ইতিহাস বিক্রি হয়। হেরিটেজও। অন্তত এমনই মনে হয় তাঁর। তাই তিনি গল্প ফাঁদেন। অলঙ্করণ করেন তাঁর, ভাইদের ও বাবার সম্মিলিত প্রতিভাকে। মাতা নি পচেড়ি হস্তকলার শিল্পী সুরেশ চিতারা এক-একটি শিল্পকর্ম তৈরি করতে করতে এইভাবেই কথা চালিয়ে যান। দেখে মনে হয় তিনি শিল্পী কম, সেলসম্যানই বেশি। হতাশ অথচ সতর্ক চোখে একবার আমাদের মেপে নেন। মনে প্রশ্ন, গল্প শুনে তাঁদের তৈরি শিল্পসামগ্রী আমরা কিনব কি? পরিবারের আট সদস্যের বাসস্থান, ওই সরু চৌহদ্দির মধ্যে মোড়া টেনে আমরা যখন বসলাম, তখন চোখ-ধাঁধানো শিল্পকর্ম, অপরাধবোধ, অসহায়তা, সব কেমন যেন একাকার হয়ে গেল।
পরদিন, সবরমতীর পাড়ে আরও ‘আরামপ্রদ’ পরিবেশে যখন হীরাভাই চৌহানকে জিজ্ঞাসা করলাম কত বছর ধরে তাঁদের পরিবার এই শিল্পকলার সঙ্গে জড়িয়ে, তিনি অস্বস্তিতে পড়লেন। বললেন, ‘বিপণনের এই ব্যাপার-স্যাপারগুলো, আমার ছেলে কার্তিকই ভাল বলতে পারবে।’
আমরা বলি, ‘এ তো বিপণনের বিষয় নয়।’ কিন্তু তাঁর এক কথা, ‘কার্তিকই পারবে। ডাক ওকে। ওয়ো অচ্ছে সে বোল পাতা হ্যায়।’
কার্তিক চৌহানও আমাদের ভুল করে খরিদ্দার ভাবেন। সুরেশ চিতারার মতো তিনিও মুখস্থ সংলাপ বলতে থাকেন। কীভাবে, চারশো বছর ধরে তাঁর পরিবার এই কাটওয়ার্ক শিল্পকর্মে নিযুক্ত রয়েছেন, জামনগরের পৈতৃক বাড়িতে ছ’শো বছরের পুরনো শিল্পকর্ম কীভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে।
এই অপ্রচলিত শিল্পকলার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের প্রায় সবাই সুযোগ পেলেই ‘মনোহারী’ পারিবারিক ইতিহাস আওড়াতে শুরু করেন। মনে হয় তাঁরা এটা করতে বাধ্য হন। তাঁরা ভাবেন এটাই আদর্শ বিপণনের কৌশল। অথচ কাপড়ে সত্য বুনতে গিয়ে, মিথ্যে ছবিই ফুটে ওঠে।
তবে সে গল্প যতই কষ্টকল্পিত হোক, তাঁদের শিল্পকলাকে অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। তাহলে অপূর্ব এই শিল্পকর্মকে মোহ আবরণে জড়াবার দরকার কী?
অসাধারণ শিল্পকলা আর চেনা গল্পগুলো
যে ছ’সাতটি পরিবার এখনও মাতা নি পচেড়ি শিল্পকলার সঙ্গে যুক্ত, তাদের একটি হল সুরেশ চিতারার পরিবার। ভাই মহেশ আর পরেশকে নিয়ে তিনি থাকেন আহমেদাবাদের এক ঘিঞ্জি বস্তিতে। লোকশ্রুতি হল, ভ্রাম্যমান ওয়াঘারি সম্প্রদায়ের মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ থাকায়, কাপড়ের উপর দেবীর (মাতা) ছবি এঁকে তাঁরা নিজেরাই মাতৃবন্দনার উপায় বার করে নেন। এই সব ছবি প্রেক্ষাপট হিসাবে বেশি পরিচিতি পাওয়ায়, এদের নামই হয়ে যায় মাতা নি পচেড়ি (দেবীমাতার পিছনে)।
যে কোনও খাদিপ্রেমীই গুজরাতের বয়নশিল্পের ঐতিহ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। বন্ধেজের পাশাপাশি নানা ধরনের সূচিশিল্পের আজও চাহিদা আছে। ইদানীং অজরখের কাজ দেখলেই তথাকথিত হস্তশিল্পপ্রেমীরা উত্তেজিত হয়ে মানিব্যাগ বার করে ফেলেন। কিন্তু মাতা নি পচেড়ি সম্পর্কে এঁদের জ্ঞান অল্পই। বাঁশের কলম আর প্রাকৃতিক রঙের যুগলবন্দিতে কাপড়ের উপর ফুটে ওঠে ছবি। সেখানে বাদ যায় না খুঁটিনাটির কাজও।
অসামান্য শিল্পকর্ম, সাধারণ গল্প
হ্যান্ডলুম ফেয়ারে যাঁদের নিত্য যাওয়া-আসা, তাঁরা পিপলির (ওডিশা) অ্যাপ্লিক শিল্পকর্ম আর উত্তর প্রদেশের ফুলপট্টি কা কাম সম্পর্কে মোটামুটি পরিচিত। অথচ গুজরাত ও রাজস্থানের নেগেটিভ অ্যাপ্লিক শিল্পকর্ম সম্পর্কে অনেকেই অবহিত নন। কাটওয়ার্ক নামেও পরিচিত এই আপাত-সহজ শিল্পকর্মে সফল হতে গেলে নকশা ও ছাঁদে বিরাট দখল থাকতেই হবে।
মাতা নি পচেড়ি বা কাটওয়ার্ক, এর কোনওটাই রাজ্যের এম্পোরিয়ামে বা হস্তকলার নামি-দামি শো-রুমে মিলবে না। ফলে সাধারণ মানুষের চেতনা বা উচ্চাশা, কোথাও এদের স্থান নেই। তা হলে কি এই শিল্পকলার শেষের সে দিন সমাগত? যাঁরা এখনও এই পেশায় রয়েছেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ কী? এই সবের উত্তর পেতে হাজির হয়েছিলাম আহমেদাবাদবাসী দুই শিল্পী বাবুভাই চিতারা এবং হীরাভাই চৌহানের কাছে।
অসুন্দর ছবি, বৈষম্যের বিভাজন
হীরাভাই জানালেন, কাটওয়ার্ক বা কতবের কাজ তিনি শিখেছিলেন তাঁর ঠাকুরমার কাছ থেকে। তিনি ছিলেন গুজরাত স্টেট এম্পোরিয়াম গারভি গুর্জরীর নথিভুক্ত হস্তশিল্পী। ‘আপনি কি গুর্জরীতে বিক্রি করেন?’ হীরাভাইয়ের সাফ কথা, ‘না’। কেনই বা? স্টেট এম্পোরিয়ামগুলোর তো হস্তশিল্পী আর উপভোক্তাদের মধ্যে সেতুবন্ধন করার কথা ছিল। ডেভেলপমেন্ট কমিশনার ফর হ্যান্ডিক্রাফটস অ্যান্ড হ্যান্ডলুম এবং স্টেট হ্যান্ডিক্রাফটস বোর্ডস এর সনদ অনুযায়ী এম্পোরিয়ামগুলোর কাজ ছিল নকশা উন্নয়ন, বিপণন এবং শিল্পসামগ্রী বিক্রির সুব্যবস্থা করা।
হীরাভাই বললেন, ‘বিপণন কেন্দ্র হিসাবে গুর্জরী এখন একেবারেই অকেজো। শুধু নমুনা চেয়ে পাঠায়। সেই নমুনার স্তূপ আজ জমতে জমতে পাহাড়।’
সুরেশ চিতারা বললেন, ‘এই এম্পোরিয়ামগুলি মাতা নি পচেড়ি শিল্পসামগ্রীর জন্য কোনও ফরমাশই করে না। তাদের মতে এসব বানাতে সময় লাগে, দামেও পড়ে বেশি তাই ডিজাইন করতেও অসুবিধা হয়। মাতা নি পচেড়ি শিল্পকর্ম দিয়ে তো আর বিছানার চাদর আর পর্দা হবে না। তবে এটাও ঠিক পরিধান ক্ষেত্রে চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে।’
কতটা জটিল আর মহার্ঘ এই শিল্পকর্ম পদ্ধতি? প্রবল উৎসাহে এর বিভিন্ন ধাপ বোঝাতে গিয়ে মহেশ চিতারা বললেন, ‘হান্ড্রেড পার সেন্ট হ্যান্ডওয়ার্ক হ্যায়। ন্যাচরাল ফ্যাক্টরস পর ডিপেন্ড করতা হ্যায়।’ যেমন জল। সাধারণত, এখানে ভেষজ রঞ্জক বা ভেজিটেবল ডাই ব্যবহার করা হয়। এই ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক রংকে চিরস্থায়ী রূপ দিতে প্রয়োজন হয় বহমান জলের।
মহেশের গলা এবার ক্লান্ত শোনায়, ‘আগে সবরমতীর পাড়ে আমরা হাঁটুজলে দাঁড়াতাম। কিন্তু রিভারফ্রন্ট তৈরি হওয়ার পর, জল কোনওরকমে গোড়ালি ছোঁয়। সেই জলও ময়লা। গ্রীষ্মকালে আগে আমরা ৫০-৬০ পিস বানিয়ে ফেলতাম। এখন তো কোনও প্রশ্নই নেই।’
কিছুটা খেদের সঙ্গেই তিনি বলেন, ‘কালার্স অচ্ছে নহি আতে। জল এত নোংরা যে রঙের মিলমিশ ভাল করে হয়ই না। প্রায়ই ফিরে আসতে হয়। কাজে তৃপ্তি হবে কী করে?’
এই শুনে ছোট ভাই সুরেশ কিছুটা অধৈর্য হয়ে বলেন, ‘বেঁচে তো আমাদের থাকতেই হবে।’
তাঁর কথায়, ‘বিনা সরকারি সাহায্যে, এই দিন আনি-দিন খাই অস্তিত্ব বেশি দিন চলবে না। শুধু প্রকৃতি আর জলের ভরসায় এই সাবেকিয়ানা আঁকড়ে থেকেও আর চলবে না। আমি তো এই শিল্পকর্ম পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছি। কেমিক্যাল ডাই দিয়ে কাজ করি বলে আবহাওয়া বা জলের আর মুখাপেক্ষী নই।’
জীবিকার শিক্ষা, জীবনের অবলম্বন
ভাইদের মধ্যে সুরেশই বাস্তববাদী, তাই কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও বটে। দেখে মনে হয় পরিবারের সব দায়িত্ব যেন তাঁরই কাঁধে। মহেশ হলেন স্বপ্নালু। প্রকৃত শিল্পী। কাজের কথা বলতে গিয়ে তাঁর চোখ আলোয় জ্বলজ্বল করে। কাজ দেখাতে গিয়ে গর্বে ভরে ওঠে বুক। অন্য দিকে সুরেশ কিন্তু মরিয়া তাঁদের পেশাকে, যেভাবেই হোক, টিকিয়ে রাখতে।
অন্য দিকে চৌহানদের কথায় ঝরে পড়ে হতাশা। কতব পদ্ধতি বাইরের কারণ বা একাধিক ধাপের উপর নির্ভরশীল না হওয়ায়, তাঁদের অবস্থা মোটামুটি ভালই। তাঁদের চিন্তা অ্যাপ্লিক শিল্পী সম্প্রদায় এবং এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েই।
অসম্পূর্ণ বর্তমান, অজানা ভবিষ্যৎ
আগে কিন্তু এরকম ছিল না। সফদর হাশমি, মৃণালিনী সারাভাই বা মল্লিকা সারাভাই যখন হ্যান্ডিক্রাফটস কাউন্সিলের দায়িত্বে ছিলেন, তখন সত্যিই সুসময় ছিল হস্তশিল্পীদের। হীরাভাইয়ের কথায়, ‘কোনও হ্যান্ডআউট নয়, শুধু পাশে থাকা। শুধু জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তদের নিয়ে প্রদর্শনী নয়, প্রত্যেকের জন্য কর্মশালা। নতুন পদ্ধতির প্রশিক্ষণ পেতেন সবাই। আমাদের কাজের একটা মূল্য ছিল। ভেবে গর্ব হত। সব থেকে বড় কথা, কোনও কিছু নকলকে বরদাস্ত করা হত না। সে সুতো বা ফ্যাব্রিকই হোক, আর ডাইং বা সূচিশিল্পই হোক।’
কিছুটা রেগেই হীরাভাই বললেন, ‘ফ্যাব্রিকে পলিয়েস্টার কখনও ভাবতে পারেন? বা স্ক্রিন প্রিন্টকে ব্লক প্রিন্ট হিসাবে বিক্রি হতে?’
হীরাভাইয়ের কথায়, ‘প্রতি মাসে, গুর্জরীকে আমরা চারশো পিস পাঠাতাম। ভাল মরসুমে হাজার পিসও বিক্রি হয়েছে। এখন বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ ওরা বস্তাপচা মাল রাখে। ওদের দোষ নয়। এ বিষয়ে ওদের কোনও জ্ঞানই নেই।’
এমন ব্যাখ্যা অবিশ্বাস্য তো ঠেকেই। বিশেষ করে এমন এক প্রজন্মের অংশ হিসাবে যারা বিভিন্ন এম্পোরিয়ামে ঘুরে দেশজ হস্তশিল্প সম্পর্কে নিজেদের স্বশিক্ষিত করে তুলেছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কিছুটা মিললেও একজন বিশিষ্ট হস্তশিল্পীর কাছে এমন কথা শুনলে হৃদয় তো দুমড়ে যাবেই।
হীরাভাই আরও বললেন, ‘লোকে সরকারি এম্পোরিয়ামে যায় শিল্পসামগ্রীর বিশ্বাসযোগ্যতার কথা ভেবে। জিনিসটা প্রামাণ্য কি না তার দায় তো এদের উপরেই।’
ক্লাস্টারের ব্যর্থতা, অধরা ট্যাগ
ক্লাস্টার তৈরি করে বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই) নথিভুক্তিকরণ করে কোনও লাভ হবে কি? এই নিয়ে কোনও কাজ হচ্ছে কি? এই বিষয়ে চিতারা এবং চৌহানরা ভিন্নমত। মাতা নি পচেড়ির জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সুরেশ জানালেন, চিতারাদের প্রথম বসতি, খানপুর, এখনও ক্লাস্টারের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। কারণ মাত্র ছ’সাতটি পরিবার এই শিল্পকর্মের সঙ্গে যুক্ত। সুরেশের কথায়, ‘ক্লাস্টার কে লিয়ে কোশিশ জারি হ্যায়।’
জি আই ট্যাগ পেতে হলে ১২০০ কারিগরের তালিকা প্রয়োজন। চিরকালের আশাবাদী মহেশের মতে, ‘হো যায়েগা। শতকরা ৭৫ ভাগ হয়েই আছে।’ তাঁকে থামিয়ে সুরেশ বললেন, ‘ও শুধু স্বপ্নেই। ১২০০-এর মধ্যে মাত্র ৬৪ জন আমরা। তবে দেখা যাক। আশা রখতে হ্যাঁয়।’
চৌহানরা মনে করেন এমন কোনও ক্লাস্টার গড়া অসম্ভব। প্রবাদপ্রতিম অ্যাপ্লিক কারিগর তেজিবেনের আগ্রহে ওয়াড়জে ঘরোয়া ভাবে একটি ক্লাস্টার তৈরি হয়। কিন্তু তেজিবেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আমেরিকায় চলে যাওয়ায় ক্লাস্টারটিও উঠে যায়।
কিন্তু যেসব কারিগর তেজিবেনের কাছে কাজ শিখলেন, তাঁদের কী হল? কার্তিক বললেন, ‘ওই এলাকার বুটিকগুলো শিল্পকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কম টাকায় নিম্নস্তরের কাজের উপরেই ওরা জোর দেয়। এতে তো শিল্পেরই অমর্যাদা করা হয়। এভাবে চলতে থাকলে, আর সরকার হস্তক্ষেপ না করলে, এই শিল্পকর্ম আমাদের কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। একদিন হয়তো শিল্পটাই হারিয়ে যাবে।’
এক্ষেত্রে ফ্যাবইন্ডিয়ার মতো জাতীয় স্তরের সংস্থার ভূমিকা কী? উত্তর মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। কার্তিকের কথায়, ‘২০০৩ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আমরা ওদের জোগান দিয়েছিলাম। প্রায় ২০০ কারিগরের সাহায্যে এর মাসিক পরিমাণ ছিল ১২,০০০ থেকে ১৩,০০০ পিস। কিন্তু রাজ্য সরকারের বিধিনিষেধের ফলে এজেন্টদের কাছ থেকে অর্ডার নিতে হত। তাই আমরা জোগান বন্ধ করে দিই। এখন ওরা রাজস্থানের কাটওয়ার্কই বেশি বিক্রি করে। সেখানে মূল ফ্যাব্রিক পেস্ট করা হয়, সৌরাষ্ট্র কতবের মতো সেলাই করা হয় না।’
কোভিড সঙ্কট এবং ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ
এমন হতাশাজনক প্রেক্ষাপটে, অতিমারীর অভিঘাত তো ভয়ঙ্কর হবেই। তবে এখানে একটা রুপোলি রেখাও আছে। কোভিডের ফলে বাজারে তো ধ্বস নেমেইছে। কেউ কোথাও যেতে পারছে না। বাজার, কারিগর, মহাজন, প্রদর্শনী, কোথাও নয়। হীরাভাইয়ের কথায়, ‘ক্ষতিগ্রস্ত সবাই, তবে গ্রামের কারিগরেরা বেশি।’
তবে চিতারা ও কার্তিক মনে করেন, এই অতিমারীর মধ্যেও ব্যক্তিগত স্তরে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছনো সম্ভব হয়েছে। মহেশ যেমন বললেন, ‘আগে সরকারের মাধ্যমে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক স্তরেই অর্ডার আসত। অতিমারীর জন্য আমাদের অনলাইনে যেতে হয়েছে। যার ফলে আমরা প্রত্যেক ক্রেতাকে জানতে পারছি। আগে তো পুরনো ক্রেতা বা সম্ভাব্য ক্রেতার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যেত না। সরকারি এজেন্সির উপর নির্ভর করতে হত। ‘পহলে কাস্টমার্স কো হামারা নাম ভি পতা নহি হোতা।’
সহমত হলেন কার্তিক চৌহানও। ‘অতিমারীর জন্যই আমরা অনলাইনে যেতে বাধ্য হয়েছি। ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম সম্ভাব্য ক্রেতাদের সঙ্গে আমাদের সরাসরি যোগাযোগের সুবিধা করে দিয়েছে। এতে আমরা বিশাল ভাবে লাভবান হয়েছি।’
এর একটি অপ্রত্যাশিত ইতিবাচক দিক হল তরুণ প্রজন্ম এই শিল্পকর্মের বিপণনের প্রতি আগ্রহী হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে আরও বড় ভাবে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছনোর সুযোগ থাকায়, সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে পারিবারিক ব্যবসাকে বাড়ানোর সম্ভাবনা দেখছে এ-যুগের টেক-স্যাভি প্রজন্ম। তাঁরা ভাবছেন, যে শিল্পকর্ম দেখে তাঁদের বেড়ে ওঠা, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তার জনপ্রিয়তা ভৌগোলিক সীমাও পেরিয়ে যাবে। ক্রেতার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে লাভ অনেক। এর ফলে সরকারি মাধ্যমগুলির উপর নির্ভরতাও কমবে। হতাশা আর অসহায়তার দিন শেষ হবে।
কার্তিক হাসতে হাসতে বলেন, ‘ইনস্টাগ্রাম হুয়া তো থোড়াসা মডেলিং ভি কর লেতে হ্যাঁয়। নতুন কিছু এলে একটা উত্তেজনা তো থাকেই।’
অতিমারীরও যে উজ্জ্বল দিক থাকে, জেনে ভাল লাগল। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারের নিশ্চয়ই একটা ভূমিকা থাকবে? কী হতে পারে সেটা?
যৌথভাবে কাজ ও প্রদর্শনীর জায়গা
সুরেশ চিতারা বললেন, ‘আমরা কারিগরেরা চাই সরকার আমাদের ক্ষমতায়নের পথ দেখিয়ে দিক। লাল ফিতের ফাঁসে না আটকে কাজ হোক সহজ-সরল পদ্ধতিতে, যাতে কারিগরেরাই উপকৃত হন। তিন মাসের অর্থের জোগান, নগদে দু’মাসের ঋণ আর দু’মাসের কাঁচামাল আগাম, বয়নশিল্পের কারিগরদের এইটুকু পেলেই যথেষ্ট।’
এতক্ষণ চুপ থাকার পর, চিতারা পরিবারের বয়োজ্যোষ্ঠ, বাবুভাই বললেন, ‘আশপাশটা চেয়ে দেখুন। এত সরু, ঘিঞ্জি জায়গায় শিল্প হয়? কাজের জন্য একটা ভাল জায়গা লাগে। দরকার হয় অনুদানও। আমাদের প্রতিভা তো ভগবানদত্ত। সবাই হাড়ভাঙ্গা খাটি। কিন্তু আগাম কাঁচামাল, সুতোর ব্যাঙ্কের তো দরকার হয়। ২০০৩ পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে কাজ পেতাম। কিছু অনুদানও। এখন ঠিক জানি না পরিস্থিতি কেমন? সব কেমন যেন ঘোলাটে লাগে।’
কার্তিকের কথায়, ‘খুচরো ব্যবসার সঙ্গে লেনদেন আমাদের রাখতেই হবে। প্রদর্শনী আর রপ্তানি, এই হবে মূল অভিমুখ। সুরেশ সখেদে বলেন, ‘ডিসি যেসব প্রদর্শনীর আয়োজন করেন তাতে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তরাই শুধু আমন্ত্রণ পান। তা হলে আমাদের কী হবে?’
সহমত কার্তিক চৌহানও। ‘পুরস্কার, অনুদান সবই পান জাতীয় পুরস্কার বিজেতারা।’ এঁদের মৃত্যুর পর কী হবে? এই প্রসঙ্গে সবাই নিরুত্তর।
কার্তিক আরও বলেন, ‘অজরখের কথাই ধরুন। ক্ষত্রী সম্প্রদায়ের ৩০০০ কারিগর এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। অথচ নাম শুনেছেন মাত্র দু’তিনজনেরই। কিন্তু রুজি-রুটি তো সবারই দরকার। না হলে এঁরা অন্য পেশায় চলে যাবেন। আর এই শিল্পকর্মও অচিরে হারিয়ে যাবে।
সংবেদনশীল নীতি, বাস্তবসম্মত উন্নয়ন
আবার আমরা জিজ্ঞাসা করি, ‘সরকারের কাছ থেকে কী ধরনের সাহায্য চান আপনারা?’ চোয়াল শক্ত করে হীরাভাই বললেন, ‘কিচ্ছু না। সাহায্য নয়। চাই এমন একটা সংবেদনশীল, বাস্তবসম্মত নীতি যাতে কারিগরেরা স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে। সরকারকে এটুকুই বলতে চাই।’
হীরাভাই আরও বলেন, ‘আপনে উনকো আপনে হাল পে ছোড় দিয়া। আমাদের গাড্ডায় ফেলে সব এম্পোরিয়ামে মিল কামাল আর মেশিন কাকাম বিক্রি করছেন। এত তো আত্মনির্ভর ভারত বলেন, আপনার নীতি দিয়ে আমাদের আত্মনির্ভর করে তুলুন।’
এত মৃদু, ভদ্র দাবির পর আর কিছু বলার থাকে না। শুধু আশা থাকবে সরকারি এজেন্সিগুলি সব জটিলতা দূর করে স্বচ্ছ পরিমণ্ডলে কারিগরদের ক্ষমতায়নে সচেষ্ট হবে। যুগ যুগ ধরে অজস্র সুতোর বন্ধনে ইতিহাস ও হেরিটেজের সঙ্গে তাঁরা আমাদের জড়িয়ে রেখেছেন। এই ঐতিহ্য হারিয়ে গেলে, আমাদেরই অপূরণীয় ক্ষতি।
ছবি তুলেছেন কুশল বাটুঙ্গে