রামায়ণের রাম কেন তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীকে অরণ্যে পরিত্যাগ করেছিলেন, সে বিষয়ে ভারতের বিচারব্যবস্থা কোনও মামলা চলার অনুমতি দেবে কেন? চিন্তা হয়, আমাদের বিচারকদের কে জানে আর কী কী মামলার শুনানি শুনতে হতে পারে! হিন্দু পুরাণ থেকে কিছু সম্ভাব্য সাজেশন রইল:
১। কৃষ্ণ কেন রাধাকে বিবাহ করেননি?
২। পরশুরাম তাঁর মা রেণুকার মুণ্ডচ্ছেদ করেছিলেন কেন?
৩। শিব কেন নিজের ছেলের মাথা কেটে ফেলে, পরে সেই জায়গায় একটি হাতির মাথা বসিয়ে দিলেন?
৪। দুর্গা এক মহিষকে হত্যা করেন কেন?
৫। কেন কালী নগ্ন হয়ে নৃত্য করেন?
স্বাভাবিক ভাবে, এবং ন্যায্য কারণেই, কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন শুধু হিন্দু লোককথা নিয়ে কেন এসব আপত্তি উঠবে? বৌদ্ধ, জৈন, বা শিখ লোককথাই বা বাদ যায় কী কারণে?
১। ‘বোধিলাভ’ হবার পরে বুদ্ধ কেন স্বামী এবং পিতা হিসেবে আবার তাঁর কর্তব্য পালন করতে ঘরে ফিরলেন না?
২। জৈনরা তাঁদের ৬৪ মহাত্মার তালিকায় কোনও নারীকে জায়গা দেননি কেন?
৩। শিখদের সব গুরুই কেন পুরুষ হন?
অতঃপর আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ দেশে আমরা মুসলমান, খ্রিস্টান আর ইহুদিদেরও ছেড়ে দেব নাকি?
১। ঈশ্বরের পয়গম্বরদের সবাইকে পুরুষ হতেই হবে কেন?
২। সর্পজাতির বিরুদ্ধে এত বিদ্বেষ কেন?
৩। মানুষকে নরকে পাঠানোর অধিকার ঈশ্বরকে কোন সংবিধান দিয়েছে?
৪। মাতা মেরির গর্ভে সন্তান দেবার আগে ঈশ্বর কি তাঁর সম্মতি চেয়েছিলেন?
প্রাচীন গ্রিক ও রোমানরা যদি আজ আমাদের সমাজে বাস করতেন, আমরা একাধিক মানবী ও অপ্সরার ধর্ষণের অপরাধে দেবরাজ জিউসকে বন্দি করার দাবিও তুলতে পারতাম।
পৌরাণিক চরিত্রদের নানা কীর্তিকলাপের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করতে যাঁরা চান, তাঁরা বেশির ভাগ সময়েই গোড়ায় গলদ করে ফেলছেন। এক-একটি সমাজের কাছে পবিত্র পৌরাণিক গল্প প্রজন্মের পর প্রজন্ম হাত থেকে হাতে ঘুরতে থাকে, কারণ তাতে অন্তর্নিহিত আছে সেই সমাজের আপেক্ষিক সত্যগুলো। এক ধরনের বিশ্বদর্শন, এক ধরনের অর্থ তারা মানুষকে দেয়। কখনওই এ সব গল্প আক্ষরিক অর্থে নিতে নেই। এ গল্পগুলোয় পুরুষও আসল পুরুষ নয়, নারীও নারী নয়, পশুরাও পশু নয়। রামায়ণের রাম এক্ষেত্রে হয়ে ওঠেন একটি ভাবের রূপক; আমাদের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত বিকল্পগুলোর মধ্যে যে টানাপড়েন— সেই ভাব। তেমনই বাইবেলের যিশু হয়ে ওঠেন দৈবী প্রেম, দয়া ও ক্ষমার রূপক।
অবশ্য এমন মানুষও আছেন, ঈশ্বরদের বা মসিহাদের ‘কেবলই রূপক’-এ পর্যবসিত করলে যাঁরা রেগে ওঠেন। মানুষের ভাবনাকে নির্দিষ্ট আকৃতি দেবার, সবকিছুকেই বাস্তবিক ও পরিমেয় করে দেখার যে শক্তি ধারণ করে ভাষা (বেদের বাক্দেবী), এই ধরনের মানুষ তা বুঝতে পারেন না। অর্থ, স্মৃতি, অধ্যাত্মতত্ত্ব ও রূপক বোঝার ক্ষমতা এঁদের নেই, এঁরা সবকিছুকেই বস্তু হিসেবে দেখেন, ভাব হিসেবে নয়। ভাবনা জিনিসটাকে এঁরা বিদ্রুপের চোখে দেখেন। রাম বা যিশুকে এঁরা রক্তমাংসের মানুষ হিসেবেই দেখতে চান, যে-মানুষকে আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়। রাম বা যিশু যে ভাবনার ধারক, যা মনুষ্যত্বে অন্তর্নিহিত হয়ে অপূর্ব সব কাহিনির মাধ্যমে বিরাজমান হয়ে রয়েছে, তাকে এঁরা বর্জন করেন। যা অবাস্তব, যা মনস্তাত্ত্বিক, তাকে এঁরা নিছক অসত্য বলে উড়িয়ে দেন। এঁদের কাছে শরীর ও টাকা-পয়সাটাই বাস্তব, প্রেম-ভালবাসা নয়। দেমাক করে এঁরা নিজেদের বিজ্ঞানমনস্ক বা যুক্তিবাদী আখ্যা দিয়ে থাকেন। আদতে তা নয়, কারণ সেটা হতে গেলে যে বিনয় ও কৌতূহল প্রয়োজন, তা এঁদের নেই। এঁরা বুঝতে চান না, আধিপত্য চান। এ বড় বিপজ্জনক গোত্রের চিন্তা। শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা পৃথিবীতে ধর্মের যে সবচেয়ে উগ্র, অযৌক্তিক, জঘন্য রূপগুলোর দাপট দেখি, তার পিছনে কাজ করে এই ধরনের ভাবনাই।