দু ’একটা ভাড়া-বাড়িতে থাকার পর শান্তিনিকেতনে আমাদের নিজেদের একটা বাড়ি হয়েছিল। আমার বাবা-মা আর বোনের বাড়ি। বাবা-মায়ের ক্যাকটাস গাছের একটা বড় সংগ্রহ ছিল। আমার হাতে এক সময় তার বহু কাঁটা ফুটেছে। তার মধ্যে একটা ছিল একেবারে বঁড়শির মতো। তাতে অনেক সময় ছানা-বেড়াল, গিরগিটি, পাখি আর কাঠবেড়ালিগুলো আটকে কষ্ট পেত। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমাদের বাড়ির নাম কী?’ বাবা বলেছিলেন, ‘ক্যাকটাস।’ চল্লিশ বছর চলে গেল, বাড়ির নামটা লেখা হয়নি। আজকাল ইন্টারনেটে কেনা জিনিস দিতে বাড়িতে কেউ না কেউ আসেন। সকালে আসে তাঁদের ফোন। ‘বাড়িটা কোন দিকে?’ আমাকে বলতে হয়, ‘‘মোহর’ বাড়ির সামনের গলি দিয়ে ‘আয়না’ বাড়িতে ধাক্কা খাবেন। তার বাঁদিকের গলির দ্বিতীয় সাদা বাড়িটা। ‘নেপথ্য’ বাড়ির একেবারে উল্টোদিকে। সামনে একটা বড় আমগাছ, দরজা-জানলা কালো, আর দুটো কুকুর চেঁচাচ্ছে।’ নিজেদের বাড়ির একটা নাম থাকলে আমাকে কয়েকটা কথা কম বলতে হত। পাড়ার বাড়িগুলো চল্লিশ বছর দেখছি, কিন্তু সব নাম মনে থাকে না, হয়তো মনে রাখবার মতো নয় বলেই।
‘শান্তিনিকেতন’ জায়গাটার নামটাই কিন্তু একটা বাড়ি থেকে। বানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। আমার মতে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের যতগুলো বাড়িঘর রয়েছে, ‘শান্তিনিকেতন গৃহ’ তাদের সেরা। কেননা, এই একটামাত্র বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথের বাবা, স্ত্রী আর পাঁচ ছেলেমেয়ের প্রত্যেকে কোনও না কোনও সময় থেকেছেন। বাকি গণ্যমান্য অতিথিদের কথা ছেড়েই দিলাম। বাড়ির বাইরে কোথাও তার নাম লেখা নেই। শান্তিনিকেতনের আরও যে কয়েকটা বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ থেকেছেন তার মধ্যে রয়েছে ‘দেহলি’ আর ‘নতুন বাড়ি’। বেশ পরে, শান্তিনিকেতন আশ্রমের পাশেই একটা রুক্ষ জায়গায় তিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটা বাড়ি করেছিলেন। ‘মৃন্ময়ী’, ‘কোণার্ক’, ‘উদয়ন’, ‘শ্যামলী’, ‘পুনশ্চ’ আর ‘উদীচী’। ‘মৃন্ময়ী’ এখন আর নেই। খেয়ালি কবি বাড়ি বদল করতে ভালবাসতেন। বলেছিলেন মাটির বাড়ি ‘শ্যামলী’ তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। সত্তর বছরের জন্মদিনে সেই বাড়িতে প্রবেশ করার এক বছরের ভিতর বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়ে। মেরামত হলে মাঝেমধ্যে থেকেছেন। ভেবেছিলেন ‘শ্যামলী’র পর আর বাড়ি করবেন না। কিন্তু যখন তারপর আর একটা বাড়ি হল, তার নাম দিলেন ‘পুনশ্চ’। যেন একটা চিঠির শেষে বলতে চাওয়া, ভুলে যাওয়া ছোট্ট দু’এক কথার মতো দাঁড়িয়ে আছে সেই বাড়ি। কিন্তু তারপরও আর একটা বাড়ি চাইলেন রবীন্দ্রনাথ। ভেবেচিন্তে নতুন আর শেষ বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ‘উদীচী’। উত্তরায়ণেই কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের শখের বাড়ি ‘গুহাঘর’ আর দোতলায় স্ত্রী প্রতিমার স্টুডিও ‘চিত্রভানু’। রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ থাকতেন যে-বাড়িটায়, তার নাম ‘দ্বিজবিরাম’।
শান্তিনিকেতন উপাসনাগৃহের পাশেই দেখা যায়, গোল একটা কুঁড়েঘরের খড়ের চাল চিরে সোজা উঠে গেছে একটা তালগাছ। এক সময় শান্তিনিকেতনের শিক্ষক তেজেশ্চন্দ্র সেনের বাড়ি। ‘তালধ্বজ’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট মেয়ে মীরার জন্য করে দিয়েছিলেন একটা বাড়ি। উত্তরায়ণের পাশেই। মীরা গাছপালা আর বাগান ভালবাসতেন। বাড়িটার নাম তাই ‘মালঞ্চ’। নাম লেখা ফলক এখন ঝাপসা । এক সময় বৈকালিক চা-চক্রের প্রয়োজনে একটা বাড়ি তৈরি হয়। আশ্রম মাঠের লাগোয়া সেই দ্বিতল চা-গৃহের নাম ‘দিনান্তিকা’। আশ্রমের পুরনো বাড়িগুলোর প্রায় কোথাও নাম-ফলক বসানো নেই। কেন নেই কে জানে! পুরনো শান্তিনিকেতনের বেশ কিছু বাড়ি অবলুপ্ত, শুধু তাদের নামগুলো জানা যায়। জাপানের দারুশিল্পী কিন্তারো কাসাহারা শ্রীনিকেতনে তিনটে গাছের উপর রবীন্দ্রনাথের জন্য বানিয়েছিলেন এক অভিনব বাড়ি। লম্বা সিঁড়ি বেয়ে রবীন্দ্রনাথ উঠতেন সেখানে। ওই কাঠের গাছ-বাড়ির নাম পাওয়া যায় না।
বাড়ির কথা ভাবতে ভাবতে একবার শান্তিনিকেতনের তল্লাট ঘুরে এলাম। মনে দাগ কাটার মতো কয়েকটা নাম। শ্রীপল্লীতে আশুতোষ আর অমিতা সেনের বাড়ি ‘প্রতীচী’। এখন চেনা অমর্ত্য সেনের বাড়ি হিসেবেই। ফলকের ‘টাইপোগ্রাফি’ চমৎকার। অবনীন্দ্রনাথের আঁকা এই বাড়ির একটা স্কেচ পাওয়া যায়। একটু এগিয়ে পিয়ারসন পল্লীতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ‘আনন্দধারা’। কাছেই চিদানন্দ দাশগুপ্তের বাসভবন। এখন কন্যা অপর্ণা সেন বাবার চলচ্চিত্রের স্মৃতিতে সেই বাড়ির নাম রেখেছেন ‘আমোদিনী’। শিল্প নির্দেশক হিসেবে তাঁর মা সুপ্রিয়াও কাজ করেছিলেন সেই ছবিতে। ফলকের ক্যালিগ্রাফি অপূর্ব। ঢেকে আছে আইভি লতায়।
শান্তিনিকেতনের উত্তরে, লালবাঁধের ধারে রবীন্দ্রনাথের সচিব অনিল চন্দ আর তাঁর স্ত্রী রানীর বাড়ি ‘জিৎভূম’। রবীন্দ্রনাথের ‘উদীচী’ বাড়ির পাশেই একটা পাকা রাস্তা। তার গা ঘেঁষে তাঁর একসময়ের সচিব, কবি অমিয় চক্রবর্তীর বাড়ি ‘রাস্কা’। সাঁওতালি ভাষায় কথাটার মানে ‘আনন্দ’। আমৃত্যু অমিয় এই বাড়িতেই ছিলেন ড্যানিশ স্ত্রী হৈমন্তীকে নিয়ে। রতনপল্লীতে রথীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা নন্দিনী আর জামাতা গিরিধারী লালার জন্য বানিয়ে দিয়েছিলেন ‘ছায়া নীড়’। এই নামের ভিতর কোথাও যেন একটা ব্রাহ্ম ছায়া। বহু অপমানের ভিতর, চোখের জল ফেলতে ফেলতে শেষবার তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে যান এই বাড়ি থেকেই। এই বাড়ির অদূরেই ক্ষিতীশ রায়ের মেয়েদের বাড়ি ‘ছায়া বীথি’।
আশ্রমের পূর্ব প্রান্তে বিশ্বভারতীর ধার দেওয়া জমিতে বহু বাড়ি রয়েছে। বেশির ভাগই দুই-বিঘা জমির উপর তৈরি। উপাচার্যের বাসভবন ‘পূর্বিতা’। তার পাশেই রেললাইন। ওই এলাকায় নজর-কাড়া নামের বাড়িগুলোর কয়েকটা— ‘ডেরা’, ‘ফেরা’, ‘আস্তানা’, ‘আকন্দ’, ‘লাবণ্য’, ‘পাখি’, ‘ঢাকা দক্ষিণ’, অথবা ‘কোরক’। বঙ্কিম বিশেষজ্ঞ অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের বাসভবন ‘আনন্দমঠ’-এর পাশেই এক সময় ছিল পদার্থবিদ্যার এক অধ্যাপকের বাড়ি ‘পরমাণু’। খুঁজতে গিয়ে দেখলাম হাত-বদল হবার পর পুরনো সব কিছু ভেঙে সেখানে নতুন বাড়ি উঠছে। পূর্বপল্লীতে ‘রবি তীর্থ’ বলে একটা বাড়ির উল্টোদিকে শিল্পী কে জি সুব্রহ্মণ্যনের বাড়ি ‘কৈলাস’। ইংরেজিতে লেখা নাম, শিল্পীর প্রিয় এক রং, কালোর উপর সাদা হাতের লেখায়। এই ধাঁচেই কলাভবনে আস্ত একটা বাড়ি নিজের হাতে আঁকা ছবি দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন তিনি। পূর্বপল্লীর দক্ষিণ প্রান্তে যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক শিবনারায়ণ রায়ের বাড়ি ‘রুদ্র পলাশ’। আর শিল্পী সুধীর খাস্তগীর এবং তাঁর কন্যা থাকতেন যে বাড়িটায়, তার নাম ‘পলাশ’। গায়িকা নীলিমা সেনের আবাস ‘সোনাঝুরি’। গায়েই বুদ্ধদেব বসুর বাড়ি। নাম তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামে। ‘স্বাগত বিদায়’। আসা আর যাওয়া। একেবারে জীবনের মতো। বাড়িটা মৃত্যুর পথে, হাত-বদল হয়ে হয়তো নতুন কোনও বাড়ির অপেক্ষায়। ফলকটা এখনও অক্ষত, ইতিহাসের পাহারাদারের মতো। ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন এক সংস্কৃত ছন্দের নামে তাঁর বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘রুচিরা’।
আশ্রম মাঠের গা ঘেঁষে স্থপতি সুরেন্দ্রনাথ করের বাড়ি ‘সুরমা’, তাঁর আর তাঁর স্ত্রী রমার নামের অক্ষর জুড়ে। শান্তিনিকেতনের বহু ঐতিহাসিক বাড়িতে রয়েছে সুরেন্দ্রনাথ করের ভাবনার পরশ। এই একই ভাবনা দেখা যায় শিল্পী সুশোভন অধিকারীর বাড়ির নামকরণে। স্ত্রী, পুত্র এবং নিজের নামের অক্ষর ব্যবহার করে বাড়ির নাম রেখেছেন শুধু ‘সু’। হাতিপুকুরের পাশেই শিল্পী-দম্পতি মিমি এবং কে এস রাধাকৃষ্ণণদের চমৎকার দুটো বাড়ি। একটা ‘মিমির বাড়ি’, পাশেই পরে কিনে মেরামত করে নেওয়া দ্বিতীয়টার নাম, ‘পাশের বাড়ি’। কী সহজ আর সাদামাটা! নন্দলাল বসু, রীতেন্দ্রনাথ মজুমদার, সনৎ কর, যোগেন চৌধুরী, দিনকর কৌশিক, সোমনাথ হোরের মতো শান্তিনিকেতনের শিল্পাচার্যদের বাড়িগুলো রহস্যময় ভাবে নামহীন! তবে অবনপল্লীতে অবনীন্দ্রনাথের নাতি অমিতেন্দ্রনাথের বাড়ি ‘আবাস’-এর নাম-ফলকে এক সময় দেখা যেত জাপানি কায়দায় অবন ঠাকুরের হাতের লেখায় বাড়িটার নাম। এখন সেটার আদলে একটা বেশ খারাপ, কালো গ্রানাইটের ফলক বসেছে বাড়িটায় । রতনপল্লীতে ভাস্কর কিরণ সিংহের বাড়ির নাম ছিল ‘বুলবুল বাড়ি’। তার অদূরেই কলকাতা থেকে এসে একটা পেল্লায় বাড়ি করেছিলেন শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য। মাঝেমধ্যে এসে থাকতেন। বাড়ির নাম রেখেছিলেন পুত্রকন্যার নামে। ‘বলাকা-বিভাস’। ওই চত্বরেই বাংলার অধ্যাপক ভবতোষ দত্তের বাড়ি ‘কুন্দকলি’। পাশেই বাবা-মায়ের স্মৃতিবিজড়িত ‘করতোয়া’য় থাকেন সঙ্গীতশিল্পী সাহানা বাজপেয়ী। ডিয়ারপার্ক এলাকায় শিল্পী মোহন সিংহ খাঙ্গুরার বাড়ি ‘শাহানা’। তার কাছেই ভাস্কর শর্বরী রায়ের বাড়ির নাম, তাঁর প্রয়াণের পর, ‘শর্বরী’। রতনপল্লীর পিছনে যে বাড়িটায় এক সময় শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ থাকতেন, সেটা ভেঙে নতুন বাড়ি হয়েছে। ইতিহাসের চিহ্ন মুছে ফেলে, সম্ভবত দয়া করে নতুন বাড়ির নাম রাখা হয়েছে ‘কিঙ্কর’। ওই বাড়ির কাছাকাছি একেবারে মুখোমুখি দুটো বাড়ির নামে চোখ আটকে যায়। ‘এলাপর্ণী’, আর রায়দের, সম্ভবত আবার একটা নতুন বাড়ি, ‘পুনরায়’। সুপ্রিয় আর শুভ্রা ঠাকুর হই-হুল্লোড়ে থাকতে না পেরে রতনপল্লীর বহুদিনের পুরনো আস্তানা ‘শোহিনী’ ছেড়ে অন্যত্র নতুন বাড়ি করে উঠে যান। বাড়ি বিক্রির শর্ত অনুযায়ী নিয়ে যান সেই নাম-ফলকও, নতুন বাড়ির জন্য।
রবীন্দ্রনাথের ছায়া শান্তিনিকেতনের অসংখ্য বাড়ির নামকরণে। রতনপল্লীতে অরূপ সরকারের বাড়ি ‘নৈবেদ্য’, পূর্বপল্লীতে জিৎ আর মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ‘খেয়া-তরী’, মৃদুচ্ছন্দা আর দেবব্রত পালিতের বাড়ি ‘ছুটি’র মতোই ‘শেষের কবিতা’, ‘তবু মনে রেখো’, ‘লিখন’, ‘লাবণ্য’ তারই কয়েকটা।
পূর্বপল্লীর একেবারে উত্তরে জাপানি স্থপতির নকশায় আমারও একটা ছোট্ট বাড়ি আছে। এলাকায় বাড়িটা পরিচিত ‘জাপানি বাড়ি’ বলেই। আমি তার একটা নাম দিয়েছিলাম, ‘কোকোরো’। বাংলায় যার মানে ‘হৃদয়’। বাড়িটা একবারে চিনে কেউ আসতে পারেনি। আমাকে বারবার বলে দিতে হয়। ‘জোড়া বাড়ির সামনে একটা ট্রান্সফর্মার। তার সামনে ভূগোল শিক্ষকের বাড়ি ‘সহ্যাদ্রি’।’ ডানদিকের পাঁচিল বরাবর রাস্তা ধরে সোজা এসে ধাক্কা খাবেন একটা বাড়িতে, যার নাম ‘ইন্দ্রপ্রস্থ’। সেখান থেকে বাঁদিকের মাটির রাস্তায় নেমে এগোবেন। বাঁদিকে ‘ময়ূরাক্ষী’। সামনে কয়েকটা স্তম্ভ পোঁতা। উল্টোদিকের সরু গলিটার শেষ বাড়ি ‘পূর্বাহ্ণিক’। তার পাশ দিয়ে বেঁকে প্রথম ডানদিক। একসময় অর্থনীতিবিদ অশোক রুদ্রের বাড়ি ‘অশোক কানন’-এর একেবারে উল্টোদিকের কালো-বাঁশওয়ালা বাড়িটাই ‘কোকোরো’। অতিথিরা জিজ্ঞেস করেন, ‘নামটা তো বুঝলাম, ফলকটা কোথায়?’ আমাকে বলতে হয়, ‘লেখা নেই, শুধু হৃদয়ে রইল আপনার!’