নারীবাদী হলেই পুরুষদের ঘৃণা করতে হয়, অনেকেই এমনটা ধরে নেয়। কিন্তু সত্যি বলতে, নারীবাদীর কোনও লিঙ্গ হয় না। পুরুষেরাও নারীবাদী হতে পারেন, এবং বেশ কিছু মহৎ পুরুষ আছেন যাঁরা সত্যিই নারীবাদী। সহযোদ্ধা হিসেবে পুরুষদের পাশে না নিয়ে কয়েক শতাব্দীর ঐতিহাসিক অন্যায় এবং আরোপিত বৈষম্যের বিরূদ্ধে লড়াই করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমার পরম সৌভাগ্য, তেমনই একজন পুরুষ আমায় কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন।
এমন একটা সংসারে আমি বড় হয়েছি, যেখানে মা কাজে যেতেন, আর বাবা থাকতেন বাড়ি। আমার বাবা চিত্রশিল্পী, সে সময়ে বাড়িতেই ছিল তাঁর স্টুডিও। অতএব মা’রা অফিস যায় আর বাবা’রা বাড়ি থাকে, এটাকেই স্বাভাবিক ধরে নিয়ে আমার বড় হয়ে ওঠা। বাবারা বুঝি রান্না করে, ঘরদোর পরিষ্কার রাখে, আর অবসর সময় কাটানোর জন্য ছবি আঁকে! ভাবলে আনন্দ হয়, সাংসারিক ভূমিকার এমন উল্টো-পুরাণের সাক্ষী আমি এত ছোট বয়সেই হতে পেরেছিলাম। অবশ্য এ ব্যবস্থায় কিছু সমস্যাও ছিল বটে। যেমন, ইস্কুলের টিফিনবাক্স। বাবার সৃষ্টিশক্তির আঁচ গিয়ে পড়েছিল রান্নাঘরেও। আমার টিফিনটা রোজই হত বেশ আজগুবি বেয়াড়া রকমের, বন্ধুরা বড় ঈর্ষা করত সেই কারণে।
যা বলছিলাম, বাবা আদতে একজন শিল্পী। চিরকাল মানুষটা আমায় উৎসাহ জুগিয়েছেন সবকিছুকেই যাচাই করে নিতে, প্রশ্ন করতে, এমনকী ওঁর নিজের কথাকেও (এদিকে আবার আজকাল মেয়ে মুখে-মুখে এত তর্ক করে বলে অবাক হন)! সততা, নীতিবোধ এবং সংবেদনশীলতাকে বড় গুরুত্ব দিতেন বাবা। আমার ভাবতে ভাল লাগে, বাবার এই প্রধান মূল্যবোধগুলো আমি কিছুটা হলেও আপন করে নিতে পেরেছি। টাকাপয়সা, সাফল্য, খ্যাতি… এগুলো কোনওদিনই আমাদের আলোচনার অঙ্গ ছিল না। এমনকী পেশা বা কেরিয়ার নিয়েও কথা হয়নি। আমায় বরাবরই শেখানো হয়েছে, ‘যা আনন্দ দেয়, যা জীবনকে অর্থবহ করে তোলে, এবং যা মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার পাথেয়, তাকেই বলে কাজ।’ যাত্রাটাই আসল কথা, গন্তব্য নয়— এই বোধ নিয়ে যে বড় হয়ে উঠতে পেরেছি, তা আমার পরম আনন্দের বিষয়।
এমন একজন বাবার সঙ্গে থাকতে গেলে কিন্তু মাঝে মাঝেই সমস্যা হয়। সবাই এখনও মনে করে লোকটা পাগল। যে মানুষটা এই বছর আশিতে পড়বে, সে এতটা সরল, এতটা ‘ছড়ানো’, তার পয়সাকড়ি মাঝেমধ্যেই ফুরিয়ে যায়, চারপাশের দুনিয়াটার ব্যপারে সে এত জ্ঞানহীন— এটা কারও বিশ্বাস হয় না। বাবা অসম্ভব স্পষ্টবাদী, যে-গোত্রের সোজা-সাপটা কথা বলায় আমাদের সামাজিক শিক্ষা লাগাম দিতে শেখায়। এ ধরনের মানুষকে সবার পছন্দ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যারা বাবাকে বহুদিন চেনে, অথবা সহজাত ভাবেই মানুষের স্বরূপ চিনে ফেলতে পারে, তারা জানে লোকটা বস্তুতই এরকম! বাবাকে মানুষ যতবার যতভাবে ভুল বুঝেছে, আমার জীবনে দেখা আর কোনও মানুষকে বোঝেনি।
হয়তো অনেকটা এ কারণেই ব্যক্তিগত ভাবে মান্টোর প্রতি আমার এত টান। মান্টোর জীবনের যত গভীরে তলিয়ে দেখতে শুরু করলাম, মানুষটাকে আরও বেশি পরিচিত লাগতে শুরু করল। মনে হত, যেন আমার বাবার কথাই পড়ছি। মান্টোও ছিলেন সহজাত ভাবেই রীতিবিরুদ্ধ এবং সাহসী স্পষ্টবক্তা, মানুষ তাঁকেও প্রায়ই ভুল বুঝত। বাবার সঙ্গে মান্টোর এই আজব সাদৃশ্য এখানেই শেষ নয়— দু’জনেই হট্টগোলের মাঝে দিব্যি কাজ করতে পারেন (এবং সম্ভবত পছন্দও করেন), রান্না ভালবাসেন, গভীর ভাবে যত্নবান, সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে খুঁতখুঁতে, বন্ধু ছাড়াও আগন্তুকদের জন্যেও তাঁদের অবারিত দ্বার, এবং দু’জনেই স্নেহশীল পিতা। বাড়ির সমস্ত ঠিকে কাজ দু’জনেই স্বচ্ছন্দে করতেন। টাকাপয়সার তোয়াক্কা কেউই করতেন না, উদার বলে সুনাম ছিল।
কোনও কিছুকে লেবেল দিয়ে দিলে একটু সঙ্কীর্ণতা চলে আসে, তাও বলছি, মান্টোকে তাঁর সময় অনুসারে নারীবাদী বলাই চলে। নিজের জীবনের নারীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কগুলোর দিকে তাকালে এর প্রমাণ মেলে। মান্টোর মা, বোন, স্ত্রী, তিন কন্যা, এবং বান্ধবী ও সহলেখিকা ইসমাত চুঘতাই— লোকটার জীবনে এঁদের প্রত্যেকেরই ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ছাড়াও তাঁর লেখায় নারী-চরিত্রগুলোকে তিনি বিপন্ন, অসহায় অবলা হিসেবে দেখাননি। এই চরিত্রেরা গল্পে যে-যার নিজের ভবিতব্য নিজেই ঠিক করেছে, তার পরিণাম ভালই হোক বা মন্দ।
মান্টো ছিলেন আধুনিক মানুষ, নিজের যুগের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। নারীদের কষ্টভোগ, তাঁদের সংগ্রাম, তাঁদের ক্ষমতাশক্তি— এ বিষয়গুলো তিনি গভীর ভাবে বুঝতেন। আহমেদ শরীফ কশমি একবার মান্টোকে প্রশ্ন করেছিলেন, এতটা অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে তিনি নারীদের কী ভাবে বুঝতে পারেন। উত্তর এসেছিল, ‘একজন নারীকে বুঝতে হলে আগে একজন নারী হয়ে উঠতে হবে।’ একজন পুরুষের মুখ থেকে এমন উক্তি সত্যিই বিরল।
আমার নায়ককে এতটা গভীর ভাবে, এত কাছ থেকে চিনতে সাহায্য করেছে, একজন ‘মান্টো-গোত্রীয়’ বাবার সঙ্গে আমার বড় হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা। মান্টোকে নিয়ে সিনেমাটা বানাতে গিয়ে বাবাকেও আরও ভাল করে চিনতেও পেরেছি। দু’জনেই জটিল মানুষ, কিন্তু ওঁদের মূল চরিত্রটাকেই এত ভালবাসি, এত ঈর্ষা করি, এত সমীহ করি।