ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি আদালতগুলোয় এক নারীর মূর্তি দেখা যায়— তাঁর চোখে কাপড় বাঁধা, হাতে দাঁড়িপাল্লা। ইনি লেডি জাস্টিস বা ন্যায়ের দেবী, হেসিয়ডের থিওগনিতে বর্ণিত দেবরাজ জিউসের কন্যা দেবী ডাইকি-র আদলে তৈরি। ডাইকি হলেন মানবসমাজের ন্যায়ের দেবী, আর দৈব ন্যায়ের দেবী তাঁর মা থেমিস। ছবিতে এঁর হাতে দাড়িপাল্লা দেখতে পাওয়া যায়, আর এঁর রোমান অবতার জুস্টিটিয়ার দু’চোখ থাকে কাপড় দিয়ে বাঁধা। এই দেবী নিষ্পাপ মূর্তিতে কল্পিতা, যে মূর্তিতে তিনি আডিকিয়া নামক অন্যায়ের কুরূপা দেবীকে লাঠির আঘাত করছেন, বা তরবারির সাহায্যে বধ করছেন। বলা হয়, স্বর্ণ এবং রৌপ্য যুগে, যখন পৃথিবীতে যুদ্ধবিগ্রহ হানাহানি ছিল না, তখন দেবী মানুষের সঙ্গেই বসবাস করতেন। ক্রমে মানুষ লোভী হয়ে ওঠে, ন্যায়ের কথা ভুলে যায়, তাই দেবী ডাইকি মানুষের এই দুর্নীতির হাত থেকে পালিয়ে অলিম্পাস পর্বতে তাঁর পিতা জিউসের কাছে আশ্রয় নেন।
ন্যায়ের সঙ্গে দাঁড়িপাল্লার রূপকের ইতিহাসটা অবশ্য আরও পুরনো, প্রাচীন মিশরের ন্যায়ের দেবী মা’আত এবং পরবর্তীকালে দেবী আইসিসের গল্পে এর যোগসূত্র পাওয়া যায়। সদ্যমৃতের আত্মা কি ওসিরিসের রাজ্যে প্রবেশের অধিকার পাবে, না তাকে পরলোকের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে এক দানবের পেটে যেতে হবে— সে বিচারে এইসব আত্মার ওজন নেওয়া হত, মা’আতের পালকের সঙ্গে মেপে। মিশরীয় রূপকথার থেকে গ্রিক রূপকথা হয়ে এই কাহিনি এসে ঠাঁই পেয়েছে খ্রিস্টান রূপকথায়, যেখানে আর্কেঞ্জেল মাইকেল প্রায়ই কল্পিত হন দাঁড়িপাল্লা হাতে। পাপে হৃদয়ের ওজন বেড়ে যায়, এবং পাপীকে যেতে হয় নরকে। পুণ্যবানের কপালে জোটে স্বর্গ।
অবশ্য ধনী, ক্ষমতাবান, বা বিখ্যাত মানুষকে যে সচরাচর নিষ্পাপ বিচার করে স্বর্গে যাওয়ার সুবিধাই দেওয়া হয়, ভারতবর্ষে সে-কথা আমরা ধীরে ধীরে মেনে নিতে শুরু করেছি। আমাদের আদালতের বিচারপতিরা ক্ষমা করতে বড়ই উদগ্রীব, রাশি রাশি প্রমাণপত্র ঘেঁটে, হয় দলিল নয় পদ্ধতিতে কোনও-না-কোনও খুঁত তাঁরা বার করেই ফেলেন, যে বেনিফিট অফ ডাউট-টি টাকাপয়সা, ক্ষমতা বা ভাল উকিল না-থাকলে দেওয়া হয় না— এ অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। চোখে কাপড় হয়তো এ-কারণেই বাঁধা। নীচের স্তরের আদালতের বিচারকদের সিদ্ধান্তগুলো যখন ‘উপরের’ বিচারকেরা নাকচ বা বাতিল করে দেন, তাঁদের বড়ই বিরক্তি হয় নিশ্চয়ই। একভাবে দেখলে বিচারপদ্ধতির দুনিয়ায় এ-ও আসলে এক ধরণের সামন্ততন্ত্র। অবশ্য আদালতের সমালোচনা জিনিসটা আবার অধার্মিকতা বা ব্লাসফেমির সমতুল্য, কারণ আদালত এবং আধুনিক বিচারব্যবস্থার সৃষ্টি আসলে আব্রাহামিক ধর্মের আখরে— সেখানে ঈশ্বর নরকযন্ত্রণার ভয় দেখিয়ে মানুষকে সৎ পথে চলতে বাধ্য করেন, এবং পৃথিবী উলটে গেলেও ঈশ্বর/বিচারক কোনওদিন ভুল করতে পারেন না।
ন্যায়ের এবং আইনের চোখে সবই সমান, এটা বোঝানোই ছিল চোখে বাঁধা কাপড়ের তাৎপর্য। ঈশ্বরের চোখেও তো তা-ই হওয়ার কথা— মাত্র একটি করে নিয়ম ভাঙার অপরাধে কি জেহোভা তাঁর পয়গম্বর মোজেস এবং তাঁর রাজা ডেভিডকেও শাস্তি দেননি? অভিযুক্তের প্রতিপত্তি, আভিজাত্য, টাকাপয়সা বা ক্ষমতার দিকে না তাকিয়েই তার অপরাধের বিচার হবে, এমন একটা পৃথিবীর স্বপ্ন মানুষ দেখতে ভালবাসে। কিন্তু সে পৃথিবী তো আদর্শবাদের, বাস্তবে তার দেখা মেলে না।
একাধিক প্রাচীন সমাজে ন্যায়বিচারের সময়ে, অভিযুক্ত বা অভিযুক্তা সমাজের কোন স্তরের মানুষ, তার নিরিখেই বিচার হত, যাতে তাদের জীবনের বৃহত্তর প্রসঙ্গগুলোকে মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বহু সমাজে একজন ধনী ব্যক্তি যদি একজন গরিব মানুষকে খুনের অপরাধে দোষী হতেন, তবে অপরাধীকে বলা হত, নিহত ব্যক্তির পরিবারকে একটা মোটা টাকা জরিমানা দিতে। এমন সিদ্ধান্ত বাস্তববাদী, প্রতিহিংসার দ্বারা প্রভাবিত নয়। মনুস্মৃতির বিধান অনুযায়ী, শাস্তির মাত্রা নির্ভর করছে অপরাধীর বর্ণ বা জাতের উপর। একাধিক সমাজেই ন্যায়বিচারের দায়িত্ব ছিল, কারও সৎ কাজের সঙ্গে অসৎ কাজের তুলনা করা। অসৎ কাজের চেয়ে সৎ কাজের পাল্লা ভারী হলে শাস্তি লঘু হত, আবার উল্টোটাও ছিল সত্যি। এই হিসাবধর্মী ন্যায়বিচারের সন্ধান বহু প্রাচীন সভ্যতাতেই পাওয়া যায়। ভারতীয় সভ্যতাও এর একটি উদাহরণ— দেশে যমরাজের লিপিকার চিত্রগুপ্ত মানুষের পাপ (যে-কর্মে দেনা বাড়ে) এবং পুণ্যের (যে-কর্মে পাওনা বাড়ে) হিসেব রাখেন। ভারতবর্ষে মামলার শুনানির ঠিক আগে-আগেই অভিযুক্তদের মধ্যে মন্দিরে পুজো দেওয়া এবং দান-ধ্যানের যে হিড়িক পড়ে যায়, এর জন্যে হয়তো এহেন ধর্মীয় বিশ্বাসই দায়ী। এদেশে বিচারকেরা ক্রমেই সত্যনিষ্ঠ দেবদূত থেকে প্রেমের ঠাকুরে পরিণত হচ্ছেন, এবং এই বিচারব্যবস্থায় আস্থা রাখার জন্যে অভিযোগকারী এবং পুলিশকর্মীদের নিজেদের নির্বোধ মনে হওয়াই স্বাভাবিক।