ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • নো স্ক্রিন টেস্ট


    সিদ্ধার্থ চ্যাটার্জি (May 29, 2021)
     

    বাংলা ভাষায় ইংরেজি awe & wonder-এর অনুবাদ কী হতে পারে? যা হতে পারে, তাই হচ্ছে সত্যজিৎ রায়। তবে চোদ্দো বছর বয়সে খুদে সিদ্ধার্থর মোটেই সেটা মনে হয়নি। তার কারণ আমি তখন অবধি সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ ছবির সঙ্গে পরিচিত এবং তার পরিচালক নিয়ে আমার কোনও উৎসাহ ছিল না। প্রথম আলাপে যখন বিশপ লেফ্রয় রোডের বৈঠকখানায় এ-কথা সে-কথার মধ্যে বাংলা সিনেমার প্রসঙ্গ এল, তখনও, সামনে বসা ভদ্রলোক যে সত্যজিৎ রায়— সেটা আমার জানা ছিল না। বাংলা ছবি দেখি কি না, প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলাম, ‘ওই বেশি কিছু না, তবে ‘গুপী গাইন…’ বেশ অনেকবার দেখেছি।’
    ‘অনেকবার?’
    ‘হ্যাঁ, প্রায় সাত-আটবার।’
    ‘এতবার কেন?’
    ‘স্কুল থেকে নিয়ে গেল, বাবা-মা’র সঙ্গে একবার, দাদুকে ছবিটার সম্বন্ধে বলতে দাদু-দিদার সঙ্গে একবার— এই করতে করতে সাত-আটবার।’ 
    ‘গুপী ভাল না বাঘা ভাল?’
    ‘বাঘা, বাঘা।’
    ‘কেন?’
    ‘মজার, খুব মজার। আর তাছাড়া বাঘা খুব ভাল ঢাক বাজাতে জানে, আর আমিও ভাল
    ঢোল বাজাতে জানি।’
    ‘গান গাইতে পারো না বুঝি?’
    ‘না, একেবারেই নয়।’
    ‘ওঃ, তাই গুপী ভাল নয়?’
    ‘না, তা নয়, তবে ‘মহারাজা তোমারে সেলাম’ গানটা একটু-আধটু গাইতে পারি।’ 
    ‘আর ফেলুদাকে চেনো?’
    ‘না, জানি না। ব্যোমকেশ জানি, দীপক চ্যাটার্জি জানি, কিন্তু ফেলুদা তো জানি না।’
    ‘বেশ, তোমাকে একটা ফেলুদার বই দিচ্ছি। পড়লে, ফেলুদা কে বুঝে যাবে।’

    অটোগ্রাফ করা ‘সোনার কেল্লা’ পেলাম। সই, সত্যজিৎ রায়। আমার হাতে প্রথম ফেলুদা। এবার সেই চোখটা চলে গেল ওঁর ওপর। সত্যজিৎ রায় আমার সামনে? এই ভদ্রলোকই ‘গুপী গাইন…’ ছবির স্রষ্টা? মনের মধ্যে সব গোলমাল হয়ে গেল। একটু লাজুক হয়ে পড়লাম। একটু আড়ষ্ট ভাব।

    ‘ফেলুদা একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর— অর্থাৎ ডিটেকটিভ। ওর এক খুদে অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে। ওরই খুড়তুতো ভাই। ডাকনাম তোপসে। এই তোমার মতন বয়স। খুব সজাগ। ফেলুদার কাজে সবসময়ের সঙ্গী।’ 
    ‘আচ্ছা। স্কুলে পড়ে?’
    ‘হ্যাঁ। মাঝে মাঝে স্কুল কামাই করে ফেলুদাকে সঙ্গ দেয়।’
    ‘বাঃ। খুব মজার।’

    ১৯৭৪-এর শীতের সময়। শহরে পোস্টার পড়ে গেছে— ‘সাংঘাতিক’ ছবি ‘সোনার কেল্লা’, সঙ্গে একটা বিছের ছবি। এই বিছেটাই ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। মনটা খারাপ হল। আমাদের ছবি নেই?

    এসব কথার মানে পরে বুঝতে পেরেছিলাম, তখন নয়। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাচ্ছিলেন। বয়সের যে তফাত, সেটা দূর করে দিচ্ছিলেন বাহান্ন বছরের সত্যজিৎ তাঁর চোদ্দো বছরের তোপসের জন্য। এতক্ষণে লোকটাকে বেশ কাছের মানুষ বলে মনে হতে আরম্ভ করেছে। সাধারণ ভাবে একজন চোদ্দো বছরের ছেলের সঙ্গে ভাব জমানো বেশ কঠিন কাজ। আপনারা চেষ্টা করে দেখুন! অসুবিধে হবে। সেটা কিন্তু সব বাচ্চার সঙ্গে উনি অবলীলায় করতে পারতেন। যেমন মুকুলের সঙ্গে। ওর তো তখন ছ’বছর বয়স। ভাবা যায়, কুশলকে কীভাবে অভিনয় করানো হয়েছিল! অবশ্য সেই বয়সেই কুশলের অনেকগুলো প্রতিভা ছিল। তার মধ্যে ওরই কথায়, ‘শের আফগান’ হুবহু অভিনয় করে দেখাতে পারত। আমি আবার অভিনয়-জগৎ থেকে বারো ফুট দূরে। জীবনে কখনও অভিনয় করিনি। স্কুলে অবশ্য একটা নাটকে পেয়াদার রোল জোরজার করে করানো হয়েছিল। কিন্তু কোনও সংলাপ ছিল না— সেই কারণেই হয়তো রাজি হয়েছিলাম। এহেন সিদ্ধার্থ এই মুহূর্তে সত্যজিতের সামনে। পরে বুঝেছিলাম যে, চাইল্ড সাইকোলজি ছিল ওঁর নখদর্পণে। না হলে প্রথম ছবিতে অপু-দুর্গাকে ওইরকম অভিনয় করালেন কী করে!

    আমাকে সেই সন্ধেতে দেখেই পছন্দ করে ফেলেছিলেন। সিনেমার ভাষায় ‘নো স্ক্রিন টেস্ট’। আসলে নিজের চোখটাই তো একটা লেন্স— তাতে যা দেখতে পেতেন, তাতেই বুঝতে পারতেন স্ক্রিনে কী দেখা যাবে। বছর দুয়েক আগে আমি একটা হিন্দি ওয়েব সিরিজে কাজ করলাম। নাম ‘কেক ওয়াক’। এই প্রথম মুম্বই-জগতে কাজ। শুটিং কলকাতাতেই ছিল। এষা দেওল-এর সঙ্গে কাজ। ছবির আগে অনেক সব ছবি তোলা হল। পরে বুঝেছিলাম, ‘লুক টেস্ট’। তার মানে, সত্যজিৎ যাকে সার্টিফিকেট দিয়েছেন, তারও লুক টেস্ট লাগে। তারপরে আরও দুটো অফার। মুম্বই থেকেই। এদের সবাইকে বলে দিলাম, ‘ওসব টেস্ট আমি দিতে রাজি নই।’ আমার টেস্ট দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কেননা যিনি আমাকে সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন— তার ওপর আমার আর কারও সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। 

    ১৯৭৪ সালে ‘সোনার কেল্লা’র শুটিং-এর জন্য হাওড়া থেকে তুফান এক্সপ্রেসে রওনা দিলাম রাজস্থানের উদ্দেশে। আজকাল তুফান এক্সপ্রেসের নাম আর শুনি না। ওই প্রথম বাবা-মাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়া। ট্রেনে হইহই ব্যাপার। দুটো বগি আমাদের। একটার মধ্যে আমরা শুটিং করতে করতে যাচ্ছি। মাঝখানে কানপুর স্টেশন। জটায়ুর আবির্ভাব। ট্রেন দাঁড়াতেই সন্তোষকাকুকে নামানো হল স্টেশনে। বেশি সময় নেই। আমার টেনশন, যদি জটায়ু ট্রেনে ওঠার আগে ট্রেন ছেড়ে দেয়! কিন্তু ঘড়ি ধরে সব প্ল্যান করাই ছিল। অনন্ত দাশের মেক-আপ করা হয়ে গেছিল। ট্রেন স্টেশনে থামতেই ক্যামেরা নামল। জটায়ু আসছে। ক্যামেরা চালু। আমরা ট্রেনের মধ্যে, জানলা দিয়ে দেখছি। ‘কাট’, হাততালি। শট ওকে। পরের দৃশ্য অবশ্য কলকাতার ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। এই প্রথম শিখলাম শট ডিভিশন কীভাবে হয়। কী আশ্চর্য ব্যাপার! কোনওদিন মাথায় ঢুকতই না, যদি না স্বচক্ষে এভাবে দেখতাম! ছবি দেখে বোঝা যাবে না। 

    ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তোপসের ভূমিকায় সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়

    ট্রেনে যেতে যেতে সত্যজিৎ রায় ততক্ষণে মানিকজেঠু হয়ে গেছেন। জেঠিমা (বিজয়া রায়), আমি, কুশল আর জেঠু মেমোরি গেম্‌স আর লুডো খেলছি। কুশল আবার দাবা খেলতে জানত। আমি দাবা আর তাস খেলতে জানতাম না। কিন্তু একসঙ্গে কী মজা! আরও কাছে চলে যাচ্ছিলাম রায় পরিবারের। আড্ডায় দাদা-কাম-বন্ধু সন্দীপদা। ওর সঙ্গেই বেশি মেলামেশা। বাড়ির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস মোবাইল ছিল না। ঘন ঘন খবরের আজকের দিনের বদভ্যেসটা সম্ভব ছিল না।

    যাক, তোপসের অভিনয়ে উতরে গেলাম। আসলে অভিনয় কোনও মুহূর্তে করিনি। ওঁর ছবিতে ওটার প্রয়োজন ছিল না। আমি যা, তাই আপনারা দেখেছেন তোপসের মধ্যে দিয়ে। সবাই বলল, ‘কী ন্যাচারাল!’ মনে মনে হাসি। তখন ক্লাস নাইন-এ। কলকাতার পাঠভবন। ১৯৭৪-এর শীতের সময়। শহরে পোস্টার পড়ে গেছে— ‘সাংঘাতিক’ ছবি ‘সোনার কেল্লা’, সঙ্গে একটা বিছের ছবি। এই বিছেটাই ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। মনটা খারাপ হল। আমাদের ছবি নেই? কী করে জানব ওটা আসলে টিজার অ্যাড! আসলে অ্যাডের দুনিয়াটা তো গুলে খাওয়া ছিল ওঁর। টিজার অ্যাড মানে লোকের মধ্যে একটা ইন্টারেস্ট তৈরি করা। কয়েক দিনের ব্যবধানে অন্য একটা পোস্টার। মনটা খুশি। যাক, আমার ছবিও আছে। ছবি রিলিজ। আমি থাকতাম ভবানীপুরে। হাজরা মোড়ের বসুশ্রী হলে রিলিজ। ছবিটার প্রিমিয়ারের পর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী, ঠিক আছে?’ ওঁর মতো লোকের এই যে প্রশ্ন, এ সব শেখার মতো বিষয়। খুব একটা বেশি মানুষের মধ্যে ওই গুণ চোখে পড়েনি পরবর্তীকালে। এতে অভিনেতারা অনেক উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়ে। এরই জন্য সবার ‘মানিকদা’, আর আমার ‘মানিকজেঠু’।

    ‘এই কয়েক বছরে তোর ভুঁড়ি হয়েছে। ওইটে কমাতে হবে। তোর ওই তিনবেলা ভাত খাওয়াটা বন্ধ করতে হবে।’ জয়বাবা ফেলুনাথে তোপসের ভুঁড়ি— ছি ছি! বেশ মনে আছে, বেশ কিছুদিন ধরে চিকেন স্টু খেয়ে রোগা হয়ে, দ্বিতীয় ছবি।

    পাঁচ বছরের ব্যবধানে আবার ডাক। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ হবে। ইতিমধ্যে ওঁর বাড়িতে যাওয়া-আসা লেগেই ছিল। প্রধান কারণ বাবুদা। ওঁদের বাড়িতে মাঝে মাঝে বিদেশি ছবি প্রোজেক্টর-এ ফেলে দেখানো হত। তখন ভিডিও আসেনি, ইউটিউব তো ভাবাই যায়নি। ইন্টারনেট ছিল না। ছিল না গুগল। আজকের দিনে যারা এসব করবে, তারা ভাববে, গুগল ছাড়া মানিকদা সিধুজ্যাঠা তৈরি করেছিলেন কী করে? একটাই কারণ, বই পড়া। আজকের দিনে কার এইসব অভ্যেস আছে? তারই জন্যে ওঁর সৃষ্টি। সেটা হলফ করে বলতে পারি। আর নিজের চোখে দেখা একটা ডায়েরি— যাকে ‘খেরোর খাতা’ বলে সবাই জানি। যখন যেটা মনে আসত, লেখা হয়ে যেত। আমাদের আজকের দিনে ডিজিটালি এসব হয়। তাতেও সবাই ভুলে যায়। বেশ মনে পড়ে, আমার বোনের বিয়ে। নেমন্তন্ন করতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কখন যেতে হবে?’ বললাম, ‘সন্ধে সাতটা থেকে যে কোনও সময়।’ বিয়ের দিন, ব্যস্ততা। তখনও জামাকাপড়ও ঠিক করে পরা হয়নি। সন্ধে সাতটা। প্রথম অতিথি জেঠু। কী কাণ্ড! আমরা তো তখনও তৈরিই হইনি। কোনওমতে সামলানো গেছিল।

    ‘এই কয়েক বছরে তোর ভুঁড়ি হয়েছে। ওইটে কমাতে হবে। তোর ওই তিনবেলা ভাত খাওয়াটা বন্ধ করতে হবে।’ জয়বাবা ফেলুনাথে তোপসের ভুঁড়ি— ছি ছি! বেশ মনে আছে, বেশ কিছুদিন ধরে চিকেন স্টু খেয়ে রোগা হয়ে, দ্বিতীয় ছবি। এবার তোপসে বড় হয়ে গেছে। দাড়ি কামায়। একটা শট-এ প্রমাণ হয়ে গেল, তোপসে বড় হয়ে গেছে। বেশি কথা বলে বোঝাবার প্রয়োজন থাকে না। ফিল্মের একটা ভাষা আছে। সেটা ওঁর ছবি দেখলে নিশ্চয়ই বোঝা যায়। ছোটবেলায় কতটা বুঝতাম তা বলতে পারি না। এখন বেশ বুঝি। হিউমারের সঙ্গে কটাক্ষ একটা অদ্ভুত ব্যাপার। ‘উটেরা কি কাঁটা বেছে খায়?’ এই একটা উক্তিতে বাঙালিয়ানা ভরপুর। এটা ইংরেজিতে অনুবাদ করা সম্ভব নয়। কিংবা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ ‘রানিং হট অ্যান্ড কোল্ড ওয়াটার?’ ‘আজ্ঞে না, রানিং সারভেন্ট পাবেন।’ চিত্রনাট্য সবল হলে ছবি যে কী হতে পারে, আমরা সবাই পরখ করেছি।

    আর কত লিখব? জেঠু আমার জীবনে এসে আমাকেই পুরোপুরি পালটে দিয়েছিলেন। নিজেকে ধন্য মনে করি ওঁর সান্নিধ্য পেয়ে। যাঁরা ওঁর সান্নিধ্যে আসেননি, তাঁরা ওঁর সবকিছু গ্রহণ করলে ধন্য হয়ে যেতেন— এটা আমার সবসময় মনে হয়। 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook