ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • নীল কেটলি: পর্ব ৩


    শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (April 10, 2021)
     

    পর্ব ২

    জাদুনগরী ময়মনসিংহ

    আমার বাবার এক বন্ধু ছিলেন শীর্ষেন্দু। তিনি ছিলেন বিদ্যাসাগরের পরিবারের এক অধস্তন পুরুষ। তাঁকে আমি কখনও দেখিনি, তবে আমার মায়ের একটা রূপোর সিঁদুরের কৌটো ছিল ডাবের আকৃতির। একটা ডিম্বাকৃতি ছোট্ট প্লেটের ওপর বসানো। সেই প্লেটের ওপর খোদাই করা ছিল ‘গায়ত্রীকে শীর্ষেন্দু’। মায়ের বিয়ের সময়ে আমন্ত্রিত হয়ে এসে দিয়ে গেছেন উপহার। ওইটুকুই জানি। মা-ও তাঁকে মনে করতে পারেনি কখনও। কিন্তু তাঁর নামটা আমার সঙ্গে আজও সেঁটে আছে। প্রথা অনুযায়ী আমার নামকরণের সময় দুটো নাম নির্বাচিত হয়। আর একটা ছিল রণজিৎ। অন্নপ্রাশনের সময় প্রদীপ জ্বালিয়ে যে-লটারিটি করা হয় তাতে রণজিৎ কল্কে পায়নি। তবে রণজিতের রেশ কিন্তু আমার ডাকনাম বহন করছে আজও, রুনু। আমার দিদির নাম ঝর্ণা, তাই থেকে ঝুনু। তখন আমরা দুই ভাইবোন ছিলাম রুনু-ঝুনু। আট বছর পর আমার ছোট বোনের জন্ম হয় কাটিহারে, তার নাম বাবা রাখেন পাঞ্চালী। তারও দু’বছর বাদে দোমোহানিতে জন্মায় আমার ছোট ভাই দিব্যেন্দু। 

    এত সব হাপরহাটি বকার মানেটা কী তাই বুঝতে পারছি না। একটা লোকের বা তার পরিবারের এত কথা শুনে লাভ কী? শুনতে যাবই বা কেন আমরা! কেউ শুনুক বা না শুনুক, মানুষ তবু কিন্তু নিজের কথা শোনাতেই চায়। কেন চায় কে জানে। হয়তো ভাবে আমার মতো তো আর কেউ নয়! কথাটা ঠিক। কেউ কারও মতো নয়। আবার তফাতও খুব বেশি কিছু নেই। 

    ময়মনসিংহ হয়তো খুব সু্ন্দর কোনও জায়গা নয়। অনেক গাছপালা ছিল, নদী ছিল, সুড়কির রাস্তা ছিল, ধুলো ছিল, রেলব্রিজ ছিল, দিগন্ত ছিল। কিন্তু সুইৎজারল্যান্ড তো আর নয়। তবু আমার কাছে কেন যে আজও সেই ময়মনসিংহের অফুরান রূপ মায়াঞ্জনের মতো লেগে আছে! এখনও মনে হয়, ইচ্ছেও হয়, সেই গান্ধা শহরটিতে ফিরে যাই। সেই উঠোনঘেরা টিনের ঘর, মাটির ভিত, খাটা পায়খানা, পচা পাটের গন্ধ। আর জগদ্ধাত্রী ভাণ্ডারের কথা তো বলাই হয়নি। মেছোবাজার অঞ্চলে আমাদের একটা পেল্লায় কাপড়চোপড়ের দোকান ছিল। আমাদের গৃহদেবতা জগদ্ধাত্রীর নামে তার নাম রাখা হয়েছিল। সেই দোকানে বসতেন আমার জ্যাঠামশাই। নিরীহ, নির্বিরোধী মানুষ। মোটা গোঁফ ছিল তাঁর, শুনেছিলাম বাবার চেয়ে তিনি কুড়ি বছরের বড়। বরাবর বাবা তাঁকে আপনি করে বলে এসেছেন। খুব বিক্রিবাটা ছিল না। শুনতাম লংক্লথ আর মার্কিন কাপড়ের বিক্রি বেশি। দোকানের সামনে চওড়া বারান্দা, সেখানে সেলাইমেশিন নিয়ে বসত দুজন দর্জি। তাদের একজনের নাম আমার এখনও মনে আছে, সুরেশ। আর একজন বোধহয় গফুর। এই দুজনের সঙ্গেই আমার খুব খাতির ছিল। মাঝেমধ্যেই জ্যাঠামশাই আমাকে সাইকেলের রডে বসিয়ে দোকানে নিয়ে যেতেন। কিনে দিতেন বালুসাই বা রসগোল্লা। পাশেই, মাঝখানে একটা দোকানের পর একটা স্পোর্টসের দোকান ছিল। সেটা ছিল বাণীকন্ঠকাকুর দোকান। বাণীকন্ঠকাকু ছিলেন খুব ফর্সা আর সুন্দর চেহারার মানুষ। থাকতেনও আমাদের পাশের বাড়িতেই। গিয়ে হাঁ করে খেলাধুলোর সব সরঞ্জাম দেখতাম। ফুটবল, ক্রিকেটের ব্যাট, হকিস্টিক, ব্যাডমিন্টনের রাকেট, ব্যাগাটেলি, লুডো, ক্যারম, আরও কত কী! বলতে বাধা নেই তখন হকিস্টিকের কদর কিন্তু খুব বেশি ছিল। খেলার জন্য নয়, মারপিট করার জন্য। আমার চার জেঠতুতো দাদার মধ্যে অন্তত দুজন মারকুট্টা স্বভাবের ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বদরাগী, সাহসী আর মারকুট্টা ছিলেন আমার বাবা। একাধারে ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেনিস ব্লু, তা ছাড়া ফুটবল, ক্রিকেট এবং হকিতেও ছিলেন পাকা খেলোয়াড়। আর তেমনি ছিলেন বেজায় মারপিট করা লোক। ঢাকাই রক্ত তাঁর শরীরে চনমন করত। সত্যিকারের ডাকাবুকো লোক আমি ওই একটিই দেখেছি। ভয়ডরের লেশমাত্র ছিল না। কথায়-কথায় হকিস্টিক নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে কাউকে সবক শিখিয়ে আসাটা ছিল তাঁর রুটিনের মতো। সারা জীবন বাবার হাতে আমি কত লোককে যে মার খেতে দেখেছি তার হিসেব নেই। যখন রেলের পদস্থ অফিসার, তখনও। বাবাকে ভয় পেত না এমন লোক খুব কমই ছিল। ভয় পাওয়ার আরও একটা কারণ ছিল, মানুষটার আপসহীন সততা। যে-লোকটা সারাজীবন এক পয়সাও ঘুষ খায়নি, তাকে সমঝে না চলে লোকের উপায় কী? এমনি সৎ মানুষকে লোকে ভয় খায় না, কিন্তু অ্যাগ্রেসিভ সৎকে পায়। আলিপুরদুয়ারে রেলের ডিস্ট্রিক্ট অফিসার থাকাকালীন একজন বেয়াদব ওপরওয়ালাকে মারধর করায় তাঁর এক বছরের জন্য পদাবনতিও হয়েছিল।

    ময়মনসিংহের অফুরান রূপ

    মা অন্য রকম। নিরীহ, ভীতু, চুপচাপ, ধার্মিক প্রকৃতির। ময়মনসিংহে থাকাকালীন মায়ের সান্নিধ্য পেতাম রাতে, ঘুমের সময়ে। সারা দিন বাড়ির অন্যদের সঙ্গে। দাদু, ঠাকুমা, জেঠিমা, জ্যাঠামশাই, দাদারা বা পাড়ার বন্ধুদের সাহচর্যে। সারা বাড়িতে সবাই ঢাকাই বাঙাল ভাষায় কথা বলত, শুধু মা বলত কলকাতার ভাষা। আজীবন মা বাঙাল কথা বলেনি। এতে একটা সুবিধে হয়েছিল, আমরা ভাইবোনেরা দুটো ভাষাই অনর্গল বলতে পারতাম। এটা আমাদের পরিবারের আর কেউই পারত না। কিন্তু মামাবাড়ি গেলে দিদিমা বা মামারা মাকে বলত, ইস, তোর কথায় তো বাঙাল টান এসে গেছে রে! এই সূক্ষ্ম তফাতটা আমি কিন্তু বুঝতে পারতাম না। 

    একটা নীল কেটলির কথা বলেছিলাম। জন্মের পর সেটাই ছিল আমার চেতনার প্রথম কোনও আইডেন্টিফিকেশন। কেটলিকে কেটলি বলে চিনতে পারা। একটা বস্তুকে তার নামে চিহ্নিত করা কিন্তু সোজা ব্যাপার নয়। অন্তত কোনও শিশুর পক্ষে। কিন্তু ঘটনাটা কোথায় ঘটেছিল সেটা এত দিন বারবার চেষ্টা করেও মনে পড়েনি। আজও চেষ্টা অব্যাহত আছে। 

    আজও কেন যে আমার ময়মনসিংহকে এক জাদুনগরী বলে মনে হয় তা বুঝতে পারি না। আজও সেই তখনকার ময়মনসিংহে আমার বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। এই শহরেই বসবাস করবেন বলে দুর্গাবাড়িতে দাদু একটা পেল্লায় দু’মহলা পাকা বাড়ি বানিয়েছিলেন। তার সামনেই এক মস্ত পুকুর। আমি জানতাম আমরা এক দিন সেই পাকা বাড়িটায় থাকব। থাকা আর হয়নি অবশ্য। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের ধারে বড় কালীবাড়ি রোডের বাড়িটাই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা, আজও প্রিয়ই আছে। প্রায় সত্তর বছর পর সেই বাড়ি খুঁজতে গিয়ে দেখি, শুধু বাড়িটাই নয়, পুরনো আবহই লুপ্ত হয়ে গেছে। কিছুই আর তেমন চেনা লাগল না। 

    আমাদের বাড়ির মধ্যেই, দক্ষিণের ঘরের পিছন দিকে একটা কোণ ঘেঁষে এক দূরের জ্ঞাতি থাকতেন। বড্ড গরিব বলেই তাঁদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল। সেই জ্যাঠামশাই ছিলেন পেশায় পুরোহিত। পূজারি ব্রাহ্মণদের চিরকালই দারিদ্র। তাঁদের ঘরে গেলেই ওই বয়সেও দারিদ্র কাকে বলে তা খানিকটা যেন বুঝতে পারতাম। তাঁর নাম ধরা যাক নিষ্কণ্টক বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ফর্সা। তাঁদের দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে। বেশ ভাব ছিল তাঁদের সঙ্গে আমাদের, যেন একই পরিবারের লোক। শুধু হাঁড়িটাই যা আলাদা। 

    ওই নি জ্যাঠার ছোট ছেলে এক দুর্গাপুজোয়, বোধহয় পঞ্চমীর দিন কোথা থেকে একটা হাত দুয়েক লম্বা দুর্গামূর্তি ঘাড়ে করে নিয়ে এল। তাতে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী সবই আছে। দেখতেও ভারি ভাল। মুহূর্তে বাড়িতে শোরগোল পড়ে গেল। নি জ্যাঠামশাই রাগে টং হয়ে বললেন, হারামজাদা, পূজা কাটাইল্যা দিনে যে-মূর্তি আইন্যা খাড়া করলি, অহন পূজা না করলে তো পাপ হইব। আমি তো নির্বংশ হইয়া যামু। এইটা কী সর্বনাশ করলি রে নির্বইংশার পো! অহন আমি কই যাই, কী করি! সে কী কান্না জ্যাঠার!

    হাত দুয়েক লম্বা দুর্গামূর্তি

    অগতির গতি হয়ে এগিয়ে এলেন আমার ঠাকুমা। বললেন, কাইন্দোনা হে নিষ্কন্টক, পূজা কাটাইল্যা দিনে যখন আইন্যাই ফালাইছে মূর্তিখান তখন পূজাও কইরতেই হইব। তুমি জোগাড়যন্ত্র কর, টাকা আমি দিমু। 

    আমাদের বাইরের দিকের মাঠটাকে বলা হত বাইরবাড়ি। সেখানেই পুজো হবে। বেশ অনেকটা জায়গা, তার ডান দিকটায় দাদুর পেল্লায় কাছারিঘর। পুজো হবে শুনে বাড়িতে পাড়ার লোক ভেঙে পড়ল। ঠাকুমা তাঁর লোহার সিন্দুক খুলে টাকা বের করে দিলেন, সারা বাড়ি, সার পাড়া জুড়ে হইহই শুরু হয়ে গেল। কাছারি থেকে ফিরে দাদু ব্যাপার শুনে খুব একটা খুশি হলেন না, তবে আপত্তিও করলেন না। একটু গম্ভীর হয়ে রইলেন, এইমাত্র। বাইরবাড়িতে তখন গরুর গাড়িতে বাঁশ আর ত্রিপল এসে পড়েছে। কামলারা মণ্ডপ খাড়া করার তোড়জোড় করতে লেগেছে। শুধু দাদুরই তেমন উৎসাহ নেই। দাদু হইচই বিশেষ পছন্দ করতেন না। বেজায় রাশভারী মানুষ। একমাত্র আমার কাছেই তিনি ছিলেন গলে জল। আর সবাই তাঁকে যমের মতো ভয় পেত। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

    পর্ব ৪

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook