জন্ম চট্টগ্রামে। মৃত্যু শান্তিনিকেতনে। কলকাতার গভঃ আর্ট কলেজে পড়েছেন। প্রথমদিকে কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে শিক্ষকতা করলেও উল্লেখযোগ্য শিল্পশিক্ষক-জীবন কাটিয়েছেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনে। ইত্যাদি ইত্যাদি জড়ো করে এক রোগাভোগা বা আপাতদৃষ্টিতে হীনস্বাস্থ্য মনে হওয়া সোমনাথ হোরের জীবনপঞ্জি পেশ করার কোনও অভিপ্রায় আমার নেই। আমি তাঁর জন্মের একশো বছর পরে এসে তাঁরই বিবিধ কর্মকাণ্ডের পিছনে ঘুরঘুর করতে চাই।
যতবারই দেখেছি তাঁকে, মনে হয়েছে লোকটার বুকের ছাতির মাপ কী ছিল। বুক ঠুকে চন্দনাদিকেও (চন্দনা হোর) জিজ্ঞাসা করতে পারিনি। হয় হেসে উড়িয়ে দিত, নয়তো রেগে যেত। আমি নিশ্চিত যে, শান্তিনিকেতন বা কলকাতার কোনও দর্জিও জানেন না সে মাপ। ফতুয়া, পাঞ্জাবি, কখনও কখনও শার্ট, পাজামা বা হলুদ লুঙ্গি আর মাথায় তালপাতার টোকা চাপিয়ে কাটিয়ে দিল জীবন। বাহন সাইকেলটাকে দেখেছি মনে আছে।
তা এমন একটা মানুষ, জ্ঞানকাণ্ড হওয়া থেকেই মনে হয় মানবতার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে আছেন। যাযাবরের মতো জীবন। ফলে আর্ট কলেজে ঢোকা-বেরোনোর বয়স, নির্ধারিত মাপ মেনে হয় না। তাই যখন তিনি কলকাতার গভঃ আর্ট কলেজের ছাত্র, সমবয়সি হলেও প্রাতঃস্মরণীয় ছাপচিত্রী হরেন দাস (জ. ১৯২১) তখন গ্রাফিক্স বিভাগের প্রধান। যদিও সঙ্গলাভ, কৃৎকৌশলচর্চা— এসবে কোনও বয়স কোনও বাধাই ছিল না।
‘অরুণ বসু, সুকান্ত বসু, সনৎ কর, অজিত চক্রবর্তী এদের সঙ্গে এবং কর্মোদ্যমে আমরা দুজনে (রেবা এবং আমি) ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাম। সকলেরই এক ভাবনা— ছবি আঁকতে হবে; তার জন্য কোথায় ঘর পাওয়া যায়— যেখানে ছবি আঁকা হবে এবং প্রয়োজনবোধে প্রদর্শনী করা হবে কিংবা গ্যালারী হিসাবেও কাজে লাগানো যাবে। আন্দোলনমুখী কিংবা আদর্শমুখী কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা এখানে জড়ো হইনি। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল ছবি আঁকা এবং দল বেঁধে সেই ছবি সাধারণের সামনে হাজির করা।— এছাড়া আর কিই বা আদর্শ থাকতে পারে। শিল্প বহির্ভূত আদর্শ নিয়ে পথচলা শিল্পী সংগঠনের পক্ষে খুবই দুষ্কর’ (বানান অপরিবর্তিত)। ১০/১১/১৯৭৫-এ সোমনাথ হোরের লেখা চিঠির এই অংশ বিশেষ স্মরণযোগ্য। চিঠিটা লেখা হয়েছিল ‘সোসাইটি অফ্ কন্টেম্পোরারি আর্টিস্টস্’-এর পনেরোতম বর্ষপূর্তিতে। সোমনাথ হোর ছিলেন এই শিল্পীদলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। অবশ্য পরবর্তীতে এই দলে তার যুক্ত হয়ে থাকাটা অতি ক্ষীণ হয়ে আসে। কিন্তু মূল বিষয়টা হচ্ছে ‘আন্দোলন’, ‘আদর্শ’ এবং জনসাধারণের সামনে শিল্পকে নিয়ে আসা। ‘আন্দোলনমুখী’ বা ‘আদর্শমুখী’ উদ্দেশ্য ছাড়া শিল্পীদল প্রতিষ্ঠার কথা ভাবলেও কিন্তু ওই ষাটের দশকে বাংলায় শিল্পীদের একত্রিত করা এবং শুধুমাত্র কাজের এবং প্রদর্শনীর নিরিখে এক ছাদের তলায় থাকার কথা ভাবাটা প্রকারান্তরে আন্দোলনই ছিল। এই আন্দোলন ছিল সমাজের আরও একটা সমান্তরাল আন্দোলন, যার বীজ রোপিত হয়েছিল আই.পি.টি.এ-র সময় থেকেই মনে হয়। এক্ষেত্রে ছবি আঁকিয়ে, ছাপচিত্রী বা মূর্তিকাররা প্রত্যেকেই যদিও আলাদা আলাদা প্রকাশভঙ্গিতে বিশ্বাসী ছিল। মনে রাখতে হবে, ১৯৪৩-এ তিনি যখন মন্বন্তরের ছবি আঁকতে ব্যস্ত সে-সময়ে কলকাতায় সুভো ঠাকুরের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’। শিল্পী-সদস্যরা একত্রিত ভাবে এক ছাদের তলায় আসার কথা ভেবেছিলেন এমন একটা সময়ে, যখন বাংলা অন্নাভাবে কাতর। ওদিকে সোমনাথ হোর, জয়নুল আবেদিনরা রাস্তায় রাস্তায় বাংলার হাহাকারের ভীষণ-দৃশ্যের স্মৃতিরক্ষকের কাজ করে চলেছেন। এখানেই তিনি অনন্য। আদর্শ, আন্দোলন, সংগঠন— সর্বক্ষেত্রেই নিজের স্বাভাবিক প্রকাশভঙ্গিকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। স্বাভাবিক ভাবে যেটা পারতেন সেটাই হাতিয়ার করেছিলেন। তাই ছবিতে, মূর্তিতে, ছাপচিত্রে সর্বত্রই শিল্পসুষমা বর্তমান থেকেছে আগাগোড়া।
অতি সাধারণ মাধ্যমে ছবি আঁকা। তীক্ষ্ণরেখায় ক্ষতবিক্ষত করার নিদারুণ প্রয়াস। নিজে আহত হচ্ছেন মর্মে মর্মে আর দর্শকরাও রক্তাক্ত হচ্ছেন প্রতি মুহূর্তে। অ্যাসিড ঢেলে ধাতু তক্ষণ। আর সেই ক্ষতবিক্ষত পাতের থেকেই ভূমিষ্ঠ হচ্ছে ছাপচিত্র। সপাট, স্পর্ধিত, উচ্চকিত বর্মের নয় কিন্তু গভীরতায় তীব্র। একটা মানুষ কী পরিমাণ মর্মপীড়া অনুভব করলে এত নিঃশব্দে ঘাতকের মতো এমন কাজ করতে পারেন আশ্চর্য হওয়ার মতো। ছবি, মূর্তি ছাড়া শুধু ছাপচিত্রের ইতিহাসে সোমনাথ হোর ভারতবর্ষকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন তা বহু শতবর্ষ মনে থাকবে। ধন্য দিনকর কৌশিক। এ হেন মানুষটিকে কলাভবনের ছাপচিত্র বিভাগে সংযুক্ত করার জন্য। সালটা ছিল ১৯৬৯। ততদিনে মন্বন্তরের কাজ, তেভাগার কাজ শিল্প-ইতিহাসেও যেমন যুক্ত হয়েছে, সাধারণের দোরেও পৌঁছে গেছে। ধন্য এই বঙ্গভূমি। ওই সময়টা ছবিতে, গানে, সাহিত্যে, সিনেমায় শুধুই সোনার ফসল। যখন ‘আধি নয় তেভাগা’ ধ্বনি উঠছে, যখন সোমনাথ হোরের ছবিতে, কাঠখোদাইয়ে তার প্রতিধ্বনি উঠছে, তখনই রচিত হচ্ছে সলিল চৌধুরীর কলমে ‘হেই সামালো ধান…’।
এরপর সেই বিখ্যাত ‘ক্ষত’ সিরিজ। মূর্তি নির্মাণের জন্য তিনি ছাঁচ গড়তেন না, ছাঁচ গড়তেন ছাপছবির জন্য। তাই ক্ষতই ক্ষতের সৃষ্টি করত। যন্ত্রণার পুনরাবৃত্তি ঘটত। তাড়িয়ে বেড়াত। লোকটা ছিল ‘ক্ষতের স্মৃতিরক্ষক’।
এমন ক্ষতচিহ্নই তো আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি। সময়ের ক্ষত, আশ্চর্যচ্যুতির ক্ষত, ভিয়েতনাম যুদ্ধের স্মরণে করা ভাস্কর্যের উধাও হয়ে যাওয়ার ক্ষত , নোবেল উধাও-এর ক্ষত। আমাদের স্মৃতিতে গ্রথিত হয়ে আছে তারা। আমৃত্যু রক্তক্ষরণ ঘটাবে এগুলো।
বয়সের পুনরাবৃত্তি হয় না। কিন্তু ক্ষতেরা থেকেই যায়। সোমনাথ হোর-ও থাকবেন তার নীরবতার স্পর্ধায়।