ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • প্রযুক্তি, প্রকৃতি আর শিশুমন


    শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য (March 16, 2024)
     

    প্রকৃতি ও শিশুমন – স্বাভাবিক পূর্ণাঙ্গ বিকাশ

    সহজ, সরল, এই দুই শব্দই চিরন্তন, শিশুমন বিশেষণে । সংস্কার মুক্ত, নির্লিপ্ত। শিশুমন চঞ্চল। হরিণ শাবকের মতোই তিড়িং-বিড়িং। অন্তর থেকে অনুভব করলে বোঝা যায়, তা কত উদার, ভাবনাচিন্তায় স্বচ্ছ ও সুদূরপ্রসারী। শিশু চায় স্বাধীনতা, খোলামেলা বন্ধনহীন জীবন, সে বিধিনিষেধের ধার ধারে না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
    ‘একটি ছোট মানুষ, তাহার একশো রকম রঙ্গতো।
    এমন লোককে একটি নামে ডাকা কি হয় সঙ্গত।’ (পরিচয়, শিশু )

    শিশুমন চায় খোলা আকাশের উন্মুক্ততা, প্রকৃতির ছন্দময় উচ্ছৃঙ্খলতা। ধরাবাঁধা রুটিনে তাকে আটকে রাখা যায় না। শিশুর স্বাভাবিক বিচরণ সবসময়ই স্কুল সিলেবাসের বাইরে। তাই সিলেবাসের রুক্ষ শৃঙ্খলায় বেঁধে রাখতে চাইলে শিশুর মন হাঁপিয়ে ওঠে। শিশু তাই বলে,

    মা গো, আমায় ছুটি দিতে বল্‌,
    সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা।
    এখন আমি তোমার ঘরে বসে
    করব শুধু পড়া-পড়া খেলা।

    আঁধার হল মাদার-গাছের তলা,
    কালি হয়ে এল দিঘির জল,
    হাটের থেকে সবাই এল ফিরে,
    মাঠের থেকে এল চাষির দল।
    মনে কর্‌-না উঠল সাঁঝের তারা,
    মনে কর্‌-না সন্ধে হল যেন।
    রাতের বেলা দুপুর যদি হয়
    দুপুর বেলা রাত হবে না কেন।

                   (প্রশ্ন, শিশু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

    শিশুর কাছে সত্য সূর্য, মেঘ, তারা, চাঁদ, বেড়ালছানা, পাখির পালক। এই সবকিছুর মতোই সুন্দর শিশুরা প্রকৃতির সৌন্দর্যে নিজেকে আমূল মিশিয়ে দিতে চায়।

    প্রকৃতির শিশু—শিশুর প্রকৃতি

    ‘বলাই’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ভাইপো বলাইকে নিয়ে পাহাড়ে গিয়েছিলেন। তিনি লিখছেন, ‘আমাদের বাড়ির সামনে ঘন সবুজ ঘাস পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে পর্যন্ত নেবে গিয়েছে, সেইটে দেখে আর ওর মন ভারি খুশি হয়ে ওঠে। ঘাসের আস্তরণটা একটা স্থির পদার্থ তা ওর মনে হয় না; ওর বোধ হয়, যেন ওই ঘাসের পুঞ্জ একটা গড়িয়ে-চলা খেলা, কেবলই গড়াচ্ছে; প্রায়ই তারই সেই ঢালু বেয়ে ও নিজেও গড়াত— সমস্ত দেহ দিয়ে ঘাস হয়ে উঠত— গড়াতে গড়াতে ঘাসের আগায় ওর ঘাড়ের কাছে সুড়সুড়ি লাগত আর ও খিলখিল করে হেসে উঠত।’
    এই হল বলাইয়ের প্রকৃতিবোধ। প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়ার তীব্র আকুতি।

    সত্তর-আশির দশকে যে সকল মানুষ জন্মেছেন, ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে ছোটবেলায় তাঁরা পায়রা পুষতেন বাড়ির ছাদে, মাছ ধরতেন ছিপ দিয়ে ডোবায়, পুকুরে, এমনকী বর্ষায় ফেঁপে ওঠা নালায়। কালবৈশাখীর ঝড়ে আম কুড়োতেন বেওয়ারিশ আমগাছের নীচে ছুটে বেড়িয়ে। এইভাবেই প্রকৃতি তাদের দিনগুলোকে ভরিয়ে তুলত। দুলিয়ে দিত তাদের কৌতূহলী মনকে, বইয়ে নিয়ে যেত অনেক দূর। শিশুদের কাছে প্রকৃতি বিভিন্ন চেহারায় আসে। একটি সদ্যোজাত বাছুর, শীতের দিনে পাঁচিলে রোদ-পোহানো বেড়াল, ফড়িং, খেলার মাঠ, বনের মধ্যে পায়ে চলা একটা পথ, ঘুলঘুলির পায়রা, ঘাসে ভরা খেলার মাঠ, জঙ্গলের মাঝে ভাঙাচোরা বাড়ি, ফাঁকা এক টুকরো জমির আর্দ্র রহস্যময় কোণ— যে চেহারাতেই আসুক না কেন, শিশু মনের কাছে প্রকৃতি ধরা দেয় তার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, পারিবারিক কাঠামো থেকে অনেকটাই আলাদা, বড় আর প্রাচীন এক সত্তার রূপে।

    অপরিহার্য পারিবারিক শাসন, স্কুলের নিয়ম শৃঙ্খলার মাঝে প্রকৃতি শিশুর কাছে আসে অব্যর্থ শুশ্রূষার মতো। কিংবা সাদা কাগজের চেহারায় যার ওপর শিশু তার সংস্কৃতির কল্পনাকে আঁকে, তাকে বুঝে নিতে থাকে। সবক’টি ইন্দ্রিয়ের পূর্ণ ব্যবহার আর প্রত্যক্ষ করার দাবি নিয়ে হাজির হওয়া প্রকৃতি এভাবে শিশুর অন্তরের সৃজনশীলতাকে জাগিয়ে তোলে। সহজ এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর আদান-প্রদানে শিশুমন বিকশিত হয়। চারপাশের দুনিয়ার জটিলতা সম্পর্কে শিশুর হাজারো প্রশ্ন, বিভ্রান্তিকে মুছে দিতে শিশু ছুটে যায় প্রকৃতির দিকে। খেলার মাঠে হোক বা অরণ্য, সমুদ্রে, প্রকৃতির ছড়ানো নানান উপাদানের সংস্পর্শেই শিশুর যাবতীয় কৌতূহলের নিরসন। প্রকৃতি শিশুর কাছে কখনও ভয়েরও হয়ে উঠতে পারে; কিন্তু তার একটা উদ্দেশ্য থাকে। সম্পূর্ণ বিকাশ, শেখার এবং পরিণত মনের দিকে যাত্রায় এই ভয়ও জরুরি। প্রকৃতির মাঝেই শিশু খুঁজে পায় স্বাধীনতা, কল্পনা আর গোপনীয়তা। প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ শিশুর কল্পনাশক্তি ও মনোবিকাশের ধারাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। প্রকৃতির মাঝে বড় হলে পরিবেশ-সচেতনতা, জীববৈচিত্র্যের প্রতি কৌতূহল ও সহমর্মিতা তৈরি হয়। বড়দের জগৎ থেকে আলাদা, অন্য ধরনের এক শান্তি। প্রকৃতির সংস্পর্শেই তৈরি হয়ে তার সর্বজনীন মন। সে বিশেষ থেকে বিশ্বমানুষ হয়ে ওঠে।  

    স্কুল অফ বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস, ইউনিভার্সিটি অফ হংকং-এর তানজা সোবকো বলেন, ‘অনেক বাবা-মা মনে করেন গাছপালা, মাটির মধ্যে নোংরা থাকে, এই ভাবনা পরে শিশুদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়।’  অনেক সময় আবার সবুজ এলাকা যাতে নষ্ট না হয়ে যায় সে জন্য সোসাইটির তরফে সেখানে ‘দূরে থাকুন’, ‘স্পর্শ করবেন না’, এ-ধরনের নোটিশবোর্ড টাঙানো থাকে। রাস্তার কুকুর-বেড়ালকে ভয়ংকর বিপজ্জনক প্রাণী মনে করে বাবা-মা শিশুকে দূরে সরিয়ে রাখেন। পরীক্ষায় নম্বর, র‍্যাঙ্ক, ঘোর প্রতিযোগিতার মধ্যেই শিশুকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলে। বিকৃত এক সামাজিক সম্পর্কে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মায়েরা নিরুপায় হয়েই শিশুদেরকে প্রকৃতিবিমুখ এক ছকে অভ্যস্ত করতে বাধ্য হন। কিন্ডারগার্টেন থেকে স্কুল, শর্তসাপেক্ষ, মাত্রাতিরিক্ত পরীক্ষায় ঠাসা এক যান্ত্রিক ধাঁচায় শিশুদেরকে ঠেলে দেওয়া হয় মোটা টাকা খরচ করে। এই পরিবেশে কেবলমাত্র প্রতিযোগিতাই প্রতি মুহূর্তে কিলবিল করে। উল্টোদিকে কোনও রকম শর্ত, অর্থের বিনিময় ছাড়াই, আরও গভীর স্তরে প্রকৃতি শিশুর কাছে নিজেকে নিবিড় সহযোগিতায় উজাড় করে দেয়। নিজের জন্যই দেয়। প্রতিযোগিতার সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি হিসেবে নয়। এই স্তরে প্রকৃতি উদ্রেক করে ব্যাখ্যাতীত এক বিনয়-নম্রতা, গভীর জীবনবোধ। স্মার্টফোনের অবিরাম ভিডিয়ো রিলসের মতো প্রকৃতি সময় চুরি করে না, বরং তাকে প্রলম্বিত করে।

    প্রযুক্তি ও শিশুমন— একাকীত্ব, অবসাদ, আত্মহত্যা প্রবণতা

    আজকের শিশুরা কথা বলতে শেখার আগেই স্মার্টফোনের আয়তঘন ধাতব অনুভবের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়। দিনের বিশৃঙ্খলা, কোলাহল হোক বা রাতের নৈঃশব্দ, সবকিছু থেকেই উদাসীন স্মার্টফোনের অবিরাম স্ক্রোলিং-এই বেশি আনন্দ পায়।  

    প্রায়ই দেখা যায়, অভিভাবকেরা বাচ্চাকে শান্ত রাখার জন্য তার হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাব ধরিয়ে দেন। গান, কার্টুন বা মজার ভিডিয়ো চালিয়ে দিয়ে তাকে শান্ত রাখা হয়। ঘরে-ঘরে এই ঘটনা এখন নিত্যদিনের। স্মার্টফোনের কল্যাণে শিশুদের শান্ত রাখা, খাওয়ানো, এমনকী বর্ণমালা ও ছড়া শেখানোর কাজটিও বাবা-মায়ের জন্য অনেক সহজ ও স্বস্তিদায়ক হয়ে উঠেছে। তবে শিশুরা স্মার্টফোন চাইলেই দিতে হবে, এটা নিশ্চয়ই স্মার্টনেস নয়। বাবা-মা কর্মব্যস্ততার দোহাই দিয়ে সময় না দেওয়ার কারণে অথবা শখ করে ফোন কিনে দেওয়ায় বা তাদের বায়না পূরণ করতে মোবাইল উপহার দেওয়া ইত্যাদি কারণে আদরের শিশুদের হাতে-হাতে স্মার্টফোন। বাচ্চারা ইচ্ছেমতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেম খেলছে, ভিডিয়ো দেখছে, ফোন নিয়ে যাচ্ছেতাই করছে।  বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্তানকে স্মার্টফোন দেওয়ার মানে, তাদের হাতে মদ কিংবা কোকেন তুলে দেওয়া! কারণ, স্মার্টফোনের আসক্তি মাদকাসক্তির মতোই বিপজ্জনক। দু-মিনিট সময়ের একটি মোবাইল কল শিশুদের মস্তিষ্কে হাইপার অ্যাক্টিভিটি সৃষ্টি করে, যা কিনা পরবর্তী এক ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের মস্তিষ্কে টিকে থাকে। হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বেড়ে যায় দ্বিগুণ, ব্যবহারকারীর স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, রক্তের চাপ বেড়ে যায়, দেহ ধীরে ধীরে ক্লান্ত ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে এমনকী নিয়মিত ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটায়। স্ক্রিনের রেডিয়েশন প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর; শিশুদের জন্য তা আরও বেশি ক্ষতিকর, যা তাদের মস্তিষ্কের বিকাশকে ব্যাহত করে। সারা পৃথিবীতে এখন শিশুরা প্রায় বেশির ভাগ সময়েই মোবাইল ফোন নিয়ে খেলা করে। এ প্রসঙ্গে সানি’স স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর ডিন ডেভিড কার্পেন্টার বলেছেন, ‘শিগগিরই আমরা হয়তো একটি মহামারি রোগের শিকার হতে পারি এবং সেটি হবে মস্তিষ্কের ক্যানসার।’   

    গবেষণা থেকে আরও বেরিয়ে এসেছে যে, মোবাইল ফোন ব্যবহার শিশুদের শ্রবণক্ষমতাও হ্রাস করে দেয়। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ৬৮০ কোটি মানুষের একটি করে স্মার্টফোন আছে। বর্তমানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ৮০০ কোটির কিছু বেশি। তাই স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে একটা অংশ যে শিশু, তা খুব সহজে বলা যায়। ফোন নিয়ে বসে থাকলে শারীরিক কার্যক্রম কমে যায়। এতে স্থূলতা, আত্মসম্মান বোধ কমে যাওয়া ও মানুষের সঙ্গে মিশতে অসুবিধা হয় শিশুদের। স্মার্টফোনে সময় কাটানোর ফলে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে ও সামাজিক ভাব বিনিময়ে তারা সময় পায় না।    

    শুধু সন্তান নয়, বাবা-মায়েরাও স্মার্টফোনের আসক্তি থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না। ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় যেহেতু আর্থিক এবং সামাজিক লেনদেনের সিংহভাগটাই স্মার্টফোনের মাধ্যমে ঘটে থাকে, তাই ইচ্ছে না থাকলেও মানুষকে স্মার্টফোন হাতে তুলে নিতে হয়ই। ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, মানুষের মনোযোগের বহর এখন গোল্ডফিশের থেকেও কম, মাত্র আট সেকেন্ড। ২০০০ জন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে দেড় দশক ধরে পরীক্ষা চালায় মাইক্রোসফট্‌ সংস্থা। দেখা যাচ্ছে ২০০০ সালে যখন মোবাইল ফোন ও ডিজিটাল সংযোগ মাধ্যম সেভাবে আসেনি, তখন মানুষের গড় মনোযোগের সময়কাল ছিল ১২ সেকেন্ড। বছর চারেক আগে সেটা কমে দাঁড়িয়েছিল আট সেকেন্ডে, চঞ্চলমতি গোল্ডফিশের ক্ষেত্রে যা নয় সেকেন্ড। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে চলে প্রযুক্তির খপ্পরে মনোযোগের গ্রাফ যে নিম্নগামী তা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয় না। মানুষের পাঠের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের যে স্নায়ুতন্ত্র জাল, খুব সূক্ষ্ম এবং দ্রুত তার বদল ঘটছে। এবং এটা ঘটছে শিশু থেকে বয়স্ক সব ধরনের মানুষের মধ্যেই। প্রায় ছয় হাজার বছর আগে সাক্ষরতা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রজাতির মস্তিষ্কে এই নতুন স্নায়ুর জাল সৃষ্টি হয়েছিল। একেবারে শুরুর দিকে সেটি ছিল সহজ তথ্যের জট খুলতে সক্ষম— যেমন একটি পালে কতগুলি ছাগল রয়েছে তার সংখ্যা নিরূপণ। সেখান থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তন হয় আধুনিক জটিল পাঠসক্ষম মানব মস্তিষ্কের। এই পাঠ সক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৌদ্ধিক প্রক্রিয়া। জ্ঞানকে কীভাবে আয়ত্ত করতে হয়, কীভাবে যুক্তি দিয়ে ভাবতে হয় এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয়; কোন বিষয়ের প্রেক্ষিতকে ধরতে হয় এবং সমব্যথী হতে হয়, কীভাবে বিচারবোধ প্রয়োগ করতে হয় এবং অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে হয়।    

    আজকের শিশুরা কথা বলতে শেখার আগেই স্মার্টফোনের আয়তঘন ধাতব অনুভবের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়। দিনের বিশৃঙ্খলা, কোলাহল হোক বা রাতের নৈঃশব্দ, সবকিছু থেকেই উদাসীন স্মার্টফোনের অবিরাম স্ক্রোলিং-এই বেশি আনন্দ পায়।  

    ইদানীং ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে উনিশ ও বিশ শতকের  ক্লাসিক সাহিত্য পাঠে প্রবল অনীহা লক্ষ করছেন শিক্ষকেরা। তার চেয়েও বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হল, সাহিত্য হোক বা বিজ্ঞান, বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োগ করে কোনও জটিল ভাবনা ও যুক্তি কাঠামো আয়ত্ত করার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে দ্রুত। বিচারবোধ বর্জিত তথ্যের আগ্রাসী ক্ষুধা— ভুল তথ্য, বানানো তথ্য এবং সেই সঙ্গে জটিল বহুস্তর বাস্তবকে সাদায়-কালোয় দেগে দেওয়ার এক বিপজ্জনক প্রবণতা। তথ্য ও জ্ঞানের নতুন সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুমন।   

    প্রকৃতির সংস্পর্শ থেকে বহু যোজন দূরে তাদের শহুরে চলাচল। প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে মনের সহজ স্বাভাবিক বিকাশ থেকে আজকালকার শিশুরা বঞ্চিত। নতুন প্রজন্মের কাছে প্রকৃতি যতটা বিমূর্ত, ততটা বাস্তব নয়। ক্রমশই প্রকৃতি হয়ে উঠছে দেখার জিনিস, ভোগ করার জিনিস, পরার জিনিস এবং পাত্তা-না-দেওয়ার জিনিস। টিভির এক বিজ্ঞাপনে দেখা যায়— একটি এসইউভি গাড়ি, এক আশ্চর্য সুন্দর পাহাড়ি নালার ওপর দিয়ে চলেছে আর তার পিছনের সিটে বসে দুটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে সিটে লাগানো ভিডিয়োর পর্দায় একটি সিনেমা দেখছে; জানলার বাইরে নিসর্গ আর জল থেকে তাদের মুখ ফেরানো।        

    ফলত প্রকৃতিবিমুখ এক জীবনচর্চায় বড় বেশি শরিক হয়ে পড়ার পরিণাম হিসেবে শিশুরা খুব তাড়াতাড়ি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে; উচ্চকিত গলায়, উৎকট শারীরিক ভঙ্গিমায় তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে খুব বেশি দ্বিধাবোধও করে না। সান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটি-র এক গবেষণায় দেখা যায়, স্মার্টফোনে সময় কাটানো মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। শুধু তা-ই নয়, দিনে মাত্র এক ঘণ্টা পর্দায় কাটানোই দু-বছরের কমবয়সি শিশুকে উদ্বিগ্ন বা বিষণ্ন করে তোলার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের অপর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যেসব শিশু স্মার্টফোনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে, তাদের মস্তিষ্কের গঠনও আলাদা হয়।

    ভিভো ও সাইবার মিডিয়া রিসার্চের এক গবেষণা সমীক্ষায় দেখা যায়, ৯১ শতাংশ শিশু মোবাইল ফোন থেকে দূরে বা আলাদা থাকলে দুশ্চিন্তা অনুভব করে। ভারতের দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, আহমেদাবাদ ও পুনের মতো শহরের ১ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি অংশগ্রহণকারীর ওপর এই সমীক্ষা চালানো হয়। স্মার্টফোন কীভাবে অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক ও তাদের মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করে সে বিষয়টি সমীক্ষায় উঠে এসেছে। স্বভাবতই তীব্র সংকটে পড়েছেন বাবা-মায়েরা। স্মার্টফোনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার শিশুদের জন্য বিপজ্জনক জেনেও তাদের হাত থেকে স্মার্টফোন কেড়ে নেওয়ার মতো সাহস তারা দেখাতে পারছেন না। তারা এতদিনে বুঝে গিয়েছেন, বাঞ্ছনীয় হলেও এই সিদ্ধান্তের ফলাফল হতে পারে মারাত্মক। কানাঘুষোয় তারা নিশ্চয়ই শুনেছেন, খবরের কাগজেও চোখ পড়তে পারে, কিংবা সতর্ক ও শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুর হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ থেকে তারা জেনেছেন, গেম খেলার জন্য স্মার্টফোন কিনে না দেওয়ায় কত স্কুলছাত্র/ছাত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।

    প্রকৃতি-বিমুখ এক বিকৃত জীবনচর্চায় স্মার্টফোনের মতো একটি সহজলভ্য যন্ত্রে বছরের পর বছর সময় কাটানোর অন্যতম একটি ঝোঁক হল, আত্মহত্যা। আত্মহত্যা একটি নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থার ফলাফল। আর বন্যতা প্রসঙ্গে জে গ্রিফিথস বলছেন, ‘বন্যতা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নিসর্গে নেই, রয়েছে একটি মানসিক অবস্থায়।’ ঘিঞ্জি শহরের গলিতেও আচমকা সেই মানসিক অবস্থা তৈরি হয়ে যেতে পারে একটি খাঁচাবন্দি পাখির ডাকে। আর যে সমস্ত পাখি খাঁচার বাইরে টকটকে লাল পুঁতির মতো চোখে আকাশের দিকে তাকায়, গান গায়, উদ্দাম উল্লাসে উড়ে বেড়ায় আমাদের ধারে কাছেই। অবিরত ভিডিয়ো রিলসের স্ক্রোলিং-এ বন্দি হয়ে আজকের প্রজন্ম সেই গান আর শুনতে পায় না। এই ধরনের গান শোনার জন্য জরুরি কান তারা ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে।   

    অহি-নকুল সম্পর্কে বলাই এবং জেনারেশন আলফা  

    রবীন্দ্রনাথ বলছেন, বলাই ‘দেবদারুবনের নিস্তব্ধ ছায়াতলে একলা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, গা ছমছম করে— এই সব প্রকাণ্ড গাছের ভিতরকার মানুষকে ও যেন দেখতে পায়।’

    এই চিত্রকল্পের সম্পূর্ণ উল্টো মেরুতে আমরা দেখি, আলফা জেনারেশনের ছেলে-মেয়েদের যাবতীয় কৌতূহল, অন্বেষণ স্মার্টফোনের ভিতরের ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। যে বাস্তব জগৎ তাদের বাবা-মা, বন্ধু, সামাজিক আদান-প্রদান, খেলাধুলো, প্রকৃতির মধ্যে সময় কাটানোকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে, সেখান থেকেই যেন আজকের ছেলেমেয়েরা পালাতে চায়। একমাত্র অবলম্বন হিসেবে তারা আঁকড়ে ধরে সেই সমস্ত গতিবিধি, আদান-প্রদান যার উৎস স্মার্টফোন। স্মার্টফোনের কোনও বিশেষ কিছুতেই তাদের মনোযোগ নেই, একটার পর একটা অনিঃশেষ  ভিডিয়ো দেখার প্রক্রিয়ায় মনোযোগের ক্ষমতা তছনছ হয়ে যায়। ইউটিউব-ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-এর উদ্দেশ্যও তাই। গাছের দিকে তাকিয়ে গাছ মানুষকে উপলব্ধি করার জন্য দরকার বিশেষ পরিবেশ। প্রকৃত প্রস্তাবে স্মার্টফোনের পরিবেশ শিশুর সহজ স্বাভাবিক উপলব্ধিগুলোকে অঙ্কুরেই পিষে দেয়।    

    রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, বলাই ‘আমার বাগানে বেড়াচ্ছে মাটির দিকে কী খুঁজে খুঁজে। নতুন অঙ্কুরগুলো তাদের কোঁকড়ানো মাথাটুকু নিয়ে আলোতে ফুটে উঠছে এই দেখতে তার ঔৎসুক্যের সীমা নেই। প্রতিদিন ঝুঁকে পড়ে পড়ে তাদেরকে যেন জিজ্ঞাসা করে, ‘তার পরে? তার পরে? তার পরে?’ তারা ওর চির-অসমাপ্ত গল্প।’

    প্রকৃতিকে আরও গভীরে অনুভব করার বলাইয়ের আকুতি শৈশবেই গড়ে তোলে আগামীর এক মহৎ মনের ভিত। এই মনের সংস্পর্শে এসে আরও অনেক মানুষ সমৃদ্ধ হবে।

    আলফা প্রজন্মের কৌতূহল, অন্বেষণ নির্মাণ করে দেয় স্মার্টফোনের ভিতরে পুষে রাখা প্রোগ্রামগুলি। ছেলেমেয়েরা তাদের স্বল্প জীবনে অত্যাধিক স্মার্টফোন নির্ভরতায় গড়ে ওঠা সংকটের সমাধানও খোঁজে স্মার্টফোনের মধ্যেই। ছেলে-মেয়েদের অঙ্গভঙ্গি, ভাষা, পোশাক, আকাঙ্ক্ষা, সবকিছুর পিছনেই কাজ করে চলেছে স্মার্টফোন। তারা কেবল টের পাচ্ছে না।   

    বলাইয়ের মন কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। তার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে নিবিড় সহানুভূতি। প্রকৃতির সঙ্গে গভীর একাত্মবোধ। ‘কেউ গাছের ফুল তোলে এইটে ওর বড়ো বাজে। …ওর সব-চেয়ে বিপদের দিন, যেদিন ঘাসিয়াড়া ঘাস কাটতে আসে। কেননা, ঘাসের ভিতরে ভিতরে ও প্রত্যহ দেখে দেখে বেড়িয়েছে- এতটুকু-টুকু লতা, বেগনি হল্‌দে নামহারা ফুল, অতি ছোটো ছোটো; মাঝে মাঝে কন্টিকারি গাছ, তার নীল নীল ফুলের বুকের মাঝখানটিতে ছোট্ট একটুখানি সোনার ফোঁটা…সমস্তই নিষ্ঠুর নিড়নি দিয়ে দিয়ে নিড়িয়ে ফেলা হয়।’ সহানুভূতি, সহযোগিতার মন, আকাশ থেকে পড়ে না। দরকার হয় উপযুক্ত পরিবেশ, মজবুত বস্তুগত ভিত। গাছ থেকে ফুল তুলে নেওয়ার ঘটনায় যে মন আহত হয়, দরকার যত্ন নিয়ে সেই মনের আজীবন সংরক্ষণ। আলফা জেনারেশনের ছেলে-মেয়েদের মন সহানুভূতিশীল নয় বা তাদের মধ্যে এক ধরনের নিষ্ঠুরতা জায়গা করে নিচ্ছে, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু গাছ-ফুল-পাখির প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে অনেকটাই দূরে তারা উল্লাসে মানুষ মারে বন্ধুক হাতে আকর্ষণীয় ভিডিয়ো গেমে। ভিডিয়ো গেমগুলি তাদের সাম্রাজ্য দখল শেখায়, শত্রু কে, তা না বুঝেই মানুষ মারতে শেখায় বিশেষ নির্দেশে, সামাজিক বা সমষ্টিগত প্রেক্ষিত থেকে দূরে সরিয়ে চূড়ান্ত ব্যক্তিবাদে তাদের আত্মকেন্দ্রিক হতে শেখায়। প্রতিযোগিতার বাতাবরণে তাদের মন বিকশিত হয়। ক্রমশ তারা নিশ্চিত হয়ে ওঠে— সহযোগিতা নয়; প্রতিযোগিতার দুনিয়াই সহজ, স্বাভাবিক।   

    বলাইয়ের চারপাশের মানুষগুলো একেবারেই তার মনের মতো ছিল না। তাই ‘বলাই অনেকদিন থেকে বুঝতে পেরেছিল, কতকগুলো ব্যথা আছে যা সম্পূর্ণ ওর একলারই— ওর চার দিকের লোকের মধ্যে তার কোনো সাড়া নেই।’

    আলফা জেনারেশনের ছেলেমেয়েরাও একা। তারা একা সময় কাটাতে ভালোবাসে। প্রাইভেসি চায়। কিন্তু বলাইয়ের একাকীত্ব ছিল অন্যরকম। বলাই চেয়েছিল, মানুষ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিক। তাই মানুষের উদাসীনতা ছিল তার ব্যথার কারণ। অন্যদিকে প্রকৃতির ব্যাপক এবং বিপুল সম্ভার থেকে সরে গিয়ে স্মার্টফোন-নির্ভর শৈশব আলফা জেনারেশনের একাকীত্ব ও অবসাদের কারণ।

    বাগানের খোয়া-দেওয়া রাস্তার মাঝখানের শিমুলগাছটা উপড়ে ফেলার কথা শুনে বলাই চমকে উঠত। বলত, ‘না, কাকা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, উপড়ে ফেলো না। …কাকি, তুমি কাকাকে বারণ করে দাও, গাছটা যেন না কাটেন।’

    দুঃখের কথা, ঠিক এই ধরনেরই নিবিড় আকুতি দেখা যায় আলফা প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যখন ভালোর জন্যই তাদের হাত থেকে স্মার্টফোন কেড়ে নেওয়া হয়। অবসাদে তারা ইউটিউবে ট্রেনিং নিয়ে গলায় দড়ি দেয়। প্রবল অভিমানে ঝোঁকের মাথায় বহুতল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।  

    নাছোড়বান্দা নেশাঘন সমস্ত অ্যাপের ব্যাপকতায় আজকের প্রজন্মে বলাইয়ের মতো মানুষের দেখা পাওয়া মুশকিল। তবু মনে রাখতে হবে, প্রকৃতিবিমুখ ডিজিটাল অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা দিয়েছে গ্রেটা থুনবার্গদের। গড্ডলিকার স্রোত প্রবল থেকে প্রবলতর হলে আরও কঠিন প্রতিরোধও বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ে। কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছে না, মানুষ অপরকে ঘৃণার চোখে দেখছে, বিকৃত মনে ছেলে-মেয়েরা আরও বেশি ডুবে যাচ্ছে প্রযুক্তির চোরাবালিতে, এমন সমাজ কাঙ্ক্ষিত তো নয়ই, বরং ভীতিজনক। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে পরিকল্পনামাফিক ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া এই অপসংস্কৃতির উৎস খুঁজে বার করে তা সমূলে উপড়ে ফেলাই হয়ে ওঠে প্রধানতম কাজ। আগামীতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই এই কাজে আমাদের সকলের সাধ্যমতো শরিক হওয়া এই সময়ের শ্রেষ্ঠ দাবি।

    ছবি : সংগৃহীত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook