আমার মতো মানুষেরা বাঙালি হওয়া নিয়ে মুখ খুললেই দেশের বন্ধুরা ভয় পান। ভাবেন, ‘ওরে বাবা, আবার সেই অনাবাসীর স্মৃতিমেদুর নস্টালজিয়া! এইসব স্মৃতিকাতর মানুষদের তো বোঝানো যায় না যে, যে-দেশ ওঁরা ছেড়ে গেছেন, সে-দেশ আর নেই রে ভাই। বাঙালিও আর সে-বাঙালি নেই। তরুণ, টগবগে মধ্যবিত্ত ভারতের বাঙালি এখন হিন্দি-ইংরিজিতে ঝরঝরে, স্মার্ট ফোন আর পাসপোর্ট-ভিসা হাতে যাকে বলে রীতিমত গ্লোবাল।’ তাই প্রথমেই পরিষ্কার করে নিই, নস্টালজিয়ার কথা বলতে বসিনি। নস্টালজিয়া অস্বীকার করি না। দীর্ঘ বিদেশবাসে একটা গভীর শূন্যতাবোধ যে আমাকে কখনওই গ্রাস করে না, বা কখনওই যে নিজের মনে বলে উঠি না, ‘কিন্তু তোমার তালছড়িটা/ মেঘে মেদুর সেই যে বক্ষে বাস্তুভিটা/ যেখান থেকে বাকি জীবন করবে শুরু বলেই এলে…’— এ সব যে একেবারে হয় না, তা নয়। কিন্তু নস্টালজিয়া হল মানুষের মনের একটি অন্তর্মুখী বা পশ্চাৎমুখী দিক। বাঙালি মনের একটি অন্য দিকও থাকে। মনের একটি দিক যেমন স্মৃতিবেদনার মালা গাঁথে, অন্য একটি দিক কিন্তু বাঙালি হিসেবেই দু’হাতের আঁজলা ভরে যা অজানা, অচেনা, নতুন ও অপর তাকে গ্রহণ করে— কিছুটা বাঙালি মনের মাধুরী মিশিয়েই— তার রসাস্বাদন করতে থাকে। যে-মনের এই প্রসার ঘটে, সেই মনটাও তো বাঙালি!
এ-কথাটা সবিস্তারে নিশ্চয়ই ইতিহাসের উদাহরণ দিয়ে বলা যেত। ইংরেজ বাংলায় আসার পর তাঁর সমস্ত অপরত্ব সত্ত্বেও তাঁর ভাষা ও সংস্কৃতিকে কি আমরা— কখনও হাস্যকর ভাবে, কখনও-বা গভীর অনুসন্ধিৎসা সহকারে ও সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের সমস্ত বৈরিতার বিরুদ্ধে গিয়ে— আত্মস্থ করে নিইনি? বাংলা ভাষায় বিরামচিহ্ন থেকে শুরু করে বাক্যের গঠনের মধ্যে আমাদের জীবনের কেন্দ্রস্থলে ইংরেজিকে বরণ করে নেবার গল্প লুকোনো আছে। কিন্তু এইভাবে অপরকে গ্রহণ করে আমরা জাত তো খোয়াইইনি— দু’একজন ট্যাঁশ গরুর কথা বাদ দিন— বরং বলা যায় আবার নতুন করে, আরও প্রসারিত অর্থে বাঙালি হয়েছি। চর্যাপদ, চণ্ডীদাস (বড়ু ও দীন), বিদ্যাপতি, শাহ মুহম্মদ সগীর, আলাওল, রামপ্রসাদ, ভারতচন্দ্র, সৈয়দ সুলতান ইত্যাদিরা হারিয়ে যাননি আমাদের নতুন পড়াশুনোর জীবন থেকে, কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের আলোচনায় পাশাপাশি এসে গেছেন কালিদাস আর শেক্সপিয়র, ‘শকুন্তলা মিরন্দা ও দেসদিমোনা’, নতুন করে ভেবেছি রামায়ণ-মহাভারতকে, বা বাংলায় বৌদ্ধ, হিন্দু, ও ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য।
বলতে পারেন, সব ভাষাভাষী মানুষেরই কি এই অপরকে গ্রহণের ক্ষমতা থাকে না? থাকে নিশ্চয়ই। কিন্তু এই গ্রহণ করার প্রক্রিয়ার মধ্যেও আমাদের নিজস্ব ঐতিহাসিকতা থেকে যায়। বিদেশে বসে কথাটা সচেতন ভাবে উপলব্ধি করতে আমার সময় লেগেছিল। নিজেরই একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। সময়টা ঠিক কবে আজ আর মনে নেই, কিন্তু ২০০০ সালই হবে। তখন আমি ২৪ বছর দেশছাড়া। অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা শহরে একা-একা গাড়ি চালিয়ে ঘুরছি। গাড়ির রেডিও চলছে। লেখিকা ও ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী ভেরনিকা ব্রেডি সদ্যপ্রয়াতা নামী ও আমার প্রিয় অস্ট্রেলিয়ান মহিলা-কবি জুডিথ রাইটের (Judith Wright) জীবন আলোচনা করতে গিয়ে হঠাৎ বলে বসলেন, ‘ইউ সি, ফর জুডিথ, বিয়িং অ্যান অস্ট্রেলিয়ান ওয়াজ অ্যান ইরটিক এক্সপিরিয়েন্স!’ ভেরনিকা ব্রেডি জানবেন, তিনি জুডিথ রাইটের জীবনী-রচয়িতা। কিন্তু কথাটা শুনেই আমি চমকে উঠলাম। ব্রেডির ভাষায় কখনও ভাবিনি, কিন্তু শুনেই মনে হল, তাই তো, আমারও তো তাই, বাংলা ছাড়ার দু’ দশক— আজ চার দশকেরও বেশি— পরেও তো মনে হয় যে, আমার পক্ষেও ‘বিয়িং এ বেঙ্গলি ইজ স্টিল অ্যান ইরটিক এক্সপিরিয়েন্স।’ আমার দীর্ঘ প্রবাসী জীবনে যে-আনন্দ আহরণ করেছি, যে-দুঃখ পেয়েছি, যে-খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়েছি, আর যে-বিষণ্ণতায় ডুবেছি— সেই সব অভিজ্ঞতাতেই তো সঙ্গী ছিল আমার বাঙালি মন। বাঙালিত্বটা স্থাণু হয়ে এক জায়গায় বসে থাকেনি। তার প্রসার ঘটেছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রান্তরে ইউক্যালিপটাস গাছের বাকল-ঝরানো উদাসীন সন্ন্যাসী-সৌন্দর্য, বা শীতাতুর শিকাগো-র মিশিগান হ্রদের জলের ওপরে জমানো বরফের পুরু আস্তরণ আমার বাঙালি মনে সূর্যালোকের অন্য পরিচয় এনে দিয়েছে নিশ্চয়ই। কখনও-বা ঘটনার অভিঘাতে বাঙালি অস্তিত্ব টালও খেয়েছে। কিন্তু কী এক মন্ত্রবলে আবার সে নিজের মধ্যেই তার মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রটি খুঁজে পেয়ে ‘কাল মধুমাস’-এর মায়ের মতো নিজেকে নিজেই বলে উঠেছে, ‘জয়মণি, স্থির হও!’
এই অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই বুঝতে পেরেছি, আমাদের স্কুলজীবনে বস্টনবাসী অমিয় চক্রবর্তীর বাংলায় রচিত তাঁর মার্কিন জীবনের যেসব কবিতার রসগ্রহণ করতে পারতাম না— আমেরিকার বরফের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক তো আর ঠিক আমাদের ঔপনিবেশিক প্রভু ইংরেজের ড্যাফোডিলের সঙ্গে যে-সাহিত্যিক সম্পর্ক, তা নয়— সেই সব কবিতায় কবির লড়াইটা কী ছিল: গোটা আমেরিকাটাকেই মুড়ে ফেলতে চাইতেন কবি তাঁর বাংলা ভাষায়! জিজ্ঞেস করতে পারেন, এই অভিজ্ঞতা বা প্রচেষ্টাকে ‘ইরটিক’ বলছি কেন? বা যে-মন্ত্রশক্তির কথা বলছি, সেই মন্ত্রটাই বা কী? এই প্রশ্নের উত্তর যে-মানুষটি ভিন্ন বাঙালি সত্তার এই জীবনভোগী সম্প্রসারিত ভূমিকার বিস্তারের ইতিহাস কল্পনা করাই শক্ত, তাঁর ভাষাতেই বলি: ‘বাঙালি বাংলাদেশে জন্মেছে বলেই যে বাঙালি তা নয়। বাংলা-ভাষার ভিতর দিয়ে মানুষের চিত্তলোকে যাতায়াতের বিশেষ অধিকার পেয়েছে বলেই সে বাঙালি।’ রবীন্দ্রনাথের কথা। তাঁর ‘সাহিত্যের পথে’ গ্রন্থে সঙ্কলিত ‘সভাপতির অভিভাষণ’ প্রবন্ধটিতে আছে। ১৯২৩ সালে লেখা দুটি বাক্য, কিন্তু আজও তাদের ঔজ্জ্বল্য মলিন হয়নি। অর্থাৎ বাংলা ভাষার ভেতর দিয়ে যিনি পৃথিবীর বৈচিত্র্যের রস আহরণ করেন, অন্য ভাষাভাষীর চিত্তের সঙ্গে আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠা করেন (এখানে অনুবাদের ভূমিকা অস্বীকার করছি না)— তা স্বদেশেই হোক কি বিদেশে, তিনিই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যথার্থ বাঙালি।
আমার সত্তরোর্ধ্ব দীর্ঘ জীবনে বাঙালি চরিত্রের দোষত্রুটি যে চোখে পড়েনি, এমন তো নয় (নিজের দিকে তাকিয়েই বলছি এ-কথা)। বস্তুত গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের গোড়ার কলকাতায় আমার একাডেমিক জীবনের শুরুই হয় আমাদের অর্থাৎ হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক পুরুষমানুষের চোদ্দো গুষ্টির নিকুচি করে। তাঁরা পিতৃতান্ত্রিক, উপনিবেশের গর্ভজাত অলস পরভৃৎ মানুষ, মুসলিমবিরোধী, নীচু জাতের মানুষদের প্রতি তাঁদের চূড়ান্ত উন্নাসিক ও শোষকের মনোভাব। ফলে বামপন্থী-আমার নিজেদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল মূলত সমালোচনামূলক। আবার অন্যদিকে বিদেশি সভ্যতায় আর সাহেবি চরিত্রে মুগ্ধ হবার মতো কিছু ছিল না বা নেই, এমনও নয়। পশ্চিমি দেশগুলো একে অপরের তুলনায় আলাদা হলেও তাদের কতগুলো সাধারণ গুণ নজরে পড়ে বইকি! আমাদের তুলনায় উদ্যমী, নিয়মশৃঙ্খলাবদ্ধ, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন মানুষগুলোকে খারাপ লাগে না। ওদিকে কলকাতায় যে বাঙালিত্ব বিপন্ন, এ-কথাও বহু মানুষের কাছে শুনি। সেদিনই এক তরুণ বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে তাঁর আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে বলতে শুনলাম, কলকাতায় বাংলা ভাষার পিঠ আজ যে শুধু দেওয়ালে ঠেকে গেছে, তাই নয়, পেরেকে ঠেকে গেছে!
এসব কথা নিশ্চয়ই সত্যি। তবু আমায় যদি জিজ্ঞেস করেন সম্ভব হলে পুনর্জন্মে কী হতে চাই, আমি নির্দ্বিধায় বলব যে, যে-ভাষায় রবীন্দ্রনাথ গান বেঁধে গেছেন, যে-ভাষার গদ্য তিনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন, সেই ভাষাতেই— আমাদের ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, শ্রেণিগত, জাতিগত সমস্ত দুঃখ ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও— পৃথিবীর মায়ায় পড়েছি। আবার যদি ইচ্ছে করত, সেই ভাষাতেই ফিরে আসতে চাইতাম। বাঙালি ছাড়া অন্য কিছু হবার লোভ কোনওদিন হয়নি। আর রবীন্দ্রনাথ তো একা নন, তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন এক হাজার বছরের বাংলা-বলা, বাংলা-লেখা মানুষ এবং জীবন ও মানসিকতার সকল দৈন্য ছাপিয়ে-ওঠা তাঁদের সারস্বত সাধনা। হতেই পারে যে, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আজ সাংস্কৃতিক ভাবে দিশাহারা। তবু বলব, সহস্র বছরের সাধনার ফসল যে বহুস্বর বাঙালি সত্তা— তার অনেক দুর্বলতা আছে, স্বীকার করি; কিন্তু বাঙালির মননের ভিত্তিভূমি ওই সাধনাটাই। ওই বুড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়েই আমাদের সব যাওয়া-আসার, লুকোচুরির খেলা।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী