অতিমারীর বিধিনিষেধ আগের চেয়ে একটু শিথিল হতেই শান্তিনিকেতনের রাস্তাঘাটে আবার ভালই লোকজন। ওদিকে ফাঁকা জায়গা, বর্ষার ভরা নদী, জলে প্রাণ ফিরে পাওয়া আগাছার বাড়বাড়ন্ত, পোকা আর পাখির ডাক, বিক্ষিপ্ত সবুজের হাতছানিতে বোঝার উপায় নেই অন্যান্য কত জায়গায়, কী দুঃসহ এক-একটা দমবন্ধ করা জীবন কাটছে! শহর আর বিভিন্ন শহরতলি থেকে সারা বছর শান্তিনিকেতনে মানুষের ঢল। অতিমারীতে খুব দূরে কোথাও যাওয়া ঝক্কির ব্যাপার। শান্তিনিকেতন তাই আবার একটু একটু পর্যটক টেনে আনছে। কিন্তু এলাকার মুখ্য আকর্ষণ বিশ্বভারতী, তার চত্বর বন্ধ বিগত এক বছরেরও বেশি। বন্ধ রবীন্দ্রনাথের বাসভবন, উদ্যান, গাছের নীচে বসা বিদ্যালয়, সংগ্রহশালাগুলো। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটা ধরে গেলে বাইরে থেকে উপাসনা গৃহ, শান্তিনিকেতন বাড়ি, ছাতিমতলা, কলাভবন, রামকিঙ্করের ভাস্কর্য, নন্দলাল বসু, অমর্ত্য সেনের বাড়ি ইত্যাদি একঝলক যতটা দেখা যায়— সেটুকুই দেখতে গাড়ি আর টোটোর ভিড়। বন্ধ বিশ্বভারতী দেখে পর্যটকদের সম্ভবত বেশির ভাগের প্রশ্ন, ‘এখানে যাওয়ার জায়গাটা কোথায়?’ সত্যি সত্যি শান্তিনিকেতনে যাওয়ার জায়গাগুলো যেন কমতে কমতে প্রায় শূন্য। তার মধ্যেই ইতিউতি জেগে রয়েছে আনন্দ।
বরোদায় শিল্পকলার প্রথাগত পড়াশোনার পর লিপি বিশ্বাস তাঁর শিল্পী-স্বামী বিদ্যুৎ রায়কে নিয়ে ডেরা বেঁধেছিলেন একটা ছায়া-সুনিবিড় আদিবাসী গ্রাম, শান্তিনিকেতন থেকে ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে সবুজের ভিতর জেগে থাকা বনেরপুকুর ডাঙায়। লিপি শান্তিনিকেতনের এক স্টুডিও পটার আর বিদ্যুৎ পরিকল্পনা করেন, পরিবেশবান্ধব মাটির বাড়ির। তাঁদের স্টুডিওটা দেখবার মতো। স্টুডিও বনেরপুকুর ডাঙা। প্রদর্শনকক্ষের ছাদের একটা জায়গা শূন্য। সেখান থেকে ঘরের ভিতর নেমে আসে বৃষ্টি। কেউ চাইলে উঁকি মেরে দেখতেই পারেন পাশেই লিপির কাজের জায়গায় যেখানে কুমোরের চাকা ঘুরছে সবসময়। একমাত্র মেয়ে আর কয়েকটা কুকুর-বেড়াল নিয়ে পাশেই লিপিদের নিজেদের বসবাসের মাটির বাড়িটাও বেশ আশ্চর্য। তবে এখানে প্রবেশের অনুমতি নেই পর্যটকদের। কখনও চায়ের সময় হাজির হলে হাতে পাওয়া যেতে পারে অপূর্ব এক মৃৎপাত্রে ‘কাফিরলাইম’-এর সুগন্ধে ভরপুর এক কাপ চা। লিপি আর বিদ্যুতের জীবনযাত্রায় দেখা যায় জাপানের ‘ওয়াবি-সাবি’র গভীর প্রভাব, যার মূলে রয়েছে সারল্য আর অসম্পূর্ণতা। প্রয়াত পিতার স্মৃতি ধরে রাখার অভিনব উদ্যোগ হিসেবে একবার লিপি তাঁর পটারি গ্লেজ করবার কাজে ব্যবহার করেছিলেন পিতার চিতাভস্ম।
বনেরপুকুর ডাঙার একেবারে উত্তর প্রান্তের ছোট্ট অথচ প্রকৃতি-ঘেরা একটা বাড়িতে থাকেন এক বিদেশি ভদ্রলোক। লম্বা একটা নাম রয়েছে, কিন্তু এলাকায় পরিচিত পেপে নামেই। নিবাস স্পেন। প্রায় এক দশক আগে ভারতে এসে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন। শিক্ষা এবং পেশায় আলোকচিত্রশিল্পী পেপে তাঁর স্টুডিওয় বিগত কয়েক বছর তৈরি করেন আশ্চর্য সব নকশার কাঠের আসবাব, ফুলদানি, আয়না। বছরের পর বছর ধরে বেড়ে ওঠা, কখনও রোদে-জলে পড়ে পড়ে নষ্ট হওয়া কাঠের নিজের সৌন্দর্য আর খুঁত বজায় রেখে তৈরি করা আসবাব তাঁর তোলা ছবির সঙ্গেই পেপে সকলকে সংগ্রহ করবার সুযোগ দিয়ে থাকেন তাঁর ইন্সটাগ্রাম প্রোফাইলের মাধ্যমে। খুব চেনা হলে মিলে যেতে পারে তাঁর বাড়ি আর স্টুডিও ঘুরে দেখবার সুযোগ।
বছর দুয়েক আগেও শান্তিনিকেতনে জনপ্রিয় ছিল ‘আলচা’। রতনপল্লীর পাশাপাশি দুটো ভাড়াবাড়িতে তৈরি হওয়া রেস্তোরাঁ আর তার সঙ্গেই এক বুটিক। দক্ষ কারিগরদের দিয়ে আলচার ভিন্ন রুচির খেসের শাড়ি, পোশাক, ব্যাগ, পর্দা, ধূপ, সাবান, ল্যাম্পশেড, বিছানার চাদর, ডোকরার কাজ নিজে তদারকি করে তৈরি করাতেন কেয়া সরকার। আর সতীশ সেতুরামন আলচার রেস্তোরাঁর জন্য বানিয়েছিলেন জিভে জল আসা একটা মেনু, যার ভিতর পাওয়া যেত স্প্যানিশ অমলেট, সাবুদানার বড়া, আলুর টিকিয়া, ঘুগনি আর বাটার টোস্ট, প্যান কেকের মতো অনেক কিছু। আলচার দোকান দুটো উঠে গেলেও প্রায় কুড়িজন কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে চমৎকার নানা কিছু আলচা তৈরি করছে আজও। আগাম যোগাযোগ করলে কেয়া সরকার দেখাতে পারেন সেইসব কাজ। চাইলে পছন্দের কিছু কেনা যায় সরাসরি সেখানেই, তাঁদের পূর্বপল্লীর ওয়ার্কশপ থেকে।
ভাস্কর আশিস ঘোষ কলাভবনের প্রাক্তন ছাত্র। এই সময় শিল্পসদনের কারুশিল্প বিভাগের অধ্যাপক। শান্তিনিকেতনে কোপাই নদীর ব্রিজ পেরিয়ে একটু এগোলেই বিদ্যাধরপুরে আশিসের স্টুডিও ‘মৃত্তিকা’। কাঠ, কংক্রিট, লোহা, পাথর, তামা ইত্যাদি নানা মাধ্যমে মূলত অন্দরসজ্জার নানা উপকরণ তৈরি করে মৃত্তিকা। বেছে বেছে আশিস তাঁর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন ভারতের দক্ষ সব কারিগরদের। সাহসী আশিস প্রয়োজনে উত্তরবঙ্গ থেকে নিয়ে আসতে পারেন অতিকায় মোসো প্রজাতির বাঁশ অথবা মূর্তি নদীর বড় বড় পাথর, কখনও রাজস্থানে তৈরি হওয়া পাথরের জাপানি লন্ঠন। মূলত বাইরের কাজ করার পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য চমকপ্রদ কিছু শিল্পকর্ম নিয়ে মৃত্তিকায় গড়ে উঠেছে একটা শোরুমও। সময় করে চলে গেলেই হল। সবসময় কেউ না কেউ সেখানে কিছু না কিছু করছেন।
এক শিল্পী দম্পতি। বিশাল ভাণ্ড আর বিজয়া হালদার। দুজনেই একসময় শান্তিনিকেতনের কলাভবনের প্রাক্তনী। বিজয়া পাঠ নিয়েছেন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ডিজাইনিং-এও। নিউজিল্যান্ডে সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষ করে বিশাল আপাতত বিশ্বভারতীর শিল্পসদনের অধ্যাপক। বিয়ের পর শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরিপল্লীতে নিজেদের বাড়ির দোতলায় শুরু করেছেন এক টেক্সটাইল ডিজাইন স্টুডিও, ‘বীজ’। ভারতের নানা জায়গা থেকে সুতো, উল নিয়ে এসে স্থানীয় তাঁতিদের দিয়ে কাপড় বুনিয়ে তারপর হরিতকী, মঞ্জিষ্ঠার মতো রঙে নানা আকারের পাতা ডুবিয়ে তার ছাপ দিয়ে এই দম্পতি তৈরি করেন অপূর্ব সব টেক্সটাইল। এই স্টুডিও দেখতে এসে বাড়তি পাওয়া বিশালের সংগ্রহের নানা প্রজাতির প্রায় দেড়শো অর্কিড।
অর্কিডের কথা বলতেই মনে পড়ে সঙ্গীতভবনের পিছনে এক পুরনো বাড়িতে তৈরি হওয়া এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী দম্পতির বহু আদরে গড়ে তোলা ছোট্ট এক নার্সারি, ‘গুল্ম’। এই বাড়ির আবার একটা জাপানি যোগাযোগ রয়েছে। এখানেও অর্কিডের বিপুল সম্ভার। দুর্লভ গাছপালা, হাতের মুঠোয় ধরে যাওয়া শ্যাওলার বাগান, থাইল্যান্ডের আদাগাছ, টি ট্রি— কী নেই এখানে! চন্দনা হোসেন তাঁর নির্বিকল্প এই নার্সারির জন্য গ্রামীণ কারিগরদের দিয়ে তৈরি করিয়েছেন টেরাকোটা আর বাঁশের অপূর্ব সব টব। বলে রাখা ভাল, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাজ করা জাপানি দারুশিল্পী এবং উদ্যানবিদ কিন্তারো কাসাহারার পরিবারই ‘গুল্ম’ গড়ে তুলেছেন এই বাড়িতে। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের সংগ্রহভুক্ত একটা রসিদে দেখা যাচ্ছে, কাসাহারা চিনের এক দোকান থেকে বীজ কিনে রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতনের জন্য নিয়ে আসবার ব্যবস্থা করছেন।
ইতিহাসের ছাত্রী শ্রেয়সী রাকা দাশ শান্তিনিকেতনে আজন্ম পেয়েছেন বিদেশিদের সান্নিধ্য আর তাঁদের সংস্কৃতির পরিচয়। মন দিয়ে দেখেছেন তাঁদের পোশাকের আদল। নিজের খেয়ালে হঠাৎ একদিন খুলে বসলেন নিজের নকশায় পোশাক তৈরির এক প্রতিষ্ঠান। নিজের নামের আদ্যাক্ষর জুড়ে তার নাম দিয়েছেন ‘এসারডি’। রতনপল্লীতে ছোট্ট একচিলতে ঘরে তাঁর শোরুম, কিন্তু তার পসার দেশের সর্বত্র। সচেতন ভাবেই কাজ করেন বীরভূমের নানা গ্রাম থেকে সংগ্রহ করা কাপড় দিয়েই। নিজে একসময় শিখেছিলেন জাপানি ভাষা। তাই জাপানি আদলে বানিয়েছেন বেশ কিছু পোশাক যার একটির নাম ‘তোমোদাচি’ অর্থাৎ বন্ধু।
শান্তিনিকেতনের নীল অর্থাৎ ‘ইন্ডিগো’ শিল্পী পাপড়ি বসাক। জলপাইগুড়ি থেকে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন বিশ্বভারতীর কলাভবনের ‘টেক্সটাইল’ বিভাগে উচ্চশিক্ষার জন্য। একসময় যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশের ‘আড়ং’-এর সঙ্গে। সে-দেশেই তাঁর নিজের কাজ নিয়ে শুরু করেছিলেন ‘সাদাফ ডিজাইন কালেকশন’। ‘সাদাফ’ একটি আরবি শব্দ যার অর্থ ভোরের প্রথম আলো। এরপর সেই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসেন শান্তিনিকেতনের রতনপল্লীতে। সেখানেই কাজ করছেন নীল, হরিতকি, মঞ্জিষ্ঠা, খয়ের, আমলকির মতো নানান প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে। তাঁর বুটিকের সংগ্রহের সিংহভাগ জুড়ে আছে শাড়ি, ওড়না আর ট্যাপেস্ট্রি। বাড়িতেই তাঁর স্টুডিও, আর সেখান থেকেই বিপণনের ব্যবস্থা।
শান্তিনিকেতনের পরিবেশ যে কীভাবে নিজের ভিতরে থাকা শিল্পীকে উতলা করে তোলে, তার একটা উদাহরণ শুভজিৎ চৌধুরী। পেশায় ছিলেন বিলেতের সফল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার। ভিতরে ছিল লুকিয়ে থাকা, ছাই-চাপা কিছু আগুন। শান্তিনিকেতনে কয়েকবার ঘন ঘন বেড়াতে এসে একেবারে নিজের উদ্যমে হয়ে উঠলেন পুরোদস্তুর এক স্টুডিও পটার। আগে যেখানে আলচা ছিল, এখন সেখানেই শুভজিতের কাজের জায়গা, যার নাম দিয়েছেন ‘পটহেড স্টুডিও’। ইংরেজি সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানের কৃতি ছাত্রী রাই গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে এখন সেখানেই গড়ে তুলছেন এক ছোট্ট সংগ্রহশালা— ‘মিউজিয়াম অফ পোয়েট্রি, ক্যালিগ্রাফি অ্যান্ড পটারি’। তাঁর নিজের পটারির সঙ্গে এখানেই দেখতে এবং কিনতে পাওয়া যাবে এক কবি ও ক্যালিগ্রাফারের কাজ। এই সংগ্রহশালার একটা মজা রয়েছে। এর প্রদর্শিত সংগ্রহগুলো কিন্তু কেনা যায়। অনেকটা আর্ট গ্যালারিরই মতো। নিজস্ব স্থায়ী সংগ্রহ বলে কিছু নেই। অনেক সময় এখানে দেখা যাবে লাইভ পটারি আর ক্যালিগ্রাফি। উৎসাহীরা যোগ দিতে পারবে পটারি আর ক্যালিগ্রাফির নানা কর্মশালায়। সেই সঙ্গে রয়েছে দেশ-বিদেশের খাবার চেখে দেখার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ। মামুলি ক্যাফে অথবা রেস্তোরাঁ নয় কিন্তু।
শান্তিনিকেতনের সৃজনের নানা ধারা সবসময় প্রবাহিত হয়েছে। তার সঙ্গে যেন খুব বেশি করে জড়িয়ে গিয়েছে বিশ্বভারতী। বিশ্বভারতীর ছায়ার বাইরে, নতুন সময়ে এবার সামনে আসছে মন ভাল করে দেওয়া এরকমই কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগ। এইসব উদ্যোগের ভিতর কোথাও যেন রয়েছে সৃজনের অনাবিল আনন্দ আর অপার স্বাধীনতা।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র