গ্রেগর সামসার জন্ম সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। কিন্তু প্রায় সকলেই জানেন, কেমন করে সে মারা যায়। তার মৃত্যু হয়েছিল শরীরে আপেলের কুচি আটকে, সম্ভবত গ্যাংগ্রিন জাতীয় কোনও অসুখে। পচ-ধরা আপেলের কুচি, তার সঙ্গে ধুলোময়লা মিশে মৃত্যুর সম্ভাবনা আরও প্রবল হয়ে ওঠে (মানুষ যদি পোকা হতে পারে, তার গ্যাংগ্রিন হতেই বা আটকাচ্ছে কোথায়?)। যাঁরা প্যাঁচ কষতে ভালবাসেন, তাঁরা বলবেন, কাফকা ওই আপেলটি ধার করেছিলেন বাইবেল থেকে। অর্থাৎ, মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে গ্রেগর সামসা ইহজাগতিক পাপ-পুণ্য সম্পর্কে আরেকবার আমাদের কিছু ভাবাতে চেয়েছিল। অথবা, হয়তো তার কিছু গোপন দুঃখ ছিল, যে-কথা সে মুখ ফুটে বলে উঠতে পারেনি।
ফ্রানৎস কাফকার ‘মেটামর্ফোসিস’ বা ‘রূপান্তর’ তো আসলে করুণ রসেরই গল্প। এর মধ্যে ম্যাজিক (বা, আরও পরে যাকে বলা হচ্ছে ‘ফ্যান্টাস্টিক’) যে-টুকু, তা সহজেই উপেক্ষা করা যায়। গ্রেগর সামসা যে পোকাটিতে রূপান্তরিত হয়, ইংরেজি ও বাংলা তরজমায় সেটিকে কেউ করেছেন আরশোলা, কেউ-বা গুবরে পোকা। কাফকা আসলে বলতে চেয়েছিলেন একটা নোংরা, ক্ষতিকর, বিকটদর্শন কীটের কথা। এর পরিচয় নির্দিষ্ট করা তাঁর ইচ্ছে ছিল না। তাই বই প্রকাশের সময় নির্দেশ দিয়েছিলেন, প্রচ্ছদে বা ভেতরে কোথাও যেন পোকার ছবি না থাকে। আসলে, পোকার চেয়ে কাফকার ঝোঁক বেশি ছিল পোকার উপদ্রবের দিকে।
যেদিন পোকা হয়, ঠিক সেদিন থেকেই গ্রেগর সামসা হয়ে যায় পঙ্গু, অথর্ব, কাজেই কর্মহীন, এবং সেহেতু: পরিবারের বোঝা। খাটে আর ঘরের মেঝেতে তার ক্লিষ্ট চলাফেরা, সবার দৃষ্টি থেকে নিজের কুৎসিত, পীড়াদায়ক উপস্থিতি আড়াল করার মরিয়া চেষ্টা, খাট থেকে নামার, দরজা খোলার বিচিত্র কৌশল— সবই এই আকস্মিক পঙ্গুত্বের হয়রানির সঙ্গে তুল্য। ১৯০৮ সাল থেকে কাফকা একটা সরকারি বিমা প্রতিষ্ঠান, ‘ওয়ার্কার্স অ্যাক্সিডেন্ট ইনস্যুরেন্স ইন্সটিটিউট ফর দ্য কিংডম অব বোহেমিয়া’-তে চাকরি করেছেন। পরে এই কোম্পানিতে তাঁর ঈর্ষনীয় পদোন্নতি হয়েছিল। কিন্তু গোড়ার দিকে বেতন খুব বেশি ছিল না। আর কাজ ছিল, মিল-কারখানার শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে আহত হলে সেই ঘটনার তদন্ত করা, আর ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নির্ধারণ করা। তখনকার দিনে মেশিনে কাটা পড়ে হাতের আঙুল হারানো, বা অঙ্গহানি হওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। দরিদ্র পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মানুষটির অঙ্গহানি ঘটলে পরিস্থিতি কতখানি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, সে অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই কাফকার হয়েছিল। তার স্পষ্ট ইঙ্গিত ‘রূপান্তর’-এ আছে। শুধু গ্রেগর সামসার দুর্দশার বিবরণ নয়, তার পরিবারের প্রাথমিক অসহায়ত্ব আর অর্জিত নিষ্ঠুরতাও এর সাক্ষ্য দেবে।
আরও পড়ুন : অজিতকৃষ্ণ বসুর লেখায় ধরা পড়ে জাদু থেকে সংগীতের এক অন্য ভুবন! লিখছেন ঋত্বিক মল্লিক…

কিন্তু, একবার পোকাটা বাদ দিয়ে ভাবুন, এমন মানুষ কি দেখেননি, যে সংসারের জোয়াল ঠেলতে-ঠেলতে প্রতিদিন নিজেকে পথশ্রমে ছিবরে করে দিচ্ছে? রোজ ইচ্ছের বিরুদ্ধে যে চাকরিটা আমরা করি, সেটা নিজেকেই বিক্রি করা নয় কি? আর এভাবে বিক্রি নিজেকে বিক্রি করতে-করতে, শুকিয়ে যেতে-যেতে, কীট হয়ে যাওয়াটাই কি সবচেয়ে স্বাভাবিক পরিণতি নয়? এভাবে ভাবতে পারলে, ‘মেটামরফোসিস’ গল্পটা খুব সহজেই আমাদের চেনা হয়ে যায়। উপরি হল— গ্রেগরের দুর্দশাকে যা আরও করুণ করেছে— তার তপতপে মন, ‘মোর দ্যান জেনারেল সেন্সিবিলিটি’। যা দস্তোইয়েভস্কির সবচেয়ে সেল্ফ-রিফ্লেক্সিভ উপন্যাস ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’-এও রয়েছে, এবং সম্ভবত যার কারণে কাফকা দস্তোইয়েভস্কিকে তাঁর বাবা মনে করতেন। এই মন নিয়ে কাফকা চিরদিন বিপর্যস্ত থেকেছেন। নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কোথায় তার এই তুলতুলে মনটা নিশ্চিন্তে জিরোতে পারে, সারা জীবনে বুঝে উঠতে পারেননি। প্রেমিকাদের সান্নিধ্যে তাঁর নিজেকে মনে হয়েছে ‘অপর্যাপ্ত’, বাবার সামনে ‘অকর্মণ্য’, আর মায়ের প্রতি ‘নিষ্ঠুর’। কখনও ভালবাসা না-পাওয়ার, কখনও ভালবাসতে না-পারার যন্ত্রণায় পুড়তে-পুড়তেই একদিন জন্ম হয়েছে গ্রেগর সামসার। যেদিন সে পঙ্গু হয়ে গেল, সেইদিন থেকে তার কথাও গেল চলে। যতই সে সকলকে আশ্বস্ত করতে চায়, জানাতে চায় যে, কারও কোনও ক্ষতিই সে করবে না— দেখা যায়, তার কথা-বলার-চেষ্টা একটা গোঙানির মতো আওয়াজে পর্যবসিত হচ্ছে। মা, বোন, বাবা— কাউকে সে হৃদয় খুলে দেখাতে পারে না, ধন্যবাদ জানাতে পারে না, আশ্বস্ত করতে পারে না। এ-ও আসলে ওই চিরপীড়িত মনেরই কারসাজি। পরিবার তার প্রতি ক্রমশ নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। ধীরে-ধীরে তার থেকে মনোযোগ অন্য-অন্য দিকে সরে যেতে থাকে সকলের (বাতিল, অকেজো মানুষের ক্ষেত্রে যা ঘটেই থাকে)।
এই গল্পে কাফকা গ্রেগরের পরিবারের নিষ্ঠুরতার যে খতিয়ান দিয়েছেন, তার তুলনা মেলা ভার। সেটা কীরকম? লক্ষ করুন: ছেলে যখন কর্মক্ষমতা হারাল, তখন তাকে ভয় দেখিয়ে, খোঁচা মেরে ঢোকানো হল ঘরের মধ্যে। বন্ধ ঘরে একরকম বন্দি করেই রাখা হল তাকে। তার খাদ্য হল বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবার। তার ব্যবহারের আসবাবপত্র সব একে-একে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল ঘর থেকে। অনেকের মনে পড়বে, গ্রেগরের লেখার টেবিলটা যখন সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন তার নিষ্ফল বিদ্রোহের কথা। প্রথমে যত্ন কমল, তারপর বাবা-মা-বোন সকলেই ভুলে যেতে চেষ্টা করল ছেলেটির কথা। বাড়ি ভাড়া দেওয়ার পর, গ্রেগরের ঘরটা কার্যত গোডাউন হয়ে গেল। ধুলোর পুরু আস্তরণ পিঠে নিয়ে যখন সে মারা গেল, বাড়ির ঝি মৃতদেহ ফেলে দিয়ে এল। হালের ভাষায় একেই বোধহয় বলা হয়, ‘ডার্ক’। গ্রেগর দেখল, তাকে ছাড়াও তার পরিবারের দিব্যি চলে যায়। বাবা, মা, বোন সকলেই কর্মক্ষম। তারা দিব্যি রোজগার করছে। সে বাতিল হয়ে গেছে বলে তার সংসার পথে বসে নেই। কী এক নির্মম জিজীবিষা তাদের গ্রেগরের কথা ভুলে গিয়ে জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াতে বলছে। এই নিষ্ঠুরতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয় যখন গ্রেটি বলে, ‘ওকে এবার তাড়াতেই হবে। আমরা যদি শুধু এটুকু মেনে নিতে পারি যে, ওটা গ্রেগর নয়, ওটা কিছুতেই গ্রেগর হতে পারে না, তাহলেই তো সমস্যা মিটে যায়!’ মৃত্যুর পরে, তাকে ভুলে যেতে এতটুকু সময় লাগে না বাবা-মায়েরও। পুত্রহীন পৃথিবীতেই তাঁরা ভবিষ্যৎ সুখশান্তির স্বপ্ন দেখেন। মেয়ের বিয়ের কথা ভাবেন। বিস্মৃতির চেয়ে, নিরাপত্তার লোভের চেয়ে বড় পাপ আর কিছু আছে কি?
গ্রেগর সামসা কিন্তু নিজের ঝক্কি আর খিদের কষ্ট সামলাতে-সামলাতে সে ভাবে, কবে আবার পরিবারের জন্য নিজেকে ‘প্রয়োজনীয়’ করে তুলতে পারবে। পরিবারের নিরাপত্তা সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ভার তুলে নিতে পারবে নিজের কাঁধে। পোকা হয়েও পরিবারের জন্য সে সদাচিন্তিত, বোন খাবার এনে দিলে কৃতজ্ঞতায় তার গলায় চুমু খেতে চায়। গ্রেটি যখন ভাড়াটিয়াদের মন রাখতে বেহালা নিয়ে বসে— তখন গ্রেগর দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে, ভাবে, যদি আমি পোকাই হই, তাহলে সুর কেন টানে আমাকে? মার্জনা করবেন, এই অংশটুকু আমি ইংরেজিতে উদ্ধৃত করতে চাই। কাফকা লিখছেন, ‘Was he a beast, that music so moved him? He felt as if he were being shown the way to that unknown nourishment he craved’। এইখানে গ্রেগরের অহমিকা, একবার, মাত্র একবার ঝলসে ওঠে। সে পণ করে বোনের স্কার্ট ধরে টান দেবে, আর সেভাবেই সে বুঝিয়ে দেবে, গ্রেটির উচিত, বেহালা নিয়ে গ্রেগরের ঘরে চলে আসা, কারণ এই বেহালা শোনার ততখানি যোগ্য আর কেউ নয়, যতখানি যোগ্য সে’। এটুকু শুশ্রূষাই তো গ্রেগর সামসা চেয়েছিল জীবনের কাছে। পোকা হয়ে গিয়েও সে ভোলেনি সংকল্প, আরও আরও খেটে, কিছু টাকা জমিয়েই গ্রেটিকে সে ভর্তি করবেই গানের স্কুলে! অল্প পুঁজির ওই চোয়াল শক্ত করা জেদ, যা সে বলব-বলব করেও বোনকে বলে উঠতে পারেনি এতদিন, আর কখনো বলা হবে না— বুঝতে পেরেই গ্রেগর সামসা নিঃশব্দে মরে যায়। ঠিক যেভাবে বাতিল, অকেজো, পঙ্গু মানুষেরা মরে। গল্প হিসেবে ‘ডেথ অফ আ সেলসম্যান’ কি এর থেকে খুব আলাদা?