আজকাল ‘Auteur তত্ত্ব’ শব্দগুলো শুনলে অনেক চলচ্চিত্র-পণ্ডিতই চোখ কোঁচকান। তাঁরা বলেন, এটা এক রক্ষণশীল জমানার অবশিষ্টাংশ, যা চলচ্চিত্রের সমষ্টিগত, শিল্পগত দিকগুলি অস্বীকার করে। যে-কোনও ছবি তৈরি করতে শুধু প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী নয়, অনেক কলাকুশলীর মিলিত শ্রম প্রয়োজন। চিত্রগ্রাহক, শিল্প-নির্দেশক, শব্দগ্রহণকারী, সাজসজ্জা কুশলী, নৃত্য পরিচালক, গায়ক— সকলের ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতা একত্র না হলে কি সিনেমা হয়? তাহলে ‘auteur’ ‘auteur’ করে এত লাফাঝাঁপি কেন? কে এই auteur? কোথা থেকেই বা auteur theory এল?
‘Auteur’ শব্দটি চলচ্চিত্রের অভিধানে নিয়ে আসেন একদল বিপ্লবী এবং উদ্দীপনাময় চলচ্চিত্র-সমালোচক। পরে এঁদের অনেকেই চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবেও বিশ্ববিখ্যাত হন। চলচ্চিত্র-অনুরাগী মানুষ এঁদের ফরাসি নবতরঙ্গ হিসেবে চেনেন। ‘Auteur’ শব্দটি যখন চলচ্চিত্রের শব্দভাণ্ডারে ঢোকে, তখন যুদ্ধপরবর্তী ফ্রান্স মার্শাল প্ল্যান-এর আর্থিক সাহায্যে পুনর্গঠিত হচ্ছে। এই পুনর্গঠনের প্রেক্ষিতে তরুণ প্রজন্ম নতুন করে পুঁজিবাদ, শহুরে মধ্যবিত্তের সামাজিক সম্মানবোধ (bourgeois respectablity) এবং পরিবার সংক্রান্ত মূল্যবোধ-এর সমালোচনায় সোচ্চার হয়। ১৯৬৮-তে এরাই ফেটে পড়বে প্যারিস তথা অন্যান্য ফরাসি শহরের পথেঘাটে। প্রখ্যাত সমালোচক আন্দ্রে বাজাঁ এবং সিনেমাথেক ফ্রঁসেজ-এর পাগলাটে, দলছুট মহাফেজদার অঁরি লংলোয়া-কে মধ্যমণি করে একদল অল্পবয়সি, বিদ্রোহী, ফরাসি সিনেফিল ‘কাহিয়ে দ্যু সিনেমা’ নামে এক পত্রিকায় প্রথম auteur-কেন্দ্রিক আলোচনা চালু করেন।
এঁদের মধ্যে ছিলেন ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, জাঁ লুক গোদার, ক্লদ শাব্রল প্রমুখ। এঁরা ‘auteur’ বলে অভিষিক্ত করেন হলিউড-এর কিছু চিত্রপরিচালককে, যাঁদের মধ্যে ছিলেন হাওয়ার্ড হকস, আলফ্রেড হিচকক, ডগলাস সার্ক, নিকোলাস রে। নিজেদের দেশের ছায়াছবিকে বড্ড বইঘেঁষা এবং পরম্পরাগত— ‘Cinema de Papa’, ‘la tradition de qualite’— বলে ঠাট্টা করে, হলিউডের চলচ্চিত্রে এঁরা এক আধুনিক জনমাধ্যমের আসল রস খুঁজে পান। সব মার্কিন পরিচালক কিন্তু এঁদের বিচারে ‘auteur’ নন। কেবল যাঁরা স্টুডিও মালিকদের বাণিজ্যিক কাঠামো বজায় রেখেও একটি ছায়াছবির ওপর নিজের কল্পনার স্বাক্ষর রেখে যেতে পারেন, তাঁরাই প্রকৃত auteur। এই ছবিগুলো বাণিজ্যের সাথে কলার আপাত-বৈরিতা ঘুচিয়ে দিয়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে প্রসাদ হয়ে ওঠে। বছর কতক পর যখন এসব অল্পবয়সি সমালোচক ছবি করায় হাত দিলেন, তখন থেকে ‘auteur’ তকমাটি হলিউডের চেয়ে, ‘art’ ছবির সাথেই বেশি করে জুড়ে গেল। হলিউডের সাথে art ছবির কথোপকথন থেকেই যে ‘auteur’-এর জন্ম হয়, তা অনেকেই ভুলে গেছেন। ভারতবর্ষের চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের মধ্যে auteur বলতে সত্যজিৎ রায় এবং ওঁর সমসাময়িক কিছু চলচ্চিত্র-নির্মাতার নাম মনে আসা বিস্ময়কর নয়। তবে একমাত্র সত্যজিতের ক্ষেত্রেই বাণিজ্যিক ও আর্ট, দুই হিসেবেই সফল এমন একাধিক ছবি পাওয়া যায়।
১৯৬০-’৭০-এর দশকে ‘death of the author’-এর ধারণার উত্থান হয়। ক্রমে ‘অথর’-এর জায়গায় আমরা ‘ডিসকোর্স’ দেখতে অভ্যস্ত হই। হাল আমলে ডিসকোর্সের জায়গা নিয়েছে ‘মিডিয়া ইকোলজি’ এবং ‘মিডিয়া আর্কিওলজি’। ফিল্ম স্টাডিজ এখন শুধু ফিল্ম নয়, সামগ্রিক ভাবে বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য বাতাবরণ নিয়ে ভাবিত। এছাড়া প্রত্নতাত্ত্বিক মডেল অনুসারে আজকে অনেকেই বলবেন যে, যদিও নিত্যদিন নতুন মিডিয়া তৈরি হচ্ছে, তার মধ্যেই নানা স্তরে রয়েছে পুরেনো মিডিয়ার রেশ।
এরকম আবহাওয়ায় সত্যজিৎ রায়কে auteur হিসেবে আলোচনা করা কি তাহলে নিছক অতীত-বিলাসিতা? হয়তো। কিন্তু তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে তাঁকে নিয়ে নতুন করে ভাবারও অবকাশ হয়েছে। এই বছর তাঁকে নিয়ে নানা প্রকল্প হচ্ছে। ডাকবাংলা.কম-এর ওয়েবসাইটেই অনেক নতুন লেখা পড়েছি, যা শিল্পী এবং মানুষ সত্যজিৎকে নিয়ে নতুন চিন্তার রসদ জোগায়। তবে গত সপ্তাহে TCG-CREST নামক এক বেসরকারি সংস্থার তৈরি exploreray.org নামক ওয়েবসাইটটি দেখে তাক লেগে গেল। ওয়েবসাইটের বিষয়সবস্তু ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’-এর (১৯৬৯) খেরোর খাতা।
অনেকেই জানবেন যে, তাঁর প্রতিটি ছবি করার আগে এবং চলাকালীন মানিকবাবু একটা লাল মলাটের লম্বা খাতায় script, screenplay, চরিত্রায়ন, বাজনা, mise-en-scene-এর সমস্ত detail পুঙ্খানুপুঙ্খ নোট করতেন। প্রথাগত চিত্রনাট্যের পরিবর্তে তিনি খেরোর খাতাই অনুসরণ করতেন। প্রচলিত ছাঁচে শুটিং স্ক্রিপ্ট বা স্টোরিবোর্ড না তৈরি করে, বরং খেরোর খাতায় টুকে রাখা বিচিত্র আঁকা আর লেখাজোকার ওপরই নির্ভর করে শুটিং করতেন। শুটিং চলাকালীন খেরোর খাতা হালনাগাদ হত। পোস্ট-প্রোডাকশনেও খেরোর খাতায় নোট করা বন্ধ হত না। কোন শট রাখা হবে, কোনগুলো বাতিল করা হবে, তারও বিস্তারিত চিত্রণ থাকত এই খাতায়।
খেরোর খাতার ‘খেরো’ কথাটা এসেছে ‘খারুয়া’ শব্দটি থেকে, যার মানে লাল-রঙা, মোটা সুতির কাপড়। এসব খাতার সাথে আমার প্রথম চাক্ষুষ পরিচয় সত্যজিৎ রায়ের ছেলে শ্রীসন্দীপ রায়ের সুবাদে, যিনি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০), ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১), এবং ‘জন অরণ্য’-র (১৯৭৬) খেরোর খাতা আমাকে দেখতে দিয়েছিলেন। কিন্তু এবার exploreray.org-এর ওয়েবসাইটে গুগাবাবার খেরোর খাতার ৯০০-র বেশি পৃষ্ঠার ঢাউস প্রতিলিপি দেখে আবার নতুন করে সত্যজিৎ রায়কে চেনার সুযোগ হল। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, exploreray.org প্রকল্পটির উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করছেন সন্দীপবাবু, এছাড়াও তাঁর সঙ্গে রয়েছেন আরেক বিখ্যাত পরিচালক মৃণাল সেনের ছেলে শ্রীকুণাল সেন।) ডিজিটাল মাধ্যমে জুম-ইন ও জুম-আউট, বা আগে পিছে বারবার করে দেখার সুবিধের দরুন, তাঁর চলচ্চিত্র হয়ে উঠল এক বিশাল প্রত্নতাত্ত্বিক সমাগম, যার নানা স্তরে রয়েছে বই, ছবি, স্থাপত্য-শিল্প, নকশা এবং আরও নানান কলা। সাজসজ্জার খুঁটিনাটি, সংলাপের রকমফের, সেটের কাঠের কাজ, লাইটিং বা ক্যামেরা অ্যাঙ্গল বাছাই করা, একটি সফল ছায়াছবির উপাদান ও আরও অনেক কিছুর সঙ্গম। এবং সত্যজিৎ রায় সেই auteur, যিনি এই প্রতিটা স্তরের মধ্যে নির্দ্বিধায় এবং অনায়াসে বিচরণ করতেন।
‘মহারাজা তোমারে সেলাম’— গানটির কথা ধরুন। exploreray.org ওয়েবসাইটে গেলে দেখবেন, খেরোর খাতার অনেকগুলো পাতায় মানিকবাবু এই গানের এক এক কলির সরগম লিখেছেন। ক্যালকাটা স্কুল অফ মিউজিক-এর সহযোগিতায়, আপনি এই বিভিন্ন নোটেশন-এর সুর আপনার কম্পিউটারে শুনতেও পারেন। দেখবেন গানটি কীরকম শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতির মতন পাখা মেলে ওঠে। কিছু সুর বাতিল হয়ে যায়, কিছু আজকের চেনা সুর।
মানিকবাবু যে ভীষণ detail-oriented ছিলেন তা আমাদের জানা। কিন্তু কতটা, তা খেরোর খাতার detail কাছাকাছি দেখলে টের পাবেন। যেমন শুণ্ডী রাজদরবারের প্রতিটা পিলার-এর কারুকার্য-খচিত groove এবং flute-এর মধ্যে কতটা দূরত্ব থাকবে, তাও শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্তকে বুঝিয়ে দেন (দেখুন: https://exploreray.org/sketch-book/pages/sketch-book-1/2)। একটি আলোকচিত্রে (https://exploreray.org/page-content/ps-images) তো মনে হয় মানিকবাবু রবি ঘোষ এবং তপেন চট্টোপাধ্যায়কে নাচের পদক্ষেপও দেখিয়ে দিচ্ছেন।
আলফ্রেড হিচকক এবং সের্গেই আইজেনস্টাইন-এর নোটবুক বিখ্যাত। তাঁদের নোটকবুক নিয়ে গবেষণাও হয়েছে। হিচককের নোটবইয়ে screenwriter বা গল্পলেখকের সাথে পরিচালকের লম্বা কথোপকথনের নজির মেলে। হিচকক মূলত ‘ট্রিটমেন্ট’ লিখতেন; ক্বচিৎ কিছু সংলাপও পরিবর্তন করতেন। মানিকবাবু কিন্তু প্রথম থেকে শেষ অবধি সবটা নিজে লিখতেন। exploreray.org ওয়েবসাইটে পাঠক চৈত্র ১৩২১, দ্বাদশ সংখ্যার ‘সন্দেশ’-এ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘গুপী গাইন’ নামে একটি আট পাতার সচিত্র ছোটগল্প পড়তে পারবেন। তারপর খেরোর খাতায় গিয়ে নিজে তুলনা করে দেখবেন দাদুর গল্পটিকে চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত করতে গিয়ে মানিকবাবু ঠিক কী কী পরিবর্তন করেছিলেন। আর এসব পরিবর্তনের ভেতর দিয়েই ‘গুপী গাইন’ হয়ে ওঠে গুগাবাবা। তার মধ্যে যুদ্ধের দীর্ঘ দৃশ্যগুলো অন্যতম। Auteur সত্যজিৎ সম্বন্ধে আরও অনেক মজার সচিত্র তথ্য পাবেন এই খেরোর খাতা থেকে। যেমন সাহেব ভূতের মধ্যে দেখবেন রবার্ট ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংস এবং লর্ড কর্নওয়ালিস-কে। অথবা কিছু পৃষ্ঠায় দেখবেন কতগুলো পোর্ট্রেট এবং তলায় কিছু ঠিকানা। শোনা যায়, শুটিং দেখতে আসা মানুষদের কারুর মুখ যদি ওঁর কৌতূহলোদ্দীপক লাগত, উনি তাঁদের অনুমতি নিয়ে মুখের স্কেচ এঁকে রাখতেন। এরম কেউ কেউ পরবর্তী ছবিতে অভিনয় করার জন্যে আমন্ত্রিতও হয়েছিলেন।
এ-বছর Ian Christie এবং Julia Vassilieva ‘The Eisenstein Universe’ (২০২১) নামে একটা সম্পাদিত গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। সত্যজিতের ‘ইউনিভার্স’-এর চাবিকাঠি তাঁর খেরোর খাতা। একটি বাংলা ছোটগল্প কী করে ৮১ সপ্তাহ ধরে টানা চলা একটি হিট ছায়াছবিতে রূপান্তরিত হল, সেই রূপান্তরের পুরো ছবিটাই ধরা পড়ে সত্যজিতের খেরোর খাতায়। TCG-Crest-এর Centre for New Media (CENEMA) প্রকল্পের দৌলতে এই খেরোর খাতা এখন একুশ শতকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সবার হাতের নাগালে। এবং নিউ মিডিয়ার যুগে film এবং auteur নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার নতুন কিছু দিশাও চিহ্নিত হল এর সূত্রে।
ছবি ঋণ: exploreray.org