গত গ্রীষ্মে ঔরঙ্গাবাদের কাছে রেললাইনের পাশে পড়ে-থাকা পোড়া রুটির টুকরোগুলোর ছবিটা মনে আছে? ওই সময়টায় আমাদের মনে খানিক জায়গা করে নিয়েছিল নতুন-পাওয়া, হোয়াটসঅ্যাপ-বান্ধব প্রিয় শব্দ ‘পরিযায়ী শ্রমিক’-দের দুর্দশা, কিন্তু তার পর অদূরেই তাদের কথা ভুলে গিয়েছিলাম, যেমন সচরাচর ভুলেই থাকি। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ছাড়া আমরা জানিই না, ভারতের ইতিহাসে বরাবরের মতো সমাজে সবচেয়ে নিপীড়িত, কয়েক সহস্রাব্দের জন্য অস্পৃশ্য (অনেক জায়গায় এখনও) দলিত মানুষগুলি কী খান। আগেই বলেছি, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাসের মতোই, আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ইতিহাসও উচ্চবর্গের পরিসরেই সীমিত, রান্নার বই থেকে টেলিভিশনের পর্দায় হরেক কুকারি শো, গবেষণা-গ্রন্থ থেকে আন্তর্জালে অসংখ্য ‘ফুড ব্লগ’— সর্বত্রই এই একই রীতি। বস্তুত ‘খাওয়া’-র সঙ্গে ‘দাওয়া’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে আমরা একটা আলগা মৌতাতের ক্যাজুয়াল আবেশ অজান্তে এনে ফেলি বটে, কিন্তু মাথায় রাখি না যে, আদতে আরবি ‘দাওয়া’ শব্দটির অর্থ অধিকার, স্বত্ব, পাওনা। তাই ‘খাওয়া-দাওয়া’ শব্দবন্ধের এক অর্থ খাদ্যের অধিকার, যার অন্তর্নিহিত প্রতিবাদী গন্ধটি আমাদের রবিবার দুপুরের মাংসের ঝোলের খুশবুর নীচে ঢাকা পড়ে যায়।
লবটুলিয়ার বারোমাস কলাইয়ের আর মকাইয়ের ছাতু-খাওয়া লোকেরা শুধু একটু ভাত খাওয়ার লোভে একটি অনাড়ম্বর আরণ্যক অঙ্গনে ভিড় জমিয়েছিল, সে-কথা হয়তো আমাদের মনে আছে। সে-কাহিনির অল্প পরেই রয়েছে সম্বৎসর ‘খেড়ীর’ (অর্থাৎ পতিত জমিতে গজিয়ে-ওঠা বুনো কলাই) দানা সিদ্ধ আর জংলি বাথুয়া শাক খেয়ে কাটানো হদ্দ গরিবদের কথা। আর পড়েছি, প্রবল বর্ষণে ভিজে ঝুপসি হয়ে দোসাদ অচ্ছুৎ-কন্যাদের অভুক্ত দাঁড়িয়ে থাকার কথা, কারণ তাদের সামান্য চিনা ঘাসের দানা, টক দই আর ভেলি গুড় পরিবেশন করার জন্য দাওয়ায় তুলতে গেলেই ঘরের সব জিনিসপত্র ফেলে দিতে হবে যে! ওই অকুস্থল হয়তো ভাগলপুরের আরণ্যভূমি, কিন্তু এই গল্প ভারতের সব অঞ্চলের, চিরন্তন। ক্ষুন্নিবৃত্তির তাগিদে এঁদো জলার কলমি শাক, বনবাদাড়ের মেটে আলু বা জংলি বুনো কলাই, এমন কত রকম ফেলনা জিনিস একাকিনী জোগাড় করতে গিয়ে নির্ভয়ার রাস্তায় হারিয়ে গেছেন আমাদের অগণিত কন্যাসন্তানরা!
এই সব উলোঝুলো টাইপের খাবার নিয়ে এক অসংলগ্ন আবেশ অনেক সময় আলগা বিছিয়ে থাকে আমাদের স্মৃতিতে, অবচেতনে। রবি ঠাকুরের রহস্যময়ী ‘সে’ আসলে কে, যে বাগান থেকে দিদির তুলে-আনা ‘একঝুড়ি বাঁশের কোঁড়া, লাউডগা আর বেতোশাক’ তুলে নিয়ে চম্পট দিল বেবাক? সে কি শখে, না কি খিদের জ্বালায়? বাঁশের কোঁড়ও— তা সে প্রজ্ঞাসুন্দরী তাকে দিয়ে যতই ছেঁচকি বানান, বা ইউরোপকেন্দ্রিক ভাষায় ‘দূরপ্রাচ্যের’ রান্নাবান্নার মিশেলিন-স্টার শেফদের এ-জিনিসটি তাঁদের শখের রান্নায় আপনি যতই ব্যবহার করতে দেখুন— আদতে তা গ্রামগঞ্জের গরিব মানুষেরই নৈমিত্তিক খাবার। খুদও— অর্থাৎ চালের ভাঙা, খুদে টুকরো— তাই, হয়তো গ্রামের গেরস্তঘরে ধান মাড়াই-ঝাড়াইয়ের পর খুদ রান্না করার প্রচলন আছে, হয়তো রেণুকা দেবী চৌধুরানী তাঁর ‘রকমারি আমিষ রান্না’র গোড়াতেই খুদের জাউকে ঠাঁই দিয়েছেন, কিন্তু ভুললে চলবে না, সে-জিনিস আসলে চণ্ডীমঙ্গলের নায়ক ক্ষুধার্ত শবর কালকেতুর দিনান্তের উদরপূর্তির জন্য (‘খুদ কিছু ধার লহ সখীর ভবনে / কাঁচড়া খুদের জাউ রান্ধিও যতনে’)। মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’-এও পড়ি, ষাটের দশকের গোড়ায় যখন এক ভয়াবহ খাদ্য সংকটের অশনি সংকেত সর্বত্র প্রকট, শরণার্থী ক্যাম্পে চলে পুকুরের ঘোলা জলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেলে, ধুয়ে ধুলোকাঁকড় থেকে খুদ আলাদা করার প্রয়াস, যা দিয়ে জাউ রেঁধে নুন-লঙ্কা দিয়ে উদরসাৎ করে দলে-দলে অসহায় শরণার্থী পরিবারের ক্ষুন্নিবৃত্তির সংগ্রাম।
আশ্চর্যের ব্যাপার, রান্নাবান্না-খাওয়া-দাওয়ার ইতিহাস নিয়ে আজকের ভারতবর্ষে বিস্তর চর্চা শুরু হয়ে গেলেও, সেখানে দেশের জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ যে দলিত ও জনজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ, তাঁদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আলোচনা প্রায় অদৃশ্য। এ দেশে দলিতদের রান্নাবান্না নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাকুল্যে এক— ২০১৫ সালে মারাঠি ভাষায় লেখা শাহু পাটোলের ‘অন্ন হে অপূর্ণ ব্রহ্ম’। বইয়ের নামেই রয়েছে প্রতিস্পর্ধী এক বিদ্রোহ। সতেরো শতকে সন্ত রামদাস বলেছিলেন ‘অন্ন হে পূর্ণ ব্রহ্ম’— জীবনদায়ী খাদ্যই ‘পূর্ণ ব্রহ্ম’, অর্থাৎ ঈশ্বরের সমতুল, যে-ভাবনা থেকে খাওয়ার আগে অনেক ধর্মেই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে ‘গ্রেস’ পড়ার রীতি রয়েছে। পাটোলে দেখিয়েছেন, দলিতের খাদ্যপাত্র কীভাবে সর্বদাই অসম্পূর্ণ, ঈশ্বরের বরাভয় নামে সর্বত্রগামী হলেও তাঁদের হাঁড়ি-পাতিল-সানকি অবধি পৌঁছয় না। দুর্জ্ঞেয় কারণে এই ব্যতিক্রমী বইটির ইংরেজি অনুবাদ এখনও হয়নি, তাই ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, তাঁর বইয়ে রয়েছে বঞ্চনায় আকীর্ণ, ফেলা-ছড়া এঁটোকাঁটার দুনিয়া থেকে টুকরোটাকরা কুড়িয়ে এনে পেট ভরানোর প্রয়াসের এক উদযাপন। স্পর্শদোষ বাঁচিয়ে দোকান থেকে মাংস কেনার ‘অধিকার’, সাহস বা সামর্থ্য, কোনওটাই দলিতের নেই, তাই ভাগাড়ে পরিত্যক্ত নিষ্প্রাণ পশুদেহ— অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গরু— থেকেই তাদের আমিষ আহরণ। অথবা কসাইখানার বাইরে অপেক্ষার পাত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা, কখন মিলবে সদ্য-জবাই পশুর রক্ত, যা ঢিমে আঁচে ফোটানোর পর ঠান্ডা ও জমাট সেই মেহগনি রঙের রক্ত-শরীরকে টুকরো-টুকরো করে কেটে পেঁয়াজ, লঙ্কা, ধনেপাতা-কুচি সহযোগে তৈরি হবে মাঙ্গ বা মাহারদের ‘ডেলিকেসি’, লাকুটি। তেল কেনার পয়সা নেই, তাই মরা গরু বা শুয়োরের চর্বিতেই রান্না হবে এই সব ‘অস্পৃশ্য’ ও ‘অশুচি’ ব্যঞ্জন।
এ প্রসঙ্গে আরেক সমাজতাত্ত্বিক দলিত শিল্পী ও লিপিকারের কথাও বলতেই হয়, তিনি পুনানিবাসী রাজ্যশ্রী গুডি, যাঁর ওয়েবসাইটে ‘রাইটিং রেসিপিজ’ নামের এক উপশাখায় (http://www.rajyashrigoody.com/is-hunger-gnawing-at-your-belly) সন্নিবিষ্ট হয়েছে খাদ্যসঙ্কুলান নিয়ে দলিত জীবনের নৈমিত্তিক সংগ্রাম বিষয়ে সাহিত্য থেকে আহরিত নানান খণ্ডচিত্র, যা আমাদের ঘাড় ধরে বোঝায়, এই ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর ভিতর আছে আরও অনেক ভারতবর্ষ, যা আমরা হেঁটে বা ভেবে, কোনও ভাবেই দেখার চেষ্টা করিনি সচরাচর। একটি উদাহরণ, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত মারাঠি লেখক লক্ষ্মণ গায়কোয়াড়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘উচল্যা’ (ইংরেজি অনুবাদে Branded), যে নামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘চোর’ অপবাদ দিয়ে তাদের গায়ে ব্রিটিশ সরকার দেগে দিয়েছিল ‘ক্রিমিন্যাল ট্রাইব’-এর তকমা। কীরকম সেই চুরি? প্রথমে বাবার সঙ্গে মেঠো ইঁদুর ধরে বেড়ায় দলিত বালক। এক চকিত মুহূর্তে সেই ইঁদুরদের ছেড়ে দেওয়া হয় উচ্চবর্ণ ভূস্বামীর গম, জোয়ার বা বাজরার ক্ষেতে, যেখান থেকে শস্যদানা মুখে করে নিয়ে এসে আবার গর্তে সেঁধিয়ে যাবে মূষিককুল। এর পরের কার্যক্রম বিধিবদ্ধ ও অমোঘ। গর্ত থেকে আবার টেনে আনো ইঁদুর, আগুনে রোস্ট হয়ে সে জোগাবে সস্তার প্রোটিন, আর গর্তের মধ্যে থেকে শস্যদানা বের করে, পিষে, সেঁকে খাও গরিবের ঝলসানো রুটি, বাখরি— যাকে নিয়ে বামপন্থী মারাঠি কবি নারায়ণ গঙ্গারাম সুর্ভে, খানিকটা আমাদের সুকান্ত ভট্টাচার্যের আদলেই, লিখেছিলেন এক ব্যঞ্জনাময় কবিতা, ‘অর্ধি বাখরিচা চন্দর’, আধখানা বাখরিতে অর্ধচন্দ্রের প্রতিবিম্ব। জাতপাত, ক্ষুধা, শোষণের এই ত্র্যহস্পর্শই রচে দেয় পেট চালানোর জন্য প্রান্তিক মানুষের নানান ফন্দিফিকির, ‘চৌর্যবৃত্তি’ আর বৈধকরণের টানা-পড়েনেই গড়ে ওঠে ভুখা দলিতের বিল্ডুংসরোমান। এই কাহিনি ‘আমাদেরই’, আবার আমাদের নয়ও।
সুনীলকে স্মরণ করেও প্রশ্ন জাগে, চে’র মৃত্যু হয়তো আমাদের অপরাধী করে দেয়, কিন্তু গরিবগুর্বো দলিত প্রান্তিকের পেট চালানোর গদ্যময় রোজনামচা? মনে হয় না, এ নিয়ে দুনিয়ার কোথাও কোনও অপরাধবোধ আমাদের আছে। তাই আমরা আরামে গা এলিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় দেখি শেফ অ্যান্ড্রু জিমার্নের Bizarre Foods সিরিজে দুনিয়ার হরেক জনজাতি ও কৌম সমাজের অন্দরমহলে ঢুকে তাদের দৈনন্দিন খাদ্যবিধিকে ‘কিম্ভূত’ তকমা দেওয়ার প্রচেষ্টা, শেফকুলপতি গর্ডন র্যামজের অতুলনীয় কিচেনে রক্ত দিয়ে তৈরি ব্ল্যাক পুডিং বা ব্লুটওয়র্স্ট-এর মহার্ঘ রেসিপি হয়ে ওঠা, অথবা জঙ্গল-বাদাড়ে শাকপাতা-ব্যাঙের ছাতা-বুনোফল কুড়িয়ে-বাড়িয়ে— যাকে, ওই ইঁদুরের অনুষঙ্গেই, আমরা ইংরিজিতে বলি ‘ফোরেজিং’— মিশেলিন-কুলীন, উচ্চবর্গের রন্ধনশৈলীর (যাকে ফরাসিরা বলেন haute cuisine) পর্যায়ে ‘জাতে তোলার’ প্রচেষ্টা। সাহেবরা আঠারো-উনিশ শতকে অ-শ্বেতাঙ্গ, তথাকথিত ‘আদিম’ জনগোষ্ঠীদের সম্পর্কে যে-ধরনের অ্যানথ্রোপলজি করতেন, সেই কায়দাতেই এখন চলে আমাদের মতো ‘শিক্ষিত’ ও ‘আধুনিক’ মধ্য ও উচ্চবিত্তের অন্তঃসলিল বর্ণাশ্রম। আমাদের জ্ঞানচর্চায়, সংস্কৃতির ইতিহাসে— খাওয়া-দাওয়ার ইতিহাসেও— প্রবল কুঠারাঘাত করার সময় তাই সমুপস্থিত, তা সে বিদ্রোহী ভৃগুর হাত দিয়েই আসুক, বা বসাই টুডুর।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র