তরঙ্গনাথ – আট
নিজের বাড়িতে এসে অবধি উদ্বেগের শেষ নেই তরঙ্গনাথের। কারণ সশস্ত্র বিপ্লবীদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে রাখতে হয়রান হয়ে যাচ্ছে সাহেবরা; সেই সঙ্গে চলেছে ধরপাকড়, অত্যাচার এবং একের পর এক মামলা। তরঙ্গনাথ অবাক হয়ে ভাবে যে, তারই বয়সি সব ছেলে, অথচ কী তাদের সাহস আর মনোবল! মিলিটারি বা পুলিশের ট্রেনিংও যেন হার মেনে যায়; আরও একটা কথা ভেবে অবাক না হয়ে পারে না তরঙ্গনাথ যে, নিজেদের এই এত বড় দেশটা ছাড়াও, অন্যান্য দেশেও কেমন পাড়ি দিচ্ছে তারা! পাবনা, রংপুর, যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, চন্দননগর, মেদিনীপুর, হরিনাভি, দার্জিলিং, মুজফফরপুর— সব জায়গা থেকে সমানেই গোয়েন্দা এ্যালার্ট আসছে কলকাতার লালবাজার দপ্তরে। মিটিং-মিছিল ছেড়ে, এখন তারা যে অন্যপথ ধরেছে, তা হল পদস্থ সাহেবদের মারা। আর কী যে সাংঘাতিক সংগঠন ক্ষমতা এই অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তর দলের ছেলেদের! পুলিশের কাছে খবর আছে যে, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ নাকি চেষ্টাচরিত্র করে প্যারিসে পাঠিয়েছে হেমচন্দ্র দাস বা কানুনগো নামে একটি ছেলেকে শক্তিশালী বোমা বানানো শিখে আসতে; কারণ নিকোলাস নামে এক রুশ বিপ্লবী যে তাদের এসব শেখাবে, সেও নাকি এখন সেখানেই আছে আত্মগোপন করে। হাওড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে থাকা উল্লাসকর দত্তের ওপরও নজর রাখছে পুলিশ। কারণ লেখাপড়া ছেড়ে, নানা রকম রাসায়নিক দিয়ে নিজেই বোমা বানাতে লেগেছে সে। এর তৈরি করা বোমার শক্তি পরীক্ষা করতে দেওঘরে যখন প্রফুল্ল চক্রবর্তী নামে একজন বোমা ফেটে মারা গেল, তখনই জানতে পারল পুলিশ। এন্ড্রু ফ্রেজার, ডগলাস কিংসফোর্ড এই সব বাঘা বাঘা গভর্নর এবং ম্যাজিস্ট্রেটরাই তাদের লক্ষ্য; নাস্তানাবুদ সাহেবরা কেবলই বদলি নিচ্ছে এখান থেকে ওখানে; নিরাপত্তার বহর বাড়ছে; বিপ্লবীদের ধরতে নামের তালিকাও বিয়েবাড়ির ফর্দের মতো লম্বা হয়ে যাচ্ছে; তবু ভয় যাচ্ছে না। বন্দুকের অভাব মেটাতে বোমাকে হাতিয়ার করেছে এরা।
২
কাটিহার ফিরে যেতে না হওয়ায় একটা ভাল হল যে, রাণীর বিয়েটা দিয়ে দেওয়া গেল। বাবা-মা তো একটা সম্বন্ধ মোটামুটি পাকা করেই রেখেছিলেন; চিন্তা ছিল তরঙ্গনাথের ছুটি পাওয়া নিয়ে। ফলে সে সমস্যায় আর পড়তে হল না কাউকেই।কাঁচরাপাড়ার ছেলে।পালটি ঘর, দেখতে শুনতে রাণীর মতো সুন্দর না হলেও স্বাস্থ্যবান এবং শিক্ষিত। সাধারণ মেয়েদের তুলনায় একটু বেশি বয়সেই বিয়ে হল রাণীর, মানে চোদ্দো পার করে। মায়ের অনুরোধে বাবার সঙ্গে গিয়ে তরঙ্গনাথ নিজেও সব দেখে এসেছিল। সকাল থেকে অধিবাস এবং ক্রমাগত এর-তার আসা যাওয়ায় বাড়ি একেবারে গমগম করছে। অনেককাল বাদে মায়ের মুখে হাসি এবং ডেকে হেঁকে কথা বলার সেই ধরনটাও ফিরে এসেছে। বিয়ে, বাসি-বিয়ে সেরে রাণী যখন শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে, সে কী কান্না বদুর! আর বাবার কান্না মুখ লুকিয়ে। গাঁটছড়া বাঁধা অবস্থাতেই রাণীকে কোলে তুলে নিয়ে বরের পাশে পাশে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল তরঙ্গনাথ; পিছন পিছন শাঁখ বাজিয়ে উলু দিতে দিতে দিদি-বউদির দল। তরু আর না নেমে, দোতলার দরজা ধরে সিঁড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে রইল একা। ওখানে দাঁড়িয়েই সে চোখ মুছতে লাগল নিজের আঁচলে একেবারে বড় মেয়েদের মতো। মুখে কিছু না বললেও তরঙ্গনাথ খেয়াল করল সেটা।
বউভাতের দিন বরযাত্রীদলে সে যেতে না পারলেও, বাড়ির ছেলেরা বেশ আনন্দ করেই গেল। দোতলার বারান্দায় মেয়ে-বউদের জটলা। পানের সাজি, ফলের ডালা, মিষ্টির ছাঁচ তোলা— সব একেবারে একসঙ্গেই চলছে রই রই করে। আজকের রাত কাবার হয়ে যাবে তত্ত্ব সাজাতে সাজাতেই। সকলের মধ্যে কেবল তরুকেই কেমন যেন একটু অবসন্ন দেখাচ্ছে; তরুর চোখের তলার কালচেটে ছাপটাও চোখ এড়াল না তরঙ্গনাথের; আর একটু নিবিড়ভাবে দেখে এও বুঝল যে, তার হাঁটাচলায় কেমন যেন স্লথভাব। কী হল তরুর! নিজের মনেই অপরাধী হয়ে রইল তরঙ্গনাথ; কারণ মায়ের ছায়া হয়ে থেকেও, সে যে কতখানি হাল ধরেছে এ সংসারের, সেটা তরঙ্গনাথই জানে; বাপের বাড়ি যেতে পারে না, বরের কাজ নিয়ে সদা-উদ্বেগ, সমানেই এসোজন-বসোজন সামলানো; তবু তরু যে কী প্রাণবন্ত! আর কী ভীষণ পরিচ্ছন্ন; তরুর সঙ্গে থেকে থেকে রাণী-বদুও যেন অনেক সাবলীল হয়ে গেছে। গত কয়েকমাস কলকাতা-সোদপুর করতে করতে তরঙ্গনাথেরই দমছুট অবস্থা। একে পুলিশের চাকরি, তার ওপর সাহেবদের যতসব হঠকারী ধরপাকড় এবং শাস্তি। কিছু কিছু কাগজে বেরোয়। তরু সেসব পড়ে; কিন্তু কখনও কোনও প্রশ্ন করে কৌতূহল দেখায় না। তরঙ্গনাথকে দেখেই তো সে বুঝে যায় যে, কতখানি ধকল সয়ে লোকটা ফিরল। আর সে কিনা তরুর দিকে তেমনভাবে নজরই করেনি!
বেশ রাত করে শুতে এলে, তরুকে কাছে টেনে তরঙ্গনাথ বলল,
‘কী হয়েছে! চোখের পাতা ভারী, চলন ভারী, মুখখানাও শুকনো!’
‘কাটিহার যাওয়া হল না তাই মন খারাপ।’
‘সে তো হবেই। ডাক এলেই যাওয়া হবে; চাকরি তো চলে যায়নি।’
‘তোমার লাগানো ফুলগাছগুলো নিশ্চয়ই সব মরে গেছে।’
‘তা হবে না। ছোটেলাল ঠিকই দেখভাল করবে; তবে বোমা মেরে উড়িয়ে দিলে অন্য কথা।’
‘তোমাকে মারবে না। তুমি ভাল পুলিশ; মেসোমশাই মাকে বলেছেন।’
‘তাই নাকি! তাই তুমি এত লক্ষ্মী হয়ে গেছ!’
একরাশ লজ্জায় ডুবে গিয়ে মুখ নামিয়ে নিলে তরু। তরঙ্গনাথ তাকে কাছে টেনে, থুতনিতে চুমু খেয়ে আর একটু ঘন হয়ে এগিয়ে আসতেই, নিজেকে আলগা করে নিল সে। তরঙ্গনাথের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে তরু শুধু বলল, ‘মা জানেন; রাণীর বিয়ে মিটে গেলেই তোমাকে বলতাম। মা না বললে…। মাসিমার সঙ্গে কথা হয়েছে কলকাতার ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারে।’
বিহ্বল তরঙ্গনাথ দেখল, সলজ্জ তরুর দেহের এক লম্বা ছায়া পড়েছে ডানদিকের দেওয়ালে। মাথার ঘোমটা সরে গিয়ে, আঁকা কল্কার মতো দুলছে তার নাকের নোলক। আর তরুর সামনের দিকে খোলা জানলা দিয়ে যে একফালি আকাশ, সেখান দিয়ে উড়ে গেল দুধসাদা কয়েকটা লক্ষ্মীপেঁচা। মুখ তুলে তরুও তা দেখল। খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সামনে ঝুঁকে, নিজের থুতনিটা তরুর ডান কাঁধে রাখল তরঙ্গনাথ। নরম আবেশে তাকে জড়িয়ে ধরতেই নাকে এল তরুর চুলে মাখা সুগন্ধি তেলের বাস; তরঙ্গনাথ অনুভব করল তরুর শরীরে ধীরে ধীরে ঢল নামা যৌবন; তার দেহ-কাঠামোয় যেন আরও কয়েক পুরু মাটি লেপার প্রলেপ। মস্ত থাবার মতো নিজের দশটা আঙুল মোলায়েম বুলিয়ে সে স্পর্শ করল তরুর তলপেট; কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে অস্ফুটে ডাকল, ‘তরুলতা’। তরু উত্তর দিল না। তরঙ্গনাথ বুঝতে পারল যে তরুর গালদুটি ভিজে যাচ্ছে কান্নায়। তনু মুছিয়ে দিল না। অনেক ক্ষণ সময় নিয়ে ঠিক ওইভাবেই দাঁড়িয়ে রইল দুজনে— যেন প্রার্থনা করছে। নতুন একটা স্বপ্ন, বড় নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল দুজনে।
৩
কলকাতা যেন বোমা তৈরি আর নানা ধরনের গুপ্ত সংগঠনের আকর হয়ে উঠেছে। মুরারিপুকুরের ‘আশ্রম’ নামে বাগানবাড়িটা ঘিরে পুলিশের ঘোর সন্দেহ। সক্রিয় সদস্যদের নামের তালিকার থেকেও বেশি ভয় সাধারণ মানুষদের নিয়ে।হাতে গোনা কয়েকজন বাদ দিলে প্রায় সকলেরই সমর্থন তাদের দিকে। সেখানে আবার ধনী-নির্ধন অথবা শিক্ষিত-অশিক্ষিত বলে কোনও ভাগ নেই। সকলেই সাহায্যকারী এবং সকলেই তাদের আশ্রয়দাতা। এরকম অবস্থায় এ দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করছে নেটিভ পুলিশ আর রাজসাক্ষীদের। তরঙ্গনাথ জানে না যে, বাগান করে বা ঘোড়ায় চড়া শিখে এই ঘৃণা থেকে কী করে বাঁচিয়ে রাখবে তার প্রাণ এবং সত্তাকে! সাহেবদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উলটো। ঘৃণা এবং জবরদস্ত কায়েমিশাসনে বিশ্বাসী সাহেবরাই দলে ভারী; দু-একজন ব্যতিক্রমী সাহেবও অবশ্য আছে; অনেকটা তরঙ্গনাথের মতোই। বিবেকশূন্য হয়ে চাকরি করতে আসেনি তারা।
কলকাতা থেকে ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড যখন বদলি হয়ে মুজফফরপুর গেলেন, ঠিক সেই সময়ে কাটিহারে পোস্টেড থাকা তরঙ্গনাথের বড়সাহেবও বদলি হয়ে এলেন পাটনায়। লালাবাজারে বসেই ‘তার’ এল তরঙ্গনাথের নামেও। মি. অগাস্টের বিশেষ সুপারিশে সেও বদলি হয়েছে পাটনায়। তাঁর নির্দেশমতো আগামী সপ্তাহেই পাটনা গিয়ে দেখা করে কাজে যোগ দিতে হবে তরঙ্গনাথকে। না, কাটিহার যাবার ব্যাপারে কোনও উল্লেখ নেই। মনে মনে যারপরনাই স্বস্তি পেল তরঙ্গনাথ। উদ্বেগে জেরবার হয়ে কলকাতা সোদপুর করার থেকে, এ শহর ছেড়ে চলে যাওয়াই ভাল। তা ছাড়া অফিস কোয়ার্টারে থাকার সুবিধেও অনেক। অফিসের কাজে পাটনা সদরে দু-একবার গেলেও পুরো এলাকাটা ঘুরে দেখার সময় পায়নি সে। মনে মনে ভাবল যে, তরুকে নিয়ে চলে গেলে এই গর্ভাবস্থায় অনেক বেশি যত্ন পাবে সে। কিন্তু তার এ-অবস্থায় মা কি তাকে একা যেতে দেবেন?
পাটনায় নেমে সোজা দপ্তরে চলে এল তরঙ্গনাথ। কাটিহারের সঙ্গে কোনও তুলনাই হয় না এই পাটনা-পুলিশ দপ্তরের। মি. অগাস্টের ওপর আরও একজন বড়সাহেব আছেন; সেই সঙ্গে আরও দুজন মি. অগাস্টের মতোই ওই একই পদে। তরঙ্গনাথকে আলাদা করে কিছুই বলতে হল না। গাড়ি থেকে নেমে তরঙ্গনাথ চত্বরে এসে দাঁড়াতেই, এক কনস্টেবল সেলাম ঠুকে তাকে নিয়ে গেল মি. অগাস্টের ঘরে। ঘর জুড়ে সারি সারি ফাইল রাখা তাকগুলো দেখেই সে বুঝল কী পরিমাণ চাপ তাঁর ওপর; এ থেকেই অনুমান করতে পারল তরঙ্গনাথ যে, এর কতখানি দায় তাকেও নিতে হবে। মি. অগাস্টকে অভিবাদন জানিয়ে চেয়ার টেনে বসতেই তিনি বললেন, ‘ইয়েস, ডিয়ার ব্রাহ্মণ— তা হলে দুজনেই বেঁচে আছি আমরা!’
‘হ্যাঁ স্যর; আবার দেখা হল এবং আবার আপনার অধীনেই থাকার সুযোগ করে দিলেন আপনি। থ্যাঙ্ক ইউ স্যর।’
‘সবার সঙ্গে কি তোমার তুলনা চলে ব্রাহ্মণ? কারও প্রমোশন আসলে পানিশমেন্ট; কারও ক্ষেত্রে সম্মান, মানে পদোন্নতি। তোমার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টা। তোমার জন্য সুপারিশ করিনি; তোমাকে আসলে আমি চেয়েছি।’
‘আমার সৌভাগ্য স্যর, আপনার মতো একজনকে অফিসার হিসেবে পাওয়া! কাজ শিখতে পারব স্যর। বাবা-মা হয়তো বুঝবেন না, কিন্তু মেসোমশাই খুব খুশি হবেন।’
‘ডিয়ার ব্রাহ্মণ তবে শোনো। এটুকু আমি জানি যে, কাকে দিয়ে ফুল তোলাতে হয় আর কে নর্দমা পরিষ্কারের জন্য। মনে রেখো যে, তোমাকে আমি প্রথম দলেই রেখেছি; এবং এটাই আমার সুপারিশ।’
‘ইয়েস স্যর; আমাকে কবে জয়েন করতে হবে স্যর?’
‘কবে মানে? আজকেই; তবে কয়েক দিনের লিভ পাবে, ফ্যামিলি নিয়ে চলে আসবার জন্য।’
‘ফ্যামিলি নিয়ে স্যর? সে ব্যাপারে আমার স্বাধীনতা নেই স্যর।’
‘এই উইকেই চলে এসো না; বাই দ্য বাই তোমার মেসোমশাই ‘তার’ করে জানিয়েছিলেন যে তোমার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট; এখানেই চলে এসো সকলে মিলে। বড় কোয়ার্টার পেয়েছ তো!’
‘দেখছি স্যর কী করা যায়! আমার ডিসচার্জ? সেটা কোথা থেকে নিতে হবে স্যর? কাটিহার?’
‘জানি কাটিহার তোমাকে টেনে রেখেছে। কিন্তু আমি আর তুমি যে হেতু একই জায়গা থেকে এসে দুজনেই পাটনা সদরে জয়েন করছি, তাই তোমার ডিসচার্জ লেটারটা আমি অ্যাপ্রুভ করিয়ে নিজেই নিয়ে এসেছি। এই নাও।’
নিজের বিস্ময় গোপন করে ডিসচার্জ লেটারটা হাতে নিয়ে ভাল করে একবার চোখ বুলিয়ে নিল তরঙ্গনাথ। মি. অগাস্টের নির্দেশে টাইপ করা জয়েনিং লেটারটা পড়ে নিয়ে, সই করে তাঁর হাতে দিল তরঙ্গনাথ। মনে হল আবার যেন, বাড়ি ফিরছে সে। মি. অগাস্টের নির্দেশে একজন আর্দালি তাকে নিয়ে গেল নতুন কোয়ার্টার দেখাতে। পুলিশ দপ্তরের এলাকাটা শহুরে হলেও তিনটে অফিসার্স কোয়ার্টারের চারপাশেই অনেক জমি। সুন্দর বাগান করা যাবে। ফাঁকা ঘরগুলোতে চোখ বুলিয়ে তরঙ্গনাথ যেন দেখতে পেল, তরুর সাজানো সংসার ঘিরে তার সেই বাগানটাও। চমৎকার এক জীবনের ইশারা নিয়ে আজ রাতের ট্রেন ধরবে তরঙ্গনাথ।
ট্রেনে বসে ডিসচার্জ লেটারটা আবার বার করে পড়তে পড়তে সে বুঝল যে, টাইপ করা ইংরেজি অক্ষরগুলো সরে গিয়ে সেখানে ভেসে উঠছে, ছোটেলালের মুখ, তার নিজের ঘোড়া-সহিস, দূরের নদী-জঙ্গল, খোলার চালের ঘরগুলো জড়ো করে, আঁকা ছবির মতো সব গ্রাম আর তার নিজের হাতে লাগানো সেই ফুল গাছগুলো। বাড়ি ছেড়ে কাটিহার যেতে তত কষ্ট হয়নি, আজ যতটা কষ্ট হচ্ছে কোনও দিন আর কাঠিহারে ফেরা হবে না ভেবে। তরঙ্গনাথ বুঝল যে, মি. অগাস্ট ওখানে যে পদে ছিলেন, এখন তাকে সেই পদটাই দেওয়া হল। কিন্তু কাটিহার না হয়ে তা হল পাটনায়। এটাই হল তার পদোন্নতির মাশুল।
৪
সুরক্ষার কারণেই ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস সাহেবকে কলকাতা থেকে দূরে মুজফফরপুর পাঠানো হয়েছে। কিন্তু গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে খবর আছে যে সেখানেও তিনি নিরাপদ নয়। বিপ্লবীদের কাছে তিনি নাকি অন্যতম টার্গেট। উদ্ধত ডগলাস অবশ্য কিছুমাত্র বিচলিত নন। সেখানেও বিচার চালাচ্ছেন একই রকম দুর্বিনীত মনোভাব নিয়ে; বাকি সময় ক্লাবে গিয়ে তাস এবং আমোদে মেতে সময় কাটছে তাঁর।ফলে শেষ রক্ষা হল না। প্রফুল্ল চাকী এবং ক্ষুদিরাম বোস নামে দুটি বাঙালি ছেলে নানা কসরত করে রীতিমতো ছক কষে বোম মেরেছে সাহেবের গাড়িতে। সাহেব অন্য গাড়িতে থাকায় বেঁচে গেলেও, সে গাড়ির মেমসাহেবরা তিনজনেই মারা গেছেন। প্রফুল্ল এবং ক্ষুদিরাম দুজনে দু-দিকে পালালেও কিছুদূর গিয়েই ধরা পড়ে গেছে তারা।বেগতিক বুঝে নিজের রিভলবার মুখে ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করেছে প্রফুল্ল।কিন্তু কিশোর ক্ষুদিরামকে পাকড়েছে পুলিশ। সে এখন মুজফফরপুর এজলাসে বিচারাধীন।এপ্রিল মাসের ঘটনার বিচার গড়িয়ে এখন তো প্রায় অগাস্ট এসে গেল।
এই ঘটনার সংযোগে মুরারিপুকুর কেন্দ্রে জোটবাধা বিপ্লবীদের ধরে, তাদেরও বিচার চলছে আলিপুর এজলাসে। তাদের দলের নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হওয়াতে, কানাই দত্ত নামে এক বিচারাধীন বিপ্লবী কৌশল করছে তাকেও হত্যা করবার। বাঙালি পুলিশ ইন্সপেক্টর সেই নন্দলাল ব্যানার্জী, যে চিনতে পেরে তৎক্ষণাৎ পুলিশে দেবার উপক্রম করেছিল প্রফুল্ল চাকীকে, তাকে মারতেও বিপ্লবীরা একেবারে বদ্ধপরিকর। অরবিন্দ, বারীন, কানাইলাল, সত্যেন, চারুচন্দ্র, বীরেন্দ্রনাথ, দীনেশ– এইসব যুবকেরা সকলেই প্রায় তরঙ্গনাথেরই বয়সি এবং সাহেব-হত্যার দায়ে বা বোমা-মামলায় বিচারাধীন। বাঁচবে না ফাঁসি যাবে– কেউ জানে না। তবে একটা খবরে স্তম্ভিত হয়ে গেছে তরঙ্গনাথ। মৃত প্রফুল্ল চাকীকে, পুলিশের হাতে ধরা-পড়া তার সঙ্গী সেই ক্ষুদিরাম শনাক্ত করলেও, সাহেবদের নাকি সন্দেহ যায়নি। তার মাথাটা ধড় থেকে কেটে একটা বাক্সে করে সেটা পাঠানো হয়েছে কলকাতায়, অন্যদের দিয়ে শনাক্ত করানোর জন্য। খবরের কাগজে বেরনো সংবাদ, গোয়েন্দা দপ্তর থেকে আসা ক্রমাগত এ্যালার্ট এবং নানাবিধ গোপন রিপোর্ট পড়তে পড়তে একেবারে জেরবার হয়ে পড়েছে তরঙ্গনাথ। তারই সঙ্গে নিজের পরিবার নিয়েও নানা উদ্বেগ তো আছেই।
তরঙ্গনাথের পোস্টিং পাটনায় হয়েছে জেনে মা খুব খুশি; কারণ তাঁর বাবার কাজের সূত্রে ছেলেবেলায় পাটনায় ছিলেন তাঁরা। এই সুযোগে পাটনায় সবাই মিলে থাকার প্রস্তাব তরঙ্গনাথ দিতেই মা-বাবা দুজনেই সম্মতিসূচক হাসি হেসে চুপ করে রইলেন। রাণীরও বিয়ে হয়ে গেছে; ফলে এখন আর বাধা কী, বাড়ি বন্ধ করে পাটনায় তার কোয়ার্টারে গিয়ে থাকতে! মুস্কিল হল বদুকে নিয়ে। ইতিমধ্যে ইস্কুলের পাশ দিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হতে হবে তাকে। পাটনাতে ভর্তি হতেই পারত, কিন্তু বাধ সাধলেন সেজোজ্যাঠামশাই। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বাইরে-বাইরে থাকলেও ধরতে গেলে তিনিই পুরো পরিবারের কর্তা। তার ওপর তরঙ্গনাথের মায়ের বাবার অত্যন্ত নিকট বন্ধু এবং তার পিতৃহীন বাবাকেও তো বড় করে তুলেছেন তিনিই। বিহারের পরিস্থিতির কথা ভেবে জ্যাঠামশাই একেবারেই রাজি নন, প্রায় যুবক বদুকে সেখানে নিয়ে গিয়ে পড়ানোয়। কলকাতার হস্টেলে রেখে তো নয়ই। ফলে সকলকে বুঝিয়েসুঝিয়ে বদুকে তিনি ভর্তি করে দিলেন হেতমপুরের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজ হস্টেলে। কারণ তিনি তখন এর কাছেই বীরভূমের সিউড়িতে পোস্টেড। তরঙ্গনাথ আর বাবা, দুজনে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে, সেখানেই ভর্তি করে দিয়ে এলেন বদুকে। এই প্রথম পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হস্টেলে চলে গেল বদু।
তবে পাটনায় এসে সবচেয়ে যে খুশি হয়েছে সে হল তরু। এখানকার হাসপাতালে সব ব্যবস্থা করা আছে, তরুর প্রসব হওয়ার ব্যাপারে। আশা করা যায় তাদের প্রথম সন্তান নির্বিঘ্নেই ভূমিষ্ঠ হবে, সাহেবডাক্তার আর মেমসাহেব নার্সদের হাতে।
আমি তরঙ্গনাথ। ব্রাহ্মমুহূর্ত পার করে, আমাদের একটি কন্যাসন্তান জন্মাল। জন্মসময় সকাল ৬টা। ২৭ শ্রাবণ, শুক্লপক্ষ, চতুর্দশী, ১৩১৫। পুলিশ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আজ ১১ অগাস্ট, মঙ্গলবার ১৯০৮।
ঠিক ওই একই সময়ে মুজফফরপুর জেলে আজ ফাঁসি হয়ে গেল যে ছেলেটির, তার নাম ক্ষুদিরাম বোস। সাহেবদের বিচারে এ দেশে সম্ভবত এটাই প্রথম ফাঁসি। নিদর্শনমূলক শাস্তি। কালকেই খবর এসেছিল। ফাঁসির সময়ে তার বয়স ১৮ বছর ৮ মাস ৮ দিন ১০ ঘণ্টা।
চোখ কেন এমন জলে ভরে এল? মেয়ে হওয়ার আনন্দে, না কি কোনও অনধিকার-শোকে!
জানি এটা গান গাইবার সময় নয়, তবু মন যেন গুমরে গুমরে ফুঁপিয়ে উঠল।
‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তিরও বারি… বিতর বিতর প্রেম পাষাণ হৃদয়ে…’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র