দ্য কনফ্লিক্ট টাইমলাইন। এমপ্যাথি অ্যালি। দ্য মেমরি ল্যাব। দ্য সরি ট্রি। আহমেদাবাদের কনফ্লিক্টোরিয়ামে ইনস্টলেশনের সমারোহ।
হাতে আঁকা সময়রেখা ধরে অনেকগুলো ডাকবাক্স, তার ভিতরে গোল করে পাকিয়ে দাঙ্গার রিপোর্ট ঢুকিয়ে রাখা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সব কান্ডারিদের এক-মানুষ উঁচু কাটআউট— গান্ধী, নেহরু, জিন্না, আম্বেদকর, সুভাষ বসু সব দাঁড়িয়ে আছেন অপ্রস্তুত দ্বিমাত্রিকতায়। সুইচ টিপলেই ঘরে গমগম করে উঠছে তাঁদের কণ্ঠস্বর। নেহরু আর জিন্না-র কণ্ঠে আভিজাত্যের আশ্চর্য মিল, গান্ধী আর আম্বেদকরের বাচনভঙ্গি অতটা ‘এলিট’ নয়, সবার কণ্ঠই বেজে উঠছে দৃঢ় সংকল্পের সুরে। ঘরে প্রদর্শিত বলতে একটিই জিনিস— উঁচু বেদির উপর রাখা ভারতের সংবিধানের একটি জরাজীর্ণ কপি। আর একটি ঘরের প্রদর্শনীতে জামাকাপড় আটকে যায়— কাঁটাতারের সব পিলার তোলা, তার ফাঁকে ফাঁকে সংকীর্ণ জায়গা। একটি মেয়ের কণ্ঠ, আকুল স্বরে সাহায্য চাইছে, সে জাতের বাইরে বিয়ে করেছে বলে তার পরিবার তাকে হুমকি দেয়। এই টেপটি বেজে ওঠার পরেই চালানো হয় একটি বাস্তবিক রেডিও ঘোষণা— মেয়েটির মৃত্যুসংবাদ। বলা বাহুল্য, অনার কিলিং— পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে খুন। এঘরে ধ্বনিত হচ্ছে অল্পবয়সি নানা মানুষের কন্ঠ, যারা আক্ষরিক অর্থেই প্রেমের জন্য প্রাণ দিয়েছে। সেসব কন্ঠ শুনলে যে কোনও অতিথিই আঁতকে উঠবেন।
এখানেই শেষ নয়। আঁতকে উঠে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে যদি পাশের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান, দেখবেন আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে একটি দেওয়ালে টাঙানো রোহিত ভেমুলার শেষ চিঠি, সে-চিঠিতে অসংখ্য দুঃখপ্রকাশের ছড়াছড়ি। সে লিখছে, আমায় ক্ষমা করে দেবেন… আর অতিথির হৃদয় কেঁপে উঠছে কত না-করা, না-চাওয়া ক্ষমার ওজনে। তারপরেই নজর গিয়ে পড়ে একটি গাছের উপর, তার ডালে-ডালে মানত করার সুতো বাঁধা। একটু কাছে গেলেই টের পাবেন, এই সুতোগুলোয় এক-একটি কাগজের ট্যাগ লাগানো রয়েছে। তাদের একদিকে লেখা ‘সরি’, অন্যদিকে হাতে লেখা নানা বার্তা। একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখুন, দেখবেন এরকম কার্ড বোঝাই করে রাখা আছে একটি কাচের বয়ামে। তার পাশেই একটা কলম রয়েছে। যাতে আপনি এই সুযোগে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারেন, যা অনেকদিন আগেই চাওয়া উচিত ছিল। যাতে আপনি, যদি আপনার পক্ষে সম্ভব হয়, দুঃখপ্রকাশ জিনিসটার ক্ষমতা নিজে টের পেতে চান। একটু শান্ত হয়ে আপনি সে-ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। যখন আর একটি ঘরে আপনি প্রবেশ করেন, যেখানে একের পর এক কাচের বয়াম ভর্তি হাতে লেখা বার্তা আছে, তখন আপনিও টের পাবেন, সংঘর্ষ কাকে বলে। আপনিও সেখানে ওই উপলব্ধিটি জমা রেখে যেতে পারবেন, ওই মেমরি ল্যাব বা স্মৃতির গবেষণাগারের একটি চিরস্থায়ী অংশ হিসেবে।
কনফ্লিক্টোরিয়াম নিজেকে বলে সংঘর্ষের জাদুঘর— একটি স্মারক স্থান বা মেমোরিয়াল, যেখানে সংঘর্ষের ঘটনাবলি এবং গুরুত্বের হিসেব রাখা হয়, বিশেষ করে গুজরাতের আখরে। রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং ব্যক্তিগত।
মির্জাপুরে নদীর অপর পারে ‘গুল লজ’ নামে একটি বিল্ডিং-এর ভিতর এই কনফ্লিক্টোরিয়াম যে-জায়গায় তৈরি, সেটিই এর অনন্য চরিত্রের প্রথম পরিচয় দেয়। এখানে আসার পথে সবরমতীর দু’ধারে দুই শহরের পার্থক্য পঞ্চেন্দ্রিয়ে ধরা দেয় অনিবার্য ভাবেই। পশ্চিম আহমেদাবাদ যেমন পরিচ্ছন্ন, নিকোনো, তার প্রতিটি ইঞ্চিতে যেমন উন্নয়নের চিহ্ন, পূর্ব আহমেদাবাদ তেমনই পাগলের মতো ছন্নছাড়া। বাড়িগুলো একেবারে ঠাসাঠাসি করে বানানো।
গুল লজ-এর আগের মালিক ছিলেন বাচুবেন নাগরওয়ালা, এখান থেকেই তিনি শহরের প্রথম বিউটি পার্লারটা চালাতেন। তাঁর কোনও উত্তরাধিকারী নেই, তিনি ‘সেন্টার ফর সোশ্যাল জাস্টিস’কে বাড়িটি দিয়ে দেন, কারণ তারা একটা ভাল কাজ করছে। তখনই বাড়িটা চলে আসে অবনী শেঠির দায়িত্বে, যিনি কনফ্লিক্টোরিয়াম-এর প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক।
‘আমাদের মনে রাখা দরকার, এই বাড়িটা যে-জায়গায় তৈরি, সেই অবস্থান এ-বাড়িটাকে শুধু ব্যক্তিগত ইতিহাসই নয়, স্মৃতির সাক্ষী হিসেবে একটি গণ-ইতিহাসের শরিকও করে তুলেছে’, অবনী তাঁর বক্তব্য শুরু করেন এ-প্রসঙ্গেই। আহমেদাবাদে এক সময়ে পার্সি সমাজের বহু মানুষ বসবাস করতেন। মির্জাপুর জায়গাটা খিচুড়ির মতো— মূলত পার্সিপাড়া, তাতে বিপুলসংখ্যক মুসলমানের বসবাস, কিছু হিন্দুরাও থাকেন। জনমানসে মির্জাপুরের ভারি বদনাম, তার খানিকটা অবশ্য বাস্তবও বটে। অবনীর মতে, ‘মির্জাপুরকে অশান্ত এলাকা বলে দেখা হয়, এবং থেকে-থেকেই এখানে অশান্তি বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। কেউ হয়তো কাউকে ছুরি মারল, ব্যক্তিগত কারণ বা গুন্ডাদের দলাদলির ব্যাপার। সেটা সাম্প্রদায়িক রং পেয়ে যায়, বা ইচ্ছে করে রং দেওয়া হয়। ব্যাস, দাঙ্গা করার একদল লোক একজোট হয়ে যায়, তারা এগোতে থাকে দিল্লি দরওয়াইয়ার দিকে। আর আহমেদাবাদিরাও সারাজীবন যা শুনতে অভ্যস্ত, আবার শোনে সেই একই কথা— ‘ধামাল হো রহা হ্যায়।’ ধামাল মানে দাঙ্গা।’
তাহলে সংঘর্ষের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন?
‘কেন নয়?’ অবনীর পালটা প্রশ্ন। ‘আহমেদাবাদে বড় হয়েছেন, এমন একজন মানুষ— মানে রক্তমাংসের একটা আস্ত মানুষ— যদি আপনি হন, তবে সেই দাঙ্গা কিন্তু আপনার শরীরকে তার রূপ দিয়েছে। আমি নৃত্যশিল্পী হিসেবে জানি, আমরা আমাদের প্রতিটি কোষে আমাদের পরিবেশজনিত এবং মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার ভার বহন করি। ডাক্তারদের জিজ্ঞাসা করুন, তাঁরাও এ-কথায় সায় দেবেন।’ কথাগুলো শুনতে আবোলতাবোল লাগলেও, ‘ট্রমা বডি’ বিষয়টা সত্যি। মানসিক বা শারীরিক আঘাত একটা রক্তমাংসের ছাপ রেখে যায়, স্মৃতিশক্তিতে তার আঘাত পড়ে, মস্তিষ্কে বাস্তবিক পরিবর্তন আসে।
অবনী বলতে থাকেন, ‘আমি নিজের অজান্তেই যে-ট্রমা নিয়ে জীবনযাপন করছিলাম, তা আত্মপ্রকাশ করে রাগের রূপে— লোকের উপর রাগ, বিশেষ করে খোশমেজাজি ডিজাইন প্রকল্পের উপর রাগ। এই রাগটাকে একরকম বের করতেই আমি প্রথমে এ-প্রকল্পটির পরিকল্পনা করি। যখন সবরকম হিসেব-নিকেশ, লজিস্টিক্স, জায়গা, অর্থ অনুদান ইত্যাদির ব্যবস্থা হয়ে গেল, তখন বুঝলাম, এ-ব্যাপারটা আরও বেশি কিছু চাইছে, আরও বেশি কিছু করা তার প্রাপ্য। অতএব, এখন যা দেখছেন।’
এই যাত্রা শুরুর উপাখ্যানটি বড়ই কৌতূহলোদ্দীপক, তবে উনি ঠিক কোন ট্রমার কথা বলছেন? ‘মনে রাখবেন, আহমেদাবাদে সব সময়েই ১৪৪ ধারা চলছে। বছরের পর বছর মানুষ জমায়েত করতে পারেনি। গুজরাতে ১৪৪ ধারা যেরকম কথায় কথায় লাগিয়ে দেওয়া হয়, তাতে আমরা ভুলেই গেছি স্বাভাবিক জীবন কাকে বলে। এ-রাজ্যে বসবাসকারী একজন গুজরাতি হিসেবে আপনাকে বলতে পারি, আমাদের পিটিয়ে বশ্যতা স্বীকার করানো হয়েছে। আমরা পিতৃধর্মী শাসনকেই একমাত্র সম্ভবপর শাসনপদ্ধতি বলে ভাবতে শুরু করেছি। উনিশ থেকে তেইশ বছর বয়স যাদের, তারা জানেও না যে অন্য কোনওরকমের নাগরিকত্ব সম্ভব। তারা জানে না যে, নিজের সরকারের সাথে তর্কবিতর্ক, দরাদরি করা যায়, বা তার চেষ্টা করা যায়।’
অবস্থা মনে হয় আরও খারাপ হতে চলেছে। আহমেদাবাদ ‘ডিস্টার্বড এরিয়াজ’ আইনের অন্তর্ভুক্ত, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে যে-আইনের সংশোধন করা হয়। অনেকেরই আশঙ্কা, এটা কেবল প্রথম ধাপ, এবারে এই পথ ধরে এখানে আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল আইন (আফস্পা) আনা হবে, যা কাশ্মীরে জারি রয়েছে। এ জিনিস সত্যিই হবে কি না, তা সময়ই বলবে। কিন্তু ডি এ এ আইনের সংশোধনটি সত্যিই আশঙ্কাজনক। আগে শুধু যে-এলাকাগুলোয় সত্যিই (সাম্প্রদায়িক) দাঙ্গা হয়েছে, সেই সব এলাকাকেই ‘ডিস্টার্বড এরিয়া’ বা ‘অশান্ত এলাকা’ বলে চিহ্নিত করা যেত। এখন প্রশাসনের যদি ‘মনে হয়’ কোনও এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সম্ভব, বা কোনও এলাকায় একটি সম্প্রদায়কে সহজেই খেপিয়ে তোলার ‘সম্ভাবনা’ আছে, তাহলেই সে এলাকাকে অশান্ত বলে চিহ্নিত করা যাবে। এবারে এই ‘সম্ভাবনা’র বিচার করা যে পুরোপুরিই শাসক দলের হাতে, তা খুবই স্পষ্ট।
আশা-ভরসা এবং যন্ত্রণার উপশম তাঁর একারই প্রয়োজন নয়, অবনীর এই উপলব্ধি থেকেই কনফ্লিক্টোরিয়ামের যাত্রা শুরু। তাঁর বক্তব্য, ‘সংঘর্ষের সমাধান খোঁজার আগে সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হবে।’ ডিজাইন বা বিন্যাসের সাহায্যে সংঘর্ষকে তুলে ধরা, এবং মানুষকে তার সম্মুখীন হতে বাধ্য করা, সহজ নয়। ওঁদের মতে, শহরে, রাজ্যে, এবং দেশে হিংসার নান্দনিকতাটাই পালটে গেছে। ‘নান্দনিকতা’-র বদলে ‘অপটিক্স’ বা দেখনদারিও বলা চলে, কিন্তু ডিজাইনার হিসেবে ওঁরা সবকিছুকেই ডিজাইনের আঙ্গিকে দেখতে অভ্যস্ত। ‘তাছাড়া’, অবনীর প্রশ্ন, ‘এ-কথা কি অস্বীকার করা চলে যে আমরা যে-হিংসা অনুভব করি, সক্রিয়ভাবে অথবা পরোক্ষভাবে যে-হিংসায় অংশগ্রহণ করি, তার একটা বড় অংশই ডিজাইন বা গঠনশৈলীর ফল?’
ওঁদের দলের লক্ষ্য যে ‘শিল্পের সৃষ্টি’ করা নয়, সে-বিষয়ে ওঁরা ওয়াকিবহাল ছিলেন। ওঁদের লক্ষ্য ছিল এইটুকু বলা যে, এ-শহরে ‘কিছু একটা গোলমাল রয়েছে।’ এর পাশাপাশি ওঁদের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন ছিল— যা অন্যায়, বা যা ভুল, তাকে কোনওভাবেই একটুখানিও প্রশ্রয় না দেবার প্রয়োজন। কী মাধ্যমে ওঁদের এই কর্ম সম্পন্ন হবে? ‘আমরা শুধু আঁকাআঁকি, গান গাওয়া, এসবই পারতাম, অতএব সে-পথেই এগোনো স্থির হল,’ অবনীর বক্তব্য। এর পরে আস্তে আস্তে কাজের পরিধি বেড়ে তাতে এল নানারকমের চিন্তাভাবনা ও ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের নকশা, তৈরি হল অতিথিদের জন্য একটি সার্বিক অভিজ্ঞতার আখর।
অতঃ কিম? অবনী বলছেন, ‘আগে এই ব্যপারটাকে স্রেফ নিজের মতো করে থাকতে দিতে হবে। এবার, এমুহূর্তে এই প্রকল্পের শুরুর গল্প এবং শুরুর যে পাত্ররা, তাদের আর প্রয়োজন নেই। এই প্রয়োজন না থাকার কৃতিত্ব আমাদের নবীন দলটির, যারা এ-যুগের পক্ষে প্রাসঙ্গিক, যারা সামাজিক-রাজনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক নানা বিষয়ে আগ্রহী।’ কনফ্লিক্টোরিয়ামের দলটি একেবারেই সমমনস্কদের সংগঠন নয়, এ-দলে ইচ্ছে করেই এমন সব লোকজনকে নেওয়া হবে যারা নিজেদের বিশ্বাস, নিজেদের ভাবনার সপক্ষে লড়তে চায়, এমন সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছিল। এখানে কাজের পরিবেশটি অতএব সরাসরি সংঘর্ষমূলক না হলেও তর্ক-বিবাদে বেশ পরিপূর্ণ। অবনী হেসে জানালেন, ‘আমাদের সবাই সবসময়েই তর্ক করছে, একে অপরের সাথে আমাদের সব বিষয়ে মিল হবে না, এটা মেনে নিয়েই আমরা একসঙ্গে থাকতে শিখি। আমাদের দলটা যদি সংঘর্ষের মোকাবিলা করতে স্বচ্ছন্দ না হয়, তবে আবেগের বা প্রবৃত্তির স্তরে সংঘর্ষের প্রকৃত রূপকে সবার সামনে তুলে ধরবে, এমন স্পেসের সৃষ্টি করা যাবে না।’
বর্তমানে এই স্পেসটির নিজস্ব একরকমের সজীবতা অবশ্যই রয়েছে। এই জাদুঘরের, তার প্রভাবের, এবং দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে-সার্বিকভাবে নিজেদের বৃদ্ধির ব্যাপারে এদের দলটি দায়িত্বশীল। এদের একটি ঘোষিত দায়িত্ব হল, যে-যে এলাকার মানুষ কনফ্লিকটোরিয়াম চান, সেখানে এমন কনফ্লিক্টোরিয়াম গড়ে তোলা। অন্যান্য কর্মীদেরও এ-বিষয়ে বিপুল সমর্থন রয়েছে। যেমন পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমাটোগ্রাফার ও পরিচালক দক্সিন বজরঙ্গে। তাঁর বক্তব্য, ‘প্রতিটি শহরের একটি নিজস্ব কনফ্লিক্টোরিয়াম থাকা উচিত। অবশ্যই ফ্র্যাঞ্চাইজি হিসেবে নয়, কোনওটাই যেন অন্যটার কার্বন কপি না হয়।’ দলের অন্যরাও এ-বিষয়ে সহমত— তাঁদের অভিজ্ঞতা, তাঁদের দক্ষতা ব্যবহার করে তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন স্থান, ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবিকতার প্রশ্ন তোলেন। কমিউনিকেশন ম্যানেজার হিসেবে ওয়াই এস কে প্রেরণা আমাদের জানালেন, সাথ চ্যারিটেবল ট্রাস্টের সাথে কাজ করে যে-দলটি মেহনত মঞ্জিল বা শ্রম যাদুঘর তৈরি করেছে (এখানে অসংগঠিত সেক্টরের শ্রমিকদের জীবনযাপনকে সম্মান জানানো হয়, তাঁদের পরিযায়ী জীবন থেকে জীবিকানির্বাহ, বসবাসের ঘরবাড়ির বিষয় থেকে পরিকাঠামো), সেটি অন্য দল ছিল। রায়পুরে সামনেই আর একটি প্রকল্পের কথা চলছে, সেখানেও আলাদা একটি দল কাজ করবে।
এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে আমজনতার মধ্যে সবকিছু মেনে নেবার যে-সংস্কৃতি, তাকে পাল্টানো। প্রেরণার কথামতো, ‘বিগত দশ বছরে একটা পরিবর্তন কিন্তু চোখে পড়ছে। একটা অশান্তি বাড়ছে, একরকমের ছটফটানি আস্তে আস্তে বাড়ছে। এতে সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার একটা ভূমিকা ছিল তো বটেই। এই পরিস্থিতিতে কনফ্লিক্টোরিয়ামের মতো জায়গাগুলো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।’
মির্জাপুরের স্থানীয় মানুষের এ-ব্যাপারে কী মত? ‘ওঁরা একটু কৌতুকের সাথেই আমাদের মেনে নিয়েছেন আর কি,’ হেসে জানালেন প্রেরণা। কনফ্লিক্টোরিয়ামে ওঁদেরও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। স্থানীয় বাচ্চারা ভিতরে এসে লুকোচুরি খেলে। বেশ কিছু টিকটক ভিডিওতেও নাকি কনফফ্লিক্টোরিয়ামকে দেখা গেছে!
এই সহাবস্থান, এই মেনে নেওয়াটা কি সহজেই লাভ করা গেছে? ‘সত্যি বলতে, একটু সময় লেগেছে’, অবনী বললেন। ‘আমরা ভেবেছিলাম এখানে একটা কমিক্স ওয়ার্কশপ করব, সেখানে মহিলাদের সাথে কথা বলব, আমাদের এই সুশিক্ষা-সুচিন্তার প্রভাবটা একটু ছড়াব। কিন্তু ওভাবে কিছু হয় না। যেটা কাজ দিল, সেটা হচ্ছে নুক্কড় মডেল। আগে স্থানীয় লোককে বিশ্বাস করাতে হল যে, আমরা বাইরে থেকে নাক গলাতে আসিনি। তারও আগে এই কথাটা নিজেদেরই বিশ্বাস করাতে হয়েছে। নাক গলানোর প্রয়োজন যদি পড়ে, ওঁরা নিজেরাই আমাদের কাছে আসবেন…।’
খবর চালাচালির মাধ্যম কিন্তু সুবিস্তৃত এবং অবারিত। প্রেরণা বললেন, ‘শেষ প্রদর্শনীর একদম শেষের দিকে রঞ্জিতাবেন (মুখ্য পরিচারিকা) তাঁর নিজের পরিবার নিয়ে হাজির, কিউরেটরের মেজাজে খালিপায়ে গোটা এলাকাটা ঘুরে ওদের দেখালেন। ওঁর আগ্রহ আছে, এটুকুই যথেষ্ট। এটুকুই প্রত্যাশার চেয়েও বেশি প্রাপ্তি।’
এ-শহরের সংস্কৃতিমণ্ডলে কনফ্লিক্টোরিয়ামের পরিচিতি কেমন?
শিল্পী বা ডিজাইন-কর্মীদের সবার আগে সুলভ পরিকাঠামো প্রয়োজন, অবনীর এ-বিষয়ে অটুট বিশ্বাস। স্বাভাবিক ভাবেই এতে অস্তিত্বের বা গোষ্ঠীর একটা প্রশ্ন চলে আসে। এরপরে আসে নিজের রুচিমতো দর্শক তৈরি করার কাজ। অবনী বললেন, ‘কবীর ভাই (কবীর ঠাকোরে) বুধনের জন্য স্ক্র্যাপইয়ার্ড থিয়েটার শুরু করলেন, কিন্তু সেখানে নাটক দেখতে আসে খুব অল্প লোক। এতে বুধন দলের লোকজনের রাগ হয় বইকি, কিন্তু ওই রাগটাকে সামলে ওদের তো কাজ চালিয়ে যেতেই হবে।’
‘এই অবস্থার জন্য দায়ী এ-শহরের প্রতিষ্ঠানগুলো,’ অবনী আরও বলেন, ‘পরিবারও বাদ যায় না। এই দেখুন না, সংস্কৃতির সাথে আমার আলাপ করাতে আমাকে শুধুই দর্পণাতে নিয়ে যাওয়া হত কেন? ছারানগরেও কেন নিয়ে যাওয়া হত না?’
তাঁকে ছারানগরে নিয়ে যাওয়া হয়তো হয়নি, কিন্তু ছারানগরের বাসিন্দারা মনেপ্রাণে কনফ্লিক্টোরিয়ামকে ভালবেসেছেন। তাঁদের মতে, কনফ্লিক্টোরিয়াম তাঁদের নিজেদেরই স্থান। ‘আপনা জগাহ হ্যায়,’ এ-কথা শোনা যায় অতীশ ইন্দ্রেকরের মুখে, বুধন থিয়েটারের একজন কর্মী, যিনি কনফ্লিক্টোরিয়ামের স্পেসটাকে ব্যবহার করেন নাটকের মহড়ার জন্য। ‘নাটক করার জায়গা আমাদের তো অনেকেই দেয়, কিন্তু আমাদের যাদের বিরাট বিরাট বসার ঘর বা ছাদ নেই, তারা মহড়া দিই কোথায়? একজন দুঃস্থ শিল্পীর কাছে মহড়ার জন্য সুলভ জায়গা কিন্তু পারফর্ম্যান্সের মঞ্চের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
সমস্ত সাংস্কৃতিক পরিসরেরই নিজস্ব অনুশাসন রয়েছে, এবং সমস্ত অনুশাসনই নিজেদের কোনও না কোনওভাবে সাজিয়ে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে। অবনীর দৃঢ় বিশ্বাস, এই আইকনদের উপস্থিতির জন্যই কর্মীদের আরও বেশি করে নানা প্রশ্ন করা উচিত। ‘বিবেকবান কর্মী হিসেবে আমাদের সমষ্টিগত কার্যকলাপের খুঁতগুলো আমাদের অবশ্যই ধরা উচিত। কারণ উদ্দেশ্য যতই সাধু হোক, আমাদের মধ্যে যাদের মজ্জাগত প্রিভিলেজ বা সামাজিক ক্ষমতা আছে, তারা বারবার হোঁচট খাবে, পড়বে, ভুল করবে।’
এর উদাহরণ ‘কড়ক বাদশাহি’, আমেদাবাদের ৬০০ বছরের উদযাপন উপলক্ষে একটি প্রযোজনা। যা শুনলাম, যতক্ষণ গল্পটি জনজাতির এলাকায় ঘটছিল, ততক্ষণ সাজপোশাক দেখে মনে হচ্ছিল সেসব পোশাকের ক্যালিকো মিউজিয়াম অফ টেক্সটাইলে স্থান পাওয়া উচিত। গল্প যেই আহমেদ শাহ অবধি গড়াল, তখনই সাজপোশাকে চলে এল চটকদারির বাড়াবাড়ি— কেবল সাটিন এবং সস্তার সোনালি জরি। অবনী বললেন, ‘আমার জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল, তোমাদের পারস্যের তাঁতশিল্প কোথায়, কোথায় তোমাদের বেনারসি ব্রোকেড? একমাত্র এইভাবেই কি মুসলমান পরিচিতিকে তুলে ধরতে হত তোমাদের? মল্লিকাবেনের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল, কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। পারলাম যে না, সে আমারই অসফলতা…’
অবনী আরও বললেন, ‘আমাদের যেগুলো নিয়ে প্রত্যেকদিন প্রশ্ন করা উচিত, সেগুলো হচ্ছে যে নীরব সিদ্ধান্তগুলো, অবচেতন সিদ্ধান্তগুলো আমরা নিজেরা নিয়ে থাকি বা অন্যদের নিতে দিই। কনফ্লিক্টোরিয়াম এমন একটা জায়গা হয়ে উঠুক, যেখানে মানুষ এই জিনিসগুলো অনুভব করে, তাদের মনে পড়ে যায় প্রশ্ন করার কথা। নিজেদের কাছে, নিজেদের সমাজ-সম্প্রদায়ের কাছে।’
ডিজাইনে ও পারফর্ম্যান্স বিদ্যায় এ-দলের শিক্ষা, এবং ইন্টারডিসিপ্লিনারি বা আন্তঃশৃঙ্খল গবেষণায় তাদের অভিজ্ঞতা তাদের এ-লক্ষ্যে অগ্রসর হবার রসদ দিয়েছে— তাঁদের লক্ষ্য একটি অনন্য, অভিজ্ঞতামূলক পরিসর সৃষ্টি করা। কিন্তু এই কনফ্লিক্টোরিয়াম তার চেয়েও বেশি কিছু, এই কনফ্লিক্টোরিয়াম সামাজিক-রাজনৈতিক কথোপকথন ও পরিবর্তনের অনুঘটক। দক্সিন বললেন, ‘কনফ্লিক্টোরিয়াম আমার মতো লোকের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, আমরা যারা নিপীড়িত সমাজের মানুষ (উনি তালিকাভুক্ত একটি জনজাতির সদস্য), তাদের মনে হয় ম্যায় অকেলে নহি হুঁ, ইয়ার! একা নই! এই উপলব্ধির থেকে রাগ হয়, একটা কোনও পরিবারের সদস্য বলে মনে হয় নিজেকে, পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার প্রেরণা পাওয়া যায়।’
শুধু ওখানকার ইন্সটলেশনগুলো নয়, এ-জাদুঘরে সজীব রয়েছে মানুষের অভিজ্ঞতার, অনুভবের, উপশমের আবেগ, প্রতিক্রিয়া, অংশগ্রহণ। দলের সদস্যরা জানালেন মানুষ কোনও না কোনও ইন্সটলেশনের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করেছেন। অন্যরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা নীরবে কেঁদেছেন। একটি ঘটনা চোখের সামনেই ঘটতে দেখেছিলাম, আমাদের মনে থাকবে। একজন নবীনা চোখে জল নিয়ে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করতে যাচ্ছেন, সবে একটু বসেছেন, একটু জিরিয়ে নেওয়া দরকার। একজন ষণ্ডামতো সিকিউরিটির লোক তাঁকে জলের বোতল বের করার থেকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখন আপনার কারও নিজের হাতে দেওয়া জলের দরকার।’ কান্নায় লাল হয়ে যাওয়া চোখে নবীনা একটু থতমত খেয়ে তাকিয়েছেন, এমন সময়ে পরিচারিকা রঞ্জিতাবেন এলেন, হাতে স্টিলের গেলাসে ঠান্ডা জল। নবীনা সেই জল খেলেন, তাঁর চোখেমুখে কৃতজ্ঞতার চিহ্ন। এই সহমর্মিতাটুকুই এই স্পেসটিকে ধারণ করে আছে। এ-শহরে যতদিন ছিলাম, রোজ নানা অন্য কাজের ফাঁকে ওখানে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে এই পরিবেশ। কনফ্লিক্টোরিয়াম কিন্তু শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত জায়গা নয়, তাকে ‘সুশ্রী’ও বলা চলে না। এই স্পেসটি অনুভূতিকে আকর্ষণ করে না, তাকে আরাম দেয় না।
বরং সে দগদগে ঘায়ের মতো টিকে থাকে, যন্ত্রণার-কাটা দাগের প্রভাব নিয়ে, একদিন সেরে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে।
তার আকর্ষণটি আন্তরিক ও আদিম, এবং আশা করা চলে, বৌদ্ধিক।
ছবি তুলেছেন কুশল বাটুঙ্গে