ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সত্যজিৎ রায় এবং বাউহাউস


    পিনাকী দে (Pinaki De) (May 1, 2021)
     

    সত্যজিৎ রায় এবং বাউহাউস শিল্প আন্দোলন-এর ভিতরের নাড়ির বন্ধন আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অনুমাননির্ভর; একটা খামখেয়ালি সমাপতনের অযৌক্তিক, প্রায় অদৃশ্য ফলাফল। ১৯১৯-এ জার্মান স্থপতি ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস-এর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘স্টাটলিখেস বাউহাউস’ শিল্প-শিক্ষাশালা— যার উদ্দেশ্য ছিল শিল্পের সমস্ত শাখাকে একত্রিত করে একটি নন্দনবোধের প্রচলন— এবং সত্যজিতের কাজের মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে বেড়ানো যেন নিতান্তই অনাবশ্যক। সত্যজিৎ নিজে কখনওই বাউহাউসকে প্রভাব হিসাবে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি, যদিও আজীবন ‘গ্রাফিস’ এবং ‘গেব্রখসগ্রাফিক’-এর মতো বাউহাউস নন্দনবোধের প্রশংসাকারী ডিজাইন পত্রিকার গ্রাহক রয়ে গিয়েছিলেন।

    কলাভবনের ছাত্র হিসাবে সত্যজিৎ নিশ্চিত ভাবে বাউহাউস আন্দোলনের সূক্ষ্ম খুঁটিনাটির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। বাংলায় বাউহাউস-এর পরিচিতি ঘটে এর আগেই, অস্ট্রিয়ান শিল্প-ইতিহাসবিদ স্টেলা ক্রামরিশের দৌলতে, যিনি শান্তিনিকেতনে ভারতীয় এবং ইউরোপীয় শিল্পের শিক্ষিকা ছিলেন ১৯২১ থেকে ১৯২৩ অবধি। বেঙ্গল স্কুলের কয়েকজন মুখ্য ভারতীয় শিল্পীদের সঙ্গে একটা যুগ্ম প্রদর্শনীর কারণে, ক্রামরিশ বাউহাউসকে অনুরোধ করেন নিদর্শনস্বরূপ কিছু পেন্টিং এবং গ্রাফিক্স কলকাতায় পাঠানোর জন্য। ভারতীয় চিত্রকলায় মডার্নিজম-এর প্রবেশপথ হিসাবে সচরাচর ‘বাউহাউস ইন ক্যালকাটা’ নামক এই প্রদর্শনীকে ধরা হয়। ‘দ্য ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট’-এর ১৪-তম বার্ষিক প্রদর্শনী উপলক্ষে এই বাউহাউস প্রদর্শনী উদ্বোধন হয় কলকাতার সমবায় ম্যানসন-এ। অসামান্য এই প্রদর্শনীতে দেখানো হয় পল ক্লি, লিওনেল ফেনিঙ্গার এবং জোহান ইট্টেন-এর মতো বাউহাউস শিল্পীদের কাজ, এবং পাশাপাশি থাকে নন্দলাল বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনয়নী দেবী এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাপের আধুনিক ভারতীয় চিত্রশিল্পীদের কাজ।     

    এইখানে দু’ধরনের নন্দনবোধ এবং বুদ্ধিবৃত্তির একটা দেখা-হওয়ার ব্যাপার ঘটল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পাশ্চাত্য আধুনিকতা খোঁজ করছিল, কী করে আধ্যাত্মিকতা এবং শিল্পবোধের পুনর্জীবন সম্ভব। আর ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে শিল্পীরা খুঁজছিলেন একটা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের পথ। স্থাপত্যের ক্ষেত্রে বাউহাউস প্রভাব দেখা যায় হাবিব রহমানের অগ্রগামী কাজে, যিনি ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার ঠিক আগে পশ্চিমবঙ্গ পি.ডব্লিউ.ডি-তে যোগ দেন এবং কলকাতার প্রধানত ঔপনিবেশিক আদলে বাড়িঘরের যে স্কাইলাইন, তার মধ্যে একদম আলাদা কাজ করে নিজের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। ১৯৫৩-য় দিল্লি চলে যাওয়ার আগে, রহমান পশ্চিমবঙ্গে ৮০টা প্রকল্প গড়ে তোলেন, যার মধ্যে ছিল অসংখ্য ছাত্রনিবাস এবং একাধিক পুলিশ ট্রেনিং অ্যাকাডেমি, শিবপুরে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বিস্তৃত নতুন ক্যাম্পাস এবং, সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য, তৎকালীন রাজ্য সরকারের নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং— দেশের প্রথম স্টিল-ফ্রেম স্কাইস্ক্র্যাপার। সত্যজিতের নাগরিক চলচ্চিত্র জুড়ে এই নতুন স্থাপত্যশিল্পের চতুর উল্লেখ দেখা যায়, বিশেষত ‘মহানগর’-এ।     

    সত্যজিতের গ্রাফিক শিল্পেও বাউহাউস-এর সূক্ষ্ম প্রভাব ছড়িয়ে আছে। ‘গেসামৎকুন্টসওয়ের্ক’ বা ‘শিল্পের সংশ্লেষণ’ নামক ধারণা ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস ধার করেন কম্পোজার রিচার্ড ওয়াগনারের কাছ থেকে; কল্পনা করেন এমন এক শিক্ষায়তনের, যা স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং চিত্রকলার মতো শিল্পের সব শাখাকে একত্রিত করে তুলবে। নানাবিধ পাশ্চাত্য প্রভাবে অনুপ্রাণিত যুবক সত্যজিতের পক্ষে এহেন এক দর্শন লোভনীয় হয়ে উঠতেই পারত। বাউহাউসের ডিজাইন দর্শনের মূলমন্ত্র ‘ফর্ম ফলোজ ফাংশন’— ‘কার্যকারিতা আঙ্গিকের চেয়ে জরুরি’। সোজা কথায়, বাউহাউসের ভিত একটা নির্মেদ, চটকহীন মনোভাবে, যা চাক্ষিক সৌন্দর্যবোধের চেয়ে উপযোগিতাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বাউহাউস ব্যাকরণের এই মিনিমালিজম— ত্রিভুজ, চতুষ্কোণ এবং বৃত্ত— শিকড়ে প্রত্যাবর্তনের এক মানসিকতার পরিচয় দেয়। একই ধরনের জ্যামিতিক স্বচ্ছতা আমরা সত্যজিতের গ্রাফিক শিল্পে দেখতে পাই। অবশ্য এ-ও মনে রাখতে হবে, কলাভবনে সত্যজিৎ ভারতীয় চিত্রকলার অপূর্ব ঐতিহ্যে দীক্ষিত হয়েছিলেন, এবং এই শিক্ষা বিশুদ্ধ মিনিমালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে তাঁর ধারণাকে সুষম করে তোলে।     

    এই কারণে, গ্রোপিয়াসের অনুশাসন সত্যজিৎকে সম্পূর্ণরূপে প্রভাবিত করতে পারেনি— যে গ্রোপিয়াস ছাত্রদের উপদেশ দিতেন ভাবপ্রবণ, বাহ্যিক রূপে শোভাপ্রদ, পুরাতন সংস্কৃতিপন্থী ধারণা ত্যাগ করে, অগ্রগামী হতে। ডিজাইনার হিসাবে সত্যজিৎ কার্যকারিতার প্রয়োজনে বহু শিল্পসৃষ্টি করেছেন— তা ডি জে কিমারে ভিসুয়ালাইজার হিসাবে হোক, সিগনেট প্রেস-এ প্রচ্ছদশিল্পী এবং পুস্তক প্রস্তুতকারক হিসাবে হোক, নিজের চলচ্চিত্রের প্রচার উপাদান তৈরি করার ক্ষেত্রে হোক, বা ‘সন্দেশ’ এবং নিজের গল্পের বইয়ের ইলাস্ট্রেটর এবং সম্পাদক হিসাবেই হোক। কিন্তু তাঁর ভিতরের শিল্পী সবসময় বিশুদ্ধ উপযোগবাদকে হারিয়ে দিয়ে, সৃষ্টি করতে চাইত এক নতুন বাগধারার, যার সঙ্গে তাঁর নিজস্ব শিল্পদর্শনের এক আত্মিক যোগ ছিল। আমার মনে হয় সত্যজিৎ এক ভারসাম্যের খেলায় এই শিল্পসৃষ্টি করতেন, নিজের নান্দনিক জীবনবোধের সঙ্গে মিলিয়ে দিতেন ফর্ম এবং ফাংশন, আঙ্গিক এবং উপযোগিতা। 

    বাউহাউসের সুনিশ্চিত প্রভাব রয়েছে, সত্যজিতের সৃষ্টি এমন ডিজাইনের একটা সম্পূর্ণ তালিকা তৈরি করা কষ্টসাধ্য কাজ, বিশেষত এই লেখার পরিধির মধ্যে। কিন্তু কিছু উদাহরণ উঠে আসে। সত্যজিতের টাইপোগ্রাফি বা অক্ষরবিন্যাস সম্বন্ধে সুস্পষ্ট তত্ত্ব তৈরি হয়নি। সত্যজিৎ চারটি ইংরেজি টাইপস্ক্রিপ্ট তৈরি করেছিলেন— ‘রে রোমান’, ‘ড্যাফনিস’, ‘হলিডে স্ক্রিপ্ট’ এবং ‘বিজার’। ১৯৬০-এর দশকে ফ্লোরিডায় অবস্থিত একটি আমেরিকান টাইপ ঢালাই সংস্থা ওঁকে বিশেষ ভাবে এই কাজের জন্য বহাল করে। এই প্রত্যেকটি টাইপফেস ধরনে একে অপরের থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা, কিন্তু প্রতিটির নকশায় একটা ‘কমন’ বা সাধারণ ডিজাইন উপাদান লক্ষ করা যায়— জ্যামিতিক ভারসাম্যের এক অসাধারণ বোধ। পরিতোষ সেনের মতো বহু শিল্পী সত্যজিতের সৃষ্ট অক্ষরছাঁদের চিত্রগুণের প্রশংসা করে গেছেন। অনেকেই মনে করেন যে, এই গুণ বস্তুত কলাভবনে নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতো শিক্ষকের প্রভাবের ফল। কিন্তু অক্ষরছাঁদগুলি আরও একটু খতিয়ে দেখলে (বিশেষত ‘রে রোমান’ এবং ‘ড্যাফনিস’) মনে হতে পারে, সত্যজিৎকে সম্ভবত প্রভাবিত করেছিলেন হার্বার্ট বেয়ার, যাঁকে বাউহাউস টাইপোগ্রাফির জনক বলা হয়। ইনি পরিচিত তাঁর জ্যামিতিক স্যান্স-সেরিফ ‘প্রোপোজাল ফর আ ইউনিভার্সাল টাইপফেস’-এর জন্য (১৯২৫) এবং ১৯৩৩-এ বের্টোল্ড টাইপ ফাউন্ড্রির জন্য সৃষ্ট ‘বেয়ার টাইপ’-এর জন্য। বেয়ারের মতোই, ব্ল্যাকলেটার টাইপোগ্রাফির বাড়তি সাজসজ্জা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে সত্যজিৎ ‘রে রোমান’-এর হরফগুলিকে তাদের মৌলিক অবস্থায় গড়ে তোলেন। নামেই বোঝা যায়, ‘রে রোমান’ একটি রোমান টাইপ, যার উপর ‘বেহরেন্স স্খ্রিফট’ (Behrens Schrift; ১৯০১-২-তে সৃষ্ট পিটার বেহরেন্স-এর তৈরি রোমান হরফমালা) একটা প্রভাব ফেলেছিল। সত্যজিৎ কিন্তু সমঞ্জস আকারের ব্যবহারে বাউহাউস-এর নান্দনিকতা এই রোমান স্ক্রিপ্টেও অঙ্গীভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।        

    ‘ড্যাফনিস’ অন্যরকম, আরও একটু দুঃসাহসী; তার বাঁকা ছাঁদ এবং ধারগুলো গোলমতো করে দেওয়ার প্রবণতা ফুটে ওঠে ‘s’ এবং ‘z’-এর মতো হরফে, যা সুষম এবং ‘রোটেশনাল’। এই দুই টাইপফেসেই, তাদের অ্যাসেন্ডার এবং ডিসেন্ডার-এর তুলনায় অপেক্ষাকৃত লম্বা x-হাইট লক্ষ করা যায় লোয়ার কেস-এর (ছোট হাতের) অক্ষরগুলিতে, এবং এই কারণেই এই হরফগুলি নিখুঁতভাবে সহজপাঠ্য। তুলনামূলক বিচারে, প্রতিরূপ হিসাবে ‘বেয়ার টাইপ’-এর একটি আধুনিক সংস্করণ, ‘আর্কিটাইপ বেয়ার’, লক্ষ করা যেতে পারে। 

    রে রোমান
    ড্যাফনিস
    বেয়ার-কৃত বিশ্বজনীন টাইপ, ১৯২৫
    ১৯৩৩-এ সৃষ্ট ‘বেয়ার টাইপ’-কে ভিত্তি করে তৈরি ‘আর্কিটাইপ বেয়ার’-এর ছোট হাতের হরফমালা

    বাউহাউস প্রভাবের অন্য আর এক বিষয় হতে পারে লোগো। সত্যজিতের তৈরি ‘আইজেনস্টাইন সিনে ক্লাব’ (ECC) -এর লোগো ‘E’-কে দুই অর্ধবৃত্তে বিভক্ত করে, যাকে ঘিরে থাকে দুটো ‘C’, যারা নিজেরাও অর্ধবৃত্ত। এই ডিজাইন গেস্টল্ট ধারণা (উপলব্ধির সামগ্রিকতা হল খণ্ড-উপাদানগুলির যোগফলের অতিরিক্ত) ব্যবহার করে, বৃত্ত/অর্ধবৃত্তের আকারগুলোর উপর নির্ভর করে, যার মধ্যে দিয়ে একতা, সামগ্রিকতা, পূর্ণতার ধারণা ফুটে ওঠে।    

    ‘আইজেনস্টাইন সিনে ক্লাব’ (ECC) -এর লোগো

    সত্যজিতের চাক্ষিক সূচিতে বৃত্তের প্রাধান্য আমরা অন্যত্র দেখতে পাই, যেমন ‘এক্ষণ’-এর প্রচ্ছদসজ্জায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং নির্মাল্য আচার্য দ্বারা সম্পাদিত প্রখ্যাত এই লিটল ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে সত্যজিৎ আবার নিখুঁত জ্যামিতিক পরিপূর্ণতা নিয়ে আসেন। ‘এ’, ‘ক্ষ’ এবং ‘ণ’-এর শিরদাঁড়ায় ব্যবহার হয় খাড়া গ্রিড লাইন; তিনটি হরফেই আলাদা করে দেওয়া বৃত্তাকার চাপ এবং এর পটভূমিতে সূক্ষ্ম, পরিষ্কার সরলরেখার সুনিপুণ ব্যবহার বাউহাউস সমেত একাধিক বিশ্ব শিল্প আন্দোলনের প্রতি সত্যজিতের নিঃশব্দ শ্রদ্ধার্ঘ্য। 

    ‘এক্ষণ’-এর কিছু প্রচ্ছদ

    বৃত্তাকারের ব্যবহারের অনুরূপ, ত্রিভুজের ধারণা নিয়ে সত্যজিৎ কাজ করেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং অসাধারণ শিল্পী সুভো ঠাকুর সম্পাদিত ‘সুন্দরম’ পত্রিকার লোগো সৃষ্টির সময়। এই পত্রিকার অসামান্য লোগোর কাজে— যাতে সমবাহু ত্রিভুজের ভিতর হরফ সাজিয়ে দেওয়া হয়— সত্যজিৎ গেস্টল্ট নিয়মের সাদৃশ্য এবং ধারাবাহিকতার দর্শন ব্যবহার করেন, যেখানে মানুষের মন একই আকারের বস্তুদের একটা করে সমষ্টি বা গ্রুপে ভাগ করে নেয়। এখানে তিনি ত্রিভুজগুলিতে রং দেন, এবং রঙের কোড ব্যবহারে ত্রিভুজাকৃতি অঞ্চলের সীমানা প্রকট হয়ে ওঠে, ত্রিভুজগুলিতে একইসঙ্গে নেগেটিভ স্পেসের যুগপৎ ব্যবহার এবং তার সাবভার্শন গড়ে ওঠে। আবার দেখে এ-ও মনে হয়, সরু সরু হরফগুলোর লম্বাটে সব ছায়া পড়েছে।

    ‘সুন্দরম’-এর লোগো

    ১৯৬৩-তে প্রকাশিত, বাউহাউস নীতি ভিত্তি করে জার্মান শিল্পী জোসেফ অ্যালবার্সের বিখ্যাত বই ‘ইন্টারঅ্যাকশন অফ কালার’-এর কালার গ্রিড, ষাটের দশকের শেষের দিকে বিজ্ঞাপন জগতে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল। অ্যালবার্স বলেছিলেন, যে দর্শক একটা ছবি দেখছে, সে প্রায় কখনওই একটা রংকে একদম ঠিকঠাক দেখতে পায় না, বা রংটা সেভাবে তার কাছে প্রতিভাত হয় না, সেদিক থেকে রং হচ্ছে শিল্পে সবচেয়ে আপেক্ষিক মাধ্যম। রংকে ঠিক করে প্রয়োগ করতে গেলে মনে রাখতে হবে, রং সারাক্ষণ ধোঁকা দিয়ে চলেছে। তাঁর তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে, অ্যালবার্স প্রথমেই ক্যাটক্যাটে রং দিয়ে শুরু করলেন না, বরং সাদা-কালো দিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। তাঁর এই ছবিগুলো বোঝাল, কীভাবে একটা রং, তার পাশের রংটার দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। তথাকথিত গ্রে-স্টেপ, গ্রে-স্কেল, গ্রে-ল্যাডার তৈরি করে তিনি দেখালেন, কালোর আর সাদার মাত্রার তারতম্য করে, কেমন হাল্কা ও গাঢ় শেড তৈরি করা যায়। যদি মনোযোগ দিয়ে দেখি, জানলার গরাদের মতো ‘নায়ক’-এর সাদা-কালো ফিল্ম টাইটেলগুলির প্রেক্ষাপট, প্রায় গ্রে-স্কেলের গঠন ও আলো-ছায়ার ধরন মেনে এগিয়ে চলে। 

    জোসেফ অ্যালবার্সের ‘স্টাডি ইন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’
    ‘নায়ক’-এর টাইটেল কার্ড (চিত্র ১)
    ‘নায়ক’-এর টাইটেল কার্ড (চিত্র ২)

    বাংলা হরফে বাউহাউস টাইপোগ্রাফির উপযোগিতার আরও সুন্দর একটি উদাহরণ আমরা দেখতে পাই ‘মহানগর’ ছবির পোস্টার, এবং আরও বিশেষ ভাবে, সংবাদপত্রে ছবিটির বিজ্ঞাপনে। ‘মহানগর’ শব্দটি দ্বিভক্ত করা হয় দুটি সারিতে (‘মহা/নগর’), একটি আর-একটির উপর বসিয়ে দেওয়ায় লম্বালম্বি অবস্থানের একটা অনুভূতি তৈরি হয়— এভাবে সাজানো অক্ষরের বিন্যাস তক্ষুনি দর্শকের মনে সৃষ্টি করে একটা নগর-চালচিত্রের পটভূমি। ‘হ’-এর লম্বা, সমকোণী ল্যাজ এই গোটা স্ট্রাকচারটিকে একটা আনুভূমিক ভিত্তি হিসাবে ধরে রাখে। আবার এটি সাজানো হয় একটা লম্বা খাড়া স্পেসের এক কোণে, যার নীচে থাকে নায়িকার সিল্যুয়েট, যে শহরের সরু গলি দিয়ে যেন একটু মুক্ত যাতায়াতের পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে, আবার যা দেখতে হয়ে ওঠে সংবাদপত্রের একটি কলাম-এরও মতো। নেগেটিভ স্পেস নিয়ে এই অসামান্য খেলা, এই ‘মেটা-প্লে’, সত্যজিতের প্রকৃত দক্ষতার পরিচয়। দৈনিক সংবাদপত্রে তাঁর ছবির এক কলামের বিজ্ঞাপনের মতো নগণ্য কাজেও তিনি নতুন ও সার্থক আইডিয়া খুঁজে বেড়িয়েছিলেন। 

    (বাঁ-দিক থেকে) ১৯২৩-এর বাউহাউস পোস্টার; বিজ্ঞাপনে ‘মহানগর’-এর হরফ; সংবাদপত্রে ‘মহানগর’-এর বিজ্ঞাপন
    ছবি সৌজন্যে: সন্দীপ রায়

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook