ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ভারতের আত্মার চিত্রকর


    লেভন আরোনিয়ান (Levon Aronian) (December 4, 2021)
     

    ভারতের প্রতি টান সেই ছোটবেলা থেকেই। জুনিয়র টুর্নামেন্টে ভারতের বহু খেলোয়াড়ের সঙ্গে দেখা হত, আর ১৯৯২ সালে ১০ বছরের কম বয়সের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সময় সূর্যশেখর গাঙ্গুলির সঙ্গে খেলেছি। এখন তো আমরা বন্ধু। তবে তখন ভারতকে মনে হত অনেক দূরবর্তী আর আশ্চর্য অচেনা। যদিও আমাদের আর্মেনিয়ার সঙ্গে ভারতের অনেক জায়গায় মিল আছে, যেমন ভারতের ভাষা আর আমাদের ভাষার আদি উৎস হল সংস্কৃত। তবু ভারতকে ভাবতাম একদম সম্মোহক একটা জায়গা। আমার যখন ১৭-১৮ বছর বয়স, তখন ঠিক করলাম, ভারতীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য সম্পর্কে আরও একটু জানব। সেই সময়েই আমি সত্যজিৎ রায়ের ম্যাজিক আবিষ্কার করি।

    আমার যখন ১৯ বছর বয়স, তখন গোয়াতে একটা টুর্নামেন্টে খেলতে এসেছিলাম। গোয়া এমন একটা অদ্ভুত জায়গা, যেখানে পশ্চিমি সংস্কৃতি আর ভারতীয় ঐতিহ্যের আশ্চর্য মিশেল রয়েছে। ভারতের সঙ্গীত, বিশেষ করে রবিশঙ্করের সেতার শুনে প্রথম আমি ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হই। তার পর শুনি নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতার। পরে আস্তে-আস্তে বুঝলাম ভারতীয় সঙ্গীতের দর্শনের মধ্যে গভীর আধ্যাত্মিকতা রয়েছে। তখনকার কালের সোভিয়েত ইউনিয়নের একটা ছোট্ট ছেলে হয়ে আমি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পড়ে ফেলেছি। আসলে রবীন্দ্রনাথও আমাদের দেশে খুবই বিখ্যাত।  

    পাশ্চাত্যের মানুষজন ভারতীয় সিনেমার গভীরতাটা ঠিক বোঝে না। তারা কেবল বলিউডের ঝকমকে নাচগানকেই ভারতীয় সিনেমা হিসেবে জানে। অবশ্য যদি কেউ বিশদে এবং গভীরে জানতে চায়, তাহলে বহু মণিমুক্তোর সন্ধান পাবে, যার সেরা রত্নটি সত্যজিৎ রায়।

    আমার সিনেমা খুবই ভাল লাগে। এশীয় সিনেমা সম্পর্কে নিয়মিত খবর রাখি, বিশেষত জাপানি সিনেমা। আমি জাপানি পরিচালক কেনজি মিজোগুচি এবং ইয়াশুজিরো ওজুর খুবই ভক্ত। ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে এই দুজন ছাড়াও অবশ্য আরও অনেক বিখ্যাত জাপানি পরিচালক কাজ করেছেন। আমি কুরোসাওয়াকেও খুবই শ্রদ্ধা করি, কিন্তু ওজু আর মিজোগুচির সিনেমায় জাপানি সংস্কৃতির ছাপ অনেক বেশি। এই দুই পরিচালকের সব সিনেমা আমার দেখা। এবং তাঁদের মুনশিয়ানা এতটাই যে, সিনেমাগুলো দর্শককে চুম্বকের মতো টেনে রাখে। কুরোসাওয়ার সিনেমা দুর্দান্ত, তীব্র, বলিষ্ঠ, কিন্তু আমি যে খাঁটি জাপানি সংস্কৃতি খুঁজি, সেটার অভাব আছে। তাঁর সিনেমাকে আমার মনে হয় অনেক বেশি পাশ্চাত্যধর্মী।

    সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, তাঁর ছবি খাঁটি ভারতীয়। এখানকার মানুষের রোজকার জীবনযাপনের খুঁটিনাটি সত্যজিতের সিনেমায় যে ভাবে দেখা যায়, সেটাই তাঁর সিনেমাকে আরও অনন্য করে তোলে। দর্শককে তুষ্ট করার দায় তাঁর নেই। সত্যজিৎ অপুর গল্প বলার সময় কিন্তু দর্শককে খুশি করতে চাননি। যেমন ধরা যাক, ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমায় সর্বজয়া যখন ইন্দির ঠাকরুনকে কর্কশ ভাষায় কথা শোনাচ্ছেন, তখন মনে হয় সর্বজয়া খুব নিষ্ঠুর এবং ইন্দির ঠাকরুনের প্রতি অন্যায় আচরণ করছেন। সর্বজয়া যেন ইন্দির ঠাকরুনকে তাড়াতে পারলেই বাঁচেন এবং দর্শকের কাছে সেটা খুব অমানবিক ব্যবহার মনে হচ্ছে। কিন্তু সিনেমা যত এগোচ্ছে, তত বিভিন্ন পরিস্থিতি দর্শকের সামনে উঠে আসছে, আর বোঝা যাচ্ছে দারিদ্রের সঙ্গে সারাক্ষণের লড়াই সর্বজয়াকে কঠিন আর নিষ্ঠুর করে তুলেছে। পরিচালক যদি চাইতেন দর্শকরা খুশি হোক, তাহলে সর্বজয়ার হৃদয়-পরিবর্তন দেখাতেন। কিন্তু সত্যজিৎ তা করেননি, তিনি সিনেমার প্রতি সৎ থেকেছেন, তাতে যদি কাহিনি বা চরিত্রকে দর্শকের অপছন্দ হয়, তবে হোক। ছবির কোনও জায়গায় কোনও চরিত্রের অনুভূতি বা কোনও পরিস্থিতিকে উঁচু-তারে বেঁধে অতিনাটকীয় করা হয়নি। সিনেমায় হরিহরকে একেবারে অপদার্থ একজন মানুষ মনে হয়। নিজের ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব ঠিক করে নিতে পারেন না। কিন্তু গল্প এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝতে পারি, তাঁর চেষ্টার ত্রুটি নেই, তিনি একজন শিক্ষিত ব্রাহ্মণ, যিনি প্রাণপণে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন। মুশকিল হল, তিনি এমন এক এঁদো জায়গায় থাকেন, যেখানে তাঁর শিক্ষার কোনও কদর নেই। তাই তাঁকে বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে রোজগার করতে হয়। দুর্গার মৃত্যুর জন্য কাউকেই সরাসরি দায়ী করা যায় না, কিন্তু দুর্গার মৃত্যু অত্যন্ত মর্মান্তিক।

    সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, তাঁর ছবি খাঁটি ভারতীয়। এখানকার মানুষের রোজকার জীবনযাপনের খুঁটিনাটি সত্যজিতের সিনেমায় যে ভাবে দেখা যায়, সেটাই তাঁর সিনেমাকে আরও অনন্য করে তোলে। দর্শককে তুষ্ট করার দায় তাঁর নেই। সত্যজিৎ অপুর গল্প বলার সময় কিন্তু দর্শককে খুশি করতে চাননি।

    ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’ সিনেমায় আমরা অপুর নিষ্ঠুর স্বভাবও দেখতে পাই। অপুর ছোটবেলার সব দুঃখ-কষ্টের স্মৃতি তার ওপর এতটাই প্রভাব ফেলে যে, সে আর তার নিজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় না। ‘অপরাজিত’ ছবিতে সে তার মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতে চায় না, গ্রামে আর থাকতে চায় না। আর ‘অপুর সংসার’-এ অপু তার নিজের ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চায় না। 

    এটা মনে রাখতে হবে, পরিচালক দর্শককে ছোট বাচ্চা হিসেবে দেখছেন না, কিছু গিলিয়ে দিচ্ছেন না, তিনি কেবল গল্পটা বলছেন এবং দর্শককে বাস্তবের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন, যাতে দর্শক নিজেই চরিত্রটাকে বুঝে নেন। সিনেমায় এই যে স্বাভাবিক অনুভূতি তুলে ধরা, এটাই এশিয়ার পরিচালকদের বৈশিষ্ট্য। এই চরম বাস্তব আর স্বাভাবিক অনুভূতির উপস্থিতিটাই অমূল্য। 

    আমার মনে হয় অপু ট্রিলজি হচ্ছে সত্যিকারের ক্লাসিক, যদিও আমি একজন দাবা খেলোয়াড় বলেই হয়তো আমায় সবাই জিজ্ঞেস করে সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ সিনেমার কথা। সত্যি বলতে কী, আমি এই সিনেমাটা দেখিনি। এই সিনেমার পোশাক-আশাক আর সেট দেখেই, সিনেমাটা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়েছিল। শুনেছি এটাই সত্যজিতের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ছবি, কিন্তু একজন দাবাড়ু হওয়া সত্ত্বেও এই সিনেমাটা আমায় কখনও টানেনি। 

    অন্য যে ছবিটা আমাকে মুগ্ধ করে, সেটা হল ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। তার মূল কারণ হল সিনেমার যুবক-যুবতী চরিত্রগুলির অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ। মেমরি গেম-এর সময় অপর্ণার (শর্মিলা ঠাকুর) নিজেকে ইচ্ছে করেই একটু গুটিয়ে রাখা, কিংবা তরুণী বিধবা জয়ার (কাবেরী বসু) প্রেমের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, সব কিছুকে দুরন্ত দক্ষতায় দেখানো হয়েছে। সঞ্জয়ের (শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়) জয়ার প্রতি তীব্র আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও যখন সে জয়ার মধ্যে একটা তীব্র কামনা দেখে, তখন নিজেকে সরিয়ে নেয়। সঞ্জয়ের মনে হয়, একজন বিধবার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করা হয়তো নীতিগত ভাবে অন্যায়।  

    একজন আর্মেনীয় হিসেবে আমি এই ধরনের মানসিকতাগুলোর সঙ্গে খুব একাত্ম বোধ করতে পারি। সিনেমায় দেখানো হয় চারজন যুবককে— উচ্চাকাঙ্ক্ষী, হামবড়া, কাজ আদায় করার জন্য দুর্নীতিকে ব্যবহার করতে এতটুকু পিছপা নয়। তারা লোক ভাল, তবে অন্যের অনুভূতির প্রতি একটু বেশিই নির্বিকার— আমি ঠিক এইরকম মানুষজন দেখেছি আমাদের দেশে। সিনেমায় চৌকিদারের স্ত্রী অসুস্থ, কিন্তু এই চারজনের তাতে কিছু এসেই যায় না। এমনকী, চৌকিদারকে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বিনা অনুমতিতে যে ওরা ডাকবাংলোয় থাকতে শুরু করে তাতে যে চৌকিদারের চাকরি যেতে পারে, এ নিয়েও তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। ভারতের জনজাতিদের সংস্কৃতি ও জীবনধারাও খানিকটা এই সিনেমায় ধরা রয়েছে, আর তাদের উৎসব দেখানোর সময় সাহিত্য বা সিনেমার একটা চেনা ছক প্রয়োগ করা হয়— কার্নিভালের সময় চরিত্রগুলোর প্রকৃত পরিস্থিতির উন্মোচন। 

    আমি প্রায় এক ডজনের ওপর সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখেছি। এবং ‘চারুলতা’র মতো আরও সিনেমা দেখতে চাই। আসলে ভাল প্রিন্ট পাওয়াটা একটা সমস্যা। ক্রাইটেরিয়ন অবশ্য সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাগুলোর চমৎকার পুনরুদ্ধার করেছে, এখন সারা বিশ্বের সিনেমভক্তদের কাছে তাঁর ছবিগুলো সহজলভ্য। 

    ভারতে অনেকেই সত্যজিৎ রায়কে ভালবাসেন, কিন্তু তাঁরা তো সত্যজিতের দেখানো দুনিয়াটাকে চেনেন-জানেন। বিদেশিরা সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখে মুগ্ধ হন একদম অন্য কারণে, বা, সাহস করে বলি, অনেক শক্তিশালী কারণে। আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে, সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার ভারতকে যদি তুলনা করি, তাহলে এত বেশি মানুষ, এত শিল্প, এত ঝাঁ-চকচকে জীবন দেখে বোঝা যায়, মাঝের দশকগুলোয় কী পরিমাণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এবং সেই কারণেই, আরও বেশি করে  সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখা উচিত। কারণ এই সিনেমাগুলোর মধ্যে ভারতের অতীত ধরা রয়েছে। ভারত যে-পথটা অতিক্রম করে আজকের ভারত হয়েছে, সিনেমাগুলো দেখলে তার ধারাটাও হয়তো বোঝা যাবে। ঠিক মার্গসঙ্গীতের মতোই, এশিয়ার অসামান্য পরিচালকরা তাঁদের দেশের চরিত্র আর আত্মাকে তাঁদের ছবিতে নিখুঁত তুলে ধরেছেন। 

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook