হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে নানা পরিবর্তন সবসময়েই ঘটে চলেছে। আমার মতে এগুলোর মধ্যে যেটা নিয়ে আলোচনা করা দরকার, সেটা হচ্ছে রেওয়াজ বিষয়ে ধারণার দ্রুত পরিবর্তন। প্রথাগত ভাবে রেওয়াজে, কেউ কেউ যাকে ‘সাধনা’ বলতে বেশি পছন্দ করেন, এক ধরনের সুবিন্যস্ত, সুশৃঙ্খল অনুশীলনে নিজেকে একান্তভাবে ডুবিয়ে দেন গায়ক। এর লক্ষ্য হল, দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে শিল্পীর নিজের দক্ষতার জায়গাগুলোকে আরও পাকা করা। কোনও কোনও সময়ে এই অনুশীলন চলে গুরু বা প্রশিক্ষকের নজরদারিতে। মাঝেমধ্যে সঙ্গত করার জন্য একজন তবলচি উপস্থিত থাকেন, তবে তাঁর দায়িত্ব অনুশীলনে সাহায্য করা, পারফর্ম করা নয়।
অতএব রেওয়াজকে সফল করার জন্য, এতদিন তাকে ইচ্ছে করেই রাখা হত লোকচক্ষুর আড়ালে একটি একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে। এ পরিসরে কোনও রকম লজ্জা বা সংকোচ ছাড়াই শিল্পী পাল্টা (কণ্ঠের একটি ব্যায়াম) অভ্যেস করতে গিয়ে স্বচ্ছন্দে হোঁচট খেতে পারতেন, এবং যতক্ষণ না সেই কৌশল নিজের আয়ত্তে আসছে, ততক্ষণ বার বার নিষ্ঠার সঙ্গে অভ্যেস চালিয়ে যেতে পারতেন। তাতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, অথবা আরও বেশি সময় নিয়ে অক্লান্ত ভাবে রেওয়াজ করে যেতেও কোনও বাধা ছিল না। এমন পরিশ্রমের ফল গায়ক পেতেন সেই মুহূর্তটিতে, যখন রেওয়াজ করে করে নিখুঁত করে তোলা একটি মনমাতানো তান জনসমক্ষে গাইতেন এবং শ্রোতারা হাততালিতে ফেটে পড়তেন। কিন্তু এই পারফর্ম্যান্সের সঙ্গে রেওয়াজের মূল পার্থক্যটিই এই, রেওয়াজ সব সময়েই চলার কথা ব্যক্তিগত, নিভৃত এবং বন্ধ পরিসরে। সেখানে বহিরাগতদের বা শ্রোতাদের প্রবেশ একেবারেই নিষেধ। অন্যদিকে, পারফর্ম্যান্সের অনুষ্ঠিত হবার কথা অবাধে এবং প্রকাশ্যে, যেখানে টিকিট কেটে অথবা কোনও সঙ্গীতগোষ্ঠীর সদস্য হয়ে সবারই আসার অধিকার রয়েছে।
আগেকার দিনে গল্প শোনা যেত, কেমন করে শিল্পীরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, রীতিমতো পরিকল্পনা করে, এমনকী লুকিয়ে-চুরিয়ে তবে বড় বড় ওস্তাদদের রেওয়াজ শোনার সুযোগ পেতেন! কারও রেওয়াজ অন্যদের অবাধে শুনতে পাওয়ার কোনও প্রশ্নই তখন ছিল না। আজকাল ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে ‘সবার অনুরোধে অমুক/তমুক রাগে জাস্ট একটুখানি রেওয়াজ আর কী’ শিরোনামে ছোট ছোট ভিডিও হামেশাই দেখতে পাওয়া যায়।
দুই পরিসরের এই মূল তফাতটা ইদানীং আস্তে আস্তে কমতে শুরু করছে বলেই মনে হয়, বিশেষ করে যে মাধ্যমটি ক্রমেই সঙ্গীতশিল্পীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে— সেই সোশ্যাল মিডিয়াতে। আগেকার দিনে গল্প শোনা যেত, কেমন করে শিল্পীরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, রীতিমতো পরিকল্পনা করে, এমনকী লুকিয়ে-চুরিয়ে তবে বড় বড় ওস্তাদদের রেওয়াজ শোনার সুযোগ পেতেন! কারও রেওয়াজ অন্যদের অবাধে শুনতে পাওয়ার কোনও প্রশ্নই তখন ছিল না। আজকাল ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে ‘সবার অনুরোধে অমুক/তমুক রাগে জাস্ট একটুখানি রেওয়াজ আর কী’ শিরোনামে ছোট ছোট ভিডিও হামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। এ কথা অবশ্য ঠিক, নিজের রেওয়াজ অন্যদের দেখতে-শুনতে দেওয়া বা না দেওয়ার অধিকার সম্পূর্ণ ভাবেই শিল্পীর একার সিদ্ধান্ত। তবে শ্রোতা যতই শ্রদ্ধাশীল হোন, বা চুপচাপ বসে যতই বিরক্ত না করুন, তাঁর উপস্থিতি রেওয়াজকে আসলে করে তোলে পারফর্ম্যান্স। এ পারফর্ম্যান্স অবশ্য ঘটে শিল্পীর নিজের বাড়ির পরিসরেই, প্রেক্ষাগৃহের কোনও আনুষ্ঠানিক ফর্ম্যালিটি ছাড়াই।
একই ভাবে, তালিম বা সঙ্গীতের প্রশিক্ষণও প্রথাগতভাবে নিভৃতেই হয়, সেখানে শ্রোতার আসার অনুমতি নেই। এই সময়টুকু গুরু বা ওস্তাদের নিজের শিষ্যকে ঘষামাজার সময়, শিষ্যের দুর্বলতাগুলো নির্মম সততার সঙ্গে চিহ্নিত করে, তার অন্তরের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেন তিনি। তালিমের সময়ে ভুলকে ভুল বলেই ভর্ৎসনা করাই রীতিগত, সাধারণত কোনও ন্যাকামি বা অহেতুক সহবত ছাড়াই। যেই মুহূর্তে এই পরিসরে ঘটে শ্রোতার প্রবেশ, দু’রকম পারফর্ম্যান্স একসঙ্গে উড়ে এসে জুড়ে বসতে পারে তালিমে। গুরু করতে পারেন গুরুর ভূমিকায় অভিনয়, একা থাকলে আসলে যেভাবে শেখাতেন তার চেয়ে নিজেকে অনেক বেশী স্নেহশীল বা মহানুভব জাহির করতে চেয়ে। কোন গুরু আর চাইবেন, বাইরের লোক দেখে ফেলুক তাঁর নির্মম বকাঝকার চোটে শিষ্য কেঁদে ফেলেছে? আবার ক্যামেরার সামনে শিষ্যও আদর্শ বাধ্য ছাত্রের মতো অভিনয় শুরু করতে পারে, তাতে অতি সন্তর্পণে পালটে যায় গুরুর সঙ্গে তার সম্পর্কের রীতিনীতি। সে-অভিনয়ের অংশ হয়ে উঠতে পারে অতিরিক্ত বশ্যতা, বিনয়, বা কাঙালপনা।
রেওয়াজ বা তালিমের পরিসরে শ্রোতার প্রবেশ নিষিদ্ধ রাখার যুক্তিটি খুব সহজ। একভাবে দেখতে গেলে, এই পরিসরগুলো অধ্যয়নের, বা নিজেকে তৈরি করার জায়গা। এ পরিসরে শিল্পীর নিজেকে নিয়ে গভীর ভাবে অনুসন্ধান করে সব সঁপে দেবার কথা। রেওয়াজ মানে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রম, যার জন্যে সবরকমের বিভ্রান্তি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে অটুট মনোযোগের প্রয়োজন, যা ঠিক সর্বসমক্ষে দেখানোর জিনিস নয়। সর্বসমক্ষে এলেই তা আসলে হয়ে যায় রেওয়াজ বা তালিমের আনুষ্ঠানিক প্রদর্শন মাত্র। সোশ্যাল মিডিয়ার নিজস্ব কিছু দেখনদারির চাহিদাও আছে, যার চাপে গোটা ব্যপারটায় উপস্থাপনার এমন অন্যান্য সব আঙ্গিক ঢুকে পড়ে, যার কোনও প্রয়োজন এমনিতে রেওয়াজের জন্য হত না। রেওয়াজের ক্ষুদ্র পারফর্ম্যান্স যত্ন করে উপস্থাপনা করা হয়, ঘরের এক পরিপাটি কোণ থেকে একগাদা বালিশের সামনে বসে, মাঝেমধ্যে কিছু বাহারি আলোর বালব টাঙিয়ে দিয়ে, বুদ্ধি করে কিছু গাছের টব এদিক ওদিক রেখে, যাতে ঘরটা দেখতে আরও একটু রঙিন লাগে। ব্যাপারটার মধ্যে একটা রেওয়াজ-রেওয়াজ ভাব আনতে শিল্পী কিছু চটকদার কালোয়াতি করে শোনাতেই পারেন বটে, তবে আদতে এসব কালোয়াতি অনেক আগেই তাঁর আয়ত্ত করা হয়ে গেছে। এসব করতে আর তিনি রেওয়াজে হোঁচট খান না।
কোনও কোনও বিরল ক্ষেত্রে অবশ্য শিল্পীরা সত্যিই উদার মনে তাঁদের তালিম শোনার সুযোগ করে দিয়েছেন সাধারণ শ্রোতাদের, যাতে সঙ্গীতের নতুন ছাত্রেরা বা অনুরাগীরা, গুরুস্থানীয়দের জ্ঞানের বা দক্ষতার পরিচয় পেতে সক্ষম হন। প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী উলহাস কাশালকর তাঁর গুরু গজাননবুয়া যোশীর কাছে তালিম নিচ্ছেন— তার যে অডিও রেকর্ডিং রয়েছে, তা এর এক চমৎকার উদাহরণ। এ কথা মনে রাখা দরকার, যে তালিম যখন চলছিল, সে সময়ে কিন্তু সেখানে শ্রোতাদের উপস্থিতি ছিল না। গুরু ও শিষ্য ছাড়া বড়জোর সেখানে উপস্থিত ছিলেন অন্য কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্র বা সঙ্গতকারী বাজনদারেরা। সেই অমূল্য তালিমের অডিও রেকর্ডিং-টুকুই এখন শিক্ষার প্রয়োজনে অন্যরা শুনতে পাচ্ছেন।
সমকালীন পৃথিবীতে আমরা অনলাইন জীবন কাটাচ্ছি, সবরকমের ব্যক্তিগত পরিসরেই সেখানে বারবার অনধিকার প্রবেশ করে ফেলছে বাইরের দুনিয়া। অতএব যে বন্ধ দরজার পিছনে এককালে তালিম বা রেওয়াজ চলত, তা যে এখন হাট করে খুলে দেওয়া হচ্ছে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। এই অতি নিভৃত পরিসরে অন্যদের প্রবেশ করতে দেবেন কি না, এবং অন্যদের সেই উপস্থিতি নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত রেখে রেওয়াজ বা তালিমের বিশুদ্ধতা আদৌ বজায় রাখা সম্ভব কি না, সে বিষয়ে প্রত্যেক শিল্পীকে ব্যক্তিগত ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।