২০২০ কেমন কেটেছে?
সভ্যতাটাকে চারপাশে ভেঙে পড়তে দেখতে ভাল লেগেছে, তাই না?
এই প্রশ্নটার দুটো উত্তর আছে, একটা ফর্মাল আর অন্যটা ইনফর্মাল।
পোশাকি উত্তরটা হল আমার পক্ষে ২০২০ আলাদা কোনও বছর হয়ে ওঠেনি। আমি এমনিতেই অন্তর্মুখী, একটু একা-একা, ছাড়া-ছাড়া থাকতেই ভালবাসি, বাড়ি থেকেই কাজ করি, যথেষ্ট সামাজিক উৎকণ্ঠায় ভুগি, স্নানের সময় বাথরুমে সামাজিক কথোপকথন বার বার আওড়াই। মুম্বইতে খুব কমই বাড়ি থেকে বেরোই।
নিজের ভেতরের সত্যি উত্তরটা হল— প্রলয়টা একটু অন্য রকম হবে ভেবেছিলাম— সিনেমায় যেমন সভ্যতার শেষটা কী কুল দেখায়! লকডাউনের শুরুর থেকেই আমাদের ফ্ল্যাটে নানা রকম অসুবিধা সৃষ্টি হল, আর তার মাঝে আমি ‘একে ভারসাস একে’ ছবিটির কাজে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
আমি মোটেই আমাদের আগের ফ্ল্যাটটা পছন্দ করতাম না; আলো আসে না, হাওয়া খেলে না, একটা স্যাঁতসেঁতে জায়গা। তার মধ্যে বৃষ্টির সময়ে একটা ঘরে এত ঘুণ ধরল যে আমাদের অন্য আর একটা ঘরেই থাকতে এবং একই সঙ্গে কাজ করতে হত; প্রতি রাতে টেবিল, চেয়ার, তোষক-বিছানা সব কিছু সরিয়ে ফেলা আর আবার পরের দিন নতুন করে গোছানো, এই ছিল রোজনামচা। এরই মধ্যে লকডাউনে আমি আর একটা বেড়ালছানাকে তুলে এনেছিলাম। তাই একটা ঘরে আমি, আমার বর ক্রেগ, অচল এসি, আমাদের কাজ, সংসার আর ঘাড়ের উপর বিড়ালেরা! এ ভাবে ছ’মাস চলেছে, সেপ্টেম্বরে বাড়ি বদলানো অবধি! আমি এতটাই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে (হলিউড অভিনেত্রী) ব্রিটানি মারফির সন্দেহজনক মৃত্যু, বা এ ধরনের অন্যান্য মৃত্যু নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছিলাম। তা ছাড়া বাবার সঙ্গে দেখা না হওয়া, তাঁর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে উদ্বেগ তো ছিলই। আর ছিল সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে একটা বিষাক্ত ‘ভাল থাকার’ ভার— যেন অন্যের ভীষণ অসুবিধার কথা ভাবলেই আমার জীবনের দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা-অসুবিধাগুলো উধাও হয়ে যাবে!
তোমার সঙ্গীত পরিচালনাকে এক কথায় বর্ণনা করতে গেলে প্রথমেই যে শব্দটি উঠে আসে তা হল ‘ডার্ক’; বাংলায় ‘বিষাদাছন্ন’, কিছু ক্ষেত্রে ‘রহস্যময়’-ও বটে। এই বিষণ্ণ সাউন্ডস্কেপের শুরু কোথা থেকে?
আমার মনে হয় এটা আমার রক্তে আছে। বেড়ে ওঠার সময় থেকেই দুঃখের আবেগটা আমায় বেশি আবেদন করেছে, ছুঁয়েছে অনেক বেশি। সে গান শোনা হোক বা বই পড়া। আমার মায়ের দাদু ছিলেন রজনীকান্ত সেন। ওঁর গান, যদিও সে সবই ভক্তিগীতি, ছিল খুবই বিষণ্ণ; আমি ছোটবেলায় ‘যেখানে সে দয়াল আমার’ গানটা গাইতে-গাইতেই কাঁদতাম। পরবর্তীকালে আমার দুটো ভীষণ পছন্দের ব্যান্ড ছিল— নাইন ইঞ্চ নেইলস আর ম্যাসিভ অ্যাটাক। ফলে, নব্বইয়ের দশকেই আমার মধ্যে বিষণ্ণ শব্দ-বিন্যাসের বীজ পোঁতা হয়ে গিয়েছে।
কলেজে পড়ার সময় আমি মা’কে হারাই। বাকি অনেক কিছুর সঙ্গে মা’কে হারানোর বেদনা ও শূন্যতা আমার গোটা ব্যক্তিত্বের উপর একটা প্রভাব ফেলেছে। ফলে, সব মিলিয়ে আমার ব্যক্তিত্বটাই আমার সংগীতের অভিজ্ঞান হয়ে উঠেছে। কাজের ক্ষেত্রে, আমার প্রথম ছবি ‘ফান্দ্রি’-তেই আমাকে স্বাভাবিক ভাবে প্রকাশ করার সুযোগ পাই। আমার মনে হয় আমার পক্ষে লঘু গান বানানো বেশ কঠিন কাজ হবে।
এই নির্দিষ্ট মিনিমালিস্ট সাউন্ডস্কেপটার নির্দিষ্ট কিছু বোদ্ধা শ্রোতা আছেন, ইংরেজিতে যাকে বলে discerning listener। সেই সংখ্যাটাও কিন্তু নয়-নয় করে কিছু কম নয়। কিন্তু অন্য দিকে, সমালোচকরা বলবেন গণ-আবেদন নেই, এবং ‘ডার্ক’ তকমাটা বসে গেলে বৈচিত্র্য নেই, সেই অপবাদও উঠে আসতে পারে। এই ধরনেরর সমালোচনায় তোমার প্রতিক্রিয়া কী?
‘ডার্ক’ তকমাটা একই সঙ্গে ভাল আর খারাপ। আমি সবার পছন্দের সুরকার নই, প্রথম বাছাইও নই। আমার কাজ এখনও অবধি যা হয়েছে, তার অনেকটাই আমার মনে হয় একটা সমাপতন। আমি গত বছর দশেক ধরেই এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে যাচ্ছি, কিন্তু আমার পরিচিতি হতে শুরু করেছে (বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে পরিচালিত) ‘সেক্রেড গেমস’ থেকে। আমি ওই পরিচালকের ছবি ‘ট্র্যাপড’-এ কাজ করার সুবাদে ‘সেক্রেড গেমস’-এ কাজ করার সুযোগ পাই।
‘ফান্দ্রি’, ‘সেক্রেড গেমস’, ‘লীলা’— এই সব সাউন্ডট্র্যাকেই আমার নিজস্ব স্টাইলে সুরবিন্যাস করতে পেরেছিলাম, সেই স্বাধীনতা আমার ছিল। এবং এই কাজগুলোর ভিতর দিয়েই নিজস্ব শব্দবিন্যাসকে আমি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। তুমি যে নির্দিষ্ট শ্রোতাদের কথা বলছ, আমি তাঁদের অনুভূতি, মনোভাবের কথা পরিচালকদের, প্রযোজকদের বোঝাতে চাই। আমি বার বার বলি যে, আমরা একা নই, পৃথিবী-জুড়ে রাত জেগে দুঃখের গান শোনে এমন বহু বহু লোক আছে।
তবে হ্যাঁ, ২০২০ বছরটা যা যাচ্ছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে একটা কথা বলতে পারি, প্রথাগত বলিউডি গান বা সাউন্ডস্কেপ যদি বানাতেই হয়, তা হলে আমি বাণিজ্যিক কারণেই বানাবো। নিজের ছাঁচ ভাঙব, বলিউডি মাস্ক পরে নেব।
বলছি বটে, কিন্তু সেটা যে সব সময় করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, এই বছরটা তা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে গেল। সুতরাংএই বিরোধটা আছেই এবং থাকবেও, ভয়টা আসলে আর যাচ্ছে না!
তোমার বাবার ছবির কথায় আসি। বাবার সিনেমা তোমাকে কী ভাবে প্রভাবিত করেছে? তোমার সঙ্গীত পরিচালনার ক্ষেত্রে এই প্রভাবটা কতটা প্রকট?
আমি সুর বা সঙ্গীত সম্বন্ধে যা ভাবতে পারি তা এক মাত্র বাবারই জন্য। বাবার ইচ্ছা ছিল আমি আর দিদি দুজনেই কন্সার্ট পিয়ানিস্ট হব, কিন্তু আমরা কেউ পারফরম্যান্সের দিকে যাইনি। আমার কোনও কালেই পারফরম্য়ান্স ব্যাপারটা পছন্দের ছিল না; আমি ঘরে বসে নিজের মনে সুর তৈরি করাটা অনেক বেশি পছন্দ করতাম। কোন ক্লাসের ঘটনা এখন ভুলে গেছি, এক বার এক জন প্রচণ্ড গম্ভীর, টাইট-লিপড ইংরেজ একজামিনার আমাদের পিয়ানোর পরীক্ষা নিতে এসেছিলেন। বাবা ছিলেন দর্শকদের মাঝে। কিছু বাজাতেই পারিনি। কিন্তু বাবার মুখে সেই প্রচণ্ড হতাশা আর যন্ত্রণার অভিব্যক্তিটা এখনও আমার দিব্যি মনে আছে।
এখন ভাবলে অদ্ভুত লাগে, কিন্তু বাবার আর আমার কাজের এবং তার মধ্যে দিয়ে ভাবনা আদান-প্রদানের এই বৃত্তটা বোধহয় এখন প্রায় সম্পূর্ণ। এটা খুবই বিরল একটা ব্যাপার হলেও আমাদের ক্ষেত্রে অঙ্কটা মিলেই গেছে! বাবার মেয়ে হয়ে বড় হওয়াটার একটা নিজস্ব প্রভাব ছিল, সেটা আজকে বুঝি। এই লোকটা, যে আমাকে ছোটবেলায় পাগল করে দিতে বাকি রেখেছিল, আজকে তাঁকে আমি বুঝতে পারি, তাঁর ভালবাসা আর যন্ত্রণা বুঝতে পারি, তাঁর উৎকন্ঠা, উদ্বেগের কারণ আমার কাছে সুস্পষ্ট। ‘বাঘ বাহাদুর’, ‘চরাচর’ আর আমার ৩-৪ বছর বয়স থেকে যা-যা ওয়ার্ল্ড সিনেমা তিনি আমাদের সামনে দেখতেন, তার সুর বা সঙ্গীত সম্বন্ধে জেনেছি, বুঝেছি, শিখেছি।
বাবার সঙ্গে আমার প্রধান পার্থক্য, বাবা আজও ভীষণ গভীর ও তীব্র। আমি কিন্তু একটা হালকা ভাবনাও ভাবতে চাই, নিজেকে সব সময় তীব্রতার মধ্যে দিয়েই নিয়ে যেতে চাই না। কান্না পেলে কাঁদতে চাই, পিয়ানো বাজিয়ে দুঃখপ্রকাশ করে একটা আর্টিস্টিক রূপ দিতে চাই না।
আসলে, আমার কাজের ক্ষেত্র, এই মুম্বই ইন্ডাস্ট্রিতে জীবনটা চলে প্রায় নাগরদোলার মতো— কখনও প্রচুর উঁচু আবার কখনও ভয়ঙ্কর নিচু। সব সময় নিজেকে তীব্রতার মধ্যে রাখলে, এই টালমাটাল, খানিকটা অনিশ্চিত মুম্বই-জীবনটা মেনে নিতে খুব অসুবিধে হয়। তাই আমি একটু একটা নিউট্রাল জীবন চাই, তীব্র আর নিরুত্তেজ— দুটো মিশিয়ে।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সিনেমায় আবহসঙ্গীত একটা প্রধান ভূমিকা পালন করে। ‘চরাচর’, ‘তাহাদের কথা’, ‘উত্তরা’-র মতো ছবিতে চলচ্চিত্রগ্রহণ আর সঙ্গীত যেন অদৃশ্য নায়ক। এ হেন পরিচালকের ছবিতে সঙ্গীত পরিচালকের কাজ কতটা কঠিন?
ভীষণ কঠিন। বা ভীষণ কঠিন ছিল।
আমি বাবার কাজে প্রথম সুর দিই ‘তেরোটা কবিতা’ নামের একটি সিরিজে, এবং তারপর ২০১০-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প অবলম্বনে ‘সে’ (হিন্দিতে ‘ওহ’)। আমি তখনও বিদেশে পড়ছি, কম্পোজ-ও করছি। আমার তৈরি কিছু সুর বাবার খুব ভাল লাগে, কিন্তু একই সঙ্গে প্রচুর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। ওই প্রথম দিকটা একটা ভয়াবহ সময় গেছিল; প্রত্যাশা ভাঙার ভয়, বাবাকে নিরাশ করার ভয়! ব্যাক্তিগত ভাবে খুবই অনিশ্চিত সময়। আমাকে প্রচুর গবেষণা করতে হয়েছিল, সাউন্ড টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে অনেক সময় কাটাতে হয়েছিল। নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছিল।
কিছু কাজ যেমন বাবার পছন্দ হয়েছিল, অপছন্দও হয়েছিল প্রচুর। আমাকে অনেক জায়গায় অনেক কিছু বদলাতে হয়, কিন্তু একই সময়, অনেক কিছু একদম ঠিকঠাক মিলে যায়। বাবা সুরের মাধ্যমে আমার বক্তব্য বুঝতে পেরেছিলেন, এবং বাবার কাজের সঙ্গে ওই প্রথম আমার একটা সামঞ্জস্য তৈরি হয়।
বুদ্ধদেববাবুর সিনেমায় বাংলা-বিহার-অসম-ওড়িশার লোকগীতি– এবং অনেক ক্ষেত্রেই পল্লি সমাজের কানায় দাঁড়ানো কিছু চরিত্র— একটা নিজস্ব জগৎ গড়ে তোলে। গত দশকে বানানো ওঁর ছবিতে কিছু শহুরে চরিত্র উপস্থিত হয়েছে ধীরে-ধীরে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য আবহ সঙ্গীতের বিবর্তন। তোমার বিশ্লেষণ কী?
আমার মনে হয় বাবা লোকগীতি আর লোকগাথার পরিধিটা যথেষ্ট অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করেছেন, ‘উত্তরা’ বা ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ সিনেমা দুটির মাধ্যমে; সিনেমাটোগ্রাফি সহ, পুরুলিয়ার রুক্ষ পটভূমি সহ। আমি কাজ করা শুরু করার সময় বাবার পাশ্চাত্য মার্গসঙ্গীতে একটা কৌতূহল জন্মায়। আমি কেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখলাম না সে বিষয়ে বাবার একটা অনুতাপ আছে। আমি অবশ্য এখনও লোকগীতি আর ভারতীয় মার্গসঙ্গীত এক্সপ্লোর করে যাচ্ছি।
বাবা কবি ও গদ্য লেখক হিসেবেও পরিচিত নাম। সিনেমার বাইরে বাবার অন্য লেখা তোমাকে প্রভাবিত করেছে?
হ্যাঁ, বিশেষত কবিতা ও ছোট গল্প। আমি ছোট থেকেই ভূত নিয়ে কৌতূহলী; ছোট থেকেই বাবার চরিত্র কাল্লু ভূতের গল্প শুনে এসেছি।
আমি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলাম। কলেজের ওই বছরগুলি সাহিত্যে ডুবে থাকা বলতে যা বোঝায়, তাই হয়েছিল। ক্লাসে হাঁ করে বার্টি ডা সিলভার পড়ানো উইলিয়াম ব্লেকের ‘টাইগার, টাইগার’ শুনতাম। সাহিত্য আমার উপর সব সময়েই একটা রেশ ফেলে গেছে। এ ছাড়া ছিল নাচ, যা আমি বেশি দূর অবধি চালিয়ে যেতে পারিনি।
বাবা আর পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে কি আলাদা করা সম্ভব?
না, একেবারেই নয়। দশ বছর বাবার সাথে কাজ করছি, ভেবো না কাজটা একটুও সহজ হয়েছে। প্রতিটা প্রজেক্টে একই মাত্রায় চাপ সৃষ্টি হয়ে এসেছে, কিন্তু আমার সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে বাবার স্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছে, যাতে আমার সুবিধা হয়।
বাবা হাতে এডিট করা, স্টুডিও-তে রেকর্ড করা মানুষ— স্ক্র্যাচ বোঝেন না, মিডি কাকে বলে জানেন না। স্ক্র্যাচ শুনে বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘না না, খুব বাজে হয়েছে, এটা কি হচ্ছে!’ ওটা যে ফাইনাল প্রোডাকশনে আমূল বদলে যেতে পারে এটা বাবা ভাবতেই পারেন না। আমার কাজের ক্ষেত্রে বাবার স্ট্যান্ডার্ড রিঅ্যাকশন হচ্ছে ‘আরে, কম্পিউটারে কী করছিস?! পিয়ানোটা বাজা!’
সুতরাং বাবার সঙ্গে কাজের এই দিকটা আমার কাছে একদম ঘরের অনুভূতি, খুব ভালবাসার একটা জায়গা। আর গত এক দশকে বাবা এমন সিনেমা বানিয়েছেন যা আমি দেখতে চাই। ফিল্মগুলো আর একটু বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। বিপদ আর ঝুঁকির সঙ্গে একটা অদ্ভুত বিষাদ আছে বাবার গত কয়েক বছরে বানানো সিনেমায়। আর আছে ওই অ্যাংস্ট। যে পরিচালকের ছবি থিয়েটারে দেখানো হয় না, সেই পরিচালকের ক্ষোভ।
গান শোনা— মনোযোগ দিয়ে গান শোনা— নিয়ে আমাদের অনেক আলোচনা আগেও হয়েছে। তোমার কিছু পছন্দসই সঙ্গীত পরিচালকের কথা বলো।
এই আলোচনাটা চলতেই থাকবে…গান শোনা…আমার জামাইবাবু আমার জন্য প্রচুর গানের একটা সংগ্রহ বানিয়ে দিতেন, এবং আমি ঘন্টা পর ঘন্টা, নাওয়াখাওয়া ভুলে গান শুনতাম। যখন পিয়ানো শিখতে ঢুকলাম, বুঝেছিলাম ওটা রয়্যাল স্কুলে পড়াশোনার মতো করেই শেখানো হত— যাকে বলে রোট লার্নিং। এর সঙ্গে ছিল সেই রাশভারী ইংরেজ একজামিনার আর বাবার হতাশা! ২০০১-এ আমি আর জামাইবাবু অমিত দত্তর গিটার ক্লাসেও কয়েক মাসের জন্য যাই!
বহু পরে, ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি গিয়ে আমি পিয়ানো বাজানো এবং কম্পোজ করার মজা আবার ফেরত পাই। আমি নিয়মিত পুরনো বাংলা আর হিন্দি সিনেমার গান শুনি— ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘হয়তো তোমারই জন্য’, নওশাদ-এর লেখা গান। এই সে দিনও ‘পকিজা’-র গান শুনছিলাম। সত্যজিৎ রায়ের ছবির আবহসঙ্গীত তো আমাদের বড় হওয়ার অঙ্গ।
হিন্দি সিনেমায় এ আর রাহমান আমার অন্যতম প্রিয় সঙ্গীত পরিচালকদের মধ্যে এক জন— আমি এখনও ‘দিল সে’ শুনি, এখনও ‘অ্যায় অজনবি’ আমার প্রিয় গানের মধ্যে একটি। পরে অমিত ত্রিবেদীর কাজ শুনি ‘আমীর’ এবং ‘দেভ ডি’-তে।
স্কুলে ও কলেজে সুমনের কবিতা আর অঞ্জন দত্ত’র গান শুনি, লিওনার্ড কোহেনের গান শুনি। ওই বয়েসে মা’কে হারিয়ে আমি গানেই নিজের সান্ত্বনা খুঁজে বেড়াতাম; ট্রেন্ট রেজনর আর নাইন ইঞ্চ নেইলস খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটা ব্যান্ড ছিল আমার কাছে। একই সময় আমি পিয়ানো ট্রেনিং নিতে শুবার্ট-এর ‘নক্টার্ন’ শুনি। এরিক সাতি’র পিয়ানো শুনে বুঝতে চেষ্টা করি এত সহজে কী করে দুঃখ পাওয়া যায়। ব্রায়ান ইনো’র গান শুনি, ফ্লিট ফক্সেস নামের ব্যান্ডটাকে খুঁজে পাই, তাদের ‘টাইগার মাউন্টেন পেজ্যান্ট সং’ শুনি। ‘ডেড ম্যান ওয়াকিং’-এ শুনি নীল ইয়ঙ-এর গান। ইদানিং পুসি রায়ট নামের রাশিয়ান অ্যাক্টিভিস্ট পাঙ্ক ব্যান্ডটা শুনছি।
মেনস্ট্রিম সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালকদের মধ্যে আমেরিকান কম্পোজার থমাস নিউম্যান (‘গ্রিন মাইল’, ‘আমেরিকান বিউটি’, ‘ফাইন্ডিং নিমো’, ‘স্কাইফল’) আমার খুবই প্রিয়। কোয়েন ভাইদের সহযোগী কম্পোজার কার্টার বারওয়েলের কাজ (‘ফারগো’, ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন’, ‘দ্য বিগ লেবওস্কি’) খুব শুনেছি।
এর মাঝেই দেখলাম ‘ওয়াইল্ড কম্বিনেশন: আ পোর্ট্রেট অফ আরথার রাসেল’ নামের তথ্যচিত্রটি, যার সাউন্ডট্র্যাক এক কথায় অসাধারণ। রাসেল এক জন ক্ষণজন্মা চেলিস্ট ও কম্পোজার ছিলেন, সত্তরের দশকে নিউ ইয়র্কে এক্সপেরিমেন্টাল, আভাঁ-গার্দ কাজ করে গেছেন শুধুমাত্র চেলোতে সুরসৃষ্টি করে। খুব দুঃখের জীবন; সমকামী ছিলেন, ১৯৯২ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়েসে মারা যান। ‘ওয়াইল্ড কম্বিনেশন’ ওনার একটি গানের নাম, এবং ডকুমেন্টারিতে ওনার গানই ব্যবহার করা হয়েছে।
আমি প্রচুর জাপানি সিনেমা দেখি। কুরোসাওয়ার ‘ড্রিমজ’-এ যে সিকুয়েন্সে কিতসুনে বা শিয়ালদের বিয়ের প্রথা দেখানো হয়, আমি তা থেকে আরও গামেলান (ইন্দোনেশিয়ার লোকসংগীত) শুনতে কৌতূহলী হয়ে উঠি। মাজিদ মাজিদির ‘বারান’(বৃষ্টি), পোলান্সকির ‘ফ্র্যান্টিক’, এস্তোনিয়ান কম্পোজার আভ্রো পার্ট ও তার মিনিমালিস্ট কাজ, গুস্তাভ সান্তাওলাল্লা– এ সবই খুব কাছের গান।
২০২১-এ তোমার থেকে আমরা নতুন কি শুনতে পাবো?
২০২০-র ডিসেম্বরে ‘একে ভার্সাস একে’ একটা বড় রিলিজ হয়েছে। ২০২১-এ এখনও অবধি নীরজ ঘেয়ানের নতুন ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব আমার; ভীষণ ইন্টারেস্টিং একটা গল্প ছবিটির, ভারতে সমকামিতা ও জাতিভেদপ্রথা নিয়ে এই ফিল্ম। আরও কিছু কাজ হাতে রয়েছে, তবে সেগুলো নিয়ে এখনই কথা বলছি না।
অলকানন্দার সুর গঠনে একটা দুঃখ, একটা বিষাদ আছে, যা আমাকে সবচেয়ে ছুঁয়ে যায়। সাত বছর বয়স থেকে পিয়ানো বাজাচ্ছে; পাশ্চাত্য মার্গসঙ্গীতে ও পারদর্শী। আমি নিজেও ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিকের ভক্ত, এবং গত দশ বছর অলকানন্দাই আমার সব কাজে সঙ্গীতবিন্যাস করেছে।
আমার সাথে অলকানন্দার বোঝাপড়াটা খুবই স্বচ্ছন্দ, আমি ওর উপর কিছু চাপিয়ে দিই না, ছবিটা দেখাই, কথা বলি। অলকানন্দার তৈরি করা সুরে কখনো কিছু বদল হয়ত হয়, কিন্তু না বলা অনেক কিছুই ও বুঝে নিতে পারে। অন্য কোনো মিউজিক ডিরেক্টর হলে এতটা স্বাচ্ছন্দ্য থাকত কি না জানি না, কিন্তু সুর কিভাবে দৃশ্যকে এনহ্যান্স করতে পারে, সেটা অলকানন্দা খুব ভালো বোঝে। ও হয়ত বয়সে অনেক ছোট, এবং কিছুটা শিশুসুলভও, কিন্তু ওর মন খুব গভীর।
অলকানন্দা চূড়ান্তভাবে ক্রিয়েটিভ; যার ফলে ওর সমস্যা দেখা দেয়। এই ধরনের সৃজনীক্ষমতা এবং আদর্শ থাকলে মুম্বাইয়ের মত ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকা খুবই শক্ত। সব সময় যে মনের মত কাজ পাওয়া যাবে, তা তো নয়। এই কারণে ও মাঝে-মাঝে আপসেট হয়ে যায়।
আমার সাথে অলকানন্দার প্রথম কাজ একটা ডকুমেন্টরির, এবং তারপর ‘ওহ’ নামের ছবিটির। ২০১৩-তে ‘আনোয়ার কা আজাব কিসসা’ তৈরি হয়; অসাধারণ কাজ করেছিল।
অলকানন্দার সব কাজই আমি দেখেছি এবং সঙ্গীত ও আবহসঙ্গীত শুনেছি; অন্য সিনেমার কাজ, ওয়েব সিরিজের কাজ, খুব ভালো বিজ্ঞাপণের কাজ। কিন্তু অলকানন্দার করা কাজের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ‘আনোয়ার’-এর সুরবিন্যাস।
২০২০-তে কোন কাজই করা গেলো না; ২০২১-এর মাঝামাঝি হয়ত পরের ছবিতে হাত দেব। স্ক্রিপ্ট-টা একটু বদলাতে হতে পারে। অবশ্যই, আমার ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করবে অলকানন্দা।