এক স্নেহময়ী দিদিকে তাঁর শান্তস্বভাব ভাইটির সম্পর্কে পরম প্রশ্রয়ে বলতে শুনেছি, ‘ওর দ্বারা কিচ্ছু হবে না, ও একটা ঢ্যাঁড়স।’ এত দিন এই ‘নিষ্পাপ’ বাক্যটি সম্পর্কে মনে কোনও সংশয় জাগেনি, আজ হঠাৎ অনেকগুলি প্রশ্ন একসঙ্গে মাথাচাড়া দিল। ভাজা বা চচ্চড়ি করে খেতে উপাদেয়, ফাইবার, ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট— সবই আছে শুনেছি, তাহলে ঢ্যাঁড়সের প্রতি কেন এই অশ্রদ্ধা? আজও কেন অনলাইন অর্ডার দিতে গেলে তাকে ‘লেডিজ ফিঙ্গার’-এর মতো একটা সেক্সিস্ট নামে খুঁজতে হবে?
অমিতাভ বচ্চনের প্রিয় খাবার ‘আলু ভিন্ডি’ (অনেকদিন আগের এক দূরদর্শন-সাক্ষাৎকার অনুযায়ী) শুনে যদি আপনার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে, তবে জেনে রাখুন, ঢ্যাঁড়সের আদি নাম ‘ওকরা’, আর তার আদি নিবাস অনুন্নয়ন, অনাহার, ও দীর্ঘকালব্যাপী ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের ত্র্যহস্পর্শে জর্জরিত পশ্চিম আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশগুলি। ষোলো শতক থেকে শুরু করে নিরন্তর এই অঞ্চলগুলি থেকে হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে অগণিত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের ক্রীতদাস বানিয়ে আমেরিকায় নিয়ে যেতেন ইউরোপের দাসব্যবসায়ীরা। অবর্ণনীয় হিংসা, দমন ও অত্যাচারের এই ইতিহাস আমরা অনেকেই জানি। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের সুবাদে বহুচর্চিত সেই কাহিনি এখন আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু অনেকেই জানি না যে, কৃষ্ণাঙ্গ এই ক্রীতদাসদের অনেকে চিরকালের মতো স্বভূমি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ভিটের স্মৃতি হিসেবে লুকিয়ে সঙ্গে নিয়ে যেতেন ঢ্যাঁড়সের শুকনো বীজ। দাসমালিকদের অকথ্য অত্যাচার সয়ে অর্ধাহারে উদয়াস্ত আবাদে কাজ করে বাকি জীবন কাটানোর ফাঁকে, কোনও এক ক্ষণিক অবসরে তাঁদের হাতের সস্নেহ পরশে নর্থ বা সাউথ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, বা অ্যালাব্যামার আবাদের এক গোপন কোণে ফনফনিয়ে, ভোরের শিশির গায়ে মেখে ফলে উঠত শিশু ঢ্যাঁড়স। সেই ঢ্যাঁড়সের সঙ্গে টোম্যাটো, ভুট্টাদানা ইত্যাদি মিশিয়ে রান্না হত এক উপাদেয় সুপ, আর বরাতজোরে যদি পাওয়া যেত মাংসের টুকরোটাকরা, তাহলে তো কথাই নেই! শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা শুয়োরের ভাল ভাল ‘কাট’, যেমন হ্যাম, লয়েন, পর্ক চপ ইত্যাদি সাবড়ে দেওয়ার পর যে অনাদৃত গোড়ালি (‘হক’ বা ‘শ্যাঙ্ক’), পায়ের পাতা (‘ট্রটার’), এমনকী কান বা মাথা পড়ে থাকত— তার সঙ্গে পেঁয়াজ, সেলেরি ইত্যাদির অনুপান সহযোগে ধূলিধূসর স্লেভ-কিচেনে তৈরি হত ‘গাম্বো’ নামের এক অলোকসামান্য ব্যঞ্জন।
অনামা কিন্তু অতুলনীয় এই কৃষ্ণাঙ্গ শেফদের হাতে গড়ে উঠেছিল নিপীড়িত আফ্রিকান-আমেরিকান ক্রীতদাসদের অভিজ্ঞান আর আত্মার অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত এক রন্ধনশৈলী, ‘সোল ফুড’। মার্কিন খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসে কৃষ্ণাঙ্গদের এই অবদানের কাহিনির মধ্যে যে লুকিয়ে আছে দাসপ্রথার এক বিভীষিকাময় ইতিহাস, বহির্বিশ্বের কথা ছেড়েই দিচ্ছি, মার্কিনিদের অনেকেই সে-কথা জানেন না। এই রক্তাক্ত ইতিহাসের এক ব্যঞ্জনাময় অগ্রসৈনিক হল ‘ওকরা’। এই শোষণ-কণ্টকিত ইতিহাসকে বিস্মৃতির অতল থেকে তুলে এনেছে কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন ইতিহাসবিদ জেসিকা হ্যারিসের দশ বছর আগে লেখা অসামান্য বই ‘হাই অন দ্য হগ: আ কুলিনারি জার্নি ফ্রম আফ্রিকা টু আমেরিকা’, যা সদ্য চার পর্বের এক অনবদ্য নেটফ্লিক্স সিরিজে চিত্রায়িত। এর পাশাপাশি অ্যামাজন প্রাইমে দৃশ্যমান আবাদবন্দি ক্রীতদাসদের বিক্ষত জীবন নিয়ে আরেক নির্মোহ ও নির্মম সিরিজ, ‘দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড’, যেখানে কিশোরী ক্রীতদাসী কোরা প্রাণ হাতে করে পালানোর সময়েও কোঁচড়ে বেঁধে নেয় তার পূর্বপলাতক মা ম্যাবেলের দিয়ে-যাওয়া, আফ্রিকা থেকে পরম মমতায় লুকিয়ে নিয়ে আসা ওকরার বীজ। আফ্রো কেশকলাতে আজও অভিজ্ঞান ও প্রতিবাদের চিহ্ন হিসেবে মাঝেমধ্যেই চুলে বেঁধে নেওয়া হয় সেই দুর্মর ও সংগ্রামী তরুলতার বীজ। তাই এখন থেকে একটু বুঝভম্বুল টাইপের মানুষদের কথায় কথায় ‘ঢ্যাঁড়স’ বলে হেলাছেদ্দা করবেন না প্লিজ।
ক্রীতদাসের রক্তাক্ত জীবন সম্পর্কে এই লেখা এই যে আপনারা অনলাইনে পড়ছেন, আর সেখানে আমি আপনাদের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে স্ট্রিমিং সার্ভিসে সেই জীবনের চিত্রভাষ্য দেখার সুপারিশ করছি, আমি জানি এর মধ্যে এক নির্দয় আয়রনি আছে। সেটা স্বীকার করেই বলছি যে, এখন মনে হয় এই যে এত দিন ধরে পাকরাজেশ্বর, ব্যঞ্জনরত্নাকর, বিপ্রদাস প্রজ্ঞাসুন্দরীদের নিয়ে লেখালিখি করলাম, তাতে সমাজের ব্যাপক নিম্নবিত্ত বা পিছড়েবর্গের উপর কতটুকুই বা আলোকপাত হল? এ তো সবই শিক্ষিত, বিত্তবান বাঙালির হেঁশেলের হালহকিকত— মার্কিন খাদ্যশৈলীতে ঢ্যাঁড়সের হারিয়ে-যাওয়া রক্তঋণের মতোই, এই মধ্যবিত্তের আত্মকণ্ডূয়নের মধ্যেও তাই নিশ্চিত চাপা পড়ে যায় এক বিস্মরণের ইতিহাস।
বাল্যকালে যা পড়েছি, এবং পরে আরেক বালককে পড়িয়েছি, রবীন্দ্রনাথের সেই ‘সহজ পাঠ’-এ যেমন অক্ষরের পাশাপাশি আমাদের পরিচয় ঘটে এক ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ গ্রামসমাজের সঙ্গে, যেখানে (খুব সম্ভব জাতপাতের ভিত্তিতে) কাজকর্মের এক সুষম বণ্টন আছে, যাকে সমাজতাত্ত্বিকরা বলেন ‘যজমানী ব্যবস্থা’। কেউ স্ক্রিপ্ট-নির্দিষ্ট রোলের বাইরে যায় না— মালী বাগানে কাজ করে, গয়লানী দুধ দেয়, মুটে মোট বয়, ভারী জল আনে, গঞ্জের জমিদার দাতব্য করে, ভিঙ্গি মেথর করে জঙ্গল সাফ। হঠাৎই মনে হল, ওই খেটে-খাওয়া মানুষগুলি বাস্তবিকই খায় কী? ক্ষীণতনু বইগুলিতে বেশি তথ্যসূত্র নেই, কিন্ত কিছু আভাস-ইঙ্গিত আছে। উশ্রী নদীর ঝর্না দেখতে গেলে সঙ্গে প্যাক করে নেব সন্দেশ, পান্তুয়া, বোঁদে, কিন্তু সঙ্গী চাকর কান্তকে তার দিদি ক্ষান্তমণি বেরনোর আগে খাইয়ে দেবে সেই নগণ্য পান্তাভাত— বাংলাদেশি ক্যুইজিনের সুবাদে ভর্তা সহযোগে ডেলিকেসি হয়ে উঠে যে তখনও আমাদের কাছে ধরা দেয়নি। আমরা আরও জানতে পারি যে, শক্তিনাথবাবু জেলেবস্তিতে থাকলেও তাঁর মস্ত বাড়ি, আর দুই কুস্তিগির দারোয়ান, তাদের মধ্যে একজনকে নিয়ে বাঘ শিকারে বেরিয়ে পথক্লান্ত তিনি একটু জিরিয়ে নিতে নিতে খান লুচি, আলুর দম, আর পাঁঠার মাংস, কিন্তু দারোয়ান আক্রম মিশ্র খায় শুধু চাটনি আর রুটি। কেন? সে কি ছিল ভেজিটেরিয়ান পালোয়ান? কিন্তু তাকে কি অন্তত আলুর দমেরও একটুখানি ভাগ দেওয়া যেত না? তার পর দেখুন, গাছে বিনিদ্র রাত কাটানোর পর পরদিন জঙ্গল-কণ্টকিত রাস্তায় ক্ষুধার্ত ও বিক্ষতশরীর শক্তিনাথবাবু কাঠুরিয়াদের কাছে অকপটে কিছু খাবার প্রার্থনা করলে তারা আদর করে তাঁকে খেতে দেয় চিঁড়ে, বনের মধু, আর ছাগলের দুধ। আন্দাজ করি আক্রমও অভুক্ত থাকেনি, দুজনেরই হয়তো ক্ষুন্নিবৃত্তি আর তৃপ্তি, দুই-ই হয়েছিল। কিন্তু অতিথিপরায়ণ বেচারা কাঠুরেদের নিজেদের পাতে সেদিন কিছু পড়েছিল কি না, বিশ্বকবি তা লেখেননি। হয়তো যুক্তাক্ষর শেখার শক্ত কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পর বক্তব্য অতিরিক্ত বৃদ্ধি করে তিনি আমাদের বিরক্ত করতে চাননি।
তাই আজ অকপটে স্বীকার করি যে, বিস্মরণের কৃষ্ণগহ্বর থেকে খুঁড়ে আনা দরকার শ্রমজীবী, নিম্নবর্গ, প্রান্তিক মানুষদের ক্ষুন্নিবৃত্তি, রান্নাবান্না, ও খাদ্যসংস্কৃতির উপেক্ষিত ইতিহাস, যে-কাজে আমরা এখনও ব্যর্থ। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির রান্নাবান্নায় পরিচারকদের যে-অবদান, অবহেলিত রয়ে গেছে তা-ও। মার্কিন দেশের ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম প্রভাবশালী রান্নার বই, ১৮২৪ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ভার্জিনিয়া হাউজওয়াইফ’-এর লেখিকা, টমাস জেফারসনের তুতো বোন মেরি র্যান্ডলফ, বিনা স্বীকৃতিতে, অক্লেশে আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন তাঁর কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস বাবুর্চিদের অনেক রেসিপি। আমরা অবশ্য সেই রাস্তায় হাঁটিনি। রেণুকা দেবী চৌধুরানী তাঁর ‘রকমারি নিরামিষ রান্নার’ ভূমিকাতে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন রন্ধনশিক্ষায় তাঁর অন্যতম গুরু, জমিদারবাড়ির মুসলমান বাবুর্চি নূরার কথা, হিন্দু পরিবারের ‘সংস্কার’ মেনে সরকারি ভাবে খাতায়-কলমে যার নাম নথিবদ্ধ ছিল ‘নূরা চক্রবর্তী’ হিসেবে। আর তাঁর ‘বুড়ি আয়া’ আমোদিনী ঘোষের দু’চারটি ‘দুঃখীর রান্না’কে অমরত্ব দিয়ে গেছেন লীলা মজুমদার তাঁর ‘রান্নার বই’তে। কিন্তু আমাদের ‘সবর্ণ’ খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসে ওকরার অশ্রুসিক্ত কাহিনির মতোই অধরা রয়ে গেছে দলিতের, তথাকথিত ‘অন্ত্যজ’-এর খাওয়া-দাওয়ার সালতামামি। আগামী কিস্তিতে সে নিয়ে দু’চার কথা বলব।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র