১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ঢাকার কলেজের ছাত্ররা ২১ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট করে, হরতাল ঘোষণা করে। এই হরতাল ঘোষণার পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলো এই আদেশ অমান্য করে অপরাহ্ণের দিকে প্রাদেশিক পরিষদের সামনে দিয়ে মিছিল করে। এই মিছিলে পুলিশ গুলি করে এবং তাতে জনা-পনেরো তরুণ নিহত হন।
আমি তখন ঢাকা সরকারি কলেজের ছাত্র। আমরা জানতে পারলাম, এই নিহত ছাত্রদের লাশ গুম করে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু এখনও একটি লাশ মেডিক্যাল কলেজের চত্বরে পড়ে আছে। তখন আমি, রফিকুল ইসলাম (বর্তমান নজরুল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক, তখন ছাত্র ছিলেন), আমার বন্ধু সিফক রেহান (পরে সাংবাদিক হন), মেডিক্যাল কলেজে যাই। সেখানে সাউথ ওয়ার্ডে একটি লাশ পড়েছিল। লাশটি ছিল শহীদ রফিকের। লাশটি দেখে আমার মনে হল, যেন আমার ভাইয়ের মৃতদেহ দেখছি। সেই দৃশ্যটি মনে বড় দাগ কাটে। তখন একটি কবিতার লাইন আমার মনে গুঞ্জরিত হয়। লাইনটি হল, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি!’ মনে মনে গুনগুন করতে করতে এলাম লাইনটা, ভাবলাম হস্টেলে গিয়ে লিখে ফেলব। হস্টেলে গিয়ে দেখি, সমস্ত ছাত্রাবাসগুলি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। তখন এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে কবিতার অর্ধেকটা লিখি, পরে আর এক বন্ধুর বাড়ি যাই, কারণ তখন ১৪৪ ধারা, কারফিউ জারি করা হয়েছে। তারপর কবিতাটি লেখা শেষ করি। এই সময়ে একটি গোপন প্রচার-পত্রে কবিতাটি ছাপা হয়। তা চোখে পড়ে আমাদের প্রয়াত সুর-শিল্পী আব্দুল লতিফের। তিনি কবিতাটিতে সুর দেন। এবং এটি ঢাকা সরকারি কলেজের ছাত্র পরিষদের অভিষেক-লগ্নে গাওয়া হয়। ফলে আমাকে সহ, ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। তখনকার যুবনেতা শেখ মুজিবর রহমান, জননেতা মৌলনা আব্দুল হামিদ খান, এ কে ফজলুল হক— এঁরা প্রতিবাদ করেন। একটি ছাত্র আন্দোলনও গড়ে ওঠে। ফলে ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই গানটি নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৫৩ সালে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে, একটি সাধারণ নির্বাচন ঘোষিত হয়। এই গানটি তখন নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও অনেকে গাইতে শুরু করে। সেই সময় আলতাফ মাহমুদ নামে আর এক সুরকার, বলেন যে, আমি এই গানটিতে আবার সুর দিতে চাই। তাঁর সুরেই গানটি জনপ্রিয় হয়। ১৯৫৪ সাল থেকে গানটি— ঢাকায় প্রতি ২১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে বিরাট যে মিছিলটি বেরোত— সেই মিছিলের বা প্রভাতফেরির গান হয়। ১৯৭১ সালে আলতাফ মাহমুদকে পাকিস্তানি হানাদারেরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে। আমার বন্ধুকেও হত্যা করা হয়, মনে করা হয় যে তাঁকে রাজাকারেরা হত্যা করেছিল। এর পর জহির রায়হান, তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি— যেটি এখন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত— এবং আমার লেখা এই গানটি সংযুক্ত করেন। এই সিনেমায় ব্যবহৃত হওয়ার পরই আমার গানটি আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গান হিসেবে ইউনেসকো (UNESCO) এই গানটি গ্রহণ করে। এবং ১১টি ভাষায় এই গানটি অনূদিত হয়ে এখন প্রতি ২১ ফেব্রুয়ারি এই গানটি গীত হয়।
এই গানের লেখক হিসেবে আমার একটা গর্ব আছে। একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আমরা দেখতে চেয়েছিলাম এবং আমাদের আশা ছিল সেখানে বাংলা ভাষা হবে রাষ্ট্রভাষা। আমাদের যে এক হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য, চর্যাপদ থেকে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ— এই ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে একটা জাতি তৈরি হবে, সে জাতির নাম হবে বাঙালি জাতি। দুঃখজনক ভাবে ১৯৪৭ সালে সেই জাতিকে রাজনৈতিক ভাবে বিভক্ত করা হয়েছে। তথাপি আমি মনে করি বাঙালি হচ্ছে একটা সাংস্কৃতিক জাতি এবং এর বিভাজন সম্ভব নয়। ২১ একটি অসাম্প্রদায়িক দিবস। যে কোনও ধর্মাবলম্বী বাঙালি এই দিনটি পালন করে এবং সেই দিবসের গান আমি লিখতে পেরেছি, এটি আমার জীবনের পরম গৌরব ও প্রাপ্তি।