সত্যজিতের এই খেরোর খাতাগুলি ছিল তাঁর সমস্ত সৃষ্টিশীল কাজের আঁতুড়ঘর। এখানে তিনি চিত্রনাট্যের খসড়া, ছবিতে ব্যবহারের জন্য গানের খসড়া, আবহসঙ্গীতের নোটেশন, চরিত্রদের পোশাকের ডিজাইন, ছবির পোস্টার, টাইটেল কার্ড, বুকলেটের ডিজাইন, ও ছবি সংক্রান্ত আরও হাজারও খুঁটিনাটি বিষয়ের নোট্স লিখে রাখতেন। চিত্রনাট্য লেখার সময় সংলাপের পাশাপাশি ছবির সম্ভাব্য একটি ফ্রেমিং-এর স্কেচও খাতায় করে রাখতেন, তাতে শুটিং-এর আগেই তার একটা চেহারা তাঁর মাথার মধ্যে ধরা থাকত। এক কথায়, খাতাগুলি ছিল তাঁর ওয়ার্ক স্টেশন। এখানে সেই খাতা থেকে তেমনই দশটা পাতা দেওয়া হল। প্রসঙ্গসূত্র ধরে ধরে।
অপুর সংসার — সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অপুর স্ত্রী অপর্ণা মারা যায়, তারপর থেকে অপু তার সন্তানের খোঁজখবর নেয় না। অপুর ছেলে গ্রামে বড় হতে থাকে। তাকে দেখাশোনা করার তেমন কেউ নেই। সে বেশ দুরন্ত। ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, পাখিদের দিকে তাক করে তির ছোড়ে, তাদের মারে। এবং এ বিষয়ে সে দুঃখিত নয়। একটা ছোট্ট চড়াইকে গুলতি দিয়ে মেরে সে খুবই আনন্দিত হয়। আসলে, সে বেশ অদ্ভুত একটা ছেলে। তার মধ্যে একটা কাব্যিক সত্তা আছে, যদিও তার যত্ন নেওয়া হয় না। (ফ্লাহার্টি সেমিনার, ভারমন্ট, ১৯৫৮-এ সত্যজিৎ রায়ের বক্তব্য)।
অরণ্যের দিনরাত্রি — চার বন্ধু হঠাৎ পালামৌ-এর জঙ্গলে বেড়াতে চলে যায়, সেখানে তাদের কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা নিয়েই ছবি। সত্যজিৎ রায় চার বন্ধুর পোশাক পরিকল্পনা করে, নিখুঁত ছবি এঁকে রেখেছিলেন। কী ধরনের কাপড় ব্যবহৃত হবে পোশাকগুলোয়, তাও ভাবা ছিল। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা প্রথমদিন কী পোশাক পরেছিল, গাড়িতে যাওয়ার সময়, রেস্টহাউসে পৌঁছনোর পরে, এবং তারপর একটা দেশি মদের দোকানে যাওয়ার সময়। পোশাকগুলোর মধ্যে দিয়ে, সামাজিক অবস্থান ছাড়াও, প্রতিটি চরিত্রের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যায়।
জলসাঘর — সিনেমাটি এক জমিদারকে নিয়ে, যিনি ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের প্রকৃত সমঝদার। তিনি জানেন তাঁর অর্থ-প্রতিপত্তি তলানিতে, কিন্তু তা-ও একজন উঠতি বড়লোক ব্যবসায়ীর কাছে নতি স্বীকার করতে তিনি নারাজ। এই সিনেমায় বিখ্যাত কিছু ধ্রুপদী সঙ্গীতের উপস্থাপনা রয়েছে। সিনেমার নামটি লেখার সময় সত্যজিৎ রায় নানারকম অক্ষর-বিন্যাস নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছেন।
অশনি সংকেত — ১৯৪৩-এ মানুষের তৈরি দুর্ভিক্ষ চলার সময়, গ্রামের পুরোহিত গঙ্গাচরণ এবং তার পরিবারের অবস্থা নিয়ে তৈরি। সত্যজিৎ রায়ের ইউনিট, এই স্কেচটা দেখে বীরভূম জেলার গোয়ালপাড়ায় গঙ্গাচরণের বাড়িটা তৈরি করে।
দেবী — এই ছবিতে, একটা জমিদারবাড়ির এক তরুণী বউকে দেবীর অবতার ভেবে পুজো করা শুরু হয়। ছবিটা সেই ধর্মবিষয়ক গোঁড়ামি দেখায়, যা এখনও আমাদের দেশে চলছে। ছবিটার নামটা পোস্টারে বা বিজ্ঞাপনে কীভাবে লেখা হবে, তা নিয়ে সত্যজিৎ অনেক ভেবেছেন, অনেকগুলো নকশা করেছেন। বাংলা অক্ষরগুলোর ছাঁদ দেখে একটা মন্দিরের চুড়োর কথা মনে হয়। দুর্গার ত্রিনেত্রও দেখা যায়। সংলাপের কয়েকটা খসড়া আর কিছু আঁকিবুঁকি পাতাটায় দেখা যাচ্ছে। একটা আঁকিবুঁকিতে ইংরেজি ‘এস’ আর ‘আর’ অক্ষর খেয়াল করা যায়, হয়তো এসআর প্রোডাকশনস-এর লোগো আঁকার কথা ভাবছিলেন।
কাঞ্চনজঙ্ঘা — দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে, শহরের বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানের কিছু লোকের দেখা হয়। সত্যজিৎ চিত্রনাট্যটা লিখেছিলেন দার্জিলিং-এর মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলে, আর অবসর সময়ে ফাউন্টেন পেন দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার একটা দারুণ ছবি এঁকেছিলেন। স্কেচটায় তাঁর সই আছে, কোথায় আঁকছেন, কবে আঁকছেন— সবই দেওয়া আছে। মাউন্ট এভারেস্ট হোটেল, রুম নং ৮৮, ২১/ ১০/ ১৯৬১।
কাপুরুষ ও মহাপুরুষ — দুটো ছোট ছবি, দুটো ছোটগল্প থেকে তৈরি। দুটো শব্দ নিয়ে, অনেক রকমের ক্যালিগ্রাফির চেষ্টা করেছেন সত্যজিৎ। ফাউন্টেন পেনে আঁকা-লেখা এতগুলো অক্ষরছাঁদ তাঁর আশ্চর্য দক্ষতার পরিচয় দেয়।
নায়ক — প্রবল বিখ্যাত এক মহানায়ক কলকাতা থেকে দিল্লি যাচ্ছেন একটা ট্রেনে। সেই যাত্রা, এবং তাঁর ও সহযাত্রীদের মধ্যে কথাবার্তা, প্রতিক্রিয়া— তা নিয়েই ছবি। সত্যজিৎ যেমন করেন, একেবারে ডিটেলে সেট-টার ছবি এঁকেছিলেন, আর চরিত্রগুলো কে কোথায় থাকবে— ফার্স্টক্লাস কুপ, চেয়ার কার, ডাইনিং কার-এ— একেবারে তাদের সিট নম্বর-সহ এঁকে রেখেছিলেন। এমনকী ট্রেনটার যাওয়ার ও ফেরার সময় বসার জায়গাগুলো কী হবে, তাও দেখিয়েছিলেন। এই স্কেচগুলোই অসামান্য শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্তকে সাহায্য করেছিল একদম সত্যিকারের ট্রেনের মতো একটা সেট তৈরি করতে, সিনেমায় ধরাই যায় না যে এটা আসল ট্রেন নয়।
শতরঞ্জ কে খিলাড়ি — মুনশি প্রেমচন্দ-এর একটা ছোটগল্প অবলম্বনে, এই ছবি একদিকে দেখায় ব্রিটিশ রাজত্ব কীভাবে আউধকে গ্রাস করে নিচ্ছে, আর অন্যদিকে দেখায় দাবার নেশায় বুঁদ দুই অভিজাত লোককে। ব্রিটিশ বাহিনী লখনৌয়ে ঢুকছে, এটা দেখানোর জন্য সত্যজিৎ প্রতিটি খুঁটিনাটি সহ সৈন্যদের একটা মিছিল এঁকে রেখেছিলেন, সেনাবাহিনীর ভিন্ন ভিন্ন ডিভিশন বুঝিয়ে। এই ধরনের যে কোনও মিছিলের যতগুলো বৈশিষ্ট্য, সবই ছবিটায় আছে— বাজনদাররা কোথায় থাকবে, তারপর বড় কামান, ছোট বন্দুক, পতাকা, উট, ঘোড়া, হাতি, গরুর গাড়ি, হাঁসমুরগি, কুকুর, পালকি— তালিকা করলে ফুরোবে না। একটা দৃশ্যের পিছনেও কতটা গবেষণা আর ভাবনাচিন্তা ব্যয় করা হয়েছে, ভাবলে অবাক হতে হয়।
জন অরণ্য — নাগরিক দুর্নীতির কাছে মূল্যবোধের আত্মসমর্পণ নিয়ে ছবি। এখানে সত্যজিৎ এঁকেছেন বিশুদা চরিত্রটিকে (এই ভূমিকায় দুরন্ত অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত) বিভিন্ন অ্যাঙ্গল থেকে কেমন দেখাবে, মেক-আপ সহ। বিশুদা একটা অর্ডার সাপ্লাই এজেন্সি চালান এবং তিনিই সোমনাথকে এই চাহিদা-জোগানের নির্মম জগৎটায় ঢোকান। প্রোফাইল স্কেচটার রেখাবিন্যাস থেকেই বোঝা যায়, সত্যজিৎ কত প্রখরভাবে মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ করতেন।