গলাই যাঁর পরিচয়
প্রথম পরিচয় ওঁর সঙ্গে গানের মাধ্যমে। ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটি শুনে শুনে ঠোঁটস্থ করে ফেলি। কিন্তু হায় কপাল, গলাটা সেই কিংবদন্তি শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের ধারেকাছে পৌঁছায়নি। ১০ বছর বয়স থেকে শুরু করে ২০-তেও যখন হল না, গান শোনাটাকেই বেছে নিলাম শখ হিসেবে। সুচিত্রা মিত্রের গান দিয়ে শুরু হত দিন। মাও ছিলেন ওঁর ফ্যান। রেডিও বা রেকর্ড, পরবর্তীতে ক্যাসেট মারফত বাজত ওঁর গান। সুচিত্রা মিত্র যখন চুল কেটে ফেললেন একেবারে ছোট করে, আমার মাও অনুপ্রাণিত হয়ে ওঁকে অনুসরণ করলেন। মা’রও ছিল সাদা-কালো গোলমরিচ-রঙা চুল। চোখে চশমা। তাই অনেকে ভাবতেন, মা বোধহয় সুচিত্রা মিত্রের বোন। আর আমি ভাবতাম, ইস, এটা যদি সত্যি হত! তাহলে অনেক কাছ থেকে জানতে পারতাম ওঁকে। তখন তো ভাবিনি ভবিষ্যতে কী হতে পারে।
‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্যের রেকর্ডে ‘না যেও না, যেও না গো, মিলন পিয়াসী মন’ গানটির মধ্যে সুচিত্রা মিত্রের যে গলার আর্তি ছিল, তা আমার বয়ঃসন্ধির প্রেম ভেঙে গেলে মনে বেজে উঠত। বারবার শুনতাম গানটি আর ভাবতাম, আমি যদি এই গানটা আমার ও-কে শোনাতে পারতাম, তাহলে ও নিশ্চয়ই ছেড়ে যেত না আমাকে। কিন্তু আমাদের সময় তো হোয়াটসঅ্যাপ ছিল না, তাই গানটি পাঠাতে পারিনি।
এই কিংবদন্তির সঙ্গে আমার দেখা হল যখন, আমার বয়স ২৬। আশির দশকের মধ্যভাগ। আমি কাজ করি একটি মহিলা-পত্রিকায়, যার সম্পাদক অপর্ণা সেন। সেই পত্রিকায় আমাদের সহকর্মী ছিলেন বিবি রায়। বিবিদির সঙ্গে উত্তমকুমার থেকে সুচিত্রা মিত্র— সবার পরিচয় ছিল। দুঃখের বিষয়, মধ্য-আশির দশকে উত্তমবাবু বেঁচে ছিলেন না। কিন্তু বিবিদির দৌলতে সুচিত্রা মিত্র ও সমরেশ বসুর সঙ্গে ডিনার করার প্রথম অভিজ্ঞতা আজও মনে আছে। খেতে বসার আগে চলছিল আড্ডা। সঙ্গে হট আর কোল্ড পানীয়। সমরেশদা বলে চলেছেন, বিভিন্ন সময়ে নারীদের নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা। আর সুচিত্রা মিত্র তা শুনে শুধু মিটিমিটি হাসছেন। সারা জীবন ওঁর গান শুনে বা ওঁর চেহারা দেখে মনে হয়েছে, অবশ্যই দূর থেকে, যে উনি বোধহয় একটু রাগী ধরনের। কিন্তু সেদিন বুঝলাম ইংরেজি প্রবাদ ‘লুকস আর ডিসেপ্টিভ’-এর আক্ষরিক অর্থ । সুচিত্রা মিত্রের রসবোধ, তাঁর জীবনবোধ আমাকে মোহিত করে তোলে। ওঁর সঙ্গীতজীবনের অভিজ্ঞতা, গান গাইতে বাধা, শারীরিক অসুস্থতা— কত কিছু নিয়ে চলল আলোচনা। এর মধ্যে সমরেশদা উত্থাপন করলেন তৎকালীন অসম সমস্যা বা শ্রীলঙ্কার এলটিটিই নিয়ে দেশের অবস্থানের প্রসঙ্গ। সব বিষয়েই সুচিত্রাদির ছিল সুস্পষ্ট মতামত। কথা বলতে বলতে যখন আবহাওয়া বেশ গরম হয়ে ওঠে, সমরেশদা গানের কথায় আসেন।
সুচিত্রাদি শরীরের, গলার সমস্যার কথা বলতেই সমরেশদা বলে ওঠেন, ‘গায়িকাদের এই দোহাই দেওয়া বয়স হলেও যায় না।’ শুনেই গাইতে শুরু করে দিলেন সুচিত্রাদি, কিন্তু সত্যি ওঁর শরীর ও গলা তখন ভাল নেই। ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ গাইতে গাইতে গলা ভেঙে গেল, চোখে তাঁর জল… গান গাইতে না পারার অসহায়তা! আমরা সবাই চুপ।
এরপর মাঝেমধ্যেই দেখা হয়েছে। তারপর কাট টু ১৯৯৬। ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘দহন’ ছবি করবেন। তাতে ঝিনুকের ঠাকুমার ভূমিকায় ভাবলেন সুচিত্রা মিত্রকে। চলে গেলাম গাড়িয়াহাটে ওঁর ফ্ল্যাটে। অভিনয় করতে রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু চিত্রনাট্য ও ছবিতে ওঁর চরিত্রের ভূমিকা শুনে রাজি হলেন।
উনি ছিলেন সেই ঠাকুমা যিনি স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। কারণ তিনি স্বাবলম্বী। বললেন, ‘আমার সঙ্গে মিল আছে।’
‘তাই তো তোমাকে অভিনয় করতে বলছি’, ঋতুপর্ণর অকপট স্বীকারোক্তি।
বজবজের কাছে একটি পরিত্যক্ত মিলে সেট করা হল বৃদ্ধাশ্রমের। বড় ঘর, পাশে বারান্দা। তাতে পায়রা ঘুরছে। পাশেই নদী। তবে সুচিত্রাদির বাড়ি থেকে সেখানে আসতে লাগে পাক্কা দু’ঘণ্টা। আমরা যেহেতু লোকেশনে থাকছিলাম, তাই সকাল থেকে রেডি হয়ে অপেক্ষমাণ সুচিত্রাদির জন্য। আমি তখন ইউনিটে একমাত্র মহিলা সহকারী, তাই ওঁকে দেখাশোনার ভার আমার। তাছাড়া সদ্য মোবাইল এসেছে। ইউনিটে আমার, ঋতুর আর শৌভিকের শুধু মোবাইল। শৌভিক গেছে ওঁকে আনতে। আমরা ঘন ঘন ফোন করছি। কতদূর? কারণ প্রেস এসেছে, এমনকী প্রোডিউসারও এসে গেছেন। প্রযোজক সুচিত্রা মিত্রের নাম শুনেছেন, চাক্ষুষ করেননি। প্রেসের উত্তেজনা দেখে তিনি বেশ চমৎকৃত। মাঝে মাঝেই ফোন করে খবর নিচ্ছিলেন, ‘হু ইজ দিস সুচিত্রা মিত্র?’ কিছুক্ষণ পর নিজে ছুটে এলেন, দারুণ উত্তেজিত হয়ে ঋতুকে বললেন, ‘আমি ওঁকে প্রথম রিসিভ করব।’ ঋতু রাজি। প্রযোজক প্রেসকে বললেন, আমার ছবি নেবেন কিন্তু সুচিত্রাজির সঙ্গে। আর প্লিজ পাঠিয়ে দেবেন আমাকে এক কপি।
অবশেষে পৌঁছলেন সুচিত্রাদি। সবাই হুড়মুড় করে এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। সবার আগে ফুলের তোড়া নিয়ে প্রযোজক। সুচিত্রাদি নামলেন। সাদা শাড়ি, চশমা পরা, প্রসাধনহীন সত্তর-ঊর্ধ্বের প্রতিভময়ী ব্যক্তিত্বকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলেন প্রযোজক। ফুল দিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন চুপিচুপি, ‘ইনিই কি উত্তমকুমারের সঙ্গে…।’ ও হরি, এতক্ষণে বোঝা গেল উনি কী ভাবছিলেন!
শুটিংয়ের মধ্যে সুচিত্রাদির সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়লাম, স্ক্রিপ্ট পড়ানোর দৌলতে। উনি খুব পেশাদার। চিত্রনাট্যের প্রতিটি সংলাপ কণ্ঠস্থ করে যেতেন ফ্লোরে। আর আমার সৌভাগ্য আমি ওঁকে সাহায্য করতাম। তার জন্য ঋতুর কাছে কথাও শুনেছি। ‘সুচিত্রাদি গোটা গোটা করে উচ্চারণ করেন, আর তুইও তাই… সিনেমার অভিনয়ে একটু কথাটা ভাসিয়ে দিতে হয়। তোর দ্বারা হবে না!’
সত্যি সুচিত্রাদিকে একবার-দু’বার বলতে চেষ্টা করেছিলাম, শব্দের শেষের ‘ট’ বা ‘থ’ অত স্পষ্ট করে না উচ্চারণ করতে। কিন্তু ওঁর ব্যক্তিত্বের সামনে গুটিয়ে যাই। তবে পর্দায় ওঁর লুক ও আবির্ভাব একটা অন্য মাত্রা জুড়ে দেয়। তাতেই ঋতু প্রসন্ন। ‘ডাবিং-এ হয়ে যাবে।’
শুটিং শেষ। এডিট করে এবার ডাবিং। সুচিত্রাদি এলেন। প্রথম দিন থেকেই চলল যুদ্ধ। ওঁর স্পষ্ট উচ্চারণকে একটু বিকৃত বা আনসফিস্টিকেটেড করার প্রচেষ্টা। দু’দিনের মাথায় সবাই রণক্লান্ত। ঋতু বলল, ‘এখন থাক, পরে আবার চেষ্টা করব।’ পরদিন যোগাযোগ করা হল অভিনেত্রী কেতকী দত্তর সঙ্গে। উনি করলেন সুচিত্রাদির ডাবিং।
শেষ হল ছবি। এবার প্রিমিয়ার। সুচিত্রাদিকে আমন্ত্রণ জানাতে গেলাম ঋতু ও আমি। সেই সুসজ্জিত ফ্ল্যাট। ওখানে পৌঁছে জানলাম, আমন্ত্রণ ছাড়াও ওঁকে জানাতে হবে ওঁর ডাবিংটা কেতকীদি করেছেন। ভয়ে-ভয়ে বসে আছি। উনি এলেন, বসলেন ডিভানে। সঙ্গে সঙ্গে ঋতু ওঁর পায়ের কাছে। আমিও। আমন্ত্রণপত্র দিয়ে অনুরোধ, ‘আসবেন নিশ্চয়ই।’
সুচিত্রাদি কার্ডটা পড়লেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার অংশটা কি বাদ চলে গেছে? মানে, ডাবিংটা তো শেষ করিনি!’
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর ঋতু বলল, ‘ওটা কেতকীদিকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছি, তোমার গলাটা আর বাচনভঙ্গি চরিত্রের সঙ্গে ঠিক মিলছিল না!’ আমি মাথা নীচু করে বসে আছি। ঘর চুপচাপ। কেউ কিছু বলছি না। এবার ধীরে ধীরে তাকালাম ওঁর দিকে। দ্বিতীয়বার ওঁর চোখে জল দেখলাম। অসহায় ভাবে বললেন, ‘আমার তো গলাটাই পরিচয়, সেটাই রাখলে না!’