আমার ছেলেবেলায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শিল্পী হিসেবে জানতাম না বিশেষ, কিন্তু আমাদের কাছে এক অত্যাশ্চর্য জগতের দরজা খুলে দিয়েছিল তাঁর জাদু-কলম। বছর দশেক বয়সে তাঁর লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, বোধহয় ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘শকুন্তলা’, বা ‘নালক’-এর মধ্যে দিয়ে, এখন ঠিক মনে নেই। কিন্তু তার অনতিবিলম্বেই পরিচয় হল ‘রাজ কাহিনী’ আর ‘বুড়ো আংলা’র সঙ্গে, আর অবনীন্দ্রনাথের মধ্যে মজে গেলাম আমি। এক কালান্তক ঊষালগ্নে পৃথ্বীরাজ যখন সেঁকোবিষ মেশানো মতিচুর খেয়ে ঢলে পড়ছেন, আর এক মরুরাজ্যের কাঁটাগাছ-বিকীর্ণ দিকচক্রবাল থেকে উজিয়ে উঠছে আহির ভৈরোঁর করুণ সুর, সেই মুহূর্তটির স্বপ্ন দেখে আমার সেই বালক-বয়সেও ঘুম ভেঙে যেত কখনও কখনও। আর বুড়ো আংলায় মানস সরোবরের পথে উড্ডীয়মান হাঁসের দল যখন রিদয়কে ডানায় লেপটে প্যাঁক প্যাঁক করে তাদের রুটম্যাপ হাঁকতে হাঁকতে যাচ্ছে, তখন তাদের পক্ষপুটের নিচে নকশি কাঁথার মতো আমার কাছে উন্মোচিত হয়েছিল আমার, তখনও না-দেখা, ‘দেশ’, অর্থাৎ চলন বিলের দেশ, পূর্ববঙ্গ। তাই, অনিবার্য ভাবেই, আমার শৈশব ও বাল্যের প্রিয়তম ঠাকুর ছিলেন ‘ওবিন ঠাকুর’, যে ‘ছবি লেখে’।
তুলনায়, ছবি লেখার উল্টো পিঠ, ‘গল্প আঁকা’ – অর্থাৎ আমাদের পরিচিত নানান কাহিনির কোনও দৃশ্যপটকে এক বিধুর পেলবতায় চিত্রায়ণ ও বাঙময় করে তোলা – আমার জগতে প্রবেশ করে এর অনেক পর। ছাত্রজীবনে, বা পরে গবেষণা-শিক্ষকতার জীবনে মুহূর্তমাত্রের জন্য কখনও কখনও চোখে পড়েছে তাঁর কিছু বিখ্যাত ও বিগ্রহপ্রতিম ছবির ছাপাই সংস্করণ, যেমন ‘ভারতমাতা’ বা ‘শাহজাহানের মৃত্যু‘ । খুব তলিয়ে সেগুলি দেখিনি, সামনে থেকে দেখা তো দূরস্থান। সারা কলকাতা শহরেই অবনীন্দ্রনাথের মতো শিল্পীর ছবি দেখা ছিল প্রায় অসম্ভব।
অথচ এমনকী ঔপনিবেশিক আমলেও এমন অবস্থা ছিল না। উনিশ শতকে প্রাচীন ভারতের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য, মুদ্রা ও শিলালিপি থেকে শুরু করে জীবজন্তু, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, ধাতব ও খনিজ সম্পদ, এবং নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র, অস্ত্রশস্ত্র, সঙ্গীত ও সাজসজ্জার সরঞ্জাম দিয়ে শুরু হয়েছিল জাদুঘর অর্থাৎ ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের সংগ্রহ, সেখানে প্রত্নসামগ্রী ও ন্যাচারাল হিস্ট্রির পাশাপাশি তথাকথিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা ডেকরেটিভ আর্টস জায়গা পেলেও, কোনও ছবির সংগ্রহ প্রথমে সেখানে ছিল না। সেই সংগ্রহ গড়ে উঠবে অনেক পরে, ১৮৯০-এর দশকে, যখন চিৎপুরের গরানহাটা থেকে আর্ট স্কুল উঠে আসবে এখনকার জাদুঘর চত্বরে, ক্যালকাটা আর্ট গ্যালারি গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টের মধ্যে সন্নিবিষ্ট হবে, আর ভারতীয় সংগ্রহশালার সঙ্গে সংযুক্তির মাধ্যমেই প্রথম গড়ে উঠবে সেই সংগ্রহালয়ের আর্ট সেকশন বা চিত্রবীথিকা। অল্প দিনের মধ্যেই হ্যাভেল সাহেবের উদ্যোগে তাঁর নিজের গড়ে তোলা চারুশিল্পের সংগ্রহ জায়গা পাবে সেই মিউজিয়ামে, সেই সংগ্রহ ঋদ্ধ হবে মুঘল অণুচিত্রের পাশাপাশি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রীদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে। এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ইয়োরোপীয় প্রাচ্যবিদরা আগে থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন চিত্রিত অলঙ্করণ সহ বৌদ্ধ ও জৈন পাণ্ডুলিপি, যেমন কল্পসূত্র, সেগুলির পাশাপাশি ১৮৮০-৯০-এর দশক থেকে এই চিত্রবীথিকায় জায়গা পায় কালীঘাট পটের সম্ভার, হ্যাভেলের নিজের মুঘল অণুচিত্রের সংগ্রহ, এবং তারপর হ্যাভেলেরই উৎসাহে অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর ছাত্রদের ছবি। ১৯১৪ সালে ভারতীয় সংগ্রহালয়ের শতবার্ষিকীর সময় এই পেইন্টিং গ্যালারি বা চিত্রবীথিকা ছিল মিউজিয়ামের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং লোকপ্রিয় শাখা।
কিন্তু এর প্রায় একশো বছর পরে আমরা দেখি, কলকাতার জাদুঘরের ‘পেইন্টিং গ্যালারি’ দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ ছিল, আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় তৈরি-হওয়া ‘ক্যালকাটা গ্যালারি’র সুসজ্জিত নাগরিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল অবনীন্দ্রনাথের একটিমাত্র ছবি। তাই সংস্কৃতির গর্বে গরীয়ান বাঙালির পীঠস্থানেও বেঙ্গল স্কুল অব আর্টের পুরোধাপুরুষের, ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীর কাজের নিদর্শন ছিল প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস বা বিড়লা অ্যাকাডেমিতে তাঁর বেশ কিছু ছবি থাকলেও, নানা কারণে সেখানে খুব বেশি জনসমাগম হয়নি, অবনীন্দ্রনাথের সামগ্রিক শিল্পকৃতির উপর সেভাবে নজর পড়েনি। তাঁর ছবি ভাল করে দেখার তাই জন্য ছুটতে হত দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্টে, যেখানে ষাটের দশক থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে জায়গা করে নিয়েছে তাঁর প্রায় একশো ছবি।
সৌভাগ্যের কথা, গত এক দশকে কলকাতায় এই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম যুগান্তকারী পরিবর্তন ২০০৭ সালে, যখন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সংরক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত সংস্থা রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি তাঁদের কাছে কুড়িটি গোদরেজ ক্যাবিনেটে ঠাসা বেঙ্গল স্কুল অব আর্টের পাঁচ সহস্রাধিক ছবি এক দীর্ঘমেয়াদি ঋণচুক্তিতে তুলে দিলেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের হাতে। সেই অতুল রত্নরাজির থেকে প্রথম প্রদর্শনী ২০১২ সালে, অবনীন্দ্রনাথের সহোদর ও সহশিল্পী গগনেন্দ্রনাথের ১০৭টি ছবি দিয়ে।
এর আট বছর পর একই সঙ্গে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও ভারতীয় সংগ্রহশালার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে এক অভূতপূর্ব সুযোগ উপস্থিত হল আমার শৈশবের প্রিয় ‘ছবি-লিখিয়ে’ অবনীন্দ্রনাথের ছবির সঙ্গে এক অদ্ভুত নৈকট্য গড়ে ওঠার। ২০১৫ সালের বসন্তে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে আমরা আয়োজন করেছিলাম অবনীন্দ্রনাথের ১২৩টি ছবির এক চমকপ্রদ প্রদর্শনী, যার অধিকাংশই কলকাতাবাসী জীবনে প্রথম দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রদর্শনীর ছবিগুলি নির্বাচন করেছিলেন ভারতীয় চিত্রশিল্পের এক অগ্রগণ্য ইতিহাসবিদ, রবীন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথের শিল্পকৃতি সম্পর্কে প্রামাণ্য গ্রন্থ আর্ট অব থ্রি টেগোরস-এর লেখক অধ্যাপক রতন পারিমু। তাঁর সঙ্গে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের একটি ছোট ঘরে বসে একটি পুরনো টেবিলের উপর কয়েক ইঞ্চি দূর থেকে ভারতমাতা, আগ্রা দুর্গ থেকে যমুনার অন্য পারে আবছায়া চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত তাজ মহলের দিকে তাকিয়ে বন্দি শাহ জাহানের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের অমর চিত্রায়ণ দ্য পাসিং অব শাহ জাহান, বা মেঘদূতের বিরহী নায়ক দ্য ব্যানিশড্ যক্ষ, ইত্যাকার ছবিগুলিকে ফুটখানেক দূর থেকে খুঁটিয়ে দেখার রোমাঞ্চ এখনও মনে আছে। আর শিহরিত হয়েছিলাম আরব্য রজনী সিরিজের ছবিগুলি দেখে, যেখানে প্রায়শই মিলে মিশে এক হয়ে যায় হারুণ অল রশিদের বাগদাদ আর অবন ঠাকুরের জোড়াসাঁকো বা চিৎপুর। নূর অল-দীনের বিয়ের সাড়ম্বর বর্ণচ্ছটা দেখে মনে পড়েছিল গুপি গাইন বাঘা বাইনের কথা, আর এক উৎসুক শ্রোতাসমাগমের মধ্যমণি প্রাজ্ঞ, দয়ার্দ্র নাবিক সিন্দবাদকে দেখে মনে হয়েছিল, ঈশ্বর যদি থাকতেন, তাঁকে দেখতে হত ঠিক এই রকম। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের এই অনন্য প্রদর্শনীটিকে আন্তর্জালে দেখানোর জন্য সোৎসাহে এগিয়ে এলেন গুগল্, তাঁদের ওয়েবসাইটে সেটি এখনও দৃশ্যমান (https://artsandculture.google.com/exhibit/abanindranath-tagore/mQLy4Bz_4BcpLg)।
এর কয়েক মাস পরেই সুযোগ এল জাদুঘরের চিত্রবীথিকাকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে প্রায় পনেরো বছরের ব্যবধানে দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়ার। সেখানে প্রদর্শিত হল অবনীন্দ্রনাথের কয়েকটি অনন্য ছবি, যেমন ‘গণেশ জননী’ বা রোম্যান্টিক নায়িকার সেই কালজয়ী প্রতিমূর্তি, ‘অভিসারিকা’। ‘অভিসারিকা’র সেই বহুদৃষ্ট, নিশিনিবিড় রূপটি ছাড়াও চমকে গেছিলাম আরেক অভিসারিকার ছবিতে, সাধারণ বেশে যিনি দিনের বেলায় মেঠো পথে হেঁটে চলেন, আর যার উপর-নিচে ব্রজবুলি অক্ষরের ছাঁদে অবনীন্দ্রনাথের অতুলনীয় ক্যালিগ্রাফিতে উৎকীর্ণ গোবিন্দ দাসের পদাবলীর কয়েক লাইন – পৌখলী রজনী পবন বহে মন্দ / চৌদিশে হিম কর হিম করু বন্দ / মন্দিরে রহত সবহুঁ তনু কাঁপ / জগজন শয়নে নয়ন করু ঝাঁপ । এই ভাবে শহরের দুটি প্রধান মিউজিয়ামেই গড়ে উঠল অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকীর্তির শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলির এক সম্ভার।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে অবনীন্দ্রনাথের সার্ধশতবার্ষিকীতে অতিমারিজনিত নানান বিধিনিষেধের কারণে আমরা তাঁর বিচিত্র ও বহুমুখী সৃষ্টি সম্পর্কে আরেকটি প্রদর্শনী এখনই করতে পারছি না, যদিও সেই কাজের জন্য আমরা ব্যগ্র। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নিজস্ব সংগ্রহে রয়েছে তরুণ অবনীন্দ্রনাথের – সতেরো-আঠারো থেকে শুরু করে তেইশ-চব্বিশ বছর বয়স অবধি – আঁকা পঞ্চাশটির বেশি ছবি, আর সেখানে সংরক্ষিত রবীন্দ্রভারতী সোসাইটির সংগ্রহে এক পরিব্যাপ্ত সম্ভার, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে পাঁচশো ছবি, যার সৃষ্টিকাল ১৮৯০ থেকে শুরু করে প্রায় তার পর অর্ধশতাব্দী জুড়ে। তাঁর বিখ্যাততম ‘সিরিজ’গুলির অধিকাংশই পূর্ণ গরিমায় এখানে মজুত, শুধু – সম্ভবত তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজের নিদর্শন – আরব্য রজনী চিত্রমালার থেকেই রয়েছে আটত্রিশটি ছবি, কৃষ্ণলীলা সিরিজের দশটি, কবিকঙ্কণ চণ্ডী সিরিজের তেইশটি, ষাটের বেশি মুখোশ – যার অধিকাংশের বিষয় ঠাকুরবাড়িতে অভিনীত নাটকের কুশীলবরা (রবীন্দ্রনাথ নিজে যার অনেকগুলির নায়ক) – বাঙালি পর্যটকদের অতি প্রিয় দুই শহর পুরী ও দার্জিলিং-এর নিসর্গ চিত্র, এ ছাড়াও অসংখ্য বিচিত্র বিষয়ে আঁকা মূলত জলরং অথবা তুলি-কালির যুগলবন্দিতে প্রাণ-পাওয়া ছবির এক অতুলনীয় ঐশ্বর্যসম্ভার। গত বছর থেকেই দিল্লি আর্ট গ্যালারির (ডিএজি) সঙ্গে সহযোগিতায় অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর সহশিল্পীদের সৃষ্টিবৈচিত্র্য নিয়ে আন্তর্জালে একাধিক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছি আমরা, সেই ধারাতেই ঠিক তিন সপ্তাহ আগে শিল্পীর ১৫০ বছরের জন্মদিনে (৭ অগস্ট) আমরা এক সঙ্গে শুরু করলাম স্মরণ, প্রদর্শন ও আলোচনার এক বর্ষব্যাপী কর্মযজ্ঞ, অবনীন্দ্রনাথ অ্যাট 150, যার মাধ্যমে ১৯১৫ সালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথ-সমরেন্দ্রনাথ-সুনয়নীর মতো ভাইবোনেদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এক অভিনব শিল্প-কর্মশালা বিচিত্রা স্টুডিওর বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিশীলতার নানান দিকগুলিকে ফিরে দেখব আমরা। এই আয়োজন ও পালনে হয়তো আপাতত আন্তর্জালই ভরসা, কিন্তু অদূরে, অতিমারি পেরিয়ে-আসা এক শহরের সর্বশ্রেষ্ঠ সৌধের মর্মরগরিমার অন্দরে তার সমস্ত বর্ণচ্ছটা, সমস্ত ইন্দ্রজাল নিয়ে দর্শকদের সামনে উদ্ভাসিত হবে ‘ওবিন ঠাকুরের’ আরব্য রজনী, সেই প্রতীক্ষার রোমাঞ্চই বা কম কী?