স্রোতের বিপরীতে

Zohran Mamdani

সুদূর মার্কিন মুলুকে মেয়র নির্বাচন আর তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে হইচই। নিউ ইয়র্ক শহর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। নির্বাচনী উত্তাপ এতটাই ছড়িয়েছে যে, সাড়ে সাত হাজার মাইল দূরত্বের একটুকরো ভূখণ্ডেও শোনা যাচ্ছে তর্জন-গর্জন। কারণ, বছর তেত্রিশের এক যুবক। নাম জোহরান মামদানি। রিপাবলিকানদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। যথেষ্ট ভাবিত খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও। মুহুর্মুহু আক্রমণ শানাচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। হবে না-ই বা কেন! ক্যাপিটালিজিমের আঁতুড়ে সমাজতন্ত্রের ঝোঁক, তার এহেন বিপুল জনপ্রিয়তা— আলোড়ন তো হবেই!

জোহরান উর্দু শব্দ, যার সূর্যের মতো ‘উজ্জ্বল’ বা ‘দীপ্তিমান’। ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার এই অন্ধকার সময়ে খানিক সূর্যের মতোই উত্থান এই ভারতীয় বংশোদ্ভুত তরুণের। ডেমোক্র্যাট রাজনীতির অভিজ্ঞ ঘোড়া অ্যান্ড্রু কুওমো-র খরচ করা লক্ষ লক্ষ ডলার জাস্ট ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে জোহরানের জনপ্রিয়তার বন্যায়। আর এহেন বিপুল জনপ্রিয়তার ধারক ও বাহক সোশ্যাল মিডিয়া, যার ওপর ভর করে নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র হওয়ার দৌড়ে সফলভাবে নিজেকে নথিভুক্ত করেছেন এই যুবক। যদিও প্রথম থেকেই স্রোতের বিপরীতে হেঁটেছেন মামদানি। আমেরিকাজোড়া তীব্র ইসলামোফোবিয়ার হাওয়ায় আঁকড়ে থেকেছেন নিজের পরিচয়। আগাগোড়া ট্রাম্পের নীতির সমালোচনা করেছেন। ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতে গাজায় উদ্দাম ধ্বংসলীলা চালানো নেতানিয়াহুকে ‘অমানবিক’ আখ্যা দিয়েছেন। পুঁজিসর্বস্ব আমেরিকার বুকে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি রেশনের পক্ষে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন।

আরও পড়ুন : দাবার ছকেও বর্ণবৈষম্য! এই বই সন্ধান দেয় যে ভুবনের… লিখছেন শরণ্য সেন…

পাল্টা ধেয়ে এসেছে রিপাবলিকানদের কটূক্তি। ট্রাম্প সমর্থকরা সোশ্যাল মিডিয়ায় অকথ্য ট্রোল করছেন। এমনকী, কাঁটা চামচের বদলে কেন তিনি হাত ব্যবহার করে খাচ্ছেন, সেই নিয়েও ধেয়ে এসেছে কটাক্ষ। ট্রাম্প নিজে ট্রুথ সোশ্যালে তাকে ‘কমিউনিস্ট পাগল’, ‘Marxist উন্মাদ’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছেন। পাশাপাশি হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন যে, জোহরান মামদানি যদি আগামী নভেম্বরে নিউ ইয়র্কের মেয়র পদে আসীন হন, তাহলে যাবতীয় অর্থ সাহায্য বন্ধ করবেন। এমনকী, ডেমোক্রেটিক পার্টিও মামদানির সমস্ত কার্যকলাপে খুশি হতে পারছে না। তারাও কিছু ক্ষেত্রে জোহরানের আচরণকে ঈষৎ বাম-ঘেঁষা ও র‍্যাডিক্যাল মনে করছে।

অন্যদিকে, মামদানিকে নিয়ে ভারতীয়দের অবস্থান বেশ কিছুটা ‘দেখছি, দেখব…’ গোছের। আপাতত জল মাপছে তারা। কমলা হ্যারিস যখন নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি কতটা ‘ভারতীয়’, তা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছিল ভারতীয়দের একাংশ। সুনীতা উইলিয়ামস থেকে ঋষি সুনক, সব জায়গাতেই ‘আত্মীয়তা’ খোঁজার প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছে ভারতীয়রা। কিন্তু বামের ছোঁয়া লাগতেই আমেরিকানিবাসী ভারতীয়কুলের কাছে কিছুটা অচ্ছুৎ জোহরান মামদানি। কঙ্গনা রানওয়াত তো আরও একধাপ এগিয়ে, জোহরানের ‘কথাবার্তা’, ‘চালচলন’ দেখে তাঁকে পাকিস্তানি ঠাওরাতেও দ্বিধা বোধ করেননি। মামদানির মুসলিম পরিচয় ও সমাজতান্ত্রিক মনোভাব অভিনেত্রীর অভিযোগে বাড়তি অনুঘটকের জোগান দিয়েছে।

যদিও তথ্য কিন্তু অন্য কথা বলছে। জোহরান মামদানি বিখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক মীরা নায়ারের একমাত্র সন্তান। যিনি ‘সালাম বম্বে’, ‘মনসুন ওয়েডিং’, ‘দ্য নেমসেক’-এর মতো একাধিক সিনেমা উপহার দিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রজগতকে সমৃদ্ধ করেছেন, সেই মীরাও বর্তমানে আমেরিকা-নিবাসী। পিতা মাহমুদ মামদানি গুজরাতি মুসলিম, যদিও জন্ম মুম্বইতে। পরবর্তীতে পাড়ি দেন উগান্ডায়, সেখানেই শৈশব কাটে। বর্তমানে লেখক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে বিশেষ পরিচিত। জোহরানের জন্ম কাম্পালায়। মাত্র সাত বছর বয়সে আফ্রিকা ছেড়ে মামদানি দম্পতির সঙ্গে পাকাপাকিভাবে ম্যানহাটন পাড়ি দেন তিনি। পড়াশোনা শুরু হয় ব্রংক্স হাইস্কুল অফ সায়েন্সে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নোবেল ল্যরিয়েট তৈরি হয়েছে যাদের ল্যাবরেটরিতে। মাত্র তিন শতাংশ যে অ্যাডমিশন টেস্টে উত্তীর্ণ হয়, তা হেলায় কোয়ালিফাই করে বসলেন জোহরান। তারপর পড়াশোনা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেন বউডিন কলেজ, যাদের প্রাক্তনীর তালিকায় আবার রয়েছে প্রাক্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট থেকে উইকিপিডিয়া, নেটফ্লিক্সের মতো সংস্থার প্রতিষ্ঠাতারা। ছোট্ট ক্যাম্পাস, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দু’হাজারেরও কম। বছরে খরচ প্রায় ৭০,০০০ ডলার। সফলভাবে পড়াশোনার পাশাপাশি চুটিয়ে রাজনীতিও করেছেন জোহরান। এহেন কেরিয়ার গ্রাফ যে-কোনও মধ্যবিত্ত ভারতীয়র চোখে ধাঁধা লাগাবে, এটাই স্বাভাবিক।

তীব্র ডানপন্থী সরকারের তত্ত্বাবধানে মার্কিন মুলুকে প্রচার ছড়াচ্ছে, জোহরান জিতলে আমেরিকা জুড়ে নাকি শরিয়ত আইন জারি হবে। কায়েম হবে মুসলিম শাসন। সমস্ত ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এমনকী, স্ট্যাচু অফ লিবার্টিকে বোরখায় মোরানো একটি কার্টুনও সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে। মোদ্দা কথা, আমেরিকা খতরে মে হ্যায়! কিন্তু সত্যিটা কী? নিজে ছোটবেলা থেকে মুক্তমনা প্রগতিশীল চিন্তাভাবনায় বড় হওয়ার পাশাপাশি, পিতা মাহমুদের মার্কসবাদ সম্পর্কে ধারণা বিপুল প্রভাবিত করে তাঁকে। মেয়র নির্বাচনের প্রাথমিক স্তরে জয়ের পর তিনি কোটিপতিদের কর বৃদ্ধির পাশাপাশি শিশুস্বাস্থ্য চিকিৎসাকে দাতব্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর বাড়িভাড়া মকুবের ঘোষণাও যথেষ্ট আলোচিত সিদ্ধান্তর মধ্যে একটি। আর শরিয়ত আইন নিয়ে যাবতীয় কুৎসা ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়, যখন তাঁর স্ত্রী খোলামেলা আধুনিক পোশাকে ছবি দেন। এর পাশাপাশি, নিউ ইয়র্ক শহরে ইহুদিদের যথেষ্ট জনবসতি রয়েছে জেনেও তিনি নির্দ্বিধায় ইজরায়েলের বিরোধিতা করেছেন।

এই সবকিছু থেকেই স্পষ্ট, আদতে যাবতীয় ভোটব্যাঙ্কের অঙ্ককে ভেঙেচুরে তিনি বুঝিয়েছেন ন্যায়দণ্ডই ভোটারের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার আসল মাপকাঠি। আমেরিকা-নিবাসী ভারতীয় নাগরিকদের প্রথম প্রজন্মের অনেকাংশই বিজেপির সমর্থক ও কট্টর হিন্দুত্ববাদী। বহু সংগঠনে ভোটের আগে তারা টাকা ঢালে, এমন অভিযোগও কম ওঠেনি। তাঁদের মন জোগানোর বৃথা চেষ্টায় না গিয়ে জোহরান হেঁটেছেন জেন-জির পথে, যারা সদ্য পড়াশোনা শেষ করেছে, যারা ধর্মীয় রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রাখে, গাজার সন্তানহারা মায়ের কান্না যাদের পীড়া দেয়, যারা নিজেদের ভাষাসত্তা নিয়ে সচেতন, জর্জ ফ্লয়েডের আর্ত কাকুতিকে নিজের কণ্ঠে স্থান দিতে যারা দ্বিধা বোধ করে না, তাদের কাছে পৌঁছেছেন মামদানি।

প্রাইড মার্চে হাঁটছেন জোহরান মামদানি

বিপরীতে, ইসলামিক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি পৌঁছে যাচ্ছেন এলজিবিটিকিউ-র ভিড়ে, হাঁটছেন প্রাইড যাত্রায়। মৌলবাদের সমালোচনা করছেন। স্বাভাবিকভাবে, নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয়তার শিখরে তিনি। কিন্তু এর জন্য রক্ষণশীল গোঁড়া ভারতীয়দের থেকে কম বিদ্রুপ শুনতে হয়নি তাঁকে। তাঁদের চোখে মামদানি খালিস্তানপন্থী, ইসলামিক ও ভারতবিরোধী। মন্দিরের হলঘরে তাঁর স্বেচ্ছাসেবকদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। ফেসবুকের অনেক গ্রুপেই তাঁরা ব্লকড। কিন্তু এত কিছুর পরেও মেয়র নির্বাচনের প্রাথমিক পর্যায় তিনি অতিক্রম করেছেন। জনপ্রিয়তায় অপ্রত্যাশিত ভাটা না পড়লে নভেম্বরে নিউ ইয়র্ক শহরে মেয়রের মসনদে তিনিই বসতে চলেছেন।

মেয়র নির্বাচনের প্রাথমিক স্তরে জয়ের পর তিনি কোটিপতিদের কর বৃদ্ধির পাশাপাশি শিশুস্বাস্থ্য চিকিৎসাকে দাতব্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর বাড়িভাড়া মকুবের ঘোষণাও যথেষ্ট আলোচিত সিদ্ধান্তর মধ্যে একটি। আর শরিয়ত আইন নিয়ে যাবতীয় কুৎসা ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়, যখন তাঁর স্ত্রী খোলামেলা আধুনিক পোশাকে ছবি দেন। এর পাশাপাশি, নিউ ইয়র্ক শহরে ইহুদিদের যথেষ্ট জনবসতি রয়েছে জেনেও তিনি নির্দ্বিধায় ইজরায়েলের বিরোধিতা করেছেন।

এহেন উল্কাসম উত্থানের নেপথ্যে রয়েছে এক সূক্ষ্ম এবং ক্ষুরধার মস্তিষ্ক। সাধারণের প্রতি জোহরানের অনাড়ম্বর সরল আপ্যায়ন এক ভিন্ন গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার অভূতপূর্ব ব্যবহার। জোহরান জেন-জির সঙ্গে নিজের প্রথম ডেটিংয়ের অভিজ্ঞতা নিঃসংকোচে ভাগ করে নেন। এছাড়াও তিনি দারিদ্রের কথা বলেন। তিনি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন, ‘এই শহরে চারজনের মধ্যে একজন দারিদ্রের শিকার!’ তিনি মনে করিয়ে দেন, এখনও এই শহরে পাঁচ লক্ষ শিশু অনাহারে ঘুমতে যায়। ছয় সপ্তাহ থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের জন্য সারা শহরে বিনামূল্যে চাইল্ড কেয়ার প্রতিষ্ঠার ডাক দেন। সাশ্রয়ের ওপর জোর দিয়ে সারা শহরব্যাপী সরকারি মুদির দোকানের ব্যবস্থা করতে চান তিনি। বাড়ি ভাড়া স্থির রাখার পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে বাড়ি ভাড়া মকুবের কথাও বলেন জোহরান। খরচ কম রেখে সাশ্রয়ী বাসস্থানের সংখ্যা তিন গুণ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেন। সর্বোপরি শহর জুড়ে বিনামূল্যে পরিবহণের বার্তা দিয়ে তিনি মুছে দিয়েছেন নিউ দিল্লি আর নিউ ইয়র্কের কয়েকশো যোজনের ব্যবধান। এসবের প্রচারেও রয়েছে তাঁর অভিনব কায়দা। বলিউডি স্টাইলে তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইনে মিশে যাচ্ছে অমিতাভ বচ্চন থেকে ঋষি কাপুর। সহজ বাংলায় তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ভোটদানের কায়দা। আসলে মামদানি যখন ইউনিয়নের অধিকার, সাম্যের লড়াই, শিক্ষাব্যবস্থায় খরচ কমানোর কথা বলেন, তখন নিউ ইয়র্ক-বাসী বামপন্থী না-হয়েও অনেকাংশে তাঁর চিন্তার সঙ্গে একাত্মবোধ করে। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর কড়া সমালোচনা হোক, কি অ্যান্ড্রু কুওমো-র ডলার, কোনওটাই যার সামনে ধোপে টেকে না। বোঝা যায়, বামপন্থী রাজনীতির সারসত্যকে গ্রহণ করে জনগণের সমস্যাকে কাছ থেকে বুঝেছেন জোহরান। সেই উপলব্ধিকে লড়াইয়ের হাতিয়ার করে এগিয়ে চলেছেন নিউ ইয়র্কের প্রথম দক্ষিণ-এশীয় মেয়র হওয়ার লক্ষ্যে।

ক্ষমতার স্বাদ পেলে তিনি কতটা বামপন্থী থাকবেন, সেই উত্তর তো সময় বলবে। কিন্তু পুঁজির জোর না থেকেও যে শুধুমাত্র আদর্শে ভর করে জনসাধারণের সমস্যা শনাক্তকরণ ও তা সমাধানের স্বপ্ন দেখা সম্ভব, তা এই যুদ্ধে করে দেখিয়েছেন মামদানি। বিশ্বজুড়ে এই মুহূর্তে বাম রাজনীতির ঝোঁক কমছে।এই পরিস্থিতিতে আসন্ন নির্বাচনে না জিতলেও, ট্রাম্পের একনায়কত্বের বধ্যভূমিতে জোহরান মামদানির উত্থানকাহিনি বাম রাজনীতির এক অভূতপূর্ব কেস স্টাডি হয়ে থেকে যাবে।