আমি থাকি সাহেবপাড়ায়। জন্মাবধি। ছোটবেলায় বড় দুঃখ ছিল ওই পাড়া নিয়ে। এখানে কোনও পুজো হয় না। না সরস্বতী পুজো, না লক্ষ্মী পুজো, না দুর্গা পুজো। খুব আক্ষেপ করতাম সারা বছর। কিন্তু শীতকাল, অর্থাৎ ডিসেম্বর মাস ছিল আমার উৎসবের মাস। আমার পাড়া তখন মেতে উঠত খ্রিস্টপুজোয়। আর তখন আমার বাড়িতে আসতে চাইত আমার বন্ধুরা। আর আমি superiority complex-এ ভুগতাম। কারণ আমি থাকি পার্ক স্ট্রিটের দক্ষিণে।
আমার যখন ছোটদিন অর্থাৎ যখন বুঝতে শিখেছি অথচ বুঝদার হয়ে উঠিনি, সেই সময় ভারি দ্বন্দ্বে ভুগতাম। শীতকালকে বা ক্রিসমাসকে বড়দিন বলা হয় কেন? এ-সময়ে তো দিনটা ছোট! আর সেটাই দুঃখ, কারণ আনন্দ করার সময়টা কম। সে যাই হোক, খ্রিস্টমাস এলেই আমি কোনও-না-কোনও ভাবে আমার পাড়ার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বন্ধুদের সঙ্গে ভিড়ে যেতাম। ওরা ক্যারল প্র্যাক্টিসে যেত, আমিও থাকতাম। শুধু ‘জিঙ্গেল বেল্স’ নয়, ‘হার্ক দ্য হেরাল্ড’, ‘সাইলেন্ট নাইট’, ‘ফার্স্ট নোয়েল’, ‘সান্তা ক্লজ ইস কামিং টু টাউন’— একের পর এক গান গাইতাম ওদের সঙ্গে। ওরা দল বেঁধে চার্চ থেকে ক্রিসমাসের তিন-চারদিন আগের থেকে বাড়ি-বাড়ি ক্রিসমাস ক্যারল শুনিয়ে যেত। আমি যেখানে থাকি তার কাছাকাছি চার-পাঁচটি চার্চ রয়েছে। ক্রিসমাস ইভে অর্থাৎ ২৪ তারিখ যেতাম একটি চার্চে মিডনাইট মাসের জন্য। সবাই মিলে একসঙ্গে গান গাওয়া, শান্তির জন্য প্রার্থনা করা… খুব ভাল লাগত। আমি ছিলাম উচ্ছ্বল। দুর্গা পুজোর ঢাক ও জাঁকজমক যেমন পছন্দ ছিল, ক্রিসমাস ইভের নৈঃশব্দ্যের মধ্যে গান ততটাই টানত। ধীরে-ধীরে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায় চলে যেতে থাকে দেশ ছেড়ে। আমার টিনেজের বন্ধু— জেনিংস, লোবো, সোয়ারেস পরিবার-সহ হয়ে গেল দেশছাড়া। আমি আর ক্যারল গাই না। বাড়ি-বাড়ি আর আজকাল কেউ ক্যারল গাইতে আসে না।
ক্রিসমাসের পর পরই এদের সঙ্গেই যেতাম ঘোড়দৌড়ের মাঠে। শীতের সোনালি দুপুরে বেটিং করা বা জুয়া খেলা উদ্দেশ্য ছিল না। আমরা মেয়েরা নানান রকম বিদেশি আউটফিট পরে, হাই বুটস পরে, মাথায় টুপি দিয়ে যেতাম ঘোড়া দেখতে এবং একটু ছেলেদেরও দেখতে। রেসের মাঠে ১৮ বছরের আগে যাওয়া মানা ছিল। সে-সময় আমরা ১৬ থেকেই ১৮ সেজে যেতাম। তখন তো আর আইডি, আধার কার্ড ইত্যাদি ছিল না। মেক-আপেই ১৬ বছর অনায়াসে ১৮ হয়ে যেত! RCTC-র মেম্বার ছিলেন বাবা, তাই পেতেন দুটো লেডিস ব্যাজ। বাবা বলতেন একটা বউয়ের জন্য, একটা বান্ধবীর জন্য। আমরা দুই বোন যেতাম বাবার বান্ধবীদের বা মা’র যাওয়া বন্ধ করে। রেসের মাঠে ফুলের বাহার, মহিলাদের পোশাক, পুরুষদের পরিপাটি চেহারা, বেটিংয়ের উত্তেজনা, ট্রেনার ও জকিদের কথাবার্তা ও পোশাক এবং সবশেষে বিকেলের চা-কফি, স্যান্ডউইচ, মাফিন ও croissant সমেত খাওয়া-দাওয়া আজও ভুলিনি। আর ভুলিনি ছেলেদের সঙ্গে চোখাচোখি, তারপর আলাপ। খুব ভদ্র ছিল সেই বন্ধুত্বের শুরুয়াত। ওই মাঠে সদস্যদের ছোট পরিসরে সবাই সবাইকে লতায়-পাতায় চিনত। তাই কাউকে পছন্দ হলে কেউ-না-কেউ আলাপ করিয়ে দিত। আমার এক কলেজের বান্ধবী প্রেম করত, ইয়ং-ড্যাশিং বিজয় মালিয়ার সঙ্গে। রেসকোর্সে ওদের একসঙ্গে দেখে বেশ হিংসে হত।
নতুন বছরের আগের দিন এখানে চলত গান, নাচ, হাসি, ঠাট্টা ও উচ্চগ্রামের মিউজিক। নাচের মিউজিক। ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা, বিটল্স, এলভিস প্রেসলি থেকে হ্যারি বেলাফন্টে, টম জোন্স, রোলিং স্টোনস। শেষ রাতে বেজে উঠত ডোর্স। এখনও সারারাত নাচানাচি হয়। এখন ইংরেজির সঙ্গে বাজে হিন্দিও। নতুন বছর উদযাপন এখন অনেক বেশি বাঙালি বা ভারতীয়।
এখনও রেসিং হয়, কিন্তু ওর সেই পুরনো গ্ল্যামার আর নেই। এখন শুধুই জুয়া। অন্তত আমার জন্য।
ইংরেজি নতুন বছর ছিল আরেক আকর্ষণ। ক্রিসমাসের সময় থেকে আলো জ্বলত পার্ক স্ট্রিটে । সেই আলোর রোশনাই কম ছিল কিন্তু আন্তরিকতা বা উষ্ণতা ছিল বেশি। তাছাড়া ভিড়ও কম হত। যদিও আমার বন্ধুরা তখন আলো দেখতে, রেস্টুরেন্টে খেতে আসত এ-পাড়ায়। সেই ট্র্যাডিশন এখনও আছে কিন্তু ভিড়, জাঁকজমক অনেক বেড়েছে।
আমার বাড়ির পাশে কলকাতার অন্যতম বড় ক্লাব Saturday ক্লাব। নতুন বছরের আগের দিন এখানে চলত গান, নাচ, হাসি, ঠাট্টা ও উচ্চগ্রামের মিউজিক। নাচের মিউজিক। ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা, বিটল্স, এলভিস প্রেসলি থেকে হ্যারি বেলাফন্টে, টম জোন্স, রোলিং স্টোনস। শেষ রাতে বেজে উঠত ডোর্স। এখনও সারারাত নাচানাচি হয়। এখন ইংরেজির সঙ্গে বাজে হিন্দিও। নতুন বছর উদযাপন এখন অনেক বেশি বাঙালি বা ভারতীয়। এখন আর এটা ইঙ্গবঙ্গ সমাজের একচেটিয়া লীলাখেলা নয়। সর্বজনীন। ক্রিসমাস বা নতুন বছরেও উপহার, কেক, ওয়াইন দেওয়া-নেওয়ার রেওয়াজ ছিল। কেক আসত ফ্লুরিস থেকে বা মধ্যবিত্তের জন্য ছিল নাহুম, ডিগামা, সালধনা। আর বাঙালিপাড়ায় জোগান দিত জলযোগ। ফ্লুরিসের কেকের উপরে থাকত মারজিপ্যানের আবরণ। আর ভিতরে ক্রিসমাস কেক। ছোটবেলায় কেকের চেয়ে বেশি পছন্দ করতাম কিটকিটে মিষ্টি আইসিং। আর এখন আইসিং ছাড়া কেকই ভাল লাগে।
পয়লা জানুয়ারিতে সারারাত নাচানাচির পর একটা ট্র্যাডিশন ছিল বৌবাজারের চিনেপাড়ায় গিয়ে ব্রেকফাস্ট খাওয়া। এখন ট্যাংরা আরও বেশি সবার রসনায় জায়গা করে নিলেও, বৌবাজারের বিগমামার বিশাল অ্যালুমিনিয়াম ডেকচিতে করে নাম-না-জানা শূকর মাংস দিয়ে নানান খাবার খাওয়া হত ভোর ছ’টায়। আমিও খেতাম গপগপিয়ে। কিন্তু দিন পালটেছে, এখন আমি নিরামিষাশী!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র