সম্পদের দেবী লক্ষ্মী আর বিদ্যার দেবী সরস্বতী ঝগড়াঝাঁটি করে কোনও দিন এক জায়গায় থাকতে চান না, ছোটবেলা থেকে এমনটাই শুনে বড় হয়েছি। বড়লোক ব্যবসায়ীরা সচরাচর শিক্ষিত হন না (বিল গেটস আর স্টিভ জোবস দু’জনেই মাঝপথে কলেজ ছেড়ে দেন, এ কথা বার বার মনে করানো হয়), আর শিক্ষিত মানুষের কপালে সাধারণত দারিদ্রই জোটে (আজীবন লাঞ্ছিত মধ্যবিত্তের দুঃখ)— লক্ষ্মী-সরস্বতীর লড়াইয়ের ধারণার মূলেও আছে এই পর্যবেক্ষণ। সরস্বতীকে মূলত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, এবং জ্ঞান অর্জনের দেবী হিসেবে ভাবা হয় বলেই এ ধারণার উৎপত্তি। দেবী সরস্বতীর এহেন মূল্যায়ন খানিকটা খেলো, এ ক্ষেত্রে খুঁটিয়ে দেখা এবং তলিয়ে ভাবার অভাব রয়েছে।
সরস্বতী শব্দটি আসছে সংস্কৃত ‘সরস’ ধাতু থেকে— অর্থাৎ যে-বস্তু বহমান, যাকে কেবল ‘সরোবর’-এ ধরে রাখা যায়, অথবা নদীর (‘সরিতা’) স্রোতে বইয়ে দেওয়া যায়। এই রূপক আসলে যে-জিনিসটির কথা বলছে, সেটি কল্পনাশক্তি— এমন একটি গুণ, যা মানুষ এবং পশুর মধ্যে পার্থক্য গড়ে তোলে। অবশ্য কল্পনা করার ক্ষমতা ডলফিনেরও আছে, এ তর্ক করাই চলে, এমনকী বাঁদরেরও। তবে মানুষের কল্পনাশক্তি যে-মাপের কীর্তি সাধন করতে সক্ষম, তার সঙ্গে পশুরা এঁটে উঠতে পারে না।
মানুষের কল্পনাশক্তি তাকে ভবিষ্যৎ সমস্যার ব্যাপারে আগেই অনুমান করার ক্ষমতা দেয়, এবং সে-সূত্রেই দেয় সমাধানের বুদ্ধি, নতুন পথ আবিষ্কারের ক্ষমতা, এবং এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের হাতে এই অর্জিত জ্ঞান তুলে দেওয়ার ক্ষমতা। পশুদের কল্পনা তাদের এই ক্ষমতা দেয় না। প্রত্যেক প্রজন্মের মানুষ তার আগের প্রজন্মের অর্জিত জ্ঞানের সুযোগ নিয়েই আরও বেড়ে ওঠে। একটি প্রজন্ম আগুনের ব্যবহার শিখেছিল, আর এক প্রজন্ম গাছেদের জন্ম-মৃত্যুর নিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি শিখে আবিষ্কার করল কৃষিবিদ্যা, আরও এক প্রজন্ম আবিষ্কার করল চাকা, আর একটি প্রজন্ম বিদ্যুৎ শক্তি, আর একটি প্রজন্ম মাইক্রোচিপ— একের পর এক আবিষ্কার পালটে দিয়েছে আমাদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার খোল-নলচে। এক লক্ষ বছর আগেকার পূর্বপুরুষদের সঙ্গে আমাদের শরীরের জেনেটিক রসায়ন একই রয়ে গেছে বটে, তবে আমরা যে তাদের থেকে সম্পূর্ণ অন্য ধারার জীবনযাপন করছি, তার মূলে রয়েছে কল্পনাশক্তি। কল্পনাশক্তি ছাড়া আমরা অনুমান করতেই পারতাম না, আর সেই অনুমান প্রমাণ খুঁজতে খুঁজতে নতুন জ্ঞানের জন্ম দিত না।
সরস্বতীকে ছাড়াই লক্ষ্মীর আগমন ঘটে শুধু দুটো ক্ষেত্রে— লটারি জিতলে, অথবা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি অর্জন করলে। কোনও এক বড়লোক কাকা আমাদের নামে বিপুল সম্পত্তি রেখে মারা গেলে সেটা আমাদের সৌভাগ্য। আবার কোনও ক্যাসিনোতে জুয়া খেলে টাকা জিতলে সেটাও সৌভাগ্য। একে অবশ্য ঈশ্বরের কৃপা অথবা পূর্বজন্মের কর্মফলও বলতে পারি। তবে অন্য সব ক্ষেত্রেই লক্ষ্মীকে পেতে হলে সরস্বতীর প্রয়োজন। সর্ব শ্রেণির জ্ঞান এবং নৈপুণ্যই আসলে সরস্বতী। যত জ্ঞান আমাদের থাকবে, কাজে আমরা তত নিপুণ হব, আর ততই বেশি হবে আমাদের সম্পদ সৃষ্টি করার সম্ভাবনা। কৃষক খাদ্যশস্যের জন্ম দিতে পারেন, কারণ তিনি কৃষিবিদ্যায় জ্ঞানী। কর্মকার মূল্যবান সব সামগ্রী গড়তে পারেন, কারণ তিনি সৃষ্টি করার বিদ্যা অর্জন করেছেন।
শুধু সম্পদ সৃষ্টি করতে নয়, তাকে ধরে রাখতে গেলেও সরস্বতীর প্রয়োজন। কৃষক বা কর্মকারের যদি ব্যবসায়িক বোধবুদ্ধি না থাকে, তবে অর্জিত ধনসম্পদ হারিয়ে ফেলতে তাঁরা বাধ্য। তাঁদের দরকার বাজারের রীতিনীতি বুঝতে পারা, ক্রয়-বিক্রয়ের হিসেব জানা। হয় তাঁদের আর্থিক হিসেবনিকেশ শিখতে হবে, নয় সে-হিসেবে পারদর্শী কারও সাহায্য নিতে হবে। বণিকেরও সরস্বতীর প্রয়োজন, ব্যাঙ্কারেরও। এমনকী একজন গৃহবধূরও সরস্বতীর প্রয়োজন— বাড়ির নানা তাৎক্ষণিক বা দীর্ঘকালীন প্রয়োজনে কোথায় কতটা টাকা লাগবে, সেই বিদ্যা এবং বুদ্ধির জন্য।
আমরা সরস্বতী বলতে বুঝি কেবল স্কুলে শেখানো বিদ্যা। অথচ স্কুল বলতে আধুনিক সমাজে আমরা যা বুঝি, ইংরেজরা এ দেশে আসার আগে কিন্তু সে-জিনিস ছিল না। অর্থনৈতিক সমাজ তখন গুরু-শিষ্য বা ওস্তাদ-শাগরেদ সংস্কৃতির ভিত্তিতে কাজ করত। মাটির কাজের সরস্বতী-বিদ্যা কুমোর শিখিয়ে যেতেন তাঁর ছেলেদের, রান্নাবান্নার সরস্বতী চলে যেতেন মায়ের থেকে মেয়েদের কাছে। সে-সরস্বতী যত উচ্চমানের, কুমোর বা গৃহবধূর সাফল্য তত বেশি।
সরস্বতীর অতএব নানা রূপ, তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রকট স্কুল-কলেজ বা ওস্তাদ-শাগরেদ সংস্কৃতির মাধ্যমে শেখানো বিদ্যা ও জ্ঞান। তবে সরস্বতীর যে-রূপটি অন্যকে শেখানো যায় না, সেটি হল প্রজ্ঞা। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রজ্ঞা হস্তান্তরিত করা সম্ভব নয়, তাকে অর্জন করতে হয় তপস্যা এবং আত্মচিন্তার মাধ্যমে। এই প্রজ্ঞারই অভাব চোখে পড়ে, যখন লক্ষ্মী পেয়ে আমরা সরস্বতীর কদর করতে ভুলে যাই। আমাদের তখন এই বিশ্বাস জন্মায় যে, ধনদৌলত আমরা মায়াবলে এমনি-এমনিই পেয়ে গেছি, এবং মায়াবলেই সে-সম্পত্তি আমাদের হাতে থাকবে। সরস্বতীর প্রকৃত ছাত্র কিন্তু জানে যে, ধনদৌলত কখনওই চিরকাল থাকে না, ভবিষ্যৎ অভাবের কথা ভেবে আমাদের আগে থেকেই সচেতন হওয়া দরকারি। একটি বিখ্যাত সফ্টওয়্যার সংস্থা কর্মীদের আনুগত্যে ভর করে বাজার থেকে মুনাফা লুটতে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, নতুন প্রতিভাকে লালন করার কোনও রকম উদ্যোগ নেয়নি এবং পরবর্তী সারির নতুন প্রতিভাদের আরও উপযুক্ত হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করে দেয়নি। অতএব বাজারের অবস্থা যখন আমূল পালটে গেল, তখন অবধারিত ভাবেই তারা যোগ্য, বুদ্ধিমান নেতৃত্বের অভাবে মুশকিলে পড়ল। সরস্বতীর (এ ক্ষেত্রে জ্ঞান, প্রজ্ঞা বা উৎকর্ষের) একটা সীমা আছে— এমনটা ধরে নিলে এ-ই হয়।
সম্পন্ন পরিবারের ক্ষেত্রে, সংসারের স্বাভাবিক, ঘরোয়া জ্ঞানে ভরসা রাখাটা বিরল। তাঁদের ধারণা: জ্ঞান অর্জন কেবল মার্কামারা স্কুল-কলেজের বিষয়। এ সমস্যা দেখতে পাই ভারতবর্ষের সেই সব ঘরে, যাঁদের ছোট বা মাঝারি পারিবারিক ব্যবসা রয়েছে। তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ইউরোপ-আমেরিকাতে বাণিজ্যবিদ্যায় ডিগ্রি পাবার জন্য পাঠান, তারপর সেই ছেলেমেয়েরা হয় আর দেশে ফিরতে চান না, নয় পারিবারিক ব্যবসায় (সম্পদে নয়) নানা রকম ঘৃণ্য ব্যাপার খুঁজে পান। বাপ-ঠাকুরদার পারিবারিক ব্যবসার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ইন্টারনেট জগতের আন্তর্জাতিক বাজারের নিরাপত্তায় তাঁরা চাকরির সুযোগ খুঁজতে থাকেন।
একটি লোকায়ত প্রবচন রয়েছে— সুসময়ে লক্ষ্মী আমাদের কাছে আসেন, আর সরস্বতী দূরে চলে যান, আবার দুঃসময়ে কাছে আসেন সরস্বতী, দূরে চলে যান লক্ষ্মী। এই দুই ক্ষেত্রেই সরস্বতীকে প্রাধান্য দেওয়াটাই আসলে বুদ্ধিমানের কাজ। সুখের সময়ে তিনি আমাদের শেখান, কী ভাবে এই ধন-সম্পদের বৃদ্ধিকে সাবধানে, যত্ন করে, বহু দিন ধরে রাখা যায়। আবার দুঃখের সময়ে তিনি শিক্ষা দেন, কী উপায়ে দুর্ভাগ্য থেকে সৌভাগ্যের দিকে নিজের কপাল ফেরানো যায়। লক্ষ্মী থাকুন বা না-থাকুন, বাঁচতে হলে এবং সাফল্য পেতে হলে, সরস্বতীকে সর্বদাই প্রয়োজন।
দেবদত্ত পট্টনায়েকের আরো লেখা পড়তে দেখুন www.devdutt.com. তাঁর লেখার প্রথম বাংলা অনুবাদ কী করে হবে লক্ষ্মীলাভ কিছুদিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে।