আপনারা কবে? আমরা এসেছি সাতাশে।/ওকভিলে আছি। আসবেন একদিন।’ এমন ডাক শোনামাত্র একটা শিরশিরানি বয়ে যায় না? দেহে, কিংবা মনে? রোজকার সংলাপ। আটপৌরে এবং আদুরে। তবু কত অধরা মাধুরী বুনে রাখা আছে ওতে। আসলে এটা ১৯৫০-এর দশকে লেখা একটা কবিতার প্রথম দুটো লাইন। কবি বুদ্ধদেব বসু। কবিতার নাম ‘ম্যাল-এ’। পরম রমণীয় এক স্থাননামের পর হাইফেনের সুতোয় দুলতে থাকা একটা বিভক্তি। তার পাকে-পাকে জড়িয়ে আছে বাঙালির সাধের হিমালয়-পর্যটনের প্রথম সোপান। মেঘের মুলুক। দার্জিলিং। বাংলার একেবারে টঙে বিলেত-বিলাসের নিবু-নিবু আঁচ। আর সাড়ে আট হাজার ফুটের ওপর থেকে দৃশ্যমান সেই আশ্চর্য। কাঞ্চনজঙ্ঘা।
কাঞ্চনজঙ্ঘার কথা উঠবে আর সত্যজিতের সেই ছবিটা মনে পড়বে না, তাও কি হয়? বিভূতিভূষণ, প্রভাতকুমার, তারাশঙ্কর, রবীন্দ্রনাথের হাত ছেড়ে একেবারে নিজের মনগড়া কাহিনি নিয়ে সত্যজিতের প্রথম ছবি তো ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ই (১৯৬২)। প্রযোজক এস সি আড্ডি চেয়েছিলেন গল্পটা কলকাতার কাছে-পিঠে কোনও বাগানবাড়িতে জমুক। আমল দেননি সত্যজিৎ। চোখের দেখা চরিত্রলিপি নিয়ে প্রাণের কথা জুড়েছিলেন দার্জিলিঙের বুকেই। এখানে বসেই স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন। ওয়ার্কিং টাইটেল ‘বাগানবাড়ি’ বদলে হয়েছিল ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’।
তাছাড়া শুধু ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নয়, ফেলুদার দু’দুটো গল্পের পটভূমি এই দার্জিলিং। সত্যি বলতে কী, ফেলুদার আবির্ভাবই এই দার্জিলিঙে ১৯৬৫ সালে, ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ দিয়ে। একুশ বছরের মাথায় ১৯৮৬-তে আবার সত্যজিৎ ফিরেছিলেন, ‘দার্জিলিং জমজমাট’ নিয়ে। শুধু কি দার্জিলিং? কাছে-পিঠের গ্যাংটক, কাঠমান্ডুকে আমাদের মনের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে সত্যজিতের বেস্টসেলার বইগুলো এখনও সমান কার্যকর। তবে দার্জিলিঙের ওপর সত্যজিতের পক্ষপাত যাবার নয়। কলকাতা বাদ দিলে এই একটিমাত্র জায়গাতেই দুটো উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ছকেছিলেন সত্যজিৎ। আসলে এই শৈলশহরের প্রতি তাঁর নাড়ির টান। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, সত্যজিৎ। মসুয়ার রায়চৌধুরী বাড়ির তিন প্রজন্মের প্রথমজন যদি বাঙালির সঙ্গে দার্জিলিঙের সখ্যের উদয়াচলের অভিযাত্রী হন, তৃতীয়জন অস্তাচলের।
একটু তলিয়ে ভাবলে বোঝা যাবে যে, ঠাকুরদার রং-তুলিতে আঁকা উদয়াচলের কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি দেখেই দার্জিলিং চিনেছিলেন সত্যজিৎ। গড়পারের বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো থাকত সেই রঙিন ছবি। মূল ছবিটা এখন কোথায় কে জানে! তবে মুদ্রণশিল্পী উপেন্দ্রকিশোর এটাকে ‘ইউ রায় এন্ড সন্স’ থেকে তিনরঙে ছেপে বের করেছিলেন। সে-ছবি ছাপা হয়েছিল কুন্তলীন প্রেসে। পরে জুড়ে গেছিল নানান বইপত্রে। ১৯২৮ নাগাদ প্রথমবারের জন্য দার্জিলিং এসে ওই ছবিতে ধরা কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে স্বচক্ষে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘার তফাত করতে পেরে আহ্লাদে আটখানা হয়েছিলেন সত্যজিৎ।
সেবার এসেছিলেন মা সুপ্রভার সঙ্গে। ‘যখন ছোটো ছিলাম’ বইতে আছে— ‘বছর সাতেক বয়সে প্রথম গেলাম দার্জিলিং। থাকব তিন মাসির বাড়ি পালা করে।’ তখন দার্জিলিং মেল এই বাংলা তল্লাটের সবচেয়ে রইস রেলগাড়ি। এখনকার মতো রাত ১০টা ৫-এ নয়, দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ ছাড়ত। ক্রাইসলার শেভ্রোলে রোলস রয়েস অস্টিনের কাতার পড়ে যেত ৯ নং প্ল্যাটফর্মের ড্রাইভওয়েতে। শেয়ালদা স্টেশন থেকে ছেড়ে সিধে শিলিগুড়িতে এসে থামত।
সুকুমার-জায়া সুপ্রভার তিন বোন দার্জিলিঙের মাটিতে গুছিয়ে বসবাস করছেন— এর থেকে স্পষ্ট যে, দার্জিলিঙের সঙ্গে রায়বাড়ির পারিবারিক যোগাযোগ কত মজবুত ছিল। সেবার সত্যজিতের মায়ামাসিমা দিদি-বোনপোকে রিসিভ করার জন্য শোফার-ড্রিভন কার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শিলিগুড়ি স্টেশনে। তাঁর স্বামী অজিত তখন দার্জিলিঙের নামকরা ডাক্তার। ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধার করার জন্য এক শ্রেণির বাঙালি তখন পশ্চিমে যেত বটে, দার্জিলিঙেও আসত। এ প্রসঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বা সিস্টার নিবেদিতার কথা সবাই জানেন। নিবেদিতার স্মৃতিমাখা ‘রায় ভিলা’ আজও দিব্যদর্শন। চিত্তরঞ্জনের শেষ দিনগুলো কেটেছিল ম্যাল থেকে দু’কদম নেমে ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ নামের একটা দুধসাদা রঙের ভিলায়। সে-বাড়িতেই অভিনীত হয়েছিল ভাওয়ালের মেজোকুমারের বর্ণময় জীবনের শেষ পর্যায়। বলাই বাহুল্য ডাক্তারদের ভাল পসার ছিল এখানে। দার্জিলিঙে এসে যাঁকে চোখে হারাতেন সত্যজিৎ, তিনি মায়া-অজিতের ছেলে দিলীপ। সত্যজিতের পাঁচ বছরের বড় মাসতুতো দাদা। সেবার মায়ামাসির বাড়িতে কিছুদিন কাটিয়ে সত্যজিৎরা উঠে গেলেন মনুমাসির বাড়ি এলগিন ভিলায়। অবিনাশ মেসোমশাই বিমা কোম্পানির বড়কর্তা। ‘বাড়ির সামনে পাহাড়ের মাথা চেঁছে তৈরি করা টেনিস মাঠ’। এখানে থাকতে থাকতেই প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছিলেন সত্যজিৎ।
তার পর থেকে ইশকুলের ছুটি পড়লেই দার্জিলিং যাওয়া অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছিল সত্যজিতের। মায়ামাসিমার কাছেই উঠতেন বেশি। দিলীপের সঙ্গ বড় প্রিয় ছিল তাঁর। পরের দিকে কিছুদিন যাতায়াত কমে এলেও সন্দীপের জন্মের পর ফের আসা-যাওয়া বাড়ে। ‘আমাদের কথা’য় ১৯৬০-এর মে মাসে প্রথম দার্জিলিং যাবার কথা হাত খুলে লিখে গেছেন বিজয়া রায়। সেই দার্জিলিং মেল। ‘সারা ট্রেন আমার কাছে দার্জিলিংয়ের গুণকীর্তন করতে করতে গেছেন। ‘এত সুন্দর জায়গা আর হয় না… ভোরবেলা সূর্যের প্রথম আলোটা যখন কাঞ্চনজঙ্ঘায় এসে পড়ে, সেই দৃশ্য পৃথিবীর সব দেশের দৃশ্যকে হার মানায়’ ইত্যাদি ইত্যাদি।’
পরের কয়েক দশক এই যাতায়াতে কোনও ছেদ পড়েনি। সন্দীপ বড় হওয়া অবধি গ্রীষ্ম কিংবা শরতে ইশকুলের ছুটি পড়লেই দার্জিলিং কিংবা পুরীতে বেড়াতে যাওয়া একরকম বাঁধা ছিল রায় দম্পতির। গরমের ছুটির মেয়াদ মোটেই কয়েক হপ্তার ছিল না সে-আমলে। মাস দেড়েকের বেশি ছুটি থাকত। পুজোতেও নিদেনপক্ষে এক মাস। চৌরাস্তা থেকে জলাপাহাড় যাবার পথে ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ হোটেলের বেশ কদর ছিল তখন। বরাবর সেখানেই উঠতেন তাঁরা। এমনকী ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র শুটিং করতে এসেও ঠাঁই বদলাননি সত্যজিৎ। শুটিং শিডিউল ফেলেছেন পুজোর ছুটি মাথায় রেখে। সপরিবার থেকেছেন হোটেল মাউন্ট এভারেস্টে। কুশীলবদের রেখেছেন ম্যাল থেকে ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে ‘অ্যালিস ভিলা’য়। অ্যালিস ভিলা এখনও আছে। যে ‘উইন্ডামেয়ার হোটেল’ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র বেশির ভাগ ইনডোর সিনের পটভূমি, কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের জেরে কিছুদিন খুব টালমাটাল হয়েছিল সেখানে। লক-আউট নোটিশ ঝুলিয়েও ফের তার দোর খুলে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। মেম মালকিন তাকিয়ে আছেন বিলিতি পর্যটকদের দিকে। সত্যি বলতে কী, ইউরোপীয়রাই টিকিয়ে রেখেছেন দার্জিলিঙের এই কলোনিয়াল হেরিটেজকে। কারণ জলের মতো পরিষ্কার। পাঁচ-পাঁচটা কোম্পানির চেয়ারম্যান ইন্দ্রনাথ চৌধুরীর উত্তর-প্রজন্ম আর এখানে ছুটি কাটাতে আসেন না। প্রজাপতির নির্বন্ধ সাজান না। উচ্চবিত্ত বাঙালির সামার আইটিনারারি থেকে কার্যত মুছে গেছে দার্জিলিং। ম্যাল থেকে অবজারভেটরি হিলের পেছনের রাস্তা বরাবর বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে এখন কোনও স্যুট-পরিহিত বা নিদেনপক্ষে ব্লেজার-পরা বঙ্গসন্তানের দেখা পাওয়া দায় হবে। কেভেন্টার্সের ছাদে ডিএসএলআর বা স্মার্টফোন হাতে ছবির তোলার হিড়িক পড়ে এখনও। হট চকোলেটের এখনকার খদ্দেরদের মধ্যে বান্টি চ্যাটার্জির বান্ধবীকে আর পাওয়া যায় না। ইন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ সন্তানের গৃহশিক্ষকের উত্তরসাধকদের হাতে এখন দার্জিলিঙের পর্যটন-বাণিজ্যের সোনার কাঠি। তাদের হাতেই তিন তারা হোটেল থেকে হলিডে হোম-হোম স্টের পয়মন্ত দশা পাহাড় জুড়ে। সিকিম, ডুয়ার্স বা আশপাশের গ্রামীণ এলাকায় বাঙালির ভিড় বাড়লেও দার্জিলিঙের মরা হাতি এখনও সওয়া লাখ দর হাঁকতে পারে।
একদা বাঙালি মধ্যবিত্তের পছন্দের বাসা তথা ‘মেঘে ঢাকা তারা’খচিত ‘লুই জুবিলি স্যানিটোরিয়াম’ এখনও আছে। ১৯৬৫-তে সেখানেই মাথা গুঁজেছিলেন ফেলুদা অ্যান্ড কোং। এখন সরকারি আপিস-কাছারি হয়েছে সেখানে। চেঞ্জারদের মরূদ্যান লুপ্ত। তার বদলে অন্তত সাড়ে তিনশো নানান রকমের হোটেল চালু আছে দার্জিলিং মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায়। এবার পুজোয় খোদ রাজ্যপাল এসে পড়েছিলেন দার্জিলিঙে। তাঁর আসা-যাওয়ার সঙ্গে কোনও সম্বন্ধ না থাকলেও কোনও হোটেলের কোনও ঘর খালি ছিল না। নীতার তৃতীয় প্রজন্ম তাতে ভিড় জমিয়েছে। তাদেরই সন্তানসন্ততি ঘোড়ার পিঠে চেপে উইন্ডামেয়ারের সামনে দিয়ে খানিক চক্কর কেটে ফিরে এসেছে। মনীষার নয়। জলাপাহাড়ের দিকে যাবার রাস্তার কথা ঘুরেফিরে এসেছে সত্যজিতের লেখায়। ফেলুদা-তোপসে-লালমোহনবাবুর আগে সেই নিরিবিলি পথে হেঁটে-চলে বেড়িয়েছেন ইন্দ্রনাথের মেয়ে-জামাই। ইন্দ্রনাথের নাতি খেলা করেছে চিলড্রেনস প্লে-গ্রাউন্ডে। সে-পথ আজ আর চেনা যায় না। প্লে-গ্রাউন্ড কবেই লোপাট। কোচবিহারের মহারাজের সাধের লালকুঠি বারে বারে হাত বদলে এখন জিটিএ-র সদর দফতর। এ আর এমন কী! বাড়ির পর বাড়ি উঠে গেছে জলাপাহাড়ের রাস্তার দু’ধারে। সবুজের দফারফা। হবারই কথা। উপেন্দ্রকিশোরের আমলে দশ হাজার জনের মাথা গোঁজার হিল স্টেশন দিনে দিনে জনবহুল হয়েছে। ১৯৬১ সালের আদমসুমারি বলছে দার্জিলিং শহরে থাকেন ৪০ হাজার লোক। ২০২১-এ হিসেব হলে দেখা যেত যে, সংখ্যাটা তার তিনগুণেরও বেশি!
সত্যজিতের অবিশ্যি এসব ভাবার অবকাশ হয়নি। পাঁচ দশক ধরে যে-দার্জিলিংকে তিনি হাতের তালুর মতো চিনেছেন, তাতে ফাটলের দাগ তাঁর নজর এড়ানোর কথা নয়। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় তার ইশারা কিছু কম নেই। তাতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সংকেত বুনেছিলেন সংগোপনে। ক’দিন আগে শেষ বর্ষণের তোড়ে যেভাবে ভেসে গেল বেঁধে ফেলা তিস্তার বুক, কেঁপে উঠল বালাসন সেতুর ভিত, ধস নামল দিগ্বিদিকে— তাতে সেই অশনি সংকেত আরও স্পষ্ট।
‘সন্দেশ’-এর পাতা ভরানোর দায় থেকে সিনেমার পাশাপাশি ফিকশন লেখায় মন দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ তৈরির তিন বছরের মাথায় প্রথম গোয়েন্দা গল্প লিখলেন একই উদ্দেশ্যে। ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’। সেই ভিনি-ভিডি-ভিসি কাহিনির টেক্কা কী? দার্জিলিং! উইন্ডামেয়ার বাদ দিলে প্রায় একই রকম লোকেশন ম্যাপ। খেয়াল করলে দেখবেন দার্জিলিং তখনও সম্পন্ন বাঙালির বার্ধক্যের বারাণসী। এ গল্পের কুশীলব কারা? বাঁকুড়ার ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে তথা কলকাতার নামকরা উকিল রাজেন মজুমদার। আইন-ব্যবসা থেকে অবসর নিয়ে তিনি জলাপাহাড়ে এসে থিতু হয়েছেন। তাঁর প্রডিগাল সান এসে উঠেছেন হোটেল মাউন্ট এভারেস্টে। ওদিকে লেডেন লা রোডে চেম্বার করছেন ফণী ডাক্তার। প্লান্টারস ক্লাবে আসর জমাচ্ছেন চা-বাগানের খানদানি ম্যানেজার গিলমোর সাহেব। আর ফেলুদা এসে উঠেছেন সাধারণ মধ্যবিত্তের আপন সেই স্যানিটোরিয়ামে। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় যেমন একটি খুদে ছাড়া কোনও স্থানীয় চরিত্র নেই, এখানেও আছে একমাত্র এক নেপালি চাকর। কোনও সন্দেহ নেই, কলোনিয়াল দার্জিলিং অর্থাৎ ম্যালকে কেন্দ্র করে ছোট ব্যাসার্ধের রঙিন ফুরফুরে চত্বরটাই তাঁর কমফোর্ট জোন ছিল। এর বাইরে তিনি বেরোতে চাননি। গোর্খালি অস্মিতার আঁতের কথা তাঁর কানে ঢোকেনি।
অস্যার্থ, তখনও বাঙালি বাঙালিতে থিকথিক করছে দার্জিলিঙের চারপাশ। স্থায়ী বাঙালি বাসিন্দা হাজার কয়েক। আছেন মানে, বেশ জাঁকিয়ে আছেন। তার ওপর গ্রীষ্মে ও শরতে মরসুমের হিসেবে বাসা ভাড়া করে বাঙালি আসছে। লম্বা মেয়াদে ছুটি কাটাতে আসছে। আন্ডাবাচ্চা নিয়ে গুষ্টিসুখ উপভোগ করতে আসছে। হোটেলে উঠছেন তারাই, যাদের থাকার মেয়াদ ছোট। এখনকার মতো পিল পিল করে না এলেও তাদের সংখ্যা কিছু কম ছিল না।
‘দার্জিলিং জমজমাট’ বেরোয় ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’র একুশ বছর বাদে, ১৯৮৬ সালের পুজোয়। ততদিনে ট্রেন থেকে প্লেনে উত্তীর্ণ হয়েছেন ফেলুদা অ্যান্ড কোং। তিনজনে এসে উঠেছেন হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘায়। ওদিকে লালমোহনবাবুর গল্প থেকে নির্মীয়মাণ হিন্দি ছবির শুটিং-পার্টি উঠেছে সেই পুরাতন হোটেল মাউন্ট এভারেস্টে। সেটা ছাড়িয়ে একটু গেলেই পুব বাংলার জমিদারের ষোলো ঘরের একতলা বাংলো ‘নয়নপুর ভিলা’— সেটাই এই আখ্যানের ভরকেন্দ্র। সে-বাড়ির মালিক বিরূপাক্ষবাবু নিজস্ব ঘোড়ার পিঠে চেপে পাহাড়ি রাস্তায় চলাফেরা করেন। তার কাছে-পিঠেই ‘দ্য রিট্রিট’ নামের ছোট এক কটেজে থাকেন হরিনারায়ণ মুখার্জি। অক্টোবরেও যিনি ‘সুতির শার্টের উপর একটা গরম চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে’ পড়তে পারেন, কেভেন্টার্সের ছাদে ঢুঁ মারতে পারেন। ম্যালের মোড়েই ডক্টর বর্ধনের ডিসপেনসারি। এই ডাক্তারবাবুর কাছে সব পেশেন্টের হাঁড়ির খবর থাকে। দার্জিলিং থানার ইনস্পেক্টর যতীশ সাহা এক কথায় ফেলুদার ওপর ভরসা করতে পারেন।
মলাট ভুলে হুট করে পড়তে বসলে দার্জিলিংকে নিউ মার্কেট চত্বর বলে ভুল হওয়া সম্ভব!
এখন এসব অলীক। জাঁক লোপ পেয়েছে কবেই! দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল বা আজকের গোর্খাল্যান্ড টেরিটরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কবজায় থাকা দার্জিলিং শহর বাইরে থেকে যেমন বদলেছে, তেমন বদলেছে ভেতর থেকেও। সত্যজিৎ যখন প্রথম দার্জিলিং আসেন, তখন এখানকার পুর প্রতিনিধিদের আঠেরো জনের মধ্যে সাতজনই ছিলেন বঙ্গসন্তান। লয়েড বোট্যানিক্যাল গার্ডেনের কাছে বাঙালিপাড়া জমে উঠেছে। পরশুরামের ‘কচি-সংসদ’-এ আছে ছুটি কাটানোর জন্য ডালহৌসি পাহাড়ের চাইতে দার্জিলিং পাহাড় কত শ্রেয় ছিল কলকাতার বাঙালির কাছে। ‘মংকি মিত্তিরের বউ তার তেরোটা এঁড়িগেঁড়ি ছানাপোনা নিয়ে’ এখানেই থিতু হতেন। মাথায় ছাতা, গলায় কম্ফর্টার, গায়ে ওভারকোট, চক্ষুতে ভ্রূকুটি ও মুখে বিরক্তি নিয়ে নকু মোক্তার এইসব আদিখ্যেতার গুষ্টির তুষ্টি করতেন। তারও আগে লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘দুরাশা’ গল্পের কথকঠাকুর ‘মোটা বুট এবং আপদমস্তক ম্যাকিন্টশ’ পরে জনশূন্য ক্যাল্কাটা রোডে ঘুরতে-ঘুরতে ঠেলাগাড়িতে ইংরাজ রমণী ও অশ্বপৃষ্ঠে বায়ুভুক ইংরাজ পুরুষগণের পাশাপাশি বদ্রাওনের নবাবপুত্রীর দর্শন পেয়েছিলেন। সেই ক্যাল্কাটা রোড এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
১৯৮৬-’৮৮ সালে গোর্খাল্যান্ড মুভমেন্টের পর আর দার্জিলিং যাওয়া হয়নি সত্যজিতের। জ্যোতি বসুর সঙ্গে সুবাস ঘিসিঙের সইসাবুদ হবার সাড়ে তিন বছরের মাথায় সত্যজিতের প্রয়াণ। তার পর আরও তিন দশক কেটেছে। পাহাড়ের বুক থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে সমতলে চলে যাওয়া বাঙালির সংখ্যা যত বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পাহাড়ে মাথা গুঁজতে আসা নেপালিদের সংখ্যা। জলাপাহাড়ের রাস্তার মুখে খুন হওয়া মদন তামাঙের অতিকায় মূর্তি বসেছে। ক্যাপিট্যাল সিনেমার সামনে মিউনিসিপ্যালিটির জলের গাড়ির আস্তানা হয়েছে। ক্লক টাওয়ার নিঃস্পন্দ। কবেই আগুনে পুড়ে গেছে হোটেল মাউন্ট এভারেস্ট। হাত বদল হবার পর তার নবীকরণের যে-সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছিল তাতে বুঝি জল ঢেলে দিয়েছে পাহাড়ের অস্থির রাজনৈতিক আবহাওয়া। আজ ক্যান্টনমেন্টের দিকে যত যাওয়া যাবে তত মিলবে বাঙালির ফেলে যাওয়া কিংবা খুইয়ে ফেলা জমিজিরেতের হিসেব। বোস ইনস্টিটিউট আছে বলে জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়িটা বেঁচে গেছে। কার্শিয়াং বা কালিম্পঙের পথে পথেও একই নাভিশ্বাস।
সত্যজিতের চেনা দার্জিলিঙের হাতে গোনা যেসব নাগরিক অনুষঙ্গ এখনও টিকে আছে, তাদের মধ্যে দাশ স্টুডিও সবার আগে। এখন আর ডার্করুম থেকে ডেভেলপ হয়ে আসা এনলার্জমেন্ট প্রিন্ট না হোক, সত্যজিৎ যে দার্জিলিঙে এসেছিলেন সেই দার্জিলিঙের ছবির হদিশ সেখানে মেলে। গ্লেনারিজের কথা সত্যজিৎ লিখে না গেলেও এর দোতলার পানশালার এক কোণে বিয়ার মাগ সামনে রেখে দিনের পর দিন আপন মনে নোটবুক ভরাতেন তিনি। সেটা একটুও পালটায়নি। ম্যালের বাঁ-দিকটা মোটের ওপর এক থাকলেও অবজারভেটরি হিলের নিছে অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকা ব্রেবোর্ন পার্ক উধাও হয়েছে ক’বছর আগে। বিমল গুরুঙের হাত ধরে সেখানে জাঁকিয়ে বসেছে ‘ওপেন এয়ার থিয়েটার’, আদতে যা সিটিং গ্যালারি, নামের সঙ্গে যার কোনও সামঞ্জস্য নেই! ওই পার্কের সামনে কবি ভানুভক্তর যে আবক্ষমূর্তি দেখে গেছিলেন সত্যজিৎ, সেটার জায়গায় মাথা তুলেছে পেল্লায় এক সোনালি মূর্তি। ভানুভক্তরই। ব্যান্ডস্ট্যান্ডের ছাউনি পালটে গেছে। সেখানে গোর্খা রেজিমেন্টের বাদ্যি যে কবে বাজে কেউ জানে না!
তবে অবজারভেটরি হিলের পেছনের রাস্তায় সেই যেখানে বসে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিপে মালতী ঘোষাল গেয়েছিলেন ‘এ পরবাসে রবে কে’, সেই ভিউপয়েন্টখানা বহাল তবিয়তে আছে। এখনও ভোরের বেলা কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন হয় সেখান থেকে। আজও হয়েছে। মুহূর্মুহু রং বদলেছে তুষারশৃঙ্গ। এখনও সেখানে এসে বসলে ‘এ পরবাসে রবে কে’ মনে আসে কারোর কারোর। মনে হবার কারণগুলো বদলে গেছে এই যা!