আর একটা খালি মাছি আছে খালি খালি আসছে জালাতোন ভারি বদমাইস মাছিটা আর বাস এইবার পাতা শেস, খাতা শেস, বাস শেস।’

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook