স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়,কোন এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে
কিছুদিন আগে রাশিয়ার এক মিউজিয়ামে জনৈক রক্ষী চূড়ান্ত বোর হয়ে একটা দুর্মূল্য ছবির মুখের ওপরে নিজের কলম দিয়ে দুখান চোখ এঁকে দিয়েছিল। ডাকবাংলার ‘এক শালিক’-এ যখন চন্দ্রিল এই গল্পটা বলছিলেন, তখন ও পুরোপুরি বোঝা যায়নি যে রাশিয়ার থেকে শিগগিরই সম্পূর্ণ অন্যরকম খবর আস্তে শুরু করবে। সেই নতুন খবরের পিছনেও কি জনৈক রাষ্ট্রপ্রধানের কিছুটা বোর হওয়া কাজ করছে কি না, তা হয়তো পরে বোঝা যাবে। বাইবেলে বর্ণিত ভগবানও কি সৃষ্টির ছ‘দিনে নেহাত বোর হয়ে গিয়ে সপ্তম দিনে মানুষ তৈরি করেন? এসব জল্পনা তোলা থাকে পন্ডিতদের জন্য।
আপাতদৃষ্টিতে সোজা প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবা যাক।বোর হওয়া বা একঘেয়েমি ব্যাপারটা আসলে কী? কেনই বা কোনো জিনিস, বা কোনো সময় আমাদের একঘেয়ে লাগে, আর আমাদের মাথার মধ্যেই বা কী চলে?
একঘেয়েমি কে বুঝতে গেলে শুরু করতে হবে সম্পূর্ণ উল্টো দিক থেকে। আমাদের জিজ্ঞেস করতে হবে, নতুনের অর্থ কী ? এই প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত আমাদের মস্তিষ্কের মূলসূত্র। ব্রেনের প্রধান কাজ হল চারপাশের জগতে পরিবর্তন লক্ষ্ করা আর সচেতন করা। যা কিছু চেনা, অভ্যস্ত, তাদের জন্যে ইন্দ্রিয়রা বা মস্তিষ্ক সেভাবে কোনো পরিশ্রম করে না। যেই মুহূর্তে আমরা কিছু নতুন দেখছি/ শুনছি/ অনুভব করছি, সেখানেই আমাদের ব্রেনের কয়েকটি বিশেষ নিউরন (বা মস্তিষ্কের কোষ) সক্রিয় হয়ে ওঠে।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমি রোজ একটা মাঠ পেরিয়ে হেঁটে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। মাঠে প্রচুর গাছগাছালি, সবই সবুজ। খুব যে সব খেয়াল করি, তা নয়। ইন্দ্রিয়গুলো ও মস্তিস্ক অভ্যস্ত এই পরিবেশে, তাই একটা ধারণা বা আন্দাজ করে নিয়েছে — এই লোকটা রোজ এইরকম সময়ে মাঠ দিয়ে হেঁটে যায়, তাই চোখের সামনে যা দেখা যায়, তার প্রায় সবকিছুই সবুজ। যখন নিউরনগুলো একটা জিনিস প্রথম বার দেখে বা অনুভব করে, তখন তারা বেশ সজাগ থাকে। এই ‘সজাগ’ থাকাটা অনুমান করা যায় একরকম ইলেকট্রোড দিয়ে, বৈদ্যুতিক প্রবাহ মেপে। বহুবার একই রকম জিনিস দেখলে বা অনুভব করলে এই নিউরনেরা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে । এই ঝিমিয়ে পড়াটাকে (বৈজ্ঞানিকেরা যাকে ‘হ্যাবিচুয়েশন’ বলেন) এক ধরনের একঘেয়েমির প্রকাশ ধরা যেতে পারে । যদি প্রত্যেকটা নিউরনের একটা নিজস্ব সত্তা থাকত, তারা নিজেরা স্বাধীন ভাবে ভাবনাচিন্তা করতে পারত, তাহলে তারা হয়তো একশো বার এক দৃশ্য দেখলে নিতান্ত বোর হয়ে যেত। আধুনিক যুগের বিশিষ্ট আমেরিকান দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেট মানুষের চেতনার উৎস নিয়ে বলতে গিয়ে এরকমই এক সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে আমাদের প্রত্যেকের মস্তিষ্কে প্রায় আট হাজার কোটি নিউরন আছে; তাই তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ‘অনু-চেতনা’ বা তার বহিঃপ্রকাশ নিয়ে ভাবা সহজ নয়। মোটের ওপর, পরিবেশের সব কিছুই যখন বহুপরিচিত, তখন নিউরনরা একরকম আন্দাজ তৈরি করে নেয়। এ হেন আন্দাজের সঙ্গে হঠাৎ কিছুর ঠোকাঠুকি লাগে — ধরা যাক একটা গাছে ফুল এসেছে, তাই এক রাশ সবুজের মধ্যে হঠাৎ একটু সাদা দেখতে পাওয়া গেল, তাহলেই আবার সজাগ হয়ে ওঠে ওই বিশেষ নিউরনগুলো। এই ‘আন্দাজের অমিল’ -বা ‘প্রেডিকশন এরর’ হল এই নিউরনদের জাগানোর চাবিকাঠি। নিজেদের মধ্যে এই বিশেষ নিউরনরা যোগাযোগ রাখে ডোপামিন নামক একটি বিশেষ যৌগের সাহায্যে। মস্তিষ্কের মধ্যে হাতে গোনা যায় এইরকম কয়েকটি যৌগ আছে যাদের সাহায্যে নিউরনরা একে অপরের সাথে কথা বলে। এদের মধ্যে ডোপামিন অন্যতম, যেহেতু আমাদের বেশিরভাগ আনন্দ, উৎসাহ বা উত্তেজনার সঙ্গে এই যৌগটি অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। চারপাশের পরিবেশে পরিবর্তনের অভাব আর তার ফলে এই বিশেষ কয়েকটি নিউরনের শান্ত থাকাই হল বোর হওয়ার ভিতরের কথা। তবে শুধু নিউরন আর মস্তিষ্কের পরিপ্রেক্ষিতে ভাবলে একঘেয়েমিকে বোঝা অসম্পূর্ণ থাকবে।
মস্তিষ্কের কোষ থেকে বেরিয়ে আসি মনস্তত্ত্বের দুনিয়ায়। প্রশ্ন এক, তবে উত্তর আলাদা। মস্তিষ্ক বিজ্ঞান যেরকম নিউরন বা বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগের মাধ্যমে কোনোকিছুকে বোঝার চেষ্টা করে, মনস্তত্ব চেষ্টা করে সার্বিক প্রক্রিয়াটিকে বোঝার। গাড়ি চালাতে জানার সার্বিক প্রক্রিয়াটিকে বোঝা যদি মনস্তত্ত্ব হয়, তাহলে ইঞ্জিন বা কার্বুরেটর কী ভাবে কাজ করে সেটা জানা হল মস্তিষ্ক বিজ্ঞান।
কিছু না করাটাই কি বোর হওয়ার প্রধান কারণ? সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর যে মেয়েটি বাড়ি এসে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে জিরোচ্ছে, সে তো বোর হচ্ছেনা! আবার দিনের নয় ঘন্টা একই রকম এক্সেল শিট-এ কাজ করতে করতে আইটি কোম্পানির অনুগত কর্মীটি কিন্তু অনেক সময়ই প্রচন্ড একঘেয়েমির শিকার। একঘেয়েমিকে বোঝার খোঁজে সদ্য প্রয়াত চেক বৈজ্ঞানিক মিহাই চিকসেন্টমিহাই একটি সরল ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন আজ থেকে প্রায় চার দশকেরও আগে – যা আজও প্রযোজ্য (ছবি)।
যখন ক্ষমতা বেশি থাকে, আর সুযোগ বা অবকাশ কম, তখনই সূত্রপাত একঘেয়েমির। এর ঠিক উল্টো অবস্থা হল ক্ষমতা কম, আর সুযোগ বেশি থাকা —যাতে শুরু হয় দুশ্চিন্তা, এবং তারপর আতঙ্ক । এই দুই খাদের মাঝে এক শুঁড়িপথ গেছে যাতে ক্ষমতা আর সুযোগ নিজেদের মধ্যে একরকম সামঞ্জস্য রেখে চলে। এই মধ্যপথকেই চিকসেন্টমিহাই আখ্যা দিয়েছেন ‘মানসিক প্রবাহ’ বা ‘ফ্লো’। এই প্রবাহে থাকলে নিজের ক্ষমতা বা সুযোগ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার আর কোনো অবকাশ থাকে না। সহজ ভাষায়, ডুবে থাকাটাই ‘ফ্লো’। যখন শাহিদ পারভেজ সেতারে আলাপ করছেন, বা কুমার বোস বেনারস ঘরানার রেলা বাজাচ্ছেন তবলায়, তখন তাঁরা যেই প্রবাহে থাকেন— সেটাই ডুবে থাকা, যেখানে একঘেয়েমি বা দুশ্চিন্তার কোনো জায়গা নেই।
মনস্তত্ত্ব ও মস্তিষ্কবিজ্ঞান দিয়ে বোর হওয়ার প্রক্রিয়া এবং কলকব্জাকে বুঝতে হলে ব্যক্তিগত এবং পরিবেশের তারতম্যকে উপেক্ষা করা চলবে না। যেকোনো গাড়ির ইঞ্জিনের ক্ষমতার ওপর যেরকম কিছুটা নির্ভর করে সে কত জোরে যাবে, ঠিক সেই মতনই নিউরনদের মধ্যেও বেশ কিছু তারতম্য দেখা যায়— কে কত সহজে ঝিমিয়ে পড়ছে, বা কে কত শিগগিরই আন্দাজের অমিল টের পেয়ে আবার সজাগ হয়ে উঠছে। আবার মনস্তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে ভাবলে ব্যক্তিগত ক্ষমতার তারতম্যও প্রচুর, তাই এক-একটা জিনিস কারুর কাছে খুব একঘেয়ে লাগলেও অন্যদের কাছে তা ডুবে থাকার রসদ।
একঘেয়েমি কী এবং কেন-র উত্তর খোঁজাটা অপেক্ষাকৃত ভাবে সহজ হলেও একে ঠেকানোর উপায় খোঁজা অনেক কঠিন। মানুষ চিরকালই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে- তবে গত দুবছরের বিভিন্ন লকডাউন-এর মধ্যে দিয়ে গিয়ে আমরা প্রত্যেকেই বিশেষ ভাবে ভুক্তভোগী। নতুনত্ব খোঁজার মরিয়া প্রচেষ্টায় কেউ বা দুর্মূল্য ছবিতে চোখ এঁকে দিচ্ছেন, আর কেউ বা চলেছেন যুদ্ধে।
একঘেয়েমি থেকে এই আমরণ পালিয়ে বেড়ানোটাই কি জীবনানন্দের বোধ?
ছবি এঁকেছেন অনুষ্টুপ সেন