সম্প্রতি আমার ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কখন আমি ঘুম থেকে উঠি। হাসি চাপতে পারিনি। বললাম, ‘যখন এক্কেবারে না উঠলেই নয়!’
সত্যি বলতে, আমি চিরকাল নিশাচর জীবনের দিকেই ঝুঁকেছি, সে আমার অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপারস্যাপার ভাল লাগে বলেই হোক, বা ওই সময়টা সবচেয়ে শান্ত, নিঃশব্দ থাকে বলেই হোক। নীরবতা আমার খুব ভাল লাগে, নিতান্ত প্রয়োজন বলেও মনে হয়। তবে এই প্যানডেমিক এসে, আমাকে ‘অনেকটা নিশাচর’ থেকে একেবারে ‘পুরোপুরি নিশাচর’ প্রাণীতে বদলে দিয়েছে। জেগে আছি কি না, মেসেজ করে আগে না জানতে চেয়েই যখন কেউ রাত তিনটেয় ফোন করে, তখন খুব উদ্ভট লাগে না। অন্তত আমার লাগে না। আমার সব বন্ধুরা ধরেই নেয় যে আমি ঠায় জেগে থাকি, এবং এই রাত-জাগা বন্ধুদের কথা জেনে আমারও স্থির বিশ্বাস হয় যে আমি একা নই, এই বিশ্বব্যাপী অতিমারী অনেকেরই ঘুমের সময় আমূল বদলে দিয়েছে।
কিছু বহুমূল্য পারিবারিক মুহূর্ত বাদে, নিজের পরিবারের সঙ্গে ২৪x৭ বন্দি থাকাও একটি চ্যালেঞ্জ। তবে ভেবে দেখেছি, মাঝে মাঝেই কিছু সুস্বাদু সুখাদ্য তৈরি হয়ে এলে বাড়ির লোকেরা খুব খিটখিটে হয়ে ওঠার সুযোগ পায় না। এই কারণেই, গত দশ মাসে আমি রান্নাঘরে এত সময় কাটিয়েছি যে, আর পেঁয়াজ কাটতে-কাটতে কাঁদি না। আবার এ-ও হতে পারে, দীর্ঘ ঘুম না-আসা রাতগুলোয় আমার সব কান্নার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।
আমার ছাত্রীজীবন শেষ হওয়ার আগে হয়তো আর কখনও কলেজ যেতে পারব না, কলেজের অন্তিম গণ্ডিতে পৌঁছে এই সম্ভাবনা মেনে নেওয়া খুবই কষ্টের। মেনে নেওয়া কঠিন যে, আমরা পাশ করে বেরোব বটে, কিন্তু যেন খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে, কোনও সমারোহ ছাড়াই।
এই কথা তুললাম কেননা ঘুমহীন প্রতি রাতেই এই ধরনের ভাবনাচিন্তা আমাকে জাগিয়ে রাখে। অতি-চিন্তার ঘূর্ণিঝড়। তবে আমার পছন্দের আবহসঙ্গীতের মাধ্যমে আমি তা থামিয়ে রাখি।
গানের পর গানে ডুবে থেকে আমার মনের জট অনেকটা খুলে আসে। এই গান শোনা কাজটাই আমি সবচেয়ে বেশি করেছি এই সময়টায়, এবং আমার এই ভাল লাগাকে আমি প্রাণ ভরে উপভোগ করেছি, অতিমারীও থামাতে পারেনি।
আর কী কী করে কাটল এই সূর্যের অন্ধকার দিকটায় যাপন করা জীবন? সকলেরই মতো, ওয়েব সিরিজের এপিসোডের পর এপিসোড দেখে, আর এক রাত্তিরেই একাধিক বই পড়ে। ও, ভুলেই যাচ্ছিলাম, আর একটা জিনিসও আছে: অবাধে এটা-ওটা খাওয়া। বাড়ির ফ্রিজটা আমার ঘরেই থাকায় খুব সুবিধা হয় বইকি।
তবে এই রাত জাগা গল্পের একটা খুব নান্দনিক দিকও আছে, ধীরে ধীরে ফুটে ওঠা ভোরের আলোর সৌন্দর্য আজ আমি উপভোগ করতে শিখেছি। আমি চিরকাল সূর্যাস্ত দেখতে, অর্থাৎ সূর্যের ঘুমিয়ে পড়া দেখতে ভালবেসেছি, কিন্তু প্রতিদিন ভোরবেলা সূর্যটাকে হাই তুলে আকাশ জুড়ে আড়ামোড়া ভাঙতে দেখাও একই রকম বিস্ময়কর। এই সূর্যোদয় দেখে আমার প্রায়— এখানে ‘প্রায়’ শব্দটি খুবই তাৎপর্যময়— প্রাতঃভ্রমণে বেড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা হয়, যদিও সে-ঘটনা এখনও ঘটেনি।
সারা রাত জাগার পর দিনের ঘুমের অ্যাডভেঞ্চারের সময়, আমি প্রাতঃকালীন চিৎকার, ঝনঝন, ক্যাঁচকোঁচ— মানে বাঙালি গেরস্থালির সকালের হট্টগোলটাকে— সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার শিল্পে রীতিমতো পারদর্শী হয়ে উঠেছি। এমনকী, এইসব ঝামেলা মাঝে মাঝে অলৌকিক ভাবে আমার স্বপ্নগুলোর অংশ হয়ে ওঠে। ঘুম থেকে কেউ টেনে তোলার পর আমি বুঝতে পারি, যা আমি স্বপ্নে দেখছি বলে ভাবছিলাম, তা আদৌ অতটা কাল্পনিক ছিল না।
নিউ নর্মালকে ঘিরে জীবন যখন ধীরে ধীরে থিতু হচ্ছে, আমার ভোর অবধি জাগা রাতগুলোকে ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু একই সঙ্গে, এই ভয়ানক অতিমারীর থেকে পৃথিবী মুক্তি পাক, এই অপেক্ষারও তর সইছে না আর।