ইনভিজিলেট করতে করতে পায়চারি করতে ভালবাসেন সুচেতনা। চেয়ারে স্থির হয়ে বসে থাকলে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে কথা বললে বা টুকলে ঠিক ধরা যায় না। আজ অবশ্য যারা পরীক্ষা দিচ্ছে, বোঝাই যাচ্ছে তারা কঠোর ডিসিপ্লিনে অভ্যস্ত। একটা নামকরা মিশনারি কলেজের মেয়েদের পার্ট-ওয়ান পরীক্ষার সিট পড়েছে সুচেতনার কলেজে। টোকা তো দূরের কথা, তারা ঘাড় ঘুরিয়ে ফিসফিস করে কথা বলারও কোনও চেষ্টা করছে না। মন দিয়ে লিখে যাচ্ছে আর মাঝেমধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে ‘মিস, পেপার’ বলে পাতা নিয়ে আবার বসে পড়ছে। সুতরাং খুব আরামে ডিউটি দিচ্ছেন সুচেতনা। এ-ঘরে ভাগ করে রমা আর সুচেতনার ডিউটি ৷ রমার শরীরটা ভাল না, পাঁচমাস চলছে। সুচেতনাই ওকে বলেছেন একটু আগে চলে যেতে। এই অবস্থায় বাসে করে যেতে হচ্ছে বেচারাকে। রমার জন্য একটু মায়াই হয় তাঁর। রমা যাবার জন্য মুখিয়েই ছিল। তবু ভদ্রতার খাতিরেই বোধহয় একটু কিন্তু কিন্তু করেছিল, ‘একা খাতা গোছাতে অসুবিধে হবে না সুচেতনাদি?’
‘না রে বাবা। পঁয়ত্রিশটা তো মাত্র খাতা। পর পর সিরিয়ালি সাজিয়ে জমা দেওয়া কোনও ব্যাপারই নয়।’ সুচেতনা হাসিমুখে বলেছিলেন।
রমা একটু চুপ থেকে বলেছিল, ‘তুমি কিন্তু আজকাল খুব চুপচাপ হয়ে গেছ সুচেতনাদি! ওই অসুস্থতার আঘাতটা ভিতরে ভিতরে তোমাকে অনেক পাল্টে দিয়েছে।’
‘তাই? পাল্টে গেছি বলছিস?’ সুচেতনা উচ্ছলভাবে বলেছিলেন।
‘না, তুমি যতই লাইট করে দাও না কেন, তোমার ভিতরটা কেমন যেন নড়ে গেছে মনে হয়।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমাকে অ্যানালাইজ পরে করিস। এখন যা, বাসে ভিড় হয়ে যাবে।’ কোনওরকমে ওকে বাড়ি পাঠিয়েছেন সুচেতনা। পরীক্ষা শেষ হতে আরও আধঘণ্টা। ঘরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পায়চারি করতে করতে রমার বলা কথাগুলোই মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঠিকই বলেছে রমা। সেই দিনটা ভিতরে ভিতরে পাল্টে দিয়েছে সুচেতনাকে। শুধু প্রভাতের অসুস্থতার আকস্মিকতাই কি? আসলে পুরো দিনটাই তো আকস্মিক ছিল। নাহলে হঠাৎ গরমে হাঁসফাঁস করে কেনই বা গেস্টরুমে ঢুকবেন সুচেতনা, তিলকের মাথাটা একদিকে হেলে গেছে দেখে কেনই বা ঠিক করে দিতে যাবেন তা? আমাদের জীবন তো কতগুলো আকস্মিকের খেলা। ‘অয়দিপাউস’ নাটকের লাইনটা খুব অস্পষ্টভাবে মনে পড়ল সুচেতনার। আকস্মিক বলে যা মনে হয়, তাই কি আসলে ভবিতব্য? সবকিছুই কি নিয়তিনির্দিষ্ট ছিল আসলে? ভবিতব্যের কাছে আত্মসমর্পণ দুর্বলের অজুহাত— তাঁর নিজের কি উচিত ছিল না নিজেকে সংযত করা? মধ্যবয়সি নারীর খোলস থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল তরুণীর অবরুদ্ধ কামনা। তিনিই বা রাশ টানতে পারলেন কই?
ভাবতে ভাবতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন সুচেতনা। নিজের বাইরে এসে আত্মবিশ্লেষণের চেষ্টা এতদিন সমানে করছেন। না, এমনিতে কোনও অপরাধবোধ জন্ম নিত না তাঁর মধ্যে। মধ্যবয়সে পৌঁছে প্রভাতের সংসারের হাল ধরে নিজের মতো করে সুখের সংজ্ঞা বুঝে নিয়েছিলেন সুচেতনা। তিলকের জন্য অবরুদ্ধ আবেগ নিজের কাছেও কখনও টের পেতে দেননি। তবু তিলক যখন এল, তখন তার আবির্ভাবকে অস্বীকার করার সাধ্য ছিল না তাঁর। শুধুই কি তাৎক্ষণিক শরীরী আবেগ, নাকি এক জীবনে দ্বিতীয় পুরুষটির সঙ্গেও মানসিক সাযুজ্য অনুভব করেছিলেন বলেই। ভেবে ঠিক করতে পারেন না সুচেতনা। গতকালও প্রভাতের কাছে মেল এসেছে তিলকের। সপ্তাহে একবার হলেও প্রভাতের খবর নিতে ভোলে না ও। মিঠি-চিকু সবার কথা জিজ্ঞেস করে। শুধু জুঁই সম্পর্কে একটি বাক্যও থাকে না। সুচেতনা জানেন তিলক আর ফিরবে না কখনও। ‘আর আসব না আমি। এলেই কষ্ট বাড়ে। যা সঙ্গে নিয়ে গেলাম— সেটুকু সারাজীবন আমার সঙ্গে থাকবে। ওইটুকুই রয়ে যাবে।’ যাবার আগে খুব সংক্ষিপ্ত অবসরে বলে গেছে তিলক। চিকু এয়ারপোর্টের দোকানে চিপ্স কিনতে গেছিল তখন। কী রয়ে যাবার কথা বলছে তিলক জানা হয়নি। জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হয়নি, সময়ও ছিল না। চিকু ফিরে এসেছিল। কী নিয়ে গেল তিলক? এক দুপুরের শরীরী সম্পর্কের উত্তাপ? নাকি আরও বেশি কিছু? তিলকের সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্ক, তা কি শুধু এক অসতর্ক দুপুরের খেলা, নাকি কুড়ি বছর ধরে জ্বলতে জ্বলতে নিভু হয়ে আসার মুহূর্তে আবার দাউদাউ জ্বলে ওঠা! যে আগুন পুড়িয়ে দেয় চারদিকে বিছিয়ে থাকা জগৎসংসার, সমাজবহির্ভূত সম্পর্কের তীব্র উত্তাপে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায় বিপরীত ঘূর্ণনে ঘুরতে থাকা নারীপুরুষ! সেই সম্পর্কের অন্য নামই কি প্রেম? অথচ এও তো সমান সত্য যে, সেদিন প্রভাতের হার্ট অ্যাটাকের খবর পেয়ে যে অপরাধবোধের জন্ম হয়েছিল তা থেকেও মুক্ত হতে পারছেন না তিনি। প্রভাতের অসুস্থতা কি নিছকই কাকতালীয়, নাকি এও দৈবনির্দিষ্ট ছিল? না হলে সুচেতনা হয়তো কোনওদিনই বুঝতে পারতেন না— এখনও প্রভাতকে তিনি কতখানি ভালবাসেন। প্রভাতের জন্য এক অদ্ভুত মায়া, একবুক আর্দ্রতা টের পান সুচেতনা। এই যে টান, এই যে কষ্ট, তার নামও কি ভালবাসা?
খাতা জমা দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সুচেতনা। অফিস-টাইমের ফিরতি ভিড় পথে। প্রভাত বাড়ি ফিরে এসেছেন নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পেয়ে আজ ক’দিন হল। বাড়ি ফিরে সুচেতনা দেখলেন, বিকেলের চা খেয়ে প্রভাত মশগুল হয়ে বই পড়ছেন। বাড়ি ফেরার পর প্রভাতের জন্য সবসময়ের একজন আয়া রাখা হয়েছে। অল্পবয়সি মেয়েটি প্রভাত আর সুচেতনাকে বাবা-মা বলে ডাকে। মিঠিরই বয়স হবে। নাম কনক। কনক সুচেতনাকে দেখে একগাল হেসে বলল, ‘চা করে দেব মা?’ ভাল লাগল সুচেতনার। বেশ একটা আপন করা ব্যাপার রয়েছে কনকের মধ্যে। মিঠি কি চিকু কখনও এত মিষ্টি করে ডেকেছে কি তাঁকে? সুচেতনা মনে করতে পারলেন না। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, চিকু আজ এয়ারপোর্টে গেছে। অভিমন্যুর আজ যাবার কথা। ওদের সঙ্গেই যাবে চিকু। ফেরার পথে অভিমন্যুর দাদু-দিদান নামিয়ে দেবেন। অভিমন্যুর বউ যাবে মাসখানেক পরে। আজ ওর শ্বশুরবাড়ির অনেকেরও এয়ারপোর্টে যাবার কথা। বেশ ছেলেটি। সুদর্শন, স্মার্ট অথচ বেশ সেন্সিটিভ বলে মনে হয়। ওর সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে চিকু অনেক নর্মাল হয়েছে। বুদ্ধি তো কম নেই। মাধ্যমিকের রেজাল্টও তো রীতিমতো ভাল। শতকরা আশির উপর নম্বর পেয়েছে চিকু। চারটে সাবজেক্টে লেটার। ওর খ্যাপাটে ভাবটা এখন কমে গেছে একদম। অভিমন্যু এই মিরাক্ল সম্ভব করেছে। এখন চিকুকে নিয়ে আর অত চিন্তা নেই। মিঠিই বরং খুব দূরে চলে গেছে। ওই দিনের পর খুব কম কথা বলে সুচেতনার সঙ্গে। আগেও যে খুব বেশি বলত তা নয়, তবে আজকাল যে সচেতন ভাবে সুচেতনাকে এড়িয়ে যায় তা স্পষ্ট। মিঠির কথা মনে পড়ায় সুচেতনা কনককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দিদি কোথায় গেল রে? ফেরেনি এখনও?’
‘ফিরল তো! জলখাবার খেল। তারপর, ‘আমি আসছি একটু’ বলে বেরোল।’
মিঠি বেরোল? কোথায়? প্রভাতকেও বলে যায়নি কিছু নিশ্চিতভাবেই। তাহলে প্রভাত বলতেন। সুচেতনার হঠাৎ একটু চিন্তা হল। মিঠি কি কোনও বন্ধুর বাড়ি গেল? কোথায় যাচ্ছে বলে যেতে পারে না একটু! সুচেতনার হঠাৎ কান্না পেল। পারলেন না তিনি। এতদিনের চেষ্টাতেও সংসারটা নিজের হয়ে উঠল না। মিঠি-চিকুর ভাগে ভালবাসা কমে যাবার ভয়ে নিজের সন্তানও আনেননি পৃথিবীতে। অথচ মিঠি এখন ভাল করে কথাই বলে না তাঁর সঙ্গে। প্রভাত অসুস্থ। আর কখনও মন খুলে কথা বলতে পারবেন না সুচেতনা। জানাতে পারবেন না, কী শূন্যতাবোধ নিয়ে তিনি বাস করেন। জানালে প্রভাতের কষ্ট হবে, শরীর খারাপ বাড়বে। সারা পৃথিবীতে মন খোলার কোনও জায়গা নেই তাঁর। এইভাবে নিজের ভিতরে পুড়তে পুড়তে একদিন ছাই হয়ে যাবে তাঁর শরীর মন। এ-জীবনে আর তেমনভাবে বাঁচা হল না। বারান্দায় বসে এসব ভাবতে ভাবতে অদ্ভুত এক বিষাদে আক্রান্ত হলেন সুচেতনা।
***
ক্লাসের পর সোজা বাড়ি চলে এল মিঠি। সুদীপ, তৃণারা দল বেঁধে সিনেমা যাবার প্রস্তাব করছিল। মিঠি রাজি হয়নি। আজ সকাল থেকেই একটু আনমনা হয়ে আছে ও। আজকেই ফ্লাইট অভিমন্যুর। চিকু এয়াপোর্টে যাবে বলে আজ স্কুলে যায়নি। মিঠি অবশ্য খুব স্বাভাবিক ভাবেই ওর নর্মাল রুটিন পালন করেছে। ও তো আর এয়ারপোর্টে যাবে না। সেটা এক্সপেক্টেডও নয়। সকলেই জানে চিকুই অভিমন্যুর ন্যাওটা। মিঠির সঙ্গে অভিমন্যুর যাদবপুরে ঝিলের ধারে কী কথা হয়েছিল, অভিমন্যু মিঠিকে কী বলেছিল— তা মিঠি আর অভিমন্যু বাদে আর কেউ জানে না। জানবেও না কখনও। আচ্ছা, অভিমন্যু কি এসব কথা বলেছে ওর বউকে? বলবে কখনও? আজ সকাল থেকে কী যেন একটা হয়েছে মিঠির। হঠাৎ খুব দেখতে ইচ্ছে করছে অভিমন্যুকে। পৃথিবীতে ওই একজনই সত্যিকারের প্রেমে পড়েছিল মিঠির। ভালবাসা জানিয়েছিল। ঝিলের ধারে বসে কাঁদছিল অভিমন্যু। কেন কেঁদেছিল সঠিক ভেবে পায় না মিঠি। মিঠির কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল বলে? নাকি ওর আসন্ন বিয়ের অনিবার্যতায় নিরুপায় লাগছিল বলে? মিঠি সম্মত হলে সে বিয়ে ভেঙে দেবে এমন কথাও ভেবেছিল অভিমন্যু। খুব ডেসপারেট না হলে কেউ কি এমন করে? কবে, কখন এভাবে মিঠির প্রেমে পড়ল ও? কতটুকুই বা দেখেছে ও মিঠিকে? ঠিক কেমন ছিল অভিমন্যুর সেই প্রেম, কয়েকদিন হল খুব জানতে ইচ্ছে করছে মিঠির। জানা হল না। মিঠিরই দোষ। ও-ই কোনও সুযোগ দেয়নি অভিমন্যুকে জানাবার। তাই ও এখন অন্য একটি মেয়ের। সেই বেচারা মেয়ে কোনওদিন জানবে না, মিঠি ইচ্ছে করলেই অভিমন্যুকে কেড়ে নিতে পারত ওর কাছ থেকে। নাহ, সে-ইচ্ছে হয়নি মিঠির। ছিঃ, সে কি এত খারাপ? ওদের বিয়ের বাজার অবধি হয়ে গেছে তখন! তাই তো মিঠি প্রত্যাখ্যান করল অভিমন্যুকে। তাছাড়া ও তো তখন তিলকের প্রেমে বুঁদ হয়ে ছিল। সত্যি! কোন আক্কেলে যে তিলককে প্রেম জানিয়েছিল, এখন ভাবতে ঘেন্নাই হয়। ওটাও আসলে ইনফ্যাচুয়েশনই। তার বেশি কিছু না। মামণির সঙ্গে তিলককে অমন ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলায় আসলে উপকারই হয়েছে মিঠির। নয়তো ও কখনওই বুঝতে পারত না— তিলকের প্রতি ওর আসলে প্রেম নেই, যা ছিল তা মোহ মাত্র। মোহমুদগরের কাজটাও বেশ ভালই হয়েছে। তিলককে সত্যিই আজকাল আর মনেই পড়ে না মিঠির। ইদানীং শুধু অন্য আরেকজনের কথাই ঘুরেফিরে মনে হতে থাকে। চশমার ফাঁকে গভীর ওই চোখদুটো কয়েকদিন হল স্থির থাকতে দিচ্ছে না মিঠিকে। আজ অভিমন্যুর যাবার দিন বলেই কি ভিতরে ভিতরে এমন অস্থির হয়ে রয়েছে মিঠি? অর্ণব ওকে দেখে কিছু কি আঁচ করেছে? বলেই ফেলল, ‘এনিথিং রং, মন্দাক্রান্তা? তোকে খুব শুকনো দেখাচ্ছে আজ।’ কোনওরকম ভাবে এটা-ওটা বলে সামাল দিয়েছে মিঠি। কারুর সঙ্গে যদি শেয়ার করা যেত এসব! নাহ, অসম্ভব। কিছুতেই তা পারবে না মিঠি। জীবনে কাউকে বলবে না অভিমন্যুর কথা। অথচ আশ্চর্য! প্রায় কাকতালীয় ভাবে শাওন ঠিক তখনই পাশ থেকে বলে উঠেছিল, ‘আচ্ছা মিঠি, অভিমন্যুদার কবে যেন ফেরার কথা? চলে গেছে?’
‘হ্যাঁ, এর মধ্যেই কবে যেন। বউ বোধহয় পরে যাবে। চিকু এসব ভাল জানে।’ ঠোঁট উল্টে নিখুঁত অভিনয় করেছে মিঠি।
‘দ্যাটস রাইট। চিকুর তো আবার অভিদা গডব্রাদার। তোর বোনটা কী সুন্দর, শান্তশিষ্ট, ওয়েল বিহেভ্ড হয়ে গেল— বিকজ অফ দ্যাট গাই। অভিদা ম্যাজিক জানে মাইরি।’ শাওন দুলে দুলে হাসছিল।
এখন ছাদে দাঁড়িয়ে এইসব কথাই মনের মধ্যে আলগা ভাবে নাড়াচাড়া করছিল মিঠি।
ঠিকই বলেছে শাওন। ম্যাজিক জানে লোকটা। মিঠিকে সম্মোহিত করেছে ও। সম্মোহিতের মতো মিঠি ভেবে চলেছে ওর কথা, ভেবেই চলেছে। কবে শুরু এই ভাবনার? বুঝতে পারছে না। শেষও দেখতে পাচ্ছে না মিঠি।
বিয়ের পর অভিমন্যু নিশ্চয়ই এখন বউ-এর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। খাওয়ারই কথা। চিকু তো অনর্গল বলে চলেছে নতুন বউদি কত রূপসী! কয়েকটা ছবিও পরে এনেছিল চিকু। দেখে অবশ্য মনে হয়েছে অভিমন্যুর দাদু-দিদিমার পছন্দ তারিফ করার মতো। ওই চটকের পাশে মিঠি কোথায় লাগে! কিন্তু তবু খটকা রয়ে গেছে। বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে এর মধ্যে তিনদিন দেখা করতে এসেছিল ও। কেন যে এসেছিল! শুধুই বাবাকে দেখতে? তাও ভাবতে পারত মিঠি, যদি না নার্সিংহোমে ঢোকার পথে একদিন দূর থেকে ওকে না দেখতে পেত। নার্সিংহোম থেকে অভিমন্যু ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিল। এদিক-ওদিক দেখছিল ঠিক যেন কারুর আসার কথা আছে। ও যে মিঠির জন্যই দাঁড়িয়েছিল, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই মিঠির। ওকে দেখতে পেয়ে যেন এক মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল হৃদ্স্পন্দন। না, ধরা দেয়নি মিঠি। একবার ভুল পুরুষের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। আর ও ফাঁদে পা দেবে না। অভিমন্যু এখন বিবাহিত। অভিমন্যু এখন অন্য নারীর। কোনওদিন ও মিঠির ছিল না। শক্ত হাতে নিজেকে শাসন করেছে মিঠি। কিন্তু আজ আর পারছে না ও। সারা দিন ভিতরে ভিতরে যে-বিষণ্ণতা আক্রমণ করছে, সেই বিষাদের পুঞ্জ পুঞ্জ চোরাবালিতে ক্রমশ অতলে তলিয়ে যাচ্ছে মিঠি।
সারা আকাশ জুড়ে কালো মেঘ করেছে। আসন্ন বৃষ্টির সম্ভাবনায় শিউরে উঠল মিঠি। অভিমন্যুর ফ্লাইট কি ছেড়ে দিয়েছে? ও হয়তো আকাশপথে উড়ে যাচ্ছে এখন। কতদূরে চলে যাচ্ছে ও! মিঠির চেনা দিগন্তরেখার বাইরে। হঠাৎ দমকা বাতাস দিল। হু হু করে উঠছে মিঠির ভিতরটা। অভিমন্যুর জন্য তীব্র আকুলতা অনুভব করল ভিতরে। আর ফেরা যায় না, আর ফেরানো যায় না সবকিছু। একটা ফাঁকা শূন্যতাবোধ গুড়গুড় করছে কোথায় যেন! এই কি তবে ভালবাসা? জীবনে প্রথম সত্যিকারের ভালবাসা এল তবে? নিতান্ত অসময়ে, সময় পেরিয়ে গিয়ে। আশ্চর্য! বুঝতেই পারেনি মিঠি। এই নতুন উপলব্ধির সামনে দিশাহারা লাগছে মিঠির।
টুপটাপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ক্রমে বড় হচ্ছে ফোঁটারা। অজান্তে কখন চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করেছে, টের পায়নি মিঠি। গোধূলির মরা আলো নিভে গিয়ে এখন শুধুই অঝোর বৃষ্টি। বাইরে-ভিতরে বৃষ্টিপতনের শব্দে আচ্ছন্ন লাগছে ওর। জীবনে প্রথম অনাত্মীয় এক পুরুষের জন্য কোমল মায়ায় ছেয়ে যাচ্ছে দেহ-মন। এই তবে প্রেম? বৃষ্টির জল একাকার হয়ে যাচ্ছে চোখের জলের সঙ্গে। আকাশ অন্ধ করা বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চেনা চৌহদ্দির সীমানা। অনেক দূরে শূন্যে দৃষ্টি মেলে কী যেন খুঁজে চলেছে মিঠি। সবই ছায়া-ছায়া, স্পষ্ট করে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।
***
অভিমন্যুর প্লেন ছাড়তে দেরি করছে। এয়ারপোর্টে পৌঁছে শুনল ফ্লাইট দু’ঘণ্টা ডিলেড। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বসে থাকার সময়টা একটু বাড়ল। অভিমন্যু একবার আড়চোখে দিদান আর দিদানের পাশে বসে থাকা কমলিকার দিকে তাকাল। কমলিকার চেহারায় একটা চটক আছে। নিউ জার্সির বন্ধুবান্ধবের কাছে ইন্সট্যান্ট হিট হয়ে যাবে ও, এই ক’দিনে তা বুঝতে পেরেছে অভিমন্যু। দাদু আর দিদান ঠিকই ধরেছে, ঠিক এইরকম মেয়েই তার দরকার ছিল। কমলিকার হাবেভাবে একেবারেই নতুন বউসুলভ জড়তা নেই, বরং বিয়ের দিন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত ও রীতিমতো সপ্রতিভ। কমলিকার অভিমন্যু সম্পর্কে কোনও বিশেষ এক্সপেক্টেশন আছে কি না অভিমন্যু জানে না। এক রাতে সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেসও করে দেখেছে অভিমন্যু। কমলিকা সরাসরি কোনও জবাব দেয়নি, খুব সহজভাবে হেসে বলেছে— ‘তোমার সবকিছু পছন্দ হয়েছে বলেই তো বিয়েতে রাজি হয়েছি, অপছন্দ হলে করতাম নাকি?’ অভিমন্যুর নিউ জার্সির বাড়ি, ওর ওয়ার্কপ্লেসের বর্ণনা, বন্ধুবান্ধবের কথা— সবকিছুই খুব মন দিয়ে শুনেছে কমলিকা, মাঝে মাঝে দু-একটা প্রশ্নও করেছে, তবে বাড়তি উচ্ছাস দেখায়নি। আর তিন সপ্তাহ পরে সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় যাবে, তা নিয়ে ওর মধ্যে একটুও উত্তেজনা নেই, অন্তত সেরকমই মনে হচ্ছে অভিমন্যুর। কিন্তু ও যে ওখানে গিয়ে মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়বে, তারপর চাকরি করবে, এসব ও স্পষ্ট করে জানিয়েছে অভিমন্যুকে। অভিমন্যুর আপত্তি আছে কি না জিজ্ঞেস করেছে। না, অভিমন্যুর আপত্তি নেই— থাকবেই বা কেন, বিশেষত কমলিকা যখন নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এত স্পষ্ট করে দেখতে পারে। তবু কমলিকা কি একটু বেশি প্র্যাক্টিক্যাল, একটু বেশি বাস্তবের ধারঘেঁষা মেয়ে? ভিতরে ভিতরে মনে না হয়ে পারেনি অভিমন্যুর। হয়তো এরকম ভাবে ভাবাটা ভুল। আফটার অল, কমলিকা যে ওখানে তার সংসারে শুধু শো-পিস হয়ে শোভা বর্ধন করতে চায় না, শুধু রসগোল্লা বানিয়ে হাউসকিপিং আর বাচ্চা মানুষ করে যে ও বাঁচতে চায় না, সেজন্য কি গর্ববোধ করাই উচিত ছিল অভিমন্যুর? বাচ্চা মানুষ করার কথা মনে আসায় অভিমন্যুর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, কমলিকা এখনই সন্তান চায় না। প্রথমেই ও স্পষ্ট করে দিয়েছে সেটা। প্রথমদিন শারীরিক ভাবে ঘনিষ্ঠ হতে গেলে একটু ইতস্তত করে বলেছিল, ‘অভি, লেট মি টেল ইউ সামথিং। আই ডোন্ট ওয়ান্ট আ বেবি রাইট নাউ। আই অ্যাম অন পিলস। আই হোপ ইউ উড নট মাইন্ড।’ যেন সব ঠিক করাই আছে। শুধু অভিমন্যুর অনুমোদনটুকু সময় বুঝে নিয়ে নেওয়া। এনডোর্সমেন্ট। সম্মতির সিলমোহর, এরকম মনে হয়েছিল। বেশ অবাকই লেগেছে অভিমন্যুর— কমলিকা এতটা গুছিয়ে, স্পষ্ট করে এবং এগিয়ে ভাবে দেখে। এর পিছনে ওর মা-বাবার কোনও প্রভাব আছে কি না বুঝতে পারেনি অভিমন্যু। তাঁদের এমনিতে খারাপ লাগেনি। বিত্তবান, তৃপ্ত দম্পতি।
গুছিয়ে ভাবতেও পারছে না অভিমন্যু। সম্পর্কে শালা শালী দু’তিনজন এসেছে এয়ারপোর্টে। উনিশ-কুড়ির ঘরে বয়েস সবার। সবার মধ্যমণি হয়ে চিকু তো রয়েছেই। তাদের আবদারে, উচ্ছাসে পাগল পাগল লাগছে অভিমন্যুর। দিদান বসে ফিসফিস করে কমলিকাকে কী সব বলছে, শুভঙ্কর রাজনীতি আলোচনা করছেন কমলিকার বাবার সঙ্গে। অভিমন্যু সবিস্ময়ে লক্ষ্য করল তার নতুন বিয়ে করা বউ-এর সঙ্গে একান্তে কথা বলতে তার একটুও ইচ্ছে করছে না। কমলিকাও নিশ্চয়ই আসন্ন তিন সপ্তাহের বিরহে খুব একটা কাতর হয়ে পড়েনি, ও ওর মা আর অভিমন্যুর দিদানের মাঝখানে চমৎকার বসে রয়েছে— একটুও উসখুস করছে না। নবদম্পতির পক্ষে কি এই আচরণ খুব অস্বাভাবিক? আপন মনে ভাবতে চেষ্টা করল অভিমন্যু।
চেক ইনের সময় হয়ে গেছে। আগে গেলে পছন্দমতো উইন্ডো সিট পাওয়া যাবে। ‘আমি তাহলে এগোই?’ ও বলছে যেন সম্মিলিত জনতার উদ্দেশ্যে।
‘সাবধানে যেও। পৌঁছেই ফোন করতে ভুলো না’, শুভঙ্কর বললেন।
‘না, না, এবার নিজের গরজেই ফোন করবে। কমল রয়েছে না আমাদের কাছে। কী রে!’ রসিকতা করে হাসছেন অদিতি। অন্যবার যাবার সময় দিদানের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। এবার তাঁর চোখমুখই অন্যরকম। দল বেঁধে টা টা করছে, হাত নাড়ছে চিকুরা। লাগেজ ট্রলি ঠেলে চেক-ইন কাউন্টারের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল অভিমন্যু।
প্লেনে উঠে সিটে বসে হাত পা ছড়িয়ে দিল ও। সামনে এয়ারহোস্টেস নিয়মমাফিক বোঝাচ্ছে, বিপদের সময় কী করণীয়। টুং করে আলো জ্বলে গেছে। ফাসেন ইওর সিট বেল্ট। নো স্মোকিং। খুব আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে প্লেনটা। টেক-অফের আগে ট্যাক্সিয়িং করা। কিছু কি ভুল হয়ে গেল? সব ঠিকঠাক নেওয়া হয়েছে তো? আরও কিছু কি করার ছিল অভিমন্যুর? একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। গতি বাড়ছে প্লেনের। সাঁ সাঁ করে রানওয়ে দিয়ে প্রচণ্ড জোরে ছুটে চলেছে অতিকায় বিমানটা। পরক্ষণেই মাটি থেকে শূন্যে উঠে পড়ল। উঠছে, উঠছে, আরও উপরে উঠল। কান বন্ধ হয়ে গেছে। ঢোঁক গিলল ও কান খোলার জন্য। বুকের ভিতরে লাফিয়ে উঠছে কী যেন। স্নায়ুতন্ত্রী হঠাৎ টানটান। একেবারেই হঠাৎ করে অভিমন্যু বুঝতে পারছে, জীবনে এই প্রথম কাউকে ছেড়ে যেতে তার কষ্ট হচ্ছে। প্রথম বিদেশে পড়তে যাবার সময় দাদু-দিদানের জন্য, কলকাতায় ফেলে যাওয়া বন্ধুদের জন্য যেমন কষ্ট হয়েছিল— এটা ঠিক তেমন নয়। এই কষ্টটা বুকের অনেক বেশি ভিতর থেকে মুচড়ে মুচড়ে আসছে। নিজেকে ও একজন যুক্তিবাদী বাস্তবঘেঁষা মানুষ বলেই জানে। নিজের স্বভাববিরুদ্ধ এরকম অযৌক্তিক কষ্ট হতে পারে বলে ধারণাই ছিল না ওর। ‘কাম অন অভি, বাক আপ, একমাস বাদে তোমার মন্ত্র পড়া বউ তোমার বিদেশের ঘর করতে যাবে, এখন কনফিউশনের আর কোনও জায়গাই নেই’ নিজেই নিজের মনকে বোঝাচ্ছে অভিমন্যু। তবু মনকে বশ করা যাচ্ছে না, বারবার মনে ভেসে উঠছে অন্য এক মুখ। চারপাশের সবকিছু ঝাপসা। নীচে ফেলে রাখা শহরের আলো মিলিয়ে যাচ্ছে, পড়ন্ত বিকেলের চৌখুপি করা চষা মাঠ, নকশি কাঁথার মতো বিছিয়ে থাকা প্রান্তর দিগন্ত অবধি সহসা সব অস্পষ্ট কুয়াশায় ঘেরা। ‘মিঠি, আর কখনও সেভাবে ফেরা হবে না তোমার কাছে। আবার যখন আসব, তখন অনেক দূর থেকে দেখতে হবে তোমাকে। হয়তো তখন তুমি অনেক দূরে। চেনা চৌহদ্দির মধ্যে আর কখনও সেভাবে একান্তে কথা হবে না। ভালো থেকো মিঠি। অন্য পুরুষকে ভালবেসে সুখী হোয়ো।’ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর কাল্পনিক সংলাপ রচনা করে চলেছে অভিমন্যু। মহাশূন্যে ভেসে যাওয়া প্লেন এবার একটু স্থিতিশীল। টুং করে ‘ফাসেন ইওর সিট বেল্ট’ লেখা আলো নিভে যাচ্ছে। হাস্যময়ী বিমানসেবিকারা ট্রলি নিয়ে আসছে ড্রিংকস আর স্ন্যাক্স সার্ভ করতে। চোখ মুছে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল অভিমন্যু। নাহ, এখন যতদূর চোখ যায়, মহাশূন্য। সেই তীব্র কুয়াশাভরা নীলের ওপারে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।
।। সমাপ্ত ।।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র