সত্যজিৎ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, কলকাতা ছাড়লে হয়তো তাঁর সৃজনশীলতায় ভাঁটা পড়তে পারে, অতএব হাজার অসুবিধে সত্ত্বেও কলকাতা শহর ছেড়ে কাজ করার কথা তিনি কোনওদিনও ভাবতে পারেননি। শহরের প্রতি ঐকান্তিক টানের এ এক বড় স্বীকৃতি। স্বাভাবিক ভাবেই কলকাতা শহরের ইতিহাসকেও তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। ইতিহাসের প্রতি এই অনুসন্ধিৎসা বিশেষ ভাবে কাজেও এসেছিল রবীন্দ্রনাথের ওপর তথ্যচিত্র অথবা ‘দেবী’ কিংবা ‘চারুলতা’র মতো পিরিয়ড-ফিল্ম বানানোর সময়। অন্যদিকে এই কাজের সূত্র ধরেই পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চাটা আরও সিরিয়াস আকার ধারণ করেছিল। সত্যজিতের পুরনো কলকাতার প্রতি অনুরাগের একটা নিদর্শন হয়ে আছে ১৯৭৭-এর ‘দেশ’ পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত ‘গোরস্থানে সাবধান’ নামক ফেলুদা-কাহিনিটি। এই উপন্যাসের মাধ্যমে সত্যজিৎ সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর এই পুরনো কলকাতার প্রতি ভাললাগাটা আরও অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। অনেকটা যেরকম তোপসের জানা ও শেখা ফেলুদার হাত ধরে, সেরকমই বহু পাঠকেরও কলকাতার ইতিহাসের প্রথম পাঠ ‘গোরস্থানে সাবধান’-এর পাতায়। তোপসে বা ফেলুদার ক্ষেত্রে এই শেখাটা অবশ্য শুধু বইয়ের পাতা ঘেঁটে হয়নি। তোপসের বয়ানে বলতে গেলে ‘ফেলুদার লেটেস্ট নেশা হলো পুরনো কলকাতা… গত তিন মাসে এই নিয়ে কত বই পড়েছে, ম্যাপ দেখেছে, ছবি দেখেছে তার ইয়ত্তা নেই। অবিশ্যি এই সুযোগে আমারও অনেক কিছু জানা হয়ে যাচ্ছে, আর তার বেশিরভাগটাই হয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দুটো দুপুর কাটিয়ে।’ তোপসের লেখনীতে সত্যজিৎ স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, কলকাতার ইতিহাসচর্চা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি কলকাতারই এই প্রতিষ্ঠানটিকে উপেক্ষা করা হয়। সত্যজিৎ নিজে বিশেষ ভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন ভিক্টোরিয়ার সংগ্রহশালাতে কাজ করতে গিয়ে। সেই মুগ্ধতারই কিছুটা প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ‘গোরস্থানে সাবধান’ উপন্যাসে। ঘটনাচক্রে এ-বছর শুধু সত্যজিৎ রায়ই নয়, কলকাতা শহরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই স্মৃতিসৌধটির শতবর্ষ। মহারানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিতে লর্ড কার্জনের পরিকল্পিত এই প্রতিষ্ঠানটির দরজা ১৯২১-এর ২৮ ডিসেম্বর জনসাধারণের জন্যে খুলে দেওয়া হয়। সেই উপলক্ষেই এই পরিসরে আমরা চেষ্টা করব সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ঐতিহাসিক সংগ্রহের যোগসূত্রটি খুঁজে দেখার।
সত্যজিৎ রায়কে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সংগ্রহের ওপর বিশেষ ভাবে নির্ভর করতে হয়েছিল ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ চলচ্চিত্রের জন্যে তথ্যসংগ্রহ করতে গিয়ে। বিজয়া রায় ‘আমাদের কথা’তে এক জায়গায় জানাচ্ছেন যে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সত্যজিতকে নিরাশ করেনি, যা যা রেফারেন্স আশা করেছিলেন তিনি ভিক্টোরিয়াতে পাবেন সবই পেয়ে গিয়েছিলেন। এরপরে তিনি একদিন ভিক্টোরিয়াতে শুটিংও করেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা উঠে এসেছে ‘আমাদের কথা’র পাতায়। ‘এর পর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে শুটিং হল। এত দিন কলকাতায় আছি, খালি বাগানটায় ঘুরে বেড়িয়েছি, ভেতরে কোনও দিন যাইনি। এ বার দেখে তাক লেগে গেল। তবে এতবড় জায়গা, মাত্র একদিন দেখে শেষ করা যায় না। ফ্যান্টাসটিক অ্যান্ড ফ্যাসিনেটিং।’ সত্যজিতের মতো বিজয়া রায়ের লেখাতেও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সংগ্রহের প্রতি সেই একই মুগ্ধতার রেশ লক্ষ করা যায়।
তবে বিজয়া রায়ের স্মৃতিকথা থেকে স্পষ্ট হয় না যে, সত্যজিৎ রায় ঠিক কোন রেফারেন্সের খোঁজে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে কেনই বা শুটিং-এর প্রয়োজন পড়েছিল? এর উত্তর খুঁজতে হবে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ সিনেমার খেরোর খাতার পাতায়। কীভাবে ধাপে-ধাপে সত্যজিৎ একটি ছবির পরিকল্পনা করতেন সেটা বোঝার জন্যে এই খেরোর খাতাগুলির মূল্য অপরিসীম। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ সংক্রান্ত নোটস, পরিকল্পনা, চিত্রনাট্যের খসড়া দুটি খেরোর খাতা জুড়ে ছড়ানো রয়েছে। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ শুধু পিরিয়ড-ফিল্মই না, বলা যেতে পারে সত্যজিতের প্রথম ও একমাত্র ছবি, যা ঐতিহাসিক পটভূমিকায় নির্মিত। ফলে সেই সময়টিকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপন করতে সত্যজিতের যে ব্যাপক পরিমাণ গবেষণার প্রয়োজন হয়েছিল তার নিদর্শন হয়ে আছে এই খাতাদুটো। এই খাতা থেকেই জানা যাচ্ছে, সত্যজিৎ আউটডোরে পাড়ি দেওয়ার ঠিক আগে, ১৯৭৭-এর ৪ এপ্রিল ভিক্টোরিয়াতে শুটিং করেন। উনি মূলত চলচ্চিত্রে ব্যবহারের জন্যে বেশ কয়েকটা চিত্রের ছবি তুলেছিলেন ভিক্টোরিয়াতে। শেষপর্যন্ত অবশ্য চলচ্চিত্রে দুটো ছবি দেখানো হয়েছিল। এই ছবিগুলো দেখানো হয়েছিল চলচ্চিত্রের একদম গোড়াতে, যেখানে অমিতাভ বচ্চনের ভাষ্য ও বিভিন্ন ছবি এবং অ্যানিমেশনের মাধ্যমে অযোধ্যা বা লখনউর ঐতিহাসিক পটভূমিটি দর্শকের সামনে তুলে ধরা হয়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সংগ্রহ ও তার ইতিহাস নিয়ে একটা প্রাথমিক ধারণা গড়ে তোলার মাধ্যম হতে পারে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’তে ব্যবহৃত এই ছবি কয়েকটা।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সংগ্রহ থেকে প্রথম ও প্রধান যে-ছবিটি সত্যজিৎ ব্যবহার করেছিলেন ওই সিনেমায়, সেটা হল ইংরেজ শিল্পী টিলি কেটল অঙ্কিত ‘Shuja-ud-daula, Nabob Vizier of Oude, with his Four sons, and General Sir Robert Barker, with his staff’। ব্রিটিশ যুগের সূচনায় যে-সমস্ত ইংরেজ শিল্পী ভাগ্যান্বষণে ভারতে এসেছিলেন, টিলি কেটল তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রথম। কেটল প্রথমে মাদ্রাজ ও কলকাতার মতো ইংরেজপ্রধান শহরে মনোনিবেশ করলেও ১৭৭১-এ তৎকালীন ফোর্ট উইলিয়ামের প্রধান জন কার্টিয়েরের সুপারিশ নিয়ে অযোধ্যার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। অযোধ্যার রাজধানী তখনও ফৈজাবাদে, লখনউর উদয় হতে আরও কয়েক বছর দেরি। যদিও অযোধ্যা ততদিনেই ইংরেজ আধিপত্যের আঁচ পেতে শুরু করেছে। ১৭৬৫-তে বক্সারের যুদ্ধে পরাজয়ের পর নবাব সুজাউদ্দৌলার প্রতিপত্তি অনেকটাই সঙ্কুচিত। সুজাউদ্দৌলাকে ইংরেজদের ‘বন্ধুত্ব’-এর দাম চোকাতে হয়েছে বারবার, কখনও আর্থিক ক্ষতির মাধ্যমে, কখনও-বা রাজ্যের অংশবিশেষ ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়ে। এরকমই এক বন্ধুত্বের উপঢৌকন তুলে দেওয়ার মুহূর্ত ধরা আছে টিলি কেটলের এই ছবিটিতে। ছবিটি আঁকা হয়েছিল ইংরেজ প্রতিনিধি স্যর রবার্ট বার্কারের উৎসাহে আনুমানিক ১৭৭২-এ। অযোধ্যার প্রতি ইংরেজদের এই বন্ধুত্বের দ্বিচারিতার এক আদর্শ নিদর্শন হিসেবে সত্যজিৎ, সুজাউদ্দৌলা ও স্যর রবার্ট বার্কারের হাত ধরার মুহূর্তটি সিনেমায় তুলে ধরেন। টিলি কেটল ফৈজাবাদে অবস্থানকালীন সুজাউদ্দৌলার আরও দুটি ছবি এঁকেছিলেন, যা বিশ্বের ভিন্নপ্রান্তে দুটি সংগ্রহশালায় রক্ষিত। বিভিন্ন হাত ঘুরে এই বিশেষ ছবিটির মালিক হন বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহাতাব বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। ছবিটি বেশ কিছু বছর টাঙানো ছিল বর্ধমান রাজবাড়িতে। অবশেষে চারের দশকে ছবিটি বর্ধমান রাজপরিবারের পক্ষ থেকে দান করা হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সংগ্রহালয়ে।
সত্যজিৎ ভিক্টোরিয়াতে তোলা অপর যে-চিত্রটি ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন, সেটি হল রবার্ট হিউমের (যদিও ইংরেজি বানান Home, উচ্চারণ হল হিউম) আঁকা বাদশাহ গাজীউদ্দিন হায়দারের একটি প্রতিকৃতি। গাজীউদ্দিন হায়দার অযোধ্যার তখ্তে আসীন হন সুজাউদ্দৌলার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে, ততদিনে দেশে ও অযোধ্যায় দুটি বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। প্রথমত, অযোধ্যার রাজধানী ফৈজাবাদ থেকে লখনউতে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং দেশে ততদিনে ইংরেজদের প্রাধান্য প্রায় সর্বত্রই স্বীকৃত। গাজীউদ্দিন নিজেও ছিলেন ইংরেজদের আনুকূল্য ও সমর্থনের ওপর একান্ত ভাবেই নির্ভরশীল। লখনউর চাকচিক্যে যদিও কোনও ভাঁটা পড়েনি। বরং লখনউর চরম উৎকর্ষের সময় এই বছরগুলিই। ভাঁটা পড়েনি বিভিন্ন বিদেশি ভাগ্যান্বেষীদের আগমনেও। রবার্ট হিউম যদিও লখনউতে এসেছিলেন স্বয়ং বাদশাহের আহ্বানেই। গাজীউদ্দিনের রাজত্বকালে হিউম টানা ১৩ বছর ধরে ছিলেন অযোধ্যার সভাশিল্পী। ১৭৯০ থেকে তিনি ভারতের বিভিন্ন শহরে থেকে শিল্পচর্চা করে গেছেন। ১৮০২ থেকে ১৮০৪ পর্যন্ত কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সচিবের দায়িত্বও সামলেছেন। হিউমের আঁকা শিল্পনিদর্শন এখনও ছড়িয়ে আছে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। লখনউতে থাকাকালীন হিউমের এই বিপুল অভিজ্ঞতা খুবই কাজে এসেছিল। সেখানে তিনি কেবল চিত্রাঙ্কনই করেননি, অযোধ্যার নবাবদের জোড়া মাছ সম্বলিত রাজপ্রতীক থেকে রাজমুকুট সবই তাঁর নকশার ভিত্তিতে করা। সেই রাজমুকুট, যা পরবর্তীতে ওয়াজেদ আলি শাহ ১৮৫১ সালে লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেস অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে পাঠিয়েছিলেন। হিউম বাদশাহ গাজীউদ্দিনের তিনটি প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন, যার মধ্যে একটি বছর কয়েক আগে লন্ডনে নিলাম হয়। দ্বিতীয় ছবিটি ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের সংগ্রহে রক্ষিত এবং তৃতীয়টি আছে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। এই তৃতীয় ছবিটিও বহু বছর ধরে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সংগ্রহে হ্যাম্পটন কোর্ট প্রাসাদে ছিল। ১৯২১-এ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের উদ্বোধনের সময়ে রাজপরিবারের তরফ থেকে তা ভিক্টোরিয়াতে দান করা হয়। ভিক্টোরিয়ার সংগ্রহে হিউমের আরও বেশ কিছু ছবি আছে, যার মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য টমাস ও উইলিয়াম ড্যানিয়েলের প্রতিকৃতিটি।
সত্যজিতের খেরোর খাতা থেকে জানা যায় যে, তিনি আরও দুটি চিত্রের ছবি তুলেছিলেন। কিন্তু সিনেমায় সেই চিত্রদুটি দেখাবার সুযোগ ঘটেনি। এর মধ্যে একটি ছবির বিষয়বস্তু হল ‘লখনউতে নবাব আসফউদ্দৌলা ও বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের সাক্ষাৎ’, শিল্পী যোহান জোফানি। দ্বিতীয় ছবিটি জোফানিরই আঁকা ‘Colonel Mordaunt’s Cock-Match’-র ভিত্তিতে করা একটি এনগ্রেভিং। যে ক’জন ইংরেজ শিল্পী ভারতে কিছুটা সময় কাটিয়ে শিল্পচর্চা করেছিলেন, জোফানি নিঃসন্দেহে ছিলেন তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক প্রতিষ্ঠিত। জোফানি ভারতবর্ষে আসেন টিলি কেটলের কয়েক বছর পরে, অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে। ভারতে পদার্পণের বছরখানেকের মধ্যেই তিনি লখনউ শহরে ঘাঁটি গাড়েন এবং তৎকালীন নবাব আসফউদ্দৌলা ও ফরাসি সেনাধ্যাক্ষ ক্লদ মার্তিনের পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি আঁকেন। চাঁদনি রাতে হেস্টিংসের সঙ্গে নবাবের সাক্ষাতের দৃশ্যটি, ১৭৮৪-তে হেস্টিংসের লখনউ সফরের সময় আঁকা। কর্নেল মোরদ্যান্ট আয়োজিত মোরগের লড়াইয়ের বিখ্যাত ছবিটি আঁকা সম্পূর্ণ হয়েছিল বছর চারেক পরে। বহু চরিত্রবিশিষ্ট, নাটকীয় এই ছবিটি পরবর্তী সময়ে শিল্প ও ঐতিহাসিক মহলের বিশেষ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মূল ছবিটি বর্তমানে রক্ষিত আছে লন্ডনের টেট চিত্রশালায়, ভিক্টোরিয়াতে আছে মূল ছবি থেকে করা একটি এনগ্রেভিং। আব্দুল হালিম শারার তাঁর বিখ্যাত স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন যে, মোরগ ও অন্যান্য পশুপক্ষীর লড়াই নবাবি পৃষ্ঠপোষকতায় লখনউ শহরে এক আলাদা জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছবিতেও লখনউ শহরের চরিত্র তুলে ধরতে সত্যজিৎ এক জায়গায় মোরগের লড়াইয়ের দৃশ্য ব্যবহার করেছেন। হয়তো সেই দৃশ্যটি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার কারণেই জোফানির আঁকা এই বিখ্যাত চিত্রটি রেফার করার দরকার হয়ে পড়েছিল। বর্তমানে জোফানির আঁকা অন্তত আটটি ছবি আছে কলকাতা শহরে। এর মধ্যে সেন্ট জনস চার্চে রক্ষিত ‘লাস্ট সাপার’-এর ছবিটি বাদ দিলে বাকি সব ক’টা ছবি আছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সংগ্রহে।
একুশ শতকে দাঁড়িয়ে অবশ্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে রক্ষিত ইংরেজ আমলের সূচনায় আঁকা এই চিত্রগুলি আর প্রশ্নহীন মুগ্ধতার চোখে দেখা সম্ভব নয়। মূলত লর্ড কার্জনের উৎসাহে গড়ে ওঠা এই শিল্পসংগ্রহের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। এই চিত্রসমূহে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গরা অনেকেই ছিলেন ভারতে সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণের কুশীলব। এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রেই এই ছবিগুলি প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দোষে দুষ্ট। এই প্রাচ্যবাদ বা ওরিয়েন্টালিজমের সীমাবদ্ধতা বা সমস্যার কথা সত্যজিৎ নিজেও বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আন্ডার ওয়েস্টার্ন আইজ’ প্রবন্ধে। এতদ্সত্ত্বেও এ-কথা বলতেই হয় যে, বর্তমান সময়েও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের চিত্র সংগ্রহের গুরুত্ব কোনও ভাবেই হ্রাস পায়নি। বরং বলা যেতে পারে নতুন ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির আঙ্গিক থেকে এই ছবিগুলি এক অন্য গুরুত্ব লাভ করেছে। একটা সময়ের দলিল হিসেবেও এই ছবিগুলির অপরিহার্যতার কথা সত্যজিৎ নিজেই উল্লেখ করেছিলেন বার্ট কার্ডুল্লোকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে। সত্যজিৎ কার্ডুল্লোকে জানিয়েছিলেন, তাঁর বিশেষভাবে পছন্দ ছিল ড্যানিয়েল কাকা-ভাইপো, টমাস ও উইলিয়াম এবং উইলিয়াম হজেসের আঁকা সমসাময়িক ভারতের ল্যান্ডস্কেপ ও প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের ছবি। এমনকী এই ইংরেজ শিল্পী-অভিযাত্রীদের ওপর চলচ্চিত্র বানানোর ইচ্ছেও তিনি প্রকাশ করেছিলেন। ঘটনাচক্রে এই ড্যানিয়েলদের আঁকা ছবির সবথেকে বড় সংগ্রহ রয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালেই। শুধু ড্যানিয়েল বা অন্যান্য ইংরেজ শিল্পীই নন, সমসাময়িক ভারতীয় শিল্পীদেরও শিল্পকীর্তির অনেকটাই রয়েছে ভিক্টোরিয়াতে। নানা কারণবশত কলকাতা শহরের সম্পদ এই সংগ্রহের অনেক ছবিই এই মুহূর্তে চাক্ষুষ দেখা সম্ভব নয়। আশা রাখা যায় শতবর্ষের এই মুহূর্তে অন্তত কিছু ছবি আবার জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
ছবি সৌজন্যে: লেখক