আপনি কলকাতায় জন্মেছেন এবং এই শহরেই জীবনের প্রথম দশটা বছর কাটান। কলকাতায় আপনার শৈশবের কোনও স্মৃতি আছে?
ওই সময়ের স্মৃতি আমার কাছে এখনও উজ্জ্বল। আমার বাবা ম্যানেজিং এজেন্সি, গিলিঅ্যান্ডার্স আরবাথনট-এ সিনিয়র পার্টনার ছিলেন। তাঁর ছয় সন্তানের একজন আমি। আমরা বেড়ে উঠি একটা বড় দোতলা বাংলোয়, যার লাগোয়া একটা টেনিস কোর্ট ছিল। আমি জীবনে দ্বিতীয়বার কখনও আর এমন সম্ভ্রান্ত, প্রশস্ত বাড়িতে থাকিনি! বাড়ির ঠিকানা ছিল ৭, রিজেন্ট পার্ক। আমি বড় হয়ে সেখানে দু’এক বার ফিরে গেছি। বাড়িটা কয়েক বছর আগে ভেঙে দেওয়া হয়।
এগুলো আমার চাক্ষুষ স্মৃতি, কিন্তু ছোটবেলার কলকাতার যে বিশেষ স্মৃতি আমার সঙ্গে এখনও আছে, তা হল গন্ধের— আমাদের বাংলোর ‘সার্ভেন্টস কোয়ার্টার্স’ থেকে ভেসে আসা বিভিন্ন ধরনের গন্ধের। সেখানে আমাদের বাড়ির কাজের লোকেরা একটা উনুনে তাদের রান্না চড়াত। আমি জানি এই গন্ধের স্মৃতি আমার সঙ্গে রয়ে গিয়েছিল, কেননা ১৯৬৫ সালে, যখন আমার প্রায় ৩০ বছর বয়স, এই গন্ধ একটা প্রবল স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে। আমি দিল্লিতে ক্ল্যারিজেস হোটেলে থাকছিলাম, আর ঘরের নিচে মালিরা তাদের দুপুরের খাবার একটা উনুনেই রান্না করছিল। এই রান্নার গন্ধ উঠে এসে আমার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি এক ধাক্কায় ফিরিয়ে আনে; মাথার ভিতর একটা এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো ছুটে চলে আমার শৈশব! আমি তখনই বুঝি যে বাকি জীবনে ভারতই আমার কাছে একটা বৃহত্তর গুরুত্ব বহন করবে।
আপনি ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনে (বিবিসি) যোগ দেন অল্প কিছুদিন পাদ্রি হওয়ার প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর। এই বদলটা কীভাবে ঘটে?
অল্প-পরিসরে দু’বার পাদ্রি হওয়ার প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর বিশপ আমাকে ডেকে বলেন যে আমি এই চার্চ কাঠামোয় যোগ দেওয়ার পক্ষে সঠিক পাত্র নই। উনি মনে করতেন, আমার আসল জায়গা পাব (pub), গির্জার প্রচারবেদী নয়। উনি খুব একটা ভুল বলেননি, কারণ আমি বেশির ভাগ সময়টাই ‘অ্যাডাম অ্যান্ড ইভ’ নামের একটা সুন্দর পাব-এ কাটাতাম, যেটা আমার পাদ্রি প্রশিক্ষণশালা, লিঙ্কন ক্যাথিড্রাল-এর কাছেই ছিল! একটা অসরকারি সংস্থায় কিছু দিন কাজ করার পর আমি বিবিসি-তে যোগ দিই।
আপনার দ্বিতীয়, এবং দীর্ঘতর ইনিংস-এর জন্য আপনি যখন ভারতে ফেরেন, দেশটাকে কেমন দেখেছিলেন?
আমি ভারতে পৌঁছই ১৯৬৫-র ডিসেম্বরে। প্রথম যে বড় ঘটনাটা আমার স্মৃতিতে গেঁথে গেছে, তা হল ১৯৬৬-র জানুয়ারি মাসে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার। ওই দিন ভিড় সামলাতে যে লাঠিচার্জ হয় তা আমার দিল্লিতে বিবিসির সঙ্গে কাজ করার প্রথম স্পষ্ট স্মৃতি। এর পর ১৯৬৯-এ আমাকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। বিবিসি-কে ভারত থেকে বহিষ্কার করার কারণে আমি ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশ তৈরি হওয়া কভার করতে পারিনি।
এর কারণ কি ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম কিছু বছর আপনার পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর করা?
না, এর কারণ (ফরাসি চিত্রপরিচালক) লুই মাল-এর ‘ফ্যান্টম ইন্ডিয়া’ নামের একটা ছবি, যাতে ভারত সম্পর্কে কিছু আপত্তিকর তথ্য উঠে আসে। ভারত সরকারের অনুরোধ সত্ত্বেও বিবিসি ছবিটার সম্প্রচার করে। এর পরে আমরা আর ভারত থেকে কাজ করতে পারিনি, যে সময়টায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ হয়।
ফলে আমি তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তানে (এখনকার বাংলাদেশ) প্রথম সাংবাদিক দলের অংশ হয়ে পৌঁছই। আমাদের সব জায়গায় অবারিত প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছিল। দু’সপ্তাহ সেখানে থেকে আমি অবস্থাটা বিচার করতে ওয়েস্ট পাকিস্তানে যাই। সেখান থেকে চলে যাই ইংল্যান্ডে, সেখানে একবারে যুদ্ধের আঁতুড়ঘর থেকে খবরাখবর জড়ো করে খবর তৈরি করতে সাহায্য করি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আপনার সাক্ষাতের ব্যক্তিগত স্মৃতি কেমন?
যে প্রথম কয়েক জন সাংবাদিক শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকার নিতে পেরেছিলেন, আমি তাঁদের একজন হতে পেরে খুব খুশি এবং গর্বিত ছিলাম। উনিও বিবিসি-র প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন, বলেছিলেন যে আমরা বাংলাদেশের স্বার্থে অনেক কিছু করেছি। আমি ওঁকে বলার চেষ্টা করেছিলাম, ‘কিন্তু শেখ সাব, (সাংবাদিক হিসাবে) আমরা কারও পক্ষ নিতে পারি না, আমাদের কর্তব্য ঘটনাবলির একটা নিরপেক্ষ অভিমত উপস্থাপন করা।’ কিন্তু উনি এ-কথা মানতে চাননি; এমনকী আমাকে একটা উপহার দিয়েই ছেড়েছিলেন, যে উপহারটি আমি সঙ্গে করে আনতে পারিনি। উপহারটি আমাদের দিল্লি অফিসে রয়ে গিয়েছিল এবং এখনও আছে।
ভারতে তখন ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী। ওঁর হত্যার আগে আপনি নিশ্চয়ই দুই দশকে বেশ কয়েক বার ওঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন?
হ্যাঁ, আমি বেশ কয়েকবার ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। কোনও-কোনও সময়ে উনি খুবই প্রাণবন্ত ব্যবহার করেছিলেন, কথা বলতে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। আবার কখনও খুব কঠোর থেকেছেন, যাকে বলে বেশ ভীতিপ্রদ! বেশ কিছু বছর ধরে নেওয়া এই সাক্ষাৎকারগুলোতে বলা ওঁর অনেক কথাই আমার মনে আছে। আমার মনে হয় ওঁর একটা ভাবনা বর্তমান ভারতের পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য। ইন্দিরাজি বলতেন, এই দেশটা পরিচালনা করা বেশ সহজ কাজ। তার কারণ দেশটা এত বড়, এত বৈচিত্র-সম্পন্ন যে, দেশের এক ভাগে যা ঘটে তা অন্য ভাগকে প্রভাবিত করে না। এটা সম্ভব কারণ, ভারতের পরিকাঠামোটি একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো। সেই বৈচিত্রের পরিকাঠামোটিকে এখন উপেক্ষা করে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার— যে সরকারের মূল লক্ষ্য হল এই বৈচিত্রের একীকরণ করা, একটি ছাতার তলায় জোর করে বৈচিত্রের সব ভাবনাকে নিয়ে আসা। এবং এই কারণেই আমরা দ্রুত এই বৈচিত্র হারাতে বসেছি। এটা সত্যিই খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতি, যা ভারতের মূল ধারণার অপরিবর্তনীয় ক্ষতি করে ফেলতে পারে।
অন্য আরও কথার মাঝে মনে আছে মিসেস গান্ধীর বন্যপ্রাণী-প্রীতি, যা ওঁর বিরাট প্যাশন ছিল। আমার মনে আছে একবার আমার ওঁর সঙ্গে দেখা হয়, বিবিসি-র এক ডিরেক্টর-জেনেরাল সঙ্গে ছিলেন, ঠিক জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক-এ যাওয়ার আগে। ‘আমি জিম করবেট পার্ক-এ যেতে ভীষণ ভালবাসি, কিন্তু যেতে পারি না, কারণ আমার দেহরক্ষীর দল এবং কনভয় জন্তু-জানোয়ারদের বিরক্ত করবে আর আমি কিছুতেই ওদের শান্তি এবং নৈঃশব্দ্যের ক্ষতি করতে প্রস্তুত নই।’
ইমার্জেন্সির সময়টা আপনার এবং বিবিসি-র পক্ষে কেমন ছিল?
ইমার্জেন্সির মুশকিলটা ছিল, মিসেস গান্ধী তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগটা মিস্টার ভি সি শুক্লা-র হাতে তুলে দেন, যিনি খুব কড়া গোছের লোক ছিলেন। শুক্লা একটা এমন দলিল তৈরি করেছিলেন, যা সই করলে— হয় আমাদের সেন্সরশিপ নিয়মাবলি সম্পূর্ণ মেনে চলতে হত, বা ভারত ছাড়তে হত। বিবিসি-সহ প্রায় সমস্ত বিদেশি সংবাদ সংস্থা এই দলিলকে উদ্ভট আখ্যা দিয়েছিল। যেমন, এই দলিলে বলা হয়েছিল যে সংসদের রিপোর্টিং হবে, কিন্তু বিরোধীপক্ষ যা বলেছে তা রিপোর্ট করা চলবে না। দলিল সই করতে রাজি না হওয়ায় আমাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ছাড়তে বলা হয়েছিল এবং আমি তাই করি।
ভারতে ফিরে আসার পর মিসেস গান্ধীর সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?
১৯৭৭-এ ফেরত আসার পর আমি আরও বারকয়েক ওঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। শেষ সাক্ষাৎকারে উনি অত্যন্ত সুমধুর ব্যবহার করেছিলেন; বলেছিলেন ‘টেপ রেকর্ডার সুইচ অফ করে দাও এবং দেশে যা ঘটছে তা নিয়ে এসো কথা বলি!’
এই সময়ে অপারেশন ব্লু স্টার কভার করে আপনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন…
অসাধারণ খবর করার গল্প ছিল। মূল চরিত্রদের সঙ্গে আমার পরিচিতি হয়… আমি (জার্নেল সিং) ভিন্দ্রানওয়ালে-র সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা করি এবং ভারতীয় সেনা আক্রমণ করার দুই বা তিন দিন আগে ওঁর সঙ্গে কথা বলি। আমি আকালি দলের নেতাদেরও চিনতাম।
শিরোমণি গুরুদ্বারা প্রবন্ধক কমিটির প্রধান গুরচরণ সিং তোহরা-কে শেষ ইন্টারভিউ করেছিলাম আমি, ব্লু স্টার-এর বহু বছর পর। আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম (আমার হিন্দির জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলাম): ‘গুরচরণজি, আপকি কেয়া ইচ্ছা হ্যায়? আপ খালিস্তান চাহতে হ্যায় ইয়া নহি চাহতে হ্যায়?’ (‘গুরচরণজি, আপনার ইচ্ছেটা কী? আপনি কি খালিস্তান চান, না কি চান না?’) তোহরা একটু হেসে আমাকে বলেছিলেন, ‘টালি-জি, জিন্দেগি মেঁ কুছ কুছ ইচ্ছা হ্যায়, জিসকো ছিপানা হ্যায়!’ (‘জীবনে কিছু কিছু ইচ্ছা আছে, যা লুকিয়ে রাখতে হয়!’) দুঃখের বিষয়, এর পরের দিন উনি মারা যান। আমি লঙ্গোয়াল, বাদল এবং আরও কিছু নেতাদের চিনি।
১৯৮৩ থেকে ১৯৯১, ব্লু স্টার থেকে রাজীব গান্ধী হত্যা, একটা বড় আলোড়নের সময় ছিল।
বড় আলোড়ন শুধু নয়, বড় হতাশার সময়ও। ভারতের দিগভ্রষ্ট হয়ে পড়ার একটা সম্ভাবনাও ছিল। কেউ কোনও দিশা, এগিয়ে চলার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিল না। রাজীব গান্ধী বহু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন: অসম, শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদ, দেশের অর্থনীতি। কিছু সময়ের জন্য মনে হয়েছিল যে উনি একটা বদল আনবেন, যেহেতু উনি অসম এবং পাঞ্জাবে চুক্তি সই করেছিলেন। মনে হয়েছিল, উনি একজন যুগোপযোগী, আধুনিক নেতা, দেশের আধুনিকীকরণের স্বার্থে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মনে হয়েছিল নড়বড়ে, পুরনোপন্থী, সেকেলে ভারতবর্ষ বুঝি তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। কিন্তু যখন রাজীব গান্ধী উন্নতির রাস্তা দেখাতে পারলেন না, তখন ভারতের পক্ষে সেটা খুবই দুর্ভাবনার সময় হিসেবে হাজির হল।
রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর পি ভি নরসিংহ রাও যখন ক্ষমতায় এলেন, ব্যাপারটা তখন একটা সঙ্কটের জায়গা থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল, কেননা রাও এই মরিয়া অবস্থাটাকে যতটা সম্ভব কাজে লাগিয়েছিলেন। এবং ঠিক এটাই দেশের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, ভারতের আশা ফিরিয়ে এনেছিল।
বর্তমান মিডিয়ায় দেখা যায়— চরম মনোভাবাপন্ন একটা টার্গেট গ্রুপ দর্শক, আর কয়েকজন সংবাদ-উপস্থাপক যাঁরা নিজেদের মনে করছেন সব কিছুর ঊর্ধ্বে— এই অবস্থা সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা?
সত্যি কথা বলতে কী, ছাপার অক্ষরে এখনও কিছু ভাল রিপোর্টিং এবং ওপ-এড (উত্তর সম্পাদকীয়/মতামত) লেখা দেখা যায়, কিন্তু যাকে বলে ‘গোদী মিডিয়া— অর্থাৎ কিনা সরকারের কোলে বসে থাকা সংবাদমাধ্যম— এই মুহূর্তে প্রাধান্য বজায় রেখে চলেছে। ইমার্জেন্সির সময় আমরা যারা সেন্সরশিপের মুখোমুখি হয়েছি, এটা তার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। একেবারে প্রকাশ্যে না হলেও, সরকার যে নানা ভাবে তার ক্ষমতা ব্যবহার করে সংবাদমাধ্যমকে প্রভাবিত করে চলেছে, তা পরিষ্কার।
টেলিভিশন মিডিয়ার অবস্থা খুবই হতাশাজনক, সাংবাদিকতা এবং প্রযোজনার মান খুবই নিচু। কয়েক জন উপস্থাপক প্রয়োজনের চেয়ে বেশি উগ্র, বাকিদের কথা বলার কোনও সুযোগ তো দেনই না। কিছু সাংবাদিক এত তাড়াতাড়ি কথা বলেন যে তাঁদের বক্তব্যের একটা শব্দও বোঝা যায় না।
এক বা দুজন সঞ্চালক অসাধারণ, যেমন এনডিটিভি-র রভিশ কুমার। সরকার ওঁর মাথায় চড়ে বসতে পারেনি। বিনোদ দুয়া-ও দারুণ, কিন্তু উনি একটা ইলেকট্রনিক চ্যানেলে আছেন। কয়েকটা ইলেকট্রনিক চ্যানেলে খুব ভাল কাজ করছে, যেমন আমি ‘দ্য ওয়্যার’ (The Wire) নিয়মিত ভাবে অনুসরণ করি।
এর সঙ্গে আছে সোশ্যাল মিডিয়া, কিন্তু আমি লজ্জিত যে আমার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। এটা হয়তো ভুল, কিন্তু যেহেতু আমি নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত মনে করি, নতুন উন্নয়নের ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রয়োজনও বোধ করি না।
বহু মিডিয়া হাউসে এখন যা প্রায় আদর্শ, সেই ভুল বা মিথ্যা খবর (ফেক নিউজ) এবং প্রকাশ্যে পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্টিং সম্বন্ধে আপনি কী বলবেন?
এটা কিন্তু সবসময়ই ছিল। তুমি একবগ্গাদের জন্য লিখছ, একবগ্গাদের দিকে তাকিয়েই টেলিভিশনে কথা বলছ। ব্রিটেনে ‘ডেলি মেল’ খুবই স্পষ্টভাবে দক্ষিণপন্থী, ‘ডেলি মিরর’ একেবারেই বামপন্থী, ‘দ্য গার্ডিয়ান’-কে লিবারেল বলে বর্ণনা করা হয়, সুতরাং একপেশে প্রবণতা বিরল কিছু নয়। কিন্তু ভারতে বিবিসি-র মতো কোনও সংবাদসংস্থা নেই। যখনই কিছু ঘটে, ধরা যাক একটা বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের মতো কিছু, জনসাধারণের পক্ষে সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য খবর পাওয়ার একটা সম্প্রচার-সংস্থা থাকা উচিত। ব্রিটেনে আজও জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ বিবিসি-কে খবরের উৎস মেনে চলেন। বহু বছর আগে, জর্জ ভার্গিস এমন একটা পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টার-এর জন্য লড়াই করেন, এবং সেখান থেকেই ‘প্রসার ভারতী’র জন্ম। কিন্তু এটাও এখন আর জনসাধারণের সুবিধার্থে নিবেদিত সংবাদমাধ্যম নয়, কারণ এটি পরিচালনা করে কেন্দ্রীয় সরকার।
বেশ কয়েক বছর আগে আমি একটা দক্ষিণ এশীয় দেশের রেডিও কনফারেন্স-এ গিয়েছিলাম। লজ্জার কথা, আমি যে-দেশে থাকি, সেই ভারতবর্ষের রেডিও সম্প্রচার বোধহয় সবচেয়ে কম উদারমনস্কতার পরিচয় দিয়েছিল। এই কথা তখনও সত্যি ছিল, আজও তাই। এদেশে প্রাইভেট রেডিও চ্যানেল সংবাদ সম্প্রচারের অনুমতি পায় না।
সমস্যাটা হচ্ছে— যে প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিক নেতাদের পরিচালনা করা উচিত, বা তারা যেন সবকিছু নিয়ে পালিয়ে না যেতে পারে, সেটা দেখা উচিত— সেই প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট ক্ষমতাবান নয়। এবং দেশের মানুষের মতামত তো শোনাই যায় না, কারণ নেতারা দিব্যি পার পেয়ে যান। বিচারকবর্গ, আমলাদের অক্ষমতা এবং পুলিশের জঘন্য অকর্মণ্যতা পুরো দেশের অসীম ক্ষতি করে চলেছে।
ভারতবর্ষ পরের বছর ৭৫-এ পা দেবে। এই দেশের জন্য আপনার আশা এবং আশঙ্কা কী?
ভারতবর্ষের সহনশীলতার ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে কেন্দ্রীয় শাসকদলের কীর্তিকলাপ যখন দেখি এবং এ-ও দেখি যে তাঁদের উচ্চপদস্থ নেতারা নীরব, তখন প্রতিষ্ঠানটি যে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে, সেই নিয়ে আমি দুশ্চিন্তায় থাকি।
ভারতের কাছে আমার আশা যে সে গোটা বিশ্বের কাছে উদাহরণস্বরূপ উন্নয়ন তুলে ধরবে। সে এমন একটা দেশ, যেখানে বহু দরিদ্র মানুষ থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্র কাজ করে, যে গণতন্ত্র দরিদ্রের সমস্যা দূর করে। আমার আশা ছিল, ভারত প্রমাণ করবে যে বহু ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব। যেখানে হিন্দু ধর্মের মতো একটা সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম, অন্য ধর্মের উপর নিজের প্রাধান্য কায়েম করার চেষ্টা করে না। আমি বিশ্বাস করতাম এবং এখনও করি যে ভারত তার ধার্য পথে ফিরে আসবে, কিন্তু আজ, ৮৫-তে দাঁড়িয়ে আমি জানি না যে সেই মুহূর্তটি আমি আর দেখতে পাব কি না!