ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • থ্রিলার লিখছে কেজিবি


    প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (December 18, 2021)
     

    রোটান্ডাকৃতি ঘরের মধ্যে অস্বাভাবিক এক সাদা আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ঘরের চার দেওয়াল জুড়ে পর্দা, ইতিউতি ছড়ানো প্রজেক্টর, রিফ্লেক্টর, টিভি ক্যামেরা, রেডিও এবং আরও হাজারখানা যন্ত্রপাতি। কৃশাবয়ব এক মূর্তি নির্দেশ দিচ্ছেন ঘরের মধ্যে ব্যস্ত একদল মানুষকে। আচম্বিতে ঘরের মধ্যে বেজে উঠেছে এক ব্যারিটোন গলা, ‘টাইটান কলিং, টাইটান’। ঘরের মানুষগুলি কাজ থামিয়ে উদ্‌গ্রীব হয়ে শুনছেন।

    ‘অল সেক্টরস ইনটু অ্যাকশন’
    ‘ড্র্যাগন ইজ মিসিং! ড্র্যাগন…’

    ব্যারিটোন গলা থামার পরমুহূর্তে দেওয়ালে আটকানো পর্দায় ভেসে উঠেছে শত্রুপক্ষের গুপ্তচরের ছবি। তার হিমশীতল চাউনির মধ্যে যেন লুকিয়ে রয়েছে ঈষৎ বিদ্রূপাত্মক এক হাসি।

    শুনে মনে হতে পারে যেন ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’ বা ‘অন হার ম্যাজেস্টিজ সিক্রেট সার্ভিস’ গোত্রের কোনও স্পাই থ্রিলারের পটভূমিকা গড়ে উঠছে। যদিও বন্ডপ্রেমী যেসব পাঠক খুঁটিয়ে পড়তে ভালবাসেন, তাঁদের মনের মধ্যে একটা খচখচানি ঠিকই থেকে যাবে। ওপরের চার-পাঁচটা লাইন পড়েই অনেকে ভাববেন, বন্ডের গল্পে যতই গল্পের গরু গাছে উঠুক না কেন, লেখার স্টাইলটি আরেকটু ধ্রুপদী নয় কি? এ-গল্পে যেন মনে হচ্ছে এর পরেই স্বপনকুমারের গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জী বাড়ির পেছনের পুকুরে সাবমেরিন নিয়ে হুশ করে ভেসে উঠবেন।   

    এরকমটি ভেবে থাকলে কিছু বাহবা তাঁদের অবশ্যই প্রাপ্য।  

    দীপক চ্যাটার্জীই বটে, তবে কলকাতার নয়। সোফিয়ার। পূর্ব ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ার মাটিতে এ-গল্পের নায়ক চরে বেড়ান। তাঁর নাম আভাকুম জাহভ। কিন্তু পৃথিবী জুড়ে এত গোয়েন্দাসম্রাট থাকতে হঠাৎ বুলগেরিয়ার নায়কটিকে নিয়ে পড়লাম কেন? কারণ, ঠান্ডা যুদ্ধের প্রবলতম মুহূর্তটিতে আভাকুম জাহভ-এর গল্প হয়ে উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন শাসিত গোটা ইস্টার্ন ব্লকের এক অন্যতম সাংস্কৃতিক হাতিয়ার। সোভিয়েত শাসকরা নিশ্চিত ভাবেই বুঝেছিলেন, সাংস্কৃতিক যুদ্ধে হেরে গেলে বিপদ আছে, যে-বিপদে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক প্রভাব। এবং সাংস্কৃতিক যুদ্ধটি লড়তে গেলে জনপ্রিয় সাহিত্যকে যে উপেক্ষা করা চলবে না, সে-বিষয়টিও শীর্ষসারির বহু নেতাই বুঝতে পারছিলেন। একটু আগেই শত্রুপক্ষের যে-গুপ্তচরের ছবি আমরা সোফিয়ার কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্সের দপ্তরে দেখেছি, সেই গুপ্তচর একার হাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে দিচ্ছেন।

    হ্যাঁ, আভাকুমের গল্পের ড্র্যাগন আর কেউ নন। স্বয়ং জেমস বন্ড। কপিরাইটগত কারণে যাঁকে বইয়ে ০০৭-এর বদলে ০৭ বলে ডাকা হয়েছে। 

    আভাকুম জাহভ বনাম জেমস বন্ড, বইয়ের পাতায় এই দ্বৈরথ প্রথম দেখা যায় ১৯৬৬ সালে। কিন্তু এর প্রায় পাঁচ বছর আগেই এ-দ্বৈরথের এক আভাস দিয়ে রেখেছিলেন সোভিয়েত ইউনয়নের গোয়েন্দাসংস্থা কেজিবি-র প্রধান ভ্লাদিমির সেমিচাস্তনি। রাশিয়ার অন্যতম প্রধান সংবাদপত্র ‘ইজভেস্তিয়া’-য় বেনামে লিখতে গিয়ে ভ্লাদিমির জানিয়েছিলেন, ‘স্টালিনের অত্যাচারের দিন শেষ। সোভিয়েতপ্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভ নিজের হাতে গড়ে তুলছেন কেজিবি, স্টালিনের অন্যায়ে যাঁরা সঙ্গ দিয়েছিলেন তাঁদের স্থান আর কেজিবি-তে নেই।’  জনমানসে কেজিবি-র এক সুস্থ ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চেয়ে ভ্লাদিমির আরও জানিয়েছিলেন, কেজিবি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইস্টার্ন ব্লকের বাকি দেশের লেখকদের আহ্বান জানাচ্ছে দেশপ্রেমী, কমিউনিস্ট দর্শনে অবিচল নায়কদের নিয়ে আরও বেশি করে লিখতে। 

    বুলগেরিয়ান সাহিত্যিক আন্দ্রেই গুলিয়াশকি সেই ডাকে সাড়া দিয়েই পুনরুজ্জীবিত করেন তাঁর নায়ক আভাকুমকে। যদিও একাধিক গবেষকের দাবি আন্দ্রেইকে কেজিবি সরাসরি নিযুক্ত করেছিল এই গোয়েন্দা-উপন্যাস লেখার কাজে। কারণ যাই হোক না কেন, ফল একটাই— আভাকুমের সঙ্গে বন্ডের মরণপণ সংঘাত। জেমস বন্ডের গল্পের ধাঁচেই যে-সংঘাতের ক্লাইম্যাক্স রচিত হবে মেরুপ্রদেশের বরফের মধ্যে, নিকষ অন্ধকার এবং মৃত্যুগ্রাসী ঠান্ডার সঙ্গে পাল্লা দিতে-দিতে। 

    ষাটের দশক নয়, লন্ডন কিংবা মস্কো নয়, ব্রিটিশ বা আমেরিকান গুপ্তচরের সঙ্গে হাতাহাতি নয়— পটভূমিকা থেকে শুরু করে সময়কাল সবেতেই রইল পরিণত বুদ্ধির ছাপ। কিন্তু যুদ্ধ যে অব্যাহত থাকল, সে নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। বইয়ের সাফল্যের ব্যাপারে কেজিবি-র কর্তারা এতই উদ্গ্রীব হয়ে ছিলেন যে, একাধিক গোপন ফাইলও তাঁরা জুলিয়ানকে দেখাতে দ্বিধাগ্রস্ত হননি। জুলিয়ানও এমন মুন্সিয়ানার সঙ্গে সেসব তথ্য গল্পে জুড়েছিলেন যে, বহু পাঠক ধরে নিয়েছিলেন গল্পের প্লটটি সর্বৈব ভাবে সত্যি!  

    ইস্টার্ন ব্লকের বাইরে আভাকুম জাহভের কীর্তিকলাপ বিশেষ সাড়া ফেলতে পারেনি। না, রাজনৈতিক শত্রুতার কারণে নয়। বরং ব্রিটেন এবং আমেরিকায় সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে মানুষের তীব্র কৌতূহল ছিল এবং ধনতান্ত্রিক বই-ব্যবসায়ীরা বেশ জানতেন যে, সোভিয়েত সাহিত্যের একটি বিশাল বাজার পশ্চিমে রয়েছে। কিন্তু আন্দ্রেই গুলিয়াশকির উপন্যাসে যে বিসমিল্লায় গলদ— গপ্পোটাই ভাল নয়। অতএব, সস্তার পেপারব্যাক সংস্করণ ছাড়া পশ্চিমের বাজারে আন্দ্রেইয়ের বিশেষ কিছু জুটল না। 

    এবার রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন কর্নেল ইসায়েভ।  
    আভাকুম জাহভের ব্যর্থতার কারণেই হোক, বা দেশপ্রেমের খাতিরে, কেজিবি-র দুই শীর্ষকর্তা ভ্লাদিমির সেমিচাস্তনি এবং তাঁর উত্তরসূরি ইউরি আন্দ্রোপভ (যিনি পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতিও হবেন) চাইছিলেন রাশিয়ান কোনও লেখককে দিয়ে বন্ডের মোকাবিলা করাতে। কিন্তু এবারের দ্বৈরথ আর আক্ষরিক অর্থেই শারীরিক দ্বৈরথ নয়, এবারের টক্কর হবে সাহিত্যিক গুণের বিচারে। এবারের লড়াই হবে সূক্ষ্মবুদ্ধির লড়াই। জেমস বন্ডের নিজের জায়গাই যে পশ্চিমি দুনিয়ায় বেশ টলোমলো হয়ে উঠেছে, সে-খবর কেজিবি এবং ক্রেমলিনের নেতারা বিলক্ষণ পেয়েছেন। ইয়ান ফ্লেমিংকে হটিয়ে সাহিত্য-আসরে ঢুকে পড়েছেন ডেভিড কর্নওয়েল ওরফে জন লে কারে। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘দ্য স্পাই হু কেম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড’ খ্যাতির তুঙ্গে পৌঁছে দিয়েছে। জন এবং তাঁর উপন্যাসের মুখ্য চরিত্ররা ইয়ান ফ্লেমিং এবং জেমস বন্ডের প্রেক্ষিতে মূর্তিমান বৈপরীত্য। জনের দুনিয়া অনেক বেশি বাস্তব, এখানে টক্কর চলে লন্ডন কি বার্লিনের অফিসে, মহাকাশ বা সমুদ্রের গভীরে নয়। দামি গাড়ি নেই, অফুরন্ত যৌনতা নেই, আছে ঠান্ডা যুদ্ধের কিছু করুণ পরিণতি। অথচ জর্জ স্মাইলি এবং তাঁর সহযোগীদের গোটা পশ্চিমি দুনিয়া সোৎসাহে ঠাঁই দিয়েছে নিজেদের বুকশেল্‌ফে। 

    কেজিবি কর্তারা নিজেদের দিকেও চাইছিলেন বুদ্ধিমত্তার উদযাপন, যৌবনের অকারণ প্রাবল্য নয়। তাঁদের উৎসাহেই রাশিয়ান লেখক জুলিয়ান সেমিওনোভ ১৯৬৯ সালে বার করলেন নতুন উপন্যাস ‘বসন্তের সতেরোটি মুহূর্ত’— যে-বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র কর্নেল ইসায়েভ। রাশিয়ান সাহিত্যজগতে ইসায়েভ আগেই কিছু খ্যাতি পেয়েছিলেন বলশেভিক বিরোধী শক্তির চক্রান্ত ভেস্তে দিয়ে। কেজিবি-র অনুরোধে জুলিয়ান সেই ইসায়েভকেই এবারে নিয়ে ফেললেন চল্লিশের জার্মানিতে। নাৎসি পার্টি এবং পশ্চিমি রাজনৈতিক শক্তিগুলির মধ্যে এক গোপন সমঝোতার সম্ভাবনা নষ্ট করতেই ইসায়েভের পুনরাবির্ভাব। ষাটের দশক নয়, লন্ডন কিংবা মস্কো নয়, ব্রিটিশ বা আমেরিকান গুপ্তচরের সঙ্গে হাতাহাতি নয়— পটভূমিকা থেকে শুরু করে সময়কাল সবেতেই রইল পরিণত বুদ্ধির ছাপ। কিন্তু যুদ্ধ যে অব্যাহত থাকল, সে নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। বইয়ের সাফল্যের ব্যাপারে কেজিবি-র কর্তারা এতই উদ্‌গ্রীব হয়ে ছিলেন যে, একাধিক গোপন ফাইলও তাঁরা জুলিয়ানকে দেখাতে দ্বিধাগ্রস্ত হননি। জুলিয়ানও এমন মুন্সিয়ানার সঙ্গে সেসব তথ্য গল্পে জুড়েছিলেন যে, বহু পাঠক ধরে নিয়েছিলেন গল্পের প্লটটি সর্বৈব ভাবে সত্যি!  

    ‘He spent more time gazing through windows than crashing through them’ … Vyacheslav Tikhonov as Stierlitz in Seventeen Moments of Spring.

    (বসন্তের সতেরোটি মুহূর্ত, রাশিয়ান টিভি সিরিজের মুখ্য চরিত্র কর্নেল ইসায়েভের ভূমিকায় ভিয়াচেসলাভ তিখোনভ) 

    বই হয়ে বেরোনোর সঙ্গে-সঙ্গেই ‘বসন্তের সতেরোটি মুহূর্ত’ সোভিয়েত পাঠকসমাজে জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের জনসংখ্যার নিরিখে যাদের হাতে এ-বই পৌঁছেছিল, তাদের সংখ্যা নগণ্য। গোটা ষাটের দশক ধরেই সোভিয়েত ইউনিয়নের ছাপাখানাগুলিতে কম পড়েছে কাগজ। এই অভাবনীয় কাগজসঙ্কট এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে, নিকিতা ক্রুশ্চেভ সমস্ত রকম গোপনীয়তা বর্জন করে জনসমক্ষে তুমুল সমালোচনা করেছিলেন কাগজ-ব্যবসায়ীদের। সেটা ছিল ষাট দশকের শুরু। দশক যখন শেষ হতে চলেছে তখনও সমস্যার সমাধান পুরোপুরি ভাবে হয়নি। এদিকে কেজিবি কর্তারা জুলিয়ান সেমিওনোভের বইকে স্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে দিতে চান না। অতএব, ফরমায়েশ এল টিভি-সিরিজ বানানোর।

    ১৯৭৩ সালে ‘বসন্তের সতেরোটি মুহূর্ত’ দেখা দিল টিভির পর্দায়। পর পর বারোটি সন্ধ্যা ধরে দেখানো হল কর্নেল ইসায়েভের বার্লিনি অ্যাডভেঞ্চার, এবং দেখলেন গড়ে পাঁচ থেকে আট কোটি মানুষ। লিওনিড ব্রেজনেভ তখন সোভিয়েত-সর্বেসর্বা, ‘বসন্তের সতেরোটি মুহূর্ত’ দেখার নেশায় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং-এর সময় অবধি বদলে দিলেন তিনি! কেজিবি এবং ক্রেমলিনের যুগপৎ সাহায্য অবশ্যই টিভি-সিরিজের জনপ্রিয়তাকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এ-কথা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই যে, অভিনয়ের মানও ছিল অত্যুচ্চ। পরিচালক তাতিয়ানা লিওজনোভা বইয়ের বেশ কিছু প্রোপাগান্ডাকে বাদ দিয়েছিলেন একটি শিল্পসম্মত কাজের খাতিরে। তাতিয়ানার সিদ্ধান্তে কেজিবি-র কর্তারা পুরোপুরি খুশি হতে পারেননি কিন্তু মস্কো থেকে কাবুল অবধি যে-অভাবনীয় সাফল্য তাঁরা পেয়েছিলেন, তাতে শেষমেশ তাঁদের রুষ্ট হয়ে থাকার কোনও কারণ ছিল না। তাতিয়ানাকে যে-কারণে ১৯৮৪ সালে ‘People’s artist of the USSR’ সম্মানে ভূষিত করা হয়।   

    ‘বসন্তের সতেরোটি মুহূর্ত’ যখন গোটা সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছে, প্রায় সেই সময়েই বিপুল ব্যয়ে তৈরি হচ্ছিল আর একটি সোভিয়েত থ্রিলার ‘স্টার্লিং ও লিরা’। সে-সিনেমা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত রাশিয়ান পরিচালক সের্গেই আইজেনস্টাইনের একদা সহকারী গ্রিগরি আলেকসান্দ্রোভ। গ্রিগরির নিজের কৃতিত্বও কিছু কম ছিল না। মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে তিনিও পেয়েছিলেন সেই বিখ্যাত ‘People’s artist of the USSR’ সম্মান। যদিও দুর্জনে গ্রিগরির নামে কম গল্প রটায়নি। প্রথমবার আমেরিকা গিয়ে আইজেনস্টাইন নাকি ফিরেছিলেন দু’সুটকেস ভর্তি বই নিয়ে, আর গ্রিগরির সঙ্গে ছিল দু’সুটকেস ভর্তি স্যুট। এও শোনা যায়, যৌবনকালে ভদ্রলোক তাঁর সহকর্মীদের ইমপ্রেস করতে মাঝে মাঝেই ফোন ধরে থেকে উচ্চগ্রামে ‘হ্যাঁ, বলুন কমরেড স্টালিন’ ইত্যাদি বলতেন। অধিকাংশ সহকর্মীই বিশ্বাস করতেন, লাইনের উল্টোদিকে গ্রিগরির কথা শোনার জন্য স্টালিন তো দূরস্থান, কেউই থাকতেন না।  

    সে যাই হোক, নতুন থ্রিলারের জন্য বর্ষীয়ান গ্রিগরিকে বিশ্বাস করে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি একটি বিশাল অঙ্কের প্রোডাকশন-বাজেট বরাদ্দ করে। স্টার্লিং এবং লিরা আসলে এক রাশিয়ান দম্পতির ছদ্মনাম। তাঁরা ছদ্মবেশে বহু বছর ধরে জার্মানিতে কেজিবি-র হয়ে কাজ করছেন আমেরিকা এবং বাকি পশ্চিমি শক্তিদের সমস্ত ষড়যন্ত্র বানচাল করতে। প্লটটি আপাতদৃষ্টিতে ‘বসন্তের সতেরোটি মুহূর্ত’-র থেকে খুব আলাদা নয়। কিন্তু এবারের লক্ষ্য বড় পর্দা, বোকা বাক্সের গণ্ডি ছাড়িয়ে কেজিবি-র লক্ষ্য এবার অমরত্বের কাছাকাছি পৌঁছানো। সেই লক্ষ্যে বাধ সাধলেন খোদ পরিচালক নিজেই। লিরা অর্থাৎ মহিলা গুপ্তচরের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য তিনি বেছে নিলেন তাঁর স্ত্রী ল্যুবভ অরলোভাকে। ল্যুবভ বিখ্যাত অভিনেত্রী কিন্তু এই সময়ে তাঁর বয়স প্রায় তিয়াত্তর, অথচ চিত্রনাট্য অনুযায়ী চরিত্রের বয়স তিরিশ। ‘স্টার্লিং ও লিরা’ তৈরি হয়েছে প্রায় সাত বছর ধরে অথচ কেজিবি কিংবা কমিউনিস্ট পার্টি কেউই গ্রিগরিকে বলে উঠতে পারেনি যে, অরলোভাকে মুখ্য চরিত্রে নেওয়া একটি ঐতিহাসিক ভুল! দীর্ঘ সাত বছর সময়, এবং সঙ্গে প্রৌঢ়া অরলোভা, রাশিয়ান সিনেমহল ‘স্টার্লিং ও লিরা’-র ডাকনাম দিয়ে ফেলল ‘Sclerosis and Menopause’। 

    A picture containing clothesDescription automatically generated

    (স্টার্লিং ও লিরা, মুখ্য অভিনেত্রীর ভূমিকায় ল্যুবভ অরলোভা) 

    গ্রিগরি অবশ্য এসব ঠাট্টাতামাশায় আদৌ বিচলিত হননি। তিনি জানতেন, কেজিবি এবং ক্রেমলিনের কৃপাদৃষ্টি আছে তাঁর ওপর, নাহলে সত্তরের দশকে ওই বিশাল বাজেটের সিনেমা সোভিয়েত ইউনিয়নে বসে বানানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু গ্রিগরির সিনেমা মুক্তি পাওয়ার ঠিক আগেই ঘটে গেল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। সাধে কি আর বলে ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’! ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে পশ্চিম জার্মানির সিক্রেট সার্ভিসের হাতে গ্রেপ্তার হলেন চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের ব্যক্তিগত সহায়ক গুন্থার গিলৌম। খবরে প্রকাশ পেল গুন্থার আসলে পূর্ব জামানির গুপ্তচর, আঠারো বছর ধরে পশ্চিম জার্মানিতে তিনি আর তাঁর স্ত্রী গুপ্তচরবৃত্তি করে এসেছেন। এক বছর ধরে তাঁকে নজরে রাখছিল পশ্চিম জার্মানির সিক্রেট সার্ভিস, অবশেষে অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ হাতে আসামাত্র তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শোনা গেল বেশ কয়েকবার চ্যান্সেলর উইলি এবং গুন্থার সপরিবারে ছুটি কাটিয়েছেন একত্রে, এবং প্রত্যেকবার গুন্থার তাঁদের যাবতীয় কথোপকথন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশদে পাঠিয়েছেন পূর্ব জার্মানির সিক্রেট সার্ভিস স্টাসিকে। 

    সত্তরের দশক থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক স্থবিরতা শুরু হয়ে গেছে। স্টালিনের সময়ে তো বটেই, ষাটের দশকেও যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে ক্রেমলিন হোয়াইট হাউস বা ডাউনিং স্ট্রিটের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে নামত, সেই আত্মবিশ্বাসে যেন একটু হলেও চিড় ধরছে। এহেন প্রেক্ষিতে বন্ধু বা নিরপেক্ষ দেশগুলির সমর্থন পাওয়া অত্যন্ত জরুরি।

    জল এতদূর গড়িয়েছিল যে, এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে উইলি ব্রান্টকে পদত্যাগ করতে হয়। কিন্তু কেজিবি কর্মকর্তাদের এদিকে চক্ষু চড়কগাছ। শুনতে অবিশ্বাস্য ঠেকলেও কেজিবি-র তৎকালীন শীর্ষনেতাদের প্রায় কেউই পূর্ব জার্মানির এই গুপ্তচর দম্পতিকে নিয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। সত্যি বলতে কী, পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট যথেষ্ট বন্ধুভাবাপন্নই ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি, তাঁকে মসনদ থেকে সরানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না কেজিবি বা ক্রেমলিনের। এদিকে গুন্থার এবং তাঁর স্ত্রীর আখ্যানের সঙ্গে  ‘স্টার্লিং ও লিরা’-র গল্পের অবিশ্বাস্য মিল, যেন গুন্থারদের পরিকল্পনার ব্লু-প্রিন্ট ধরে-ধরেই গ্রিগরির চিত্রনাট্যটি বানানো হয়েছে। 

    সত্তরের দশক থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক স্থবিরতা শুরু হয়ে গেছে। স্টালিনের সময়ে তো বটেই, ষাটের দশকেও যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে ক্রেমলিন হোয়াইট হাউস বা ডাউনিং স্ট্রিটের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে নামত, সেই আত্মবিশ্বাসে যেন একটু হলেও চিড় ধরছে। এহেন প্রেক্ষিতে বন্ধু বা নিরপেক্ষ দেশগুলির সমর্থন পাওয়া অত্যন্ত জরুরি। গুন্থারদের কেলেঙ্কারির ছোঁয়া থেকে তাই যেনতেনপ্রকারেণ সোভিয়েত ইউনিয়নকে বেরোতেই হত। অতএব, কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ‘স্টার্লিং ও লিরা’ দেখে ওঠার পর পরেই কেজিবি-র পক্ষ থেকে গ্রিগরি এবং তাঁর শিল্পীদের জানিয়ে দেওয়া হল ‘স্টার্লিং ও লিরা’-য় যে সোভিয়েত বিদেশনীতি তুলে ধরা হয়েছে তা বড়ই সেকেলে, ব্রেজনেভের নীতির সঙ্গে তার কোনও সাযুজ্য নেই।

    অতএব?

    আর কী, নটে গাছটি মুড়ল। সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকে থাকতে-থাকতে সেই বিশাল ভূখণ্ডের মানুষ স্টার্লিং বা লিরাদের বড় পর্দায় দেখার সুযোগ পাননি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর নব্বইয়ের দশকে মস্কোয় কিছুদিনের জন্য মুক্তি পেয়েছিল সিনেমাটি, আদপেই সাড়া জাগাতে পারেনি। কেজিবি সেকেলে বলে নিষেধাজ্ঞা জারি করার কয়েক মাসের মধ্যেই ল্যুবভ অরলোভাও মারা যান। গ্রিগরি আলেকসান্দ্রোভ আর একটিই সিনেমা বানিয়েছিলেন, তাঁর প্রয়াত স্ত্রী অরলোভাকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র। ‘সেকেলে’ শব্দটি একটি গভীর ট্র্যাজেডির সঙ্গে অনুরণিত হয়েছিল গ্রিগরি আর অরলোভার জীবনে। 

    ভালবাসা-ঈর্ষা, সাফল্য-ব্যর্থতা, অ্যাকশন-ট্র্যাজেডি, সোভিয়েত থ্রিলারের ইতিহাসেই যা নাটকীয়তা, খান কয়েক থ্রিলার তো লিখে ফেলাই যায়। কেজিবি-র টাকাটুকুই যা পাবেন না!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook