ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামান্য জীবনের গল্প


    জয়া মিত্র (March 5, 2021)
     

    আকাশ পরিষ্কারই ছিল। কখন যে আকাশের কিনার থেকে এতটুকুনি কালো মেঘ উঠেছে, জানে না সামরি। ঝড়ের সময়ও নয় এখন। এই শীতের হাওয়ায় ঝোপঝাড় সকল শুকনা, যে ক’টা গাছ বাকি আছে সারাদিন ঝুরঝুর পাত-পালা ঝরছে সেই গাছ থেকে, সেই কুড়াতে কুড়াতেই না এতদূর আসা হয়ে গেল তার। হাওয়া কখন ঘুরে গেছে, নজর করে নাই। খেয়াল যখন হল, তখন আর সাবধান হওয়ারও সময় ছিল না। জোর হাওয়া দিতে লেগেছে। শীতের বাতাসে ঝরা পাত-পালা এখন যেন তিরের ফলার মতো উড়ে আসছে। কপালে মুখে হাতে লাগলে ব্যথা জানাচ্ছে। ধুলো উড়ছে হু-হু করে। এ কী রকম বাতাস? কেবলই বাতাস, না যেন আরও কী আছে ওই ঝড়বাতাসের মধ্যে! মোটা মোটা ফোঁটায় বৃষ্টি আসে উত্তরের দিক থেকে। বিজলির ঝলকে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। হঠাৎ কী একটা ভয় লাফিয়ে পড়ে সামরির ঘাড়ের ওপর। কিচ্ছু না ভেবে সামনের দিকে দৌড়য় সে, পিঠের ওপর বাতাস নিয়ে। একটা ঘরের মতো কিছু দেখা যাচ্ছিল। টিনের দরজার ওপর যেন তাকে উড়িয়ে এনে ফেলে বাতাসে। দরজাটা খুলে যায়, আর তার সঙ্গেই ধুলা, শুকনা ডালপাতা, জল হাওয়ার ছাঁট, সব ঢুকে যায় ভিতরে। যে দরজা খুলেছিল সে তাড়াতাড়ি ঠেলা দিয়ে দরজা বন্ধ করে, আর তার মুখের দিকে তাকিয়ে সামরি নিজের মুখ-মাথা মুছতেও ভুলে যায়। হায় ভগবান, হায় রে ভগবান!

    শিবানীও সামরির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েই ছিল। না কথা, না কিছু। সামরি নিমেষের মধ্যে ভাবে, ও কি দরজা দিয়ে বার করে দেবে? এত ঝড়তুফানে? শুকনা পাতা ভর্তি জালের থলিটা আগেই কখন তার পায়ের কাছে নেমে পড়েছিল। নিজেকে খানিক সামলে একটু নিচু হয়ে টেনে আনা শুকনা পাতাভরা জালের মস্ত থলিটা তুলে নেবার চেষ্টা করে সে। শিবানী একটু চমকে ওঠে আর বলে,

           — ভিতরি আয়। 

    তার গলা এত প্রাণহীন, যেন মানুষের আওয়াজই নয়। সামরি দাঁড়িয়েই থাকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। শিবানী আবার বলে, 

          — ভিতরি আয়। ই ঝড়তুফানে… ভিজলি? 

    এতক্ষনে সামরি কিছু বলার পায়। বলে, 

          — না না। ঝড়ের ঠেলা খায়ে… 

    সে বলতে চায়, জানত না যে এই ঘরে শিবানী থাকে। কিন্তু কিছুই বলে উঠতে পারে না, চুপ করে থাকে।

          — হঁ, আচাক্কা আইল ঝড়টো। ই ঝড়ে… 

    কোথা থেকে একটা সাদা গামছা সামরির হাতে দেয় সে। 

       —  লে, মাথাটো মুছ। 

    একবার টেনে যেন সামরির মস্ত থলিটা একদিকে করে নিতে চায়। সামরি নিজেই সেটা দেওয়ালের দিকে সরায়। ভারী নয়, লম্বা হলেও, শুকনা পাতাতেই ত’ বোঝাই। 

    ধানমাঠের কাজ শেষ হয়ে গেলে এই শুকনা পাতা কুড়ানোই তাদের ঘরের মেয়ে-বৌদের বড় কাজ ছিল। এখন ধান না থাকুক, জ্বালানি তো লাগেই। জঙ্গলে যত গাছ আছে, সব এই বারো-পনেরো দিনেই নিজেদের সব পাতা ঝরিয়ে দেয়। তখন যা কুড়াতে পারলে, পারলে। বচ্ছরদিন না হোক, অন্তত বর্ষার মাসগুলার জ্বালানিটুকু হবে। এখন ধানমাঠও কমে গেছে, জঙ্গলও আর বেশি নাই। গ্রাম থেকে দূরে দূরেই সরে যাচ্ছে জঙ্গল। তাই জন্যই না পাতা কুড়াতে কুড়াতে এতদূর এসে পড়েছিল সামরি। সঙ্গের বিটিছেলাগুলার থেকে এতদূরে। শিবানী হাতে করে একটা দড়িবোনা মাচুলি এগিয়ে দেয়। সেই রকমই ঘষা গলায় বলে,

       — বস। চা করি। জাড় লাইগে গেছে। 

    চায়ের ছোট কাচের গেলাসটা হাতে নিয়ে তখনই মুখে দেয় না সামরি। হাতে ধরে তাপটা হাতের তালু থেকে শরীরের মধ্যে নিতে থাকে একটুক্ষণ। ভিতরে যেন একটা কাঁপুনি উঠছিল। শিবানীও হাতে ধরেই ছিল নিজের গেলাস। বাইরে হাওয়ার দাপট বাড়ছে। বৃষ্টি বেড়েছে। টিনের দরজা খটখট শব্দ করছিল। ঘরের চালেও শব্দ হচ্ছিল জোর। তার মধ্যে দুইজন মানুষ বসে থাকে আট বছরের দূরত্ব পার করে। 

    চা ফুরিয়ে গেছিল দুই চুমুকে। সামরির কাঁপুনি লাগছিল, গায়ে যে ক’টা জলের ফোঁটা পড়েছে সেগুলো শুকিয়ে যাওয়ার বদলে যেন বরফ হয়ে যাচ্ছিল। চোখে পড়তে শিবানী বলে, 

        — ভিজে গেছিস? কাপড়টো বদলাবি? 

    সামরির দরকার নেই শুনে ঘরের ভিতর থেকে একটা বিছানার চাদর এনে তার হাতে দেয়।

        — ইটো উড়ে বস, ঠিক হয়ে যাবে। 

    বৃষ্টি কমবার কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। বাইরে মনে হয় অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। সামরি মনে মনে চায় কিছু কথা বলতে, নাহলে এরকম করে বসে থাকা কি যায়! কিন্তু কী বলে! শিবানীই শুধায়,

          — পাতা কুড়াতে এতদূর আসিস? 

    সামরি এতক্ষনে কথা বলতে পেরে বাঁচে।

          — রোজ আসি না। জঙ্গল তো আর নাই হামদের উধারে। এই ক’টা না কুড়ায়ে রাখলে বারিসের দিনে কী হবে! তাথেই… আরও সবগুলা আসেছিল, আমি ইধারটায় আসে পড়েছি, উয়াদের আর ফিরে দেখি নাই। এমনি আচাক্কা আইল আঁধি-ট’! 

    জঙ্গল নেই ওধারে, শিবানী জানে। তার এই ঘর থেকে আর তো জঙ্গল দেখাই যায় না। এখন আর এক রকম বদলে যাওয়া চেহারা।

    তার ছোটবেলায় বরং ঝোপঝাড় এদিকেই কম ছিল। ওই সামনে খানিক দূরে ছিল কারখানা। ফায়ার ব্রিক তৈরি হত। সেই কারখানার ক্যান্টিনে ঝাঁটপাট করত শিবানীর মা। চারটা বাংলো বাড়ি ছিল ওইখানে। সাহেবদের বাংলো। ওর বাবা পরমা মাঝি সেইখানে মালি। বেশ সুন্দর ছিল জায়গাটা। ওরা তখন সেই কারখানার সায়েবের বাংলোর বাইরে ছোট কোয়াটারে থাকত। কাছে এইখানে গাঁয়ে দাদা-দাদি থাকত। কাকা-কাকি, ভাইবুন। এক-দুই দিন ছাড়া ছাড়া তারা চলে আসত দাদির বাড়ি। কত বড় মাঠ। তিনটা দীঘি ছিল একের পর এক। দাদি গল্প বলত, ওইগিলা মিহিজামের রাজার দীঘি। সেই সময়েই ক্যান্টিনে কাজ করা একজনার সাথে রঙ হয়ে বাপলা হয়েছিল শিবানীর। কিন্তু টিকে নাই। শহরের বাবুদের মতন জামা-জুতা পরত ভামর। তা পরুক, কিন্তু নিজেদের গাঁ-ঘরের ছেলেদের সঙ্গে মিলমিশ ছিল না। পালা-পরবে যায়, কিন্তু ঠিকমতো চলে না, দিকুদের মতো বাইরে-বাইরে। আর, খুব মারধর করত শিবানীকে। বিনা কারণে মারত। লোকজন মাইনত নাই। শিবানী বাপের একটি বিটি, সে কেন মানবে? নিত্য অশান্তি, শাশুড়ির কাছে রোজই মদ খাওয়ার ‘টাকা দাও, টাকা দাও।’ শিবানীর দলমলা বয়েস। বলে দিল ‘মার খাব নাই।’ নাইকি হাড়াম নিয়ে গেল মাঝি হাড়ামের কাছে। ভামরের বাপ-মা আসে নাই। শিবানীর গাঁয়ের পাঁচজনার সামনে ঘাসের তিনকা ছিঁড়ে কাটান হয়ে গেল। অমনিই ছিল কতদিন। মন-গুমরানো। ওর ছোটবেলার সাথী-সাথিনদের সব কোলে কাঁখে ছেলেপিলে। হাসিখুশি চেহারা। ওর সামনে পড়লে তারা লজ্জা পায়। 

    ধীরে ধীরে কী যে সব হল তারপর, যেমন লোকে কোনওদিন ভাবেও নাই। কারখানা একদিন বন্ধ হয়ে গেল। লোকজন মাইনা পায় নাই কেউ একমাস, কেউ দুই মাস। মালিক-লোকেরা আসে না। সায়েবরা আগেই একে-দুইয়ে সরে গেছিল। এখানকার লোক অত হুজ্জতি জানে না যে ভাঙচুর করবে কি আটকাবে। অত বড় বড় সাজানো বাংলোবাড়ি, কারখানা বাড়ি, সব পড়ে পড়ে নষ্ট হল। গাছপালা গজাল চারিদিকে। কীরকম হয়ে গেল। 

    শিবানীরা আগেই দাদির ঘরের কাছে নিজেদের ঘর তুলে চলে আসেছিল। ওদের ছোট গ্রামটার নাম চাঁদনি। ছোট একটি নদী আছে গাঁয়ের পাশ দিয়ে। ও-পারের ভারী গাঁ গামারসোল। অনেক ঘর, অনেক লোকজন থাকে। বড় চাষ। ওইখানে দাদির বাপের ঘর। সামরি গামারসোলের মেয়ে। দাদির সইয়ের নাতিন। শিবানীর থিকে অনেক ছোট। হাসিখুশি মেয়ে। 

    কতদিন ধরে লোকে বলাবলি করছিল, এইধারে পাথর খাদান হবে। কেউ বলে ভাল হবে, ছেলা-মেয়ারা কাজ পাবে, নগদ হাতে-হাতে পয়সা পাবে। কেউ বলে, ভাল নয়। পাথর ফাটাবে, লোকের ঘরবাড়ি ভাঙবে। তারা দেখেছে পাথরখাদান কেমন হয়। চাঁদনির দুটা ঘর খাদান খুলতে নিজেদের জমি দিয়ে দিল। তাদের অনেক জমি, ঢের দামও পাইল। গাঁ থেকে অল্প দূরে শুরু হল খাদানের কাজ। প্রথমে তো শুধু মাটি কাটা। গাঁয়ের সব ছেলে গেল। মেয়েরাও গেল কেউ কেউ। কাটা মাটি ঝুড়ি করে ফেলানোর কাজ। শিবানীও গেছিল। বাপ-মায়ের কাজ বন্ধ, পয়সা-টাকার দরকারও ছিল। ঘরে মনও লাগত না। বাইরে থিকে অনেক লোকজনা আসা শুরু হল খাদানে। এক বছরের মধ্যে পাকা রাস্তা হল। ভটভটি মটর সাইকেল ঢুকল। মাটিকাটা কাজ কমে গেল। মাটির নিচ থিকে এই বড় বড় পাথরের চাটান বেরায়ে পড়েছিল ততদিনে। গ্রামটা কেমন হয়ে গেল, ছিরিছাঁদ-হীন। বাইরের লোকজন। লোকের ঘরদুয়ার মানামানি নাই। খুব শব্দ করা সব বড় বড় যন্ত্র। দুপুরে বিকালে বিকট শব্দ করে পাথর ফাটায় ডিনামাটি দিয়ে। পাথরের এত বড়-বড় চাঁই একেবারে উপর তক্ক ছিটকে ওঠে। দেখলে অনেক ভয় লাগে। কতদিনের পুরানো সব পাথর, তাকে অমন কইরে ফাটায়! ধরতি বোঙা রাগ করে কি না, কে জানে! তারপর সেইগুলা ভাঙার কাজ শুরু হয়। এত বড়-বড় হাম্বর দিয়ে ঠুকে ঠুকে ভাঙে। ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। ওই অত বড় হাম্বরটা গাঁয়ের কেউ এক হাতে তুলতেও পারবে না। হ্যাঁ, গাঁয়ের লোকে একমণি ধানের বস্তা মাথায় তুলে নিতে পারে, সে হল গিয়ে জানা কাজ। কিন্তু, ওই পাথর ভাঙা! বাপ রে, এক হাতে হাতুড়িটো তুলে বড়-বড় চাঙড়গুলায় মারে, আগুনের ফুলকি ছিটে উঠে। সবাই দেখেছে। অন্য অন্য জায়গা থিকে লোক আসল, সে সকল কাজ করতে। তারাও মাঝিই বটে, কিন্তু তারা আগেও পাথরখাদানে কাজ করেছে। জানে। ওই হাবড়াপাহাড়ি, চাঁদা, সগরভাঙা— উ সকল জায়গায়। ইয়ারা আইসে অই কাছেই ঘর বানাল। সংসারের বৌ-বাচ্চাও আনল। ছোটপারা গাঁ হল। কিন্তু ইয়াদের জমি নাই অইখানে। ওই খাদানেই কাজ। গ্রামও নোংরা হয়ে গেল। চতুর্দিকে পাথরকুচি, ধুলা। 

    সেই অন্য গাঁ থেকে আসা লোকদের মধ্যেই আইসেছিল শিমুল। হাট্টাকাট্টা জোয়ান। ঝাঁকড়া চুল আর হাঁকড়া গলা। সে আরও কাজ জানে। একটা বল্লমের মতো লোহার লাঠিকে বলে ড্রিল। তার সঙ্গে বিজলির তার লাগানো। সেইটা পাথরের উপরে বসায়ে নিয়ে চাইপে রাখে আর লাঠিটো ঘড়ঘড় শব্দ করে পাথর কাইটে ছেদ বানায়। লোকটা লাঠিটাকে ধইরে রাখে আর সিটো বনবন করে ঘুরে ঘুরে পাথর ফুটা করে। লোকটার দেহি থরথর কাঁপে। কী জোর! মেয়েরা হাঁ করে দেখে। মাটির ঝুড়ি নিয়ে আসা-যাওয়া শিবানীকে তারও চোখে লাগল।

    খাদান করতে যত যত মাটি কাটা হয়েছিল, সব উঁচু হয়ে একটি পাহাড়ের পারা হল। যে জানে না, সে-লোক মনে করবে সত্যি পাহাড়, কিন্তু মন দিয়ে দেখলে জানা যায়। একটি গাছ নাই, ঘাস নাই, খালি বালি কাঁকর। মাটিটো ত’ নিচে চাপা।

    তবু সেই শুকনা বালিপাথরের মধ্যেও শিবানীর মনে ফুল ফুটছিল। শিমুল একদিন-দুইদিন এল ওদের ঘরের কাছাকাছি। পাড়ার দুই-চারজনাও দেখল। শিবানীর বাপে খালি একবার বলেছিল,           

         — কুন গাঁয়ের বটে? ঘরে কে আছে না আছে শুধাবি। উয়ার মা-বাপের সাথে কথা বইলব না? 

    শিমুল নিজে কিছু বলে না। কথাও বলে না বেশি। বাহা পরবের সময় তাদের নিজেদের সমাজে জলখেলা হয়। জোয়ান কুড়া-কুড়িরা সকলে সকলের গায়ে জল ছুড়ে দেয়। মানে, গেল এক বছরে যদি কেহু কারও মনে দুখ দিয়ে থাকে, জল দিয়ে সেটি ধুয়ে দিবার নিয়ম। সেইদিনে সবাই সবার ঘরে যায়। সাজগোজ করে। সামরিও আসেছিল দাদি-সইয়ের ঘরে, শিবানীদিদির সঙ্গে খেলতে। কিন্তু খেলাটি যে কী হয়েছিল শিবানী বুঝে নাই। জানল, যখন সেই দুখ মুছে দিবার খেলা শেষ হল— শিমুল সামরিকে বিহা করে নিল। সামরির ঘরে গিয়ে, তার বাবাকে বলে, ঘর বসাল। 

    আট বচ্ছর পর আজ মুখোমুখি বসা দুইজনের মাঝ দিয়ে শিবানীর সেই দুঃখের নদীটি বহে যায়। সামরি ভাবে, শিবানীদিদির মনে কত না রাগ-রিস উঠছে তাকে দেখে। কিন্তু মুখটো দেখে কিছুই জানাচ্ছে নাই। ভগবানেরই বিচার বটে! আজ ঝড়ে বিপদে তাকে শিবানীদিদিরই ঘরে আসতে হল ঠাঁই নিতে। শিবানী দেখে, সামরির চেহারা কীরকম শুকনা খড়ের পারা হয়ে গেছে। এই মাঠগুলার মতন। 

           — কেমন আছিস তু? 

    কথাটা বেরিয়েই পড়ে তার মুখ থেকে। সামরি মাথা নিচু করে থাকে একটুখানি। তারপর বলে,

          — ই যেমনটি দেখছিস। উ জনা ত’ নাই! 

    চমকে ওঠে শিবানী,

        — কেনে? ফেলায় গেছে তুকে? 

    সামরি মাথা নাড়ে,

          — উ যো ড্রিল চালাত, উয়েই খায়ে নিল। অত জোরে ঝাঁকাইত শরীরটো, হাড়ে এমুন অসুখ হল, অত বড় জোয়ান লোকটো এতটুকু হয়ে যেমন একটা বস্তার পারা হয়ে গেল দুই বছরে। উঠতে চইলতে পারত না। 

          — ঝাড়ালি নাই?

          — অনেক। কনো হইল নাই। ব্যথায় দিনরাত গোঙাত। শেষে খাদানের পুরানো লোকেরা বলে, ড্রিলারদের অমনই দশা হয়। যত বড় জুয়ান হক, এক বছরের বেশি কেহু উ কাজ করতে পারে নাই। হাড়ের জোড়গিলা জখম হয়ে যাবেক। পাঁচ বচ্ছর হইল উয়ার মরা।

       — বেটাবিটি হয় নাই তুর?

       — একটি বিটি। উয়াকে লিয়ে বাবা-মায়ের কাছে রহি আমি। গাঁ-টো তিতর-বিতর হয়ে গেলছে। 

    শিবানী জানে। গামারসোল, চাঁদনি না দেখেও জানে। অপমানে, রাগে সে খাদানের রঙলালকে সাঙা করে এই সাজোড় গাঁয়ে আসে। খাদানও আসে যেন তার পিছন পিছন। পাঁচ বছরে সব খেতমাঠ খাদান হয়ে গেল। শুধু অতল পাতালের পারা গাড্ডা। আর দূরে দূরে ক্রাশার মেশিন। আজ এই উজাড় হয়ে যাওয়া ভাঙা গ্রামের ঘরে কেবল একটি দুর্যোগের ঘেরাটোপের মধ্যে শিবানীর কাঠের চৌকিটির ওপরে বসা দুটি মানুষী তাদের গ্রাম, তাদের হাসিখুশির ছোটবয়স, তাদের ছেতরে যাওয়া, শান্তিতে বুড়ো-হতে-না-পারার জীবনকে বিছিয়ে দ্যাখে। মনে জানতে পারে, দিনের আলোয় দরজার বাইরে তাদের সেই গ্রাম কোথাও নেই আর। চারিদিক ঘিরে পড়ে আছে কেবল ধরতি মায়ের বুক খুঁড়ে ফেলা পাহাড়ের মত উঁচু মাটি, আর ক্রাশার মেশিনের অমঙ্গুলে ছড়ানো হাত। সকাল হতে-না-হতে কাছের দূরের মেয়ে-মরদ হাজির হবে ওই ক্রাশার মেশিনের পাশে। ওর মাথায় চড়ে পাথরের বড় বড় টুকরা ঢালতে, নিচে পড়া গিটি ঝুড়ি করে তুলে ট্রাকে বোঝাই করে দিতে। চারদিকে পাথরের ধুলা হি ধুলা। 

    চালের ওপর কড়কড় শব্দে বোঝা যায়, শিল পড়ছে। আলোর লালচে শিখাটুকু দপদপ করে উঠে। রাত বেশি হয় নাই, কিন্তু ই দুর্যোগে বাড়ি যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। শিবানী সেই কথা বলে সামরিকে,

          — তুর মা চিন্তা ত’ করবেকই, তবু জানবে যে কনোখানে আছে। এখন কি বাহিরে যাওয়া যায়! ই তুফান থামলে, কাইল ভোরে যাবি।

    কোনওরকমে ফোটানো দুটি ভাত খেয়ে, মায়ের জন্য, বিটির জন্য দুশ্চিন্তা করতে করতে সময় যায়। শিবানী কাছে এসে চৌকির ওপর বসে। যে কথা সামরিকে অনেকক্ষণ ধরে খোঁচাচ্ছিল, সেটা জিগেস করেই ফেলে। এই অন্ধকার আর বাতাসের আওয়াজে যেন কিছু একটা আড়াল তৈরি হয়েছে।

          — তু আমার পরে অনেক রাগ করে আছিস? 

    শিবানী অদ্ভুত ভাবে তার কাঁধের ওপর একটি হাত রাখে,

          — নাঃ, এখুন আর রাগঝাল কিছুই নাই। হঁ, তখন আগুনের পারা রাগ উঠেছিল, তুর পরে থিকেও, মরদটোর পরে। পরে দেখলি, অমনই হয়, যৈবনের দিনই অমন। আর দেখ, তাই কি রইল? তখন কতবার ভাবেছি, যেন মইরে যায়। নয় তুই যেন মরিস। কিন্তু আজ মানুষটার দশা শুইনে মনে দুখই হইল ত’। অমন চেহারা, যেমনি শালগাছের পারা। তাও গেল অই খাদানে। তুর লাগেও দুখ হল। কী ভাবলি, আর কী হল! আবার খানিক চুপ। তারপর আবার সামরিই শুধায়,

            — তুই ইখানকে একাই থাকিস? কেনে এমুন? 

    নিঃশ্বাস ফেলে শিবানী,

            — উ ক্রাশারে কাজ করি। কাশরোগ হইল, খুন বেরাল গলায়। সকল জনা বইলল, টিবি হইলছে তুর। বেটাটো চইলে গেল শহরে। উ সেন্টারে টিবির অষুধ খাওয়াইল দুইমাস। পরে শহরের দুই-চাইরটা ডাক্তারবাবু আসেছিল। সকলকে নিয়ে মিটিন করাল। বইললেক ‘টিবি লয়, ইটো খাদানের ধুলা বুকে ঢুকার অসুখ। কেস হবে, সরকার পইসা দিবে, মালিক পইসা দিবে।’ পিছে সব গেল। মালিকের লুক ঘরে আইসে কলা আর গুড় দিয়ে গেল। বইললেক, কলা-গুড় খালে ধুলা বুকে বসে নাই। কতদিন দিল। একাই থাকি এখুন। যেদিন পারি ক্রাশারে যাই, যেদিন যাই না ঘরে থাকি। ছেলাটো কনো কনো দিন আসে। 

    দুজনের সব কথা বলা হয়ে যাওয়ার পর, অনন্ত চুপ করে থাকার পর, এক সময় সামরি ঘুমে ঢলে পড়ে। ওর মুখের দিকে দেখে দেখে শিবানী ভাবে, আজ এত বৃষ্টিতে সবদিক ভিজে গেছে, কাল ক্রাশার চলবে না। কাজে যাবে না। ধুলাও উড়বে না। আজ সে ঘরে একা নাই। এখুন বৃষ্টি কম হচ্ছে। বাতাসের শব্দ, আবার নামতেও পারে। যেন এখনই অন্ধকার ঘরের কোণ থেকে তার মা ভাত খাবার জন্য ডাক দিবে।    

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র       

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook